১৫২১ বার পঠিত
সম্প্রতি নুসরাত নামের এক কিশোরীকে পুড়িয়ে মারার ঘটনার প্রধান অপরাধী হিসেবে একজন মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এই মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে তার মাদ্রাসার ছাত্রীদের যৌন-নির্যাতনের মত মানবতা বিরোধী অপরাধের তদন্তে জানা যাচ্ছে, ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল ওই মাদ্রাসার শিক্ষক সিরাজ উদ দৌলা। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ১৩ জনের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছে পুলিশ। আর নুসরাতের গায়ে সরাসরি আগুন দেয় চারজন। তাদের মধ্যে একজন ছিল শাহাদাত হোসেন শামীম। আরেকটি মেয়ে ছিল (যার পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে)। আগুন দিয়ে মাদ্রাসার মূল গেট দিয়েই পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
অনুসন্ধানে এটা বেরিয়ে আসছে, ঐ মাদ্রাসার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে পর্যাপ্ত। ফলে মাদ্রাসা অধ্যক্ষের জীবনটি রাজসিক। এই রাজসিক জীবনের আরাম-আয়েশ বিনির্মাণে অধ্যক্ষ তার দপ্তর কক্ষকে ‘খাস কামরা’ হিসেবে ব্যবহার করেছে। আর মাদ্রাসা অধ্যক্ষের নবাবি টিকিয়ে রাখতে তাকে সাহায্য করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কিছু স্থানীয় নেতা। সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের লোক। আর সাবেক ক্ষমতাসীন বিএনপি ও জামাতের কিছু স্থানীয় নেতা। এই প্রভাবশালী চক্রকে টাকা দিয়ে তুষ্ট করেছে ঐ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। মাদ্রাসাটি ‘আল্লাহর নামে’ পরিচালিত হলেও; মাদ্রাসার অধ্যক্ষের ঈশ্বর হিসেবে কাজ করেছে অর্থ-সম্পদ।
সব মানবতাবিরোধী অপরাধের প্যাটার্ন ঠিক একই রকম। যারা খুন-নারী নির্যাতন-দখল-লুন্ঠনের কাজগুলো করে; তাদের অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ-সম্পদের চারপাশে এরকম প্রভাববলয় তৈরী হয়। অর্থ-সম্পদের ঈশ্বরই যেহেতু সামষ্টিকভাবে কাংক্ষিত; তাই অপরাধীর ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক আত্মপরিচয় খুবই গৌণ এক ব্যাপার। সংঘটিত অপরাধের পেছনে টাকা-টুকাটাই আসল শক্তি ও মদদদাতা।
ধর্মীয় আদর্শ যেহেতু প্রাচীনতম আদর্শ; তাই ‘আল্লাহর নামে’ টাকাটুকার ঈশ্বর-চর্চার ব্যবসাটা সবচেয়ে জনপ্রিয়। ফলে মাদ্রাসা থেকে জাতীয় জীবনে এই ব্যবসার দাপট আর সংঘটিত অপরাধ সর্বব্যপী। শিশু-কিশোর-কিশোরীদের যৌন নির্যাতনের ঘটনা সেখানে নিত্য নৈমিত্তিক।
এরপর রয়েছে রাজনৈতিক আদর্শ। এর উগ্রজাতীয়তাবাদী আস্ফালন ও মানবতাবিরোধী অপরাধ রাজনৈতিক ব্যানারে নেতা-নেত্রীদের ছবি দিয়ে সংঘটিত হলেও; এর পেছনের প্রধান শক্তি হচ্ছে টাকা-টুকা লুন্ঠনের অর্থনীতি। নারীর বিরুদ্ধে অধিকাংশ সহিংসতার পেছনে কাজ করে ‘আলোচিত মাদ্রাসা’ অধ্যক্ষের তৈরি করা সর্বদলীয় প্রভাব বলয়ের মডেলটি।
এরপর রয়েছে সাংস্কৃতিক আদর্শ। এই সংস্কৃতি শব্দটি খুব আগ্রহউদ্দীপক। এর পেছনে রয়েছে ধনিক শ্রেণী ও তাদের পালিত সংস্কৃতি সৈনিকদের অর্থ-সম্পদের কারবার। প্রতিটি নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। সেসব সংস্কৃতিকে গুঁড়িয়ে দিয়ে সংস্কৃতি মোড়লেরা তাদের একটা কল্পিত সংস্কৃতি চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে।
বাংলাদেশের সংস্কৃতির সমৃদ্ধ চিহ্ন এখানকার যাপিত জীবনে খুঁজে পাওয়া যায়। এখানকার লোকজ সংগীতে; খাদ্যাভাস, পোশাকে সহজাত সংস্কৃতির আভাস রয়েছে। কিন্তু প্রথমে বৃটিশ ও পরবর্তীতে পাকিস্তানি উপনিবেশ তার অপভ্রংশ সংস্কৃতির উপাদান প্রবেশ করানোর অপচেষ্টা করে এই জনপদে। আর ভারতেরও নিজের অপভ্রংশ সংস্কৃতি চাপিয়ে দেবার অপচেষ্টা সতত জারী রয়েছে এ অঞ্চলে। বাংলাদেশে বৃটিশ, পাকিস্তানি ও ভারতীয় সংস্কৃতির সংঘর্ষে স্বকীয় সংস্কৃতিটি ধরে রাখা খুব কঠিন হয়েছে। বাংলাদেশের বাইরের অন্য দেশগুলোর নিজস্ব সংস্কৃতি তাদের কাছে আদরনীয়। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের ভূমি-সঞ্জাত সংস্কৃতি এ অঞ্চলের মানুষের প্রিয়। প্রতিটি মানুষ তার মতো করে স্বকীয় সংস্কৃতির চর্চা করতে চেষ্টা করে।
কিন্তু বৃটিশ, পাকিস্তানি, ভারতীয় সংস্কৃতি এসে বাংলাদেশের স্বকীয় সংস্কৃতিকে শাসন করতে চাইলে তা অনধিকার চর্চা।
বৃটিশ সংস্কৃতির প্রচ্ছায়া এসে একটি লিস্টি ধরিয়ে দিয়ে যদি বলে, এগুলো করো; তবেই তোমাকে সঙ্গে নেবো; তা খুবই আপত্তিজনক। একই সমস্যা পাকিস্তানি ও ভারতীয় সংস্কৃতির প্রচ্ছায়াগুলোর ক্ষেত্রে। আর এই পাকিস্তানি ও ভারতীয় সংস্কৃতির আদর্শিক শক্তি না থাকায় তা প্রথমে ইসলাম ধর্ম ও হিন্দু ধর্মের নামে উদয় হয়ে শেষপর্যন্ত জামাত ও শিবসেনার সংস্কৃতি হয়ে টানা-হ্যাঁচড়া করছে বাংলাদেশের মানুষকে।
এই জামাত ও শিবসেনার সংস্কৃতির দোকানদারদের কাছে সংস্কৃতি শেখার দৈন্য বাংলাদেশের মানুষের কখনোই ছিলো না। কিন্তু যেহেতু বিদ্যমান বাস্তবতায় সংস্কৃতির ঈশ্বরও টেকাটুকা; তাই অনেক দরিদ্র ও মানসিকভাবে দরিদ্র মানুষ জামাত ও শিবসেনার সাংস্কৃতিক পণ্যের ভোক্তা হয়ে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে লাঠালাঠি করে বেড়ায়।
সংস্কৃতিতে গ্রহণ-বর্জনের ব্যাপারগুলো ব্যক্তির ইচ্ছার স্বাধীনতা। তাই সর্বত্র জামাত ও শিবসেনার সংস্কৃতি পুলিশির যে প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় তা অনধিকার চর্চা। আর সারল্য, সততা ও মানবতা হচ্ছে সংস্কৃতির আত্মা। এই আত্মাকে হত্যা করে সংস্কৃতির খোলস নিয়ে দক্ষযজ্ঞ খুবই হাস্যকর এক ব্যাপার।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন