“স্ট্যাটাস …” চিরকালের একটা দাম্ভিক শব্দ । সেটা নিয়ে সবাই খুব গর্ব করে । এই “স্ট্যাটাস ” যার থাকে তাকে সেটা রীতিমত “মেইনটেন ” করতে হয়, না হলে সেটার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় । কিন্তু বর্তমানে এই স্ট্যাটাসের চিত্র কিছু ভিন্ন ও সুদূরপ্রসারি… ।
বর্তমানে জীবন যাপনে আধুনিকতার নামে আমরা একপ্রকার কৃত্রিম “স্ট্যাটাস সর্বস্ব” জীবে পরিণত হয়েছি । যতদূর জানি সামাজিক পদমর্যাদা ছাড়াও স্থিতাবস্থা বা পূর্বাবস্থা বোঝাতেও স্ট্যাটাস শব্দটা ব্যবহার করা হয় ।
কিন্তু ফেবুর কল্যাণে “স্ট্যাটাস” এক ভিন্ন রূপ ও মাত্রা পেয়েছে । সকালে উঠে দাঁত মাজা থেকে শুরু করে রাতে বিছানায় যাবার আগে পর্যন্ত প্রায় সবই এই স্ট্যাটাস এর আওতায় চলে এসেছে। , কখন ঘুম থেকে উঠলো , সাদা জামা পড়লো নাকি কালো প্যান্ট, বিরিয়ানি খেলো নাকি পান্তাভাত ! বরের সাথে ঝগড়া নাকি প্রেম.., ঠান্ডা জলে স্নান করলো না গরমজলে মুখ পুড়লো , হাত দিয়ে স্যুপ খেতে হয় না চামচ দিয়ে, তরল গ্লাসে খায় না প্লেটে … সব … সব… স্ট্যাটাসের বিষয় বস্তু । (এরপর আরো একটু আধুনিক হলে হয়তো বাকি সময়ের কর্মকান্ড ও এর অন্তর্ভুক্ত হবে)।
এ প্রসঙ্গে একটা বেশ মজার গল্প আছে… , এক দম্পতি কোথাও একটা বেড়াতে গিয়েছিলেন, এবং যথারীতি যাওয়া থেকে শুরু করে ঘুরে আসা পর্যন্ত সব ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরন ছবি সহ আপলোড করার অনিবার্য কার্যটি অত্যন্ত নিয়মানুবর্তীতার সঙ্গে আপলোড করে যাচ্ছিলেন এবং বিভিন্ন তথাকথিত ‘বন্ধুদের’ যথাযথ মন্তব্য সহযোগে বেড়ানোর মজা দ্বিগুণ … চতুর্গুণ করে তুলছিলেন। “স্ট্যাটাস” এর কল্যাণে সকলেই জানলো তার বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে , এবং সেই ফাঁকা বাড়ি কিভাবে পরিচর্যা করতে হবে সে নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হলো মন্তব্যের বাক্স তে।
তারপর তারা ফিরে এসে আক্ষরিক অর্থেই বাড়ি একদম ‘ফাঁকা’ পেয়েছিলেন । এমনকি খাবার জন্য একটা থালা বা পরবার জন্য একটা পোষাক ও অবশিষ্ট ছিলনা বাড়িতে ।
এগুলো আসলে কি ? সামাজিকতা? পদমর্যাদা? ব্যক্তিগত অবস্থান বোঝানো ? কিন্তু এত কিছু কে জানতে চায় ? আর এগুলো জানানোর পরিণতিই বা কি হতে পারে সেসব নিয়ে ভাবার প্রয়োজনই বোধ করে না কেউ … ! আসলে এগুলো একধরনের আসক্তি, নেশার মতো।
তবে আমার এই লেখার মূল বিষয় স্ট্যাটাস এর অর্থ নিরুপণ করা অথবা কাউকে আঘাত করা নয় , বরং বিষয়টা বেশ সিরিয়াস । যে কারণে ধান ভানতে শিবের গীত গাইলাম, তা হলো…
আমার মাঝে মাঝে এসব দেখে একটা প্রশ্ন খুব মনে জাগে , আচ্ছা … আমরা কি আদৌ সুস্থ মানুষ ? বর্তমান জীবন যাপনে আধুনিকতার নামে আমরা কোথায় চলেছি ? সভ্যতা মানে কি শুধুই সোসাল মিডিয়াতে নিজের সারাদিনের কাজ কর্মের খন্ড চিত্র আপলোড করা নাকি জ্ঞানগর্ভ বাণী উপচে দেওয়া ? আজকাল তো এটা কারো কারো কাছে রীতিমতো প্রেস্টিজ ইস্যু! সোসাল মিডিয়া তে আপডেট থাকতে হয় , নাহলে তুমি……… ।
আমরা আসলে যন্ত্রের মতো হয়ে যাচ্ছি সবাই, হয়ে যাচ্ছি ই বা কেন বলছি ! অলরেডি হয়ে গেছি । সদা সর্বদা ‘ অনলাইন ‘ থাকাটাও একটা ‘স্ট্যাটাস ‘ ! একটা অবাস্তব আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছি আমরা। চোখের সামনে অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করিনা , কিন্তু নেট দুনিয়ায় এসে প্রতিবাদের ঝড় তুলি।
পাশের বাড়ির বৌটাকে স্বামীর হাতে মার খেতে দেখে তাকে রক্ষা করতে যাই না বরং কিছুক্ষন জানালা থেকে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে তারপর জানালা বন্ধ করে “জাস্ট – কেটে পড়ি” । তারপর কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে সমালোচনা করে ব্যাস — ঢুকে যাও নেটে । অথবা রাস্তায় বিবাদে রত দু’পক্ষকে দেখে সাবধানে, আঁচ বাঁচিয়ে পাশ কাটিয়ে নিরাপদে সরে এসে ফেসবুকে জমাটি পোস্ট … ট্রল কত কী !
কেন আমরা বাস্তবে প্রতিবাদ করি না ? এটা কি সুস্থ মানসিকতার লক্ষন ? আগে যখন আমরা যন্ত্রমানব / মানবী হই নি তখন তো প্রতিবেশীর বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছি । অচেনা ব্যক্তির সমস্যাকেও গুরুত্ব দিয়েছি । তাহলে?
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় একটা গোটা সমাজ, একটা শ্রেণী একসাথে মানসিক অসুস্থতার শিকার হচ্ছি। ড্রাগের থেকেও সাংঘাতিক ভাবে এবং আরো সুদূর প্রসারী এর প্রভাব। হয়তো আমি নিজেও এর ব্যতিক্রম নই ।
এই অনলাইন আসক্তি এতটাই মানসিক আসক্তি তৈরি করেছে যে মনোবিজ্ঞানীরা একে ‘ডিজিটাল কোকেন ‘ বলে অভিহিত করেছেন । গবেষকরা বলছেন– একটা সমীক্ষায় ব্রেন স্ক্যান করে দেখা গেছে, যারা অতি মাত্রায় ইন্টারনেট আসক্ত তাদের ব্রেনও মাদকাসক্তের মতই সমান ক্ষতিগ্রস্ত। এই অতিরিক্ত নেট আসক্তির ফলে ব্রেনের সামনের হোয়াইট ম্যাটার ক্ষতি গ্রস্ত হচ্ছে । যার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক অনুভূতি গুলো । কারণ মানুষের আবেগ , মনোযোগ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়গুলো এই হোয়াইট ম্যাটারই নিয়ন্ত্রণ করে । আর এই অন্তর্জালে আবদ্ধ হয়ে সেগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ।
আমরা ভাবছি, বিভিন্ন কাজের মাঝে বারবার সোসাল মিডিয়া তে আপডেট থেকে আমরা বেশ মাল্টি টাস্কার হয়ে উঠছি, কিন্তু বাস্তবে এটা ভয়ংকর রকমের ভুল । গবেষণায় এটাও প্রমাণিত যে যারা ইন্টারনেট আসক্ত তাদের মধ্যে মনোযোগের ক্ষমতা এবং স্মৃতি শক্তি কমে যাচ্ছে । শুধু তাই না, এর সাথে মস্তিষ্কে ডিজিটাল হ্যালুসিনেশন হতে শুরু করেছে যার ফল হলো- “ফ্যান্টম ভাইব্রেশন সিনড্রোম”।
অনেক সময়ই এমন মনে হয়.. রিং হচ্ছে, অথচ ফোন চেককরে দেখা যায় যে কোন কল আসেনি । অথবা থেকে থেকেই ইচ্ছা করে ফোন চেক করার । কোন ম্যাসেজ এল নাকি , কোন কল এলো নাকি , অথবা দেখিতো সোসাল মিডিয়াতে এই মুহূর্তে কি আপডেট এলো !… এক অদম্য ইচ্ছা হয় যার ফলে মানুষ বারবার ফোন চেক করে এবং এগুলোই হচ্ছে ফ্যান্টম ভাইব্রেশন সিনড্রোমের লক্ষণ।
আসলে যেটা হচ্ছে … এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এসে বাস্তবে আমাদের অসামাজিক এবং সমাজ বিচ্ছিন্নই করে তুলেছে । এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে , আমরা কাছের মানুষের থেকে দূরের বন্ধু কে গুরুত্ব দিই বেশি । সামনের মানুষ টির সাথে কথা বলতে বলতে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তার ফলে সেই মানুষটি অপমানিত হন , কিন্তু আমরা খেয়ালই করি না সেটা। আর এভাবেই কাছের মানুষদের সাথে সম্পর্ক গুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত হয়ে যাচ্ছি আমরা প্রত্যেকেই । এরসাথে আছে আরো বিভিন্ন উপসর্গ, আজকাল অনলাইন প্রেম বা সেক্স বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। স্বামী স্ত্রী, বা প্রেমিক প্রেমিকার সঙ্গ ভালোলাগেনা , তৈরি হচ্ছেনা কোন মানসিক টান , দু দিন ছাড়াই ব্রেক আপ এবং সেটাও বেশ ফলাও করে স্ট্যাটাসে আপডেটেড । আর মুহূর্তেই তার পরিপূরক হিসেবে বেছে নিচ্ছে অনলাইন চ্যাট, ভার্চুয়াল ফ্রেন্ড .. সেখানে সুখ খুঁজছে মানুষ । আর এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসছে মানুষের চরিত্রের যত অন্ধকার দিক গুলো । কোন দায়বদ্ধতা নেই সম্পর্কে , যতদিন ভালো লাগে ততদিন চলছে এই নকল ভালোবাসা, বন্ধুত্ব তারপর ব্লক অপশন তো আছেই ।
কিন্তু এই যে অলীক সুখ খোঁজার প্রয়াস এটাও কি একপ্রকার বিকৃতি নয় ? এরফলে কি স্বাভাবিক আবেগ , বন্ধুত্বের পরিভাষা বা স্বাভাবিক যৌনতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না? যেখানে অনেক সময়ে অপর দিকের ব্যক্তির বাস্তবতা আসলে কি সেটা জানাই যায় না , বা অনেকে হয়তো জানতেও চায়না । সবটাই হয় বড্ড ক্যাজুয়াল মানসিকতা নিয়ে , যেন কিছুক্ষণের টাইম পাস… বেড়াতে যাওয়া বা সিনেমা দেখার মত… আবেগ খুঁজতে যাওয়া! তারপর তো আছে ফেক একাউন্টের ছড়াছড়ি । ‘শুকনো পাতা’ , ‘চোখের তারা’, ‘ভালো ছেলে’, ‘মন্দ মেয়ে ‘ , ‘চোখের বালি’, ‘খড় বিচালি’ কত মনোহারী নাম… !!!
এছাড়াও আছে অন্যান্য অনেক সামাজিক বা পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক দায় বদ্ধতার জায়গা , এগুলো থেকেও কিন্তু বর্তমানে মানুষ সরে গেছে অনেকটাই এই ভার্চুয়াল জগতের অতিরিক্ত আসক্তির ফলে। সৃষ্টি হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক সমস্যা । এছাড়াও আছে সাইবার বুলিং.. অনলাইনে আছেন অথচ সাইবার বুলিং এর শিকার হননি এমন অভিজ্ঞতা বিরল , অন্তত পক্ষে আশি শতাংশ মানুষই এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন , সমীক্ষার রিপোর্ট তাই বলছে। শুধু তাই নয় সাইবার ক্রাইম এর শিকার হয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন এমন নজির ও কম নেই, এক্ষেত্রে মহিলারাই বেশির ভাগ এই সমস্যার সম্মুখীন হন ।
এর সাথে আরো একটা ভয়াবহ আশঙ্কা থাকে , নতুন প্রজন্মের জন্য । কারণ নিউ জেনারেশন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইন্টারনেট এর খারাপ দিকগুলো গ্রহণ করছে প্রবল ভাবে । (এক বছরেরও কম বয়সেই আসক্ত হয়ে যাচ্ছে বাচ্চারা ) অপরিণত মস্তিষ্কে অকালেই কিছু অনাবশ্যক ভুল তথ্যের ভিত্তিতে তারা বয়সোচিত স্বাভাবিক প্রবৃত্তি থেকে বিরত থাকছে এবং বিভিন্ন অনলাইন গেম ইত্যাদি তে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে । যা সাংঘাতিক ভাবে তাদের মস্তিষ্কে ডিজিটাল হ্যালুসিনেশন সৃষ্টি করছে । তৈরি হচ্ছে মানসিক অস্থিরতা, বিভিন্ন অস্বাভাবিকতা দেখা যাচ্ছে তাদের আচরণে । মেকানিক্যাল হয়ে যাচ্ছে তাদের চিন্তা, ভাবনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের মানসিকতা । এই সমস্যা আজ ঘরে ঘরে । কিন্তু তবুও আমরা নির্বিকার ।
আজ হয়তো একটু ভাবার সময় হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক জেনারেশন পর চিত্র টা কি দাঁড়াবে? আবেগ অনুভূতি তো সব ডোডো পাখি হয়ে যাবে। সম্পর্কে ভাঙন একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে যাবে যা নিয়ে কোন ফিলিংস ই থাকবে না হয়তো। মানুষ বিকল্প পথ খুঁজে নেবে ইন্টারনেট এ !!
অনলাইন activities , ভিডিও কল , সেক্স চ্যাট … এসবেই মিটে যাবে সব চাহিদা ? তারপর… ?
জেনারেশন নেক্সট … কিভাবে এগোবে ? নাকি কল্পবিজ্ঞানের গল্পের মতো মানুষ দীর্ঘ জীবন লাভের উপায় বের করবে ! কয়েকশ বছর করে বাঁচবে মানুষ, বিজ্ঞানের উন্নতি ছাড়া আর কোন কিছুই প্রাধান্য পাবেনা তখন সেই পৃথিবীতে ! মানুষ হুট হাট করে চাঁদে বা মঙ্গলে যাবে এবেলা ওবেলা… !?
এটাই কি ভবিষ্যতের পৃথিবী হতে চলেছে?
আমার একটাই প্রশ্ন – এখনো কি ফেরার সময় আছে ? ঠুনকো এই সামাজিক মাধ্যমের থেকে আমাদের দেহের সুস্থতা, মনের স্বাভাবিকতা অনেক বেশি কাম্য নয় কি ? ভবিষ্যতের জন্য আমাদের এখনই সচেতন হওয়া প্রয়োজন , কিন্তু এর সমাধানের সঠিক উপায় কি এটাই সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ প্রশ্ন এই মুহূর্তে ।