সক্রেটিস
আত্মার অমরত্বের প্রশ্ন সক্রেটিসের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল। তার মতে একমাত্র আত্মার অমরত্ব থাকলে আমাদের কর্মের এবং তার ফলাফলের স্বার্থকতা দেখতে পাওয়া যায়। আত্মার অমরত্বই আমাদের সর্বোচ্চ মূল্যবোধ, সত্য, ন্যায়পরায়ণতা, সৌন্দর্য্য ইত্যাদির অন্তিম প্রমাণ। মানুষ এসব পরম মূল্যবোধের ধারণা নিয়ে জন্মায়, তাই আগে থেকেই আত্মা থাকলেই কেবল এসব মূল্যবোধ সম্ভব হতে পারে। আত্মা মানুষের মনে এসব মূল্যবোধের ছাপচিত্র তৈরি করে, আমাদের জন্মের আগেই তাই আত্মা ছিল, এবং মৃত্যুর পরেও সেটা থাকবে। আত্মা যদি আমাদের জন্মের আগে থেকেই থাকে, তাহলে আমরা কিভাবে জানব যে মৃত্যুর সাথে আত্মাও ধ্বংস হবে না?
এ প্রশ্নের জবাবে সক্রেটিস বলেন, আত্মা অমর কারণ এটি জীবন দান করে। পরম আত্মা বা জীবন অবশ্যই পরম মৃত্যুর বিপরীত, এবং কোন পরমই তার পরম বিপরীতকে স্বীকার বা নিজের অংশ করতে পারে না। সেজন্য, আত্মা অবশ্যই বেঁচে থাকবে, এর কোন ক্ষয় নাই।
তারপরেও সারাজীবন ধরে যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে খুঁজে সক্রেটিস এ সিদ্ধান্তে আসেন যে আত্মার অমরত্ব প্রমাণ করা যাবে না; একমাত্র বিশ্বাসের মাধ্যমে (Leap of faith) একে গ্রহণ করতে হবে।
“If you do, fair is the prize and great is the hope, and it is in that hope I can go happily to my death.”
তবে সক্রেটিস জ্ঞানের সম্ভাব্যতাকে উড়িয়ে দেননি, তাঁর মতে জ্ঞান সম্ভব এবং তিনি সারাজীবন সে লক্ষ্যেই দর্শন চর্চা করে গেছেন।
প্লেটোর ‘ফর্ম’
সমগ্র পাশ্চাত্য দর্শনকে প্লেটোর দর্শনের ফুটনোট বললে অত্যুক্তি করা হবে না। প্লেটোর দর্শনের মূল কথা হল স্থান-কালের বাইরে ‘ভাব’ এবং ‘রূপ’ এর অবস্থান। আমাদের চিরচেনা জগতের কোন কিছুই স্থায়ী নয়, সবকিছু ক্ষণে অস্তিত্ববান হয় তারপরে আবার মিলিয়ে যায়, এ জগতে কোন কিছুই পারফেক্ট নয়, সবকিছুরই ক্ষয় আছে। আমাদের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা এ জগতেরই সন্ধান পাই, কিন্তু স্থান-কালের বাইরে আরেকটা জগত আছে যেটা আমাদের ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য নয়, যেখানে সবকিছু চিরস্থায়ী এবং সুষম শৃঙ্খলাবদ্ধ। সে জগত চিরন্তন, যার তুলনায় আমাদের নিত্য পরিবর্তনশীল দুনিয়া চোখের পলক ফেলার মত ক্ষণস্থায়ী। সেটাই একমাত্র জগত যাকে আমরা বাস্তব বলতে পারি, কারণ সে জগত স্থায়ী, একমাত্র সত্য। অন্যসব জগত অস্থায়ী এবং সতত পরিবর্তনশীল।
আমাদের নিজেদের জীবনের কিছু অংশ আমরা দেখি, আবার কিছু অংশ আছে যা আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু আমাদের মন সেসব বিষয় সম্পর্কে সচেতনতা লাভ করতে পারে। যে অংশটুকু আমরা দেখি সেটা আমাদের শরীর, বস্তুময় জগত, যে জগত স্থান-কালে অবস্থিত, এবং পদার্থবিদ্যার সূত্র মেনে চলে। বস্তুময় এ জগত সবসময় পরিবর্তিত হচ্ছে, একবার অস্তিত্বময় হয়, আবার সেটা বিলীণ হয়ে নতুন কিছুর তৈরি হয়। কিন্তু আমাদেরই অস্তিত্বের আরেকটা অংশ আছে, যার খুবই ক্ষণস্থায়ী তড়িৎ-আভাস আমরা মাঝে মাঝে পাই, যে অস্তিত্ব নির্বস্তুক, চিরন্তন, অক্ষয়, যাকে আমরা আত্মা বলে থাকি। আত্মা আমাদের চিরস্থায়ী ‘রূপ’। আত্মা চিরন্তন, স্থান-কালের বাইরে বাস করে এবং অন্তিম বাস্তবতায় ‘রূপ’ই সত্য।
স্পিনোজার ‘সারবস্তু
দার্শনিক স্পিনোজার মতে সবকিছুর মূলে ‘সাবস্ট্যান্স’ বা সার বস্তু (essence of thing)। স্পিনোজার দার্শনিক সারবস্তুর ধারণা দেকার্তের কাছ থেকে নেয়া। দেকার্ত মনে করতেন, আমাদের মনের বৈশিষ্ট্য বা গুন হল চিন্তা করা এবং শরীরের বৈশিষ্ট্য হল ‘বিস্তৃতি’। মানুষ হিসেবে আমরা চিন্তা এবং বিস্তৃতির এ দুটি গুনের অধিকারী। স্পিনোজার মতে, অসীম গুণাবলীর অধিকারী একটাই সত্ত্বা আছে যার কাছ থেকে আমরা আমাদের দুটি গুনাবলী পেয়েছি। এবং এ দুটি গুনাবলী দিয়ে আমরা তার অন্যান্য গুণাবলী বুঝতে পারি।
আমাদের ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভাষায়, ‘একমাত্র ঈশ্বরই বস্তু (substance), বাকি সব অবস্তু’।
কান্টের ‘থিং ইন ইটসেলফ’
দার্শনিক কান্ট যুক্তির মাধ্যমে অন্তিম প্রজ্ঞার সন্ধান করেছেন, তিনি কখনও যুক্তির বাইরে গিয়ে অতিন্দ্রীয় ভাবের আশ্রয় নেননি। আমাদের স্বাভাবিক চেতনা এবং বুদ্ধির সাহায্যে কান্ট সত্য অনুসন্ধানের প্রয়াস চালান। তো যুক্তির মাধ্যমে খুঁজতে গিয়ে তিনি যুক্তির সীমাবদ্ধতা নির্দিষ্ট করেন। তার সিদ্ধান্ত দাঁড়ায়, কেবল স্থান-কালের সীমাবদ্ধতাই নয়, আমাদের চিন্তার সকল পদ্ধতি কেবল বস্তুসকলের বাহ্যিক রূপ দেখতে এবং বুঝতে সাহায্য করে, তারা আসলে কী রকম (থিং-ইন-ইটসেলফ) সেটা আমরা জানতে পারি না। চিন্তার এ ধরণগুলোকে কান্ট বলছেন ‘ক্যাটেগরিক্যাল ইম্পের্যাটিভ’, এসব ক্যাটেগরিক্যাল চিন্তা আর স্থান-কালে পূর্বনির্দিষ্টভাবে আবদ্ধ থাকার কারণে যুক্তির মাধ্যমে বস্তুর আসল রূপ বা ‘বাস্তবতার আড়ালের বাস্তবতা’ আমাদের জানার বাইরে থেকে যায়।
শোপেনহাওয়ারের ‘উইল’
শোপেনহাওয়ার মনে করতেন তিনি কান্টের দর্শনকে পূর্ণতা দিয়েছেন। বস্তুর বাস্তবগুণের (মায়া) বাইরের জগত (Noumenal world) এক ও অবিচ্ছিন্ন, কারণ সেটা স্থান-কালের বাইরে অবস্থান করে। কার্য-কারণের মাধ্যমে আমরা সে জগতকে আমাদের প্রাত্যহিক জগতের সাথে সম্পর্কিত করতে পারব না। শোপেনহাওয়ার সে জগতকে বলছেন ‘উইল’ বা ইচ্ছাশক্তির জগত।
স্থান-কাল, আমাদের চেনা বস্তুজগত সেই জগতের ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ। আমাদের শারীরিক ভিন্নতা সত্ত্বেও অন্তিম সত্ত্বায় আমরা সবাই একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। এর দ্বারা মানুষে মানুষে যে সহানুভূতি, সহমর্মিতা তা বুঝা যায়। আমি কারো ক্ষতি করলে শেষ বিচারে সেটা নিজেরই ক্ষতি। সেজন্য কান্টের ‘যুক্তি’ নয়, আমাদের নীতি এবং ভালবাসার মূল স্তম্ভ হলো ‘সহমর্মিতা’।
অস্তিত্ববাদীদের ‘আছেময়তা’
অস্তিত্ববাদী দার্শনিক সোরেন কিয়ের্কেগার্ড, মার্টিন হাইডেগার এদের দর্শনের মূল লক্ষ্য সত্ত্বার অস্তিত্ব বা ‘আছেময়তা’ থেকে দার্শনিক উপলদ্ধিতে পৌঁছানো।
“Why there is something, rather than nothing?”
সত্ত্বা কোন অস্তিত্ব নয়, কোন বস্তু নয়, এটা এমন কিছু নয় যা আমার আছে এবং আমি যা সেটা তাও নয়। সত্ত্বা একটা সম্পর্ক যে নিজের সাথে নিজেকে সম্পর্কিত করে। মানুষ শুধু চিরন্তন এবং অস্থায়ী, অসীম এবং সসীম, আত্মা এবং শরীর, এসব সম্পর্কের সংশ্লেষণও নয়। কেবল যখন এসব সম্পর্ক নিজের সাথে নিজেকে সম্পর্কিত করে সেটাই হল অস্তিত্বময় সত্ত্বা।মানুষের সত্ত্বা তাই উৎপন্ন সত্ত্বা।
“By relating itself to its own self, and by willing to be itself,the self is grounded transparently in the Power which posited it.” The self “in being itself and in willing to be itself, is grounded transparently in God.”
অস্তিত্ব দ্বন্দ্বময়, এটি নিশ্চয়তা এড়িয়ে চলে। এটি একই সাথে নিজ এবং অপর; এ দুইয়ের মধ্যে সম্পর্কে সত্ত্বা হলো নিজের সাথে সম্পর্ক, এবং যে ক্ষমতা থেকে এ সম্পর্ক উৎসারিত তাতে প্রোথিত। দ্বন্দ্বময় এ অবস্থা থেকে কোন একটা উপাদানকে সরিয়ে নেয়া হলে অন্যদেরও কোন ভিত্তি থাকে না। “আমি সত্য না হলে গুরু সত্য কোনকালে।”
অস্তিত্ব চেতনার সবচেয়ে বড় উপাদান চেতনা নিজেই। এটা এমনি এক বিষয় যে কোন সর্বোচ্চ শক্তিশালী লেখকও এর কোন বর্ণনা দিতে পারে না, যদিও সব মানুষের মধ্যে চেতনা আছে।ফকির লালন যেমন বলেছেন, “আমি কে তা জানলে সাধন সিদ্ধ হয়।” অসীম চেতনাময় সত্ত্বা হলো চেতনার সবচেয়ে বিমূর্ত রূপ, সত্ত্বার সবচেয়ে বিমূর্ত সম্ভাবনা। সত্ত্বার সূলুক সন্ধান করে সত্ত্বাময় হয়ে ওঠা মানুষের অপার সম্ভাবনা।
“To be a self is the greatest, the infinite concession made to man, but at the same time it is eternity’s demand upon him.”
হেগেলের ‘পরম’
দার্শনিক হেগেল তাঁর দ্বান্দ্বিকতা দিয়ে কর্তাসত্ত্বার সাথে বস্তুময় জগত বা অপরের সম্পর্ক সন্ধান করেছেন। হেগেলের মতে, পরমের জ্ঞান পেতে হলে দ্বান্দ্বিকতার আশ্রয় নিতে হবে কারণ জগত দ্বন্দ্বময়। এ জগতে কর্তা এবং কর্মকে বুঝার আগে আমাদের ক্রিয়ার জ্ঞান হয়, সেখান থেকে পেছনে ফিরে আমরা কর্তাসত্ত্বার উপস্থিতি টের পাই। কর্মের মাধ্যমেই কর্তাসত্ত্বা কর্তা ‘হয়ে ওঠেন’। হেগেলের দর্শন সমগ্রতার দর্শন, একটা সিস্টেমের মধ্যে কোন পরম ভাবনা বা চিন্তার সমন্বয় ছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে শুধু দ্বান্দ্বিক ত্রয়ীর চর্চা করে জ্ঞানের অনুভূতি হবে কিন্তু সেটা সত্যিকারের জ্ঞান হবে না।
বাইবেলের অদ্বৈতবাদ
সৃষ্টির পূর্বে ঈশ্বর তাঁর স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির কারণে নিজেকে প্রকাশের ইচ্ছা পোষণ করেন। সে ইচ্ছার কারণে প্রজ্ঞার (সোফিয়া) আয়নায় তার ইচ্ছার প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। ঐশ্বরিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে ঈশ্বর নিজেকে প্রকাশিত করেন এবং তার ইচ্ছা পূর্ণতা পায়। ওল্ড টেস্টামন্টে ঐশ্বরিক প্রজ্ঞার বিবরণঃ
“The LORD brought me forth as the first of his works, before his deeds of old; I was formed long ages ago, at the very beginning, when the world came to be. When there were no watery depths, I was given birth, when there were no springs overflowing with water; before the mountains were settled in place, before the hills, I was given birth, before he made the world or its fields or any of the dust of the earth.
I was there when he set the heavens in place, when he marked out the horizon on the face of the deep, when he established the clouds above and fixed securely the fountains of the deep, when he gave the sea its boundary so the waters would not overstep his command, and when he marked out the foundations of the earth. Then I was constantly at his side. I was filled with delight day after day, rejoicing always in his presence, rejoicing in his whole world and delighting in mankind.” (Proverbs 8:22-31)
সোফিয়া বা প্রজ্ঞা সৃষ্টির শুরুতে ঈশ্বরের ইচ্ছায় তাঁর সামনে হাজির হয়ে, তাঁর প্রকাশের ইচ্ছাকে সম্ভব করে তোলে। তাকে কূমারী বলা হয় কারণ সে কোন জন্ম দেয় না, বরং প্রতিকৃতিকে গ্রহণ করে এবং তাদের প্রতিফলিত করে। তার কোন সত্ত্বাবোধ বা ইচ্ছাশক্তি নেই, সে কেবলমাত্র ঈশ্বরের আয়না হিসেবে কাজ করে, যার মাধ্যমে ঈশ্বর নিজের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখতে পান।
অনন্ত প্রকৃতির মাধ্যমে ঈশ্বর তাঁর প্রকাশ করেন। কিন্তু এ প্রকাশ তাঁর প্রজ্ঞার বিপরীতে অবস্থান নেয়। প্রজ্ঞা যেখানে ভাব বা ধারণা মাত্র, বিমূর্ত প্রকাশ সেখানে প্রকৃতি বাস্তব হয়ে ওঠে। “God who see himself in the mirror, desires what he sees.” এ ঐশ্বরিক ইচ্ছার কারণে প্রকৃতি ঈশ্বর থেকে পৃথক হয়ে পড়ে অসংখ্য ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ ঘটায়। প্রকৃতির এ বিচ্ছিন্নতার ফলে দ্বৈততার সৃষ্টি হয়।
ঈশ্বর সোফিয়ার মাধ্যমে নিজেকে এবং তার সম্ভাবনাকে প্রকাশ করেন এবং দেখতে পান। সোফিয়া আদমের চক্ষু উম্মোচন করে যাতে আদম ঈশ্বরের মহিমা দেখতে পায় এবং নিজেকে চিনতে পারে। ঈশ্বরের প্রকাশ তাই শুধু নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তিনি নিজের বাইরে একটা জগত সৃষ্টি করেছেন। সেজন্য জগতটাকে ঈশ্বর বলা যাবে না, জগত ঈশ্বর সৃষ্ট এবং তাঁর সত্ত্বা বহির্ভূত।
ভারতীয় বেদান্ত দর্শন
বেদান্ত দর্শন উপনিষদ এবং ব্রহ্মসূত্র অনুযায়ী রচিত হিন্দু দর্শন। ভারতীয় ষড়দর্শনের অন্যতম ‘মীমাংসা দর্শন’ যেমন কর্ম মীমাংসা, বেদান্ত সেরূপ ব্রক্ষ্ম-মীমাংসা। যা হতে জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও বিনাশ হয়, তিনিই ব্রক্ষ্ম। তিনি সত্য-স্বরূপ, জ্ঞান-স্বরূপ, ও অনন্ত-স্বরূপ। তিনি অদ্বিতীয়, একমাত্র সত্য, অপর সবকিছু মিথ্যা। রাতের বেলা দড়িকে সাপ বলে ভুল হতে পারে (রজ্জুতে সর্প ভ্রম), সেরূপ, সৎ-স্বরুপ পরব্রক্ষ্ম আছেন বলে জগৎও বিদ্যমান আছে এরূপ ভ্রম হচ্ছে।
কুমার মাটির কলস বানায়, এখানে কুমার নিমিত্ত কারণ আর মাটি উপাদান কারণ। প্রথমে একমাত্র অদ্বিতীয় পরমেশ্বরই ছিলেন, আর কিছুই ছিল না; অতএব তাকে জগতের নিমিত্ত ও উপাদান উভয় কারণই বলিতে হয়। কিন্তু তিনি নিজে পরিণত বা বিকৃত হয়ে জগৎ সৃষ্টি করেন নাই। মাটি যেমন কলসীর উপাদান তিনি সেরূপ জগতের উপাদান হতে পারেন না। দড়িকে সাপের ও পরব্রক্ষ্মকে জগতের বিবর্ত উপাদান। এ মতকে মায়াবাদ বলে। উপনিষদ-ভাগেই বেদান্ত দর্শনের প্রধান প্রমাণ, তাতে পরব্রক্ষ্ম জগতের উপাদান কারণ বর্ণিত হয়েছে। জৈমিনি দর্শনকে যেমন পূর্বমীমাংসা বা কর্মমীমাংসা বলা হয়, তেমনি বেদান্ত দর্শনকে উত্তর মীমাংসা বলা হয়। (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়ঃ ২য় খন্ড)
বেদান্ত দর্শন জ্ঞানবাদী দর্শন, জ্ঞানের আলো জ্বেলে সব অজ্ঞতাকে সমূলে ধ্বংস করতে দিতে হবে। এক্ষেত্রে, প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। বিবেক অর্থাৎ মনে একমাত্র ব্রক্ষ্মাকে সত্য মেনে বাকি সবকিছুকে অসত্য বিচার এ দর্শনের প্রাথমিক কাজ। এর লক্ষ্য অসত্য থেকে সত্যকে আলাদা করা, অস্থায়ী আর চিরস্থায়ীর ভেদ, আত্মা আর অনাত্মার পার্থক্য নিরুপণ করে চিরস্থায়ী, সত্য, এবং আত্মার অনুসারী হওয়া। শংকরাচার্যের মতে আত্মার সাথে একাত্মবোধ ছাড়া মুক্তি নাই, শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ ও উদ্ধৃতি, যাগযজ্ঞ, বলিদান, প্রথাযাপন, উপাসনা, ধনসম্পদ এসবের কোনটাই কোন কাজে আসবে না। যোগ, সাংখ্য, তন্ত্র, শিক্ষা কোনটায় কিছু হবে না। প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। একমাত্র নিজের আত্মাকে পরমাত্মার সাথে সংযোগেই মুক্তি। ঔষধ না খেলে যেমন অসুখ সারে না, তেমনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া কেবল নামজপে মুক্তি নাই। মুক্তির পথ প্রথমতঃ, অস্থায়ী জিনিসের প্রতি চরম বিতৃষ্ণা, দ্বিতীয়তঃ, শান্তভাব অর্জন, আত্মনিয়ন্ত্রণ,কর্মত্যাগ এবং সবশেষে শ্রবণ,ধ্যান,নির্বিকল্প।
বেদান্ত জ্ঞানবাদী দর্শন, এ দর্শনের অনেকগুলো উপধারা আছে। বিভিন্ন ধারায় জ্ঞানের উৎস হিসেবে প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান, অর্থপাত্তি, অনুপলব্ধি, শব্দ এগুলোকে প্রমাণ হিসেবে মানা হয়।
অদ্বৈতবাদ
এক ব্রহ্ম, এক আত্মা, সবকিছু একসূত্রে গাঁথা। আত্মাই একমাত্র সত্য, বাকি সব মায়া, ক্ষণস্থায়ী। আদি শংকারাচার্য এ মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা। ব্রক্ষ্মবাদী এ দর্শনের মূল কথা, ‘ব্রক্ষ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা’। অদ্বৈতবাদীর কাছে জগত মিথ্যা, মায়াময়, তাই রজ্জুতে সর্পভ্রম করলে চলবে না।
বিশিষ্টাদ্বৈত
রামানুজ প্রবর্তিত এ দর্শনে সর্বোচ্চ সত্তার গুনাবলীকে স্বীকার করা হয়। ব্রহ্মা এক এবং অনন্ত, সকল সৃষ্টির মূল, সর্বত্র বিরাজমান, সক্রিয়ভাবে সকল সত্ত্বায় অবস্থিত। কর্তা এবং কর্মে কোন ভেদ নেই। ব্যক্তি সত্ত্বার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সম্পূর্ণ বিভ্রম যেহেতু সেটা ব্রহ্মা সার্বজনীন সত্ত্বার থেকে উদ্ভূত।
দ্বৈতবাদ
ত্রয়োদশ শতকের দার্শনিক মাধবাচার্যের মতে ঈশ্বর এবং জীবাত্মা স্বাধীন অস্তিত্বময় সত্ত্বা, তারা পৃথক। ব্রহ্মা বা বিষ্ণু প্রথম এবং একমাত্র স্বাধীন অস্তিত্বময় সত্ত্বা, পূর্ণপ্রজ্ঞ। ঈশ্বর অনন্ত সত্ত্বা, বিশ্বজগত যার নিয়মাধীন, তিনি একে নিয়ন্ত্রণ করেন। বিশিষ্টাদ্বৈত শেষ পর্যন্ত অদ্বৈতবাদী, কিন্তু দ্বৈতবাদ সব সময় ঈশ্বর এবং জীবাত্মার পার্থক্য বজায় রাখে। ঈশ্বরের করুণায় জীবাত্মা মুক্তি পায়।
দ্বৈতাদ্বৈত
এ মতবাদের প্রবক্তা নিম্বারক, ত্রয়োদশ শতকের বৈষ্ণব দার্শনিক। এ দর্শন মতে অস্তিত্বের তিনটা ধরণ আছঃ ব্রহ্মা, আত্মা এবং বস্তু। এর মধ্যে আত্মা এবং বস্তু ব্রহ্মার থেকে পৃথক তাদের নিজস্ব গুনাবলী আছে, ব্রহ্মা স্বাধীন, পক্ষান্তরে বস্তু এবং আত্মা পরাধীন। ব্রহ্মা সবকিছুর নিয়ন্ত্রক, আত্মা উপভোগকারী এবং বস্তু হলো যা উপভোগ করা হয়।
শুদ্ধাদ্বৈত
বল্লভাচার্য (১৪৭৯-১৫৩১) এ মতবাদের প্রবক্তা, তিনি ছিলে বল্লভ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা গুরু। ব্রহ্মা এ জগত সৃষ্টি করেছেন, এর সাথে মায়া বা কোন কিছুর সম্পর্ক নেই, এবং তিনি নিজে জগতব্যাপী প্রকাশিত। এ মতবাদের আরেক নাম ‘অবিকৃত পরিণামবাদ’। ঈশ্বর নিজে এক থেকে বহু হবার ইচ্ছা করেন, যার ফলে জগতে অসংখ্য জীবাত্মা সৃষ্টি। জগতটা তাই মায়া বা ভ্রমাত্মক নয়। সৃষ্টি থেকে স্রষ্টাকে পৃথক করা যায় না যেমন অগ্নি থেকে এর স্ফুলিঙ্গ বা দাহিকা শক্তিকে পৃথক করা যায় না।
অচিন্ত্য ভেদ অভেদ
বাংলা নবজাগরণের পথিকৃত শ্রীচৈতন্যের (১৪৮৬-১৫৩৪) মতে আত্মা বা ঈশ্বরের শক্তিকে ঈশ্বরের থেকে পৃথক ভাবা যায় না আবার অপৃথকও বলা যায় না। প্রেমময় ভক্তির মাধ্যমে অচিন্তনীয় তাঁকে অনুভব, উপলব্ধি করা যায়। শ্রীচৈতন্য মাধবাচার্যের দ্বৈত মতবাদের অনুগামী ছিলেন। তাঁর দর্শন হলো একইসাথে ‘অবোধগম্য একত্ববাদ এবং পার্থক্য’ এর দর্শন।
বেদান্ত ধারার দর্শনের মধ্যে বিশিষ্টাদ্বৈত এবং শুদ্ধাদ্বৈতের সাথে বাইবেলে বর্ণিত অদ্বৈতবাদের সাথে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু তিনি তাঁর সৃষ্টি থেকে পৃথক। বাইবেলে প্যানথেইজম বা সর্বেশ্বরবাদের কোন স্থান নেই। বাইবেলের অদ্বৈতবাদের সাথে তাই বেদান্তের দ্বৈতবাদ এবং দ্বৈতাদ্বৈতবাদের সাথে মিল বেশি। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই সব হচ্ছে, আবার মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাও আছে। ‘মানুষ খোদা নয়, আবার খোদা থেকে জুদাও নয়’, ঈশ্বরের শক্তিকে ঈশ্বরের থেকে পৃথক ভাবা যায় না আবার অপৃথকও বলা যায় না। ঈশ্বরের কৃপায় মানুষ তার ‘আদিম পাপ’ থেকে মুক্তি পেয়ে তাঁর সান্নিধ্যও লাভ করতে পারে।
বাংলায় বেদান্ত দর্শন তেমন আদৃত হয়নি। শ্রীচৈতন্য জ্ঞানবাদী এ দর্শনের বিরোধীতা করে জ্ঞান-ভক্তি মার্গের পক্ষালম্বন করেন।জগতে বাস করে জগতটাকে মায়া বলা যায় না, ‘ব্রহ্ম সত্য, জগতও সত্য’। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বেদান্ত দর্শনের সমালোচনা করে বলেন, ‘চিনি হতে চাই না, চিনি খেতে চাই’, অর্থাৎ নিজে ঈশ্বর না হয়ে ঈশ্বরের উপাসক/ভক্ত হতে চান। লালন ফকিরের গানেও আছে, ‘চিনি হওয়া মজা কি খাওয়া মজা, দেখ দেখি মন কোনটা মজা’।
“সব সৃষ্টি করল যে জন, তারে সৃষ্টি কে করেছে
সৃষ্টি ছাড়া কিরূপে সে সৃষ্টিকর্তা নাম ধরেছে।
সৃষ্টিকর্তা বলছ যারে, লা-শরীক হয় কেমন করে?
ভেবে দেখ পূর্বাপরে, সৃষ্টি করলে শরীক আছে।”
– লালন সাঁই