০
৫৯৬ বার পঠিত
মানুষের জীবন চক্রে কখন কি হয় কেউ জানেনা। তবে আমি একটি বিষয় নিশ্চিত জানি আমি কখনই বাংলাদেশে ফিরে যাব না। ইউরোপে এসে এর আবহাওয়া, ভাষার প্রতিবন্ধকতা, খাবারের ভিন্নতা নিয়ে যতটা অস্বাচ্ছন্দ্যে ছিলাম, ততটাই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছি ব্যাক্তি স্বাধীনতার যে স্বরূপটি আমি দেখেছি, বিশেষ করে একজন নারী হিসেবে। এই স্বাধীনতার স্বাচ্ছন্দ্যের স্বরূপটি আমি ভাষায় বোঝাতে পারব না। অনেকটাই জেলে বন্দি আসামির মুক্তো বাতাসে আশার মত। এখানে এসেই যে বিষয়টি নজর কাড়ল সেটি হল, রাস্তায় কিশোর-কিশোরীর একসাথে উচ্ছল চলাফেরা, তরুণ-তরুণীর উজ্জ্বল তারুণ্যের দাপট কফি শপে বা রেস্তরায়। যার যেমন পছন্দ তার তেমন কাপড় চোপড়। ধর্মের বা সংস্কৃতির কথা বলে কেউ তাদের তারুণ্যের উচ্ছলতায় বাধা দিয়ে বলছে না, হেই তোমার ওড়না কই, হেই তুমি নারী বেহায়ার মত অন্য পুরুষের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন? হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম, ছোটবেলা থেকে আমি একটি মেয়ে, এই কথাটি একটি মুহূর্তের জন্যে না ভোলার যে ছবক আমাকে শেখান হয়েছিল সেটি আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি কীপোশাক পরছি, কার সাথে কথা বলছি, কোথায় যাচ্ছি এই সব আর ধর্তব্যের বিষয় নয়। এখানে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে আমার যোগ্যতাকে। এখানে সবাই আমাকে দেখছে একজন ব্যক্তি হিসেবে। স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে প্রথমবারের মত উপলব্ধি করলাম, আহ! আমি তাহলে মানুষ, শুধুই মেয়ে নই! আমি বলছি না যে এদের সামাজিক সমস্যা নেই, তবে ব্যক্তি স্বতন্ত্রকে এদের সমাজ এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের সমাজে একটি মেয়ে হয়ে বড় হবার প্রথম উপলব্ধিটি ছিল- এই সমাজ আমার নয়! এটি, ছিল কখন আমার বাবার, আমার ভাইয়ের, স্কুলে ছেলে বন্ধুদের, শেষ সময় হবে আমার হবু বরের। ছোট সময় থেকেই দেখছি আমার সব কিছু কন্ট্রোল করছেন বাবা। মা ছায়ার মত, বিশাল কাঁধে ক্লান্তিহীন দায়িত্বের বোঝায়, মরু পার হওয়া উটের মত কুঁজো হয়ে আছেন। তারপরে বড় ভাইয়েরা, স্কুলে ছেলে বন্ধুরা, বড় বোনদের জীবনে রাজত্ব করছে তাদের স্বামীরা। বিভিন্ন স্তরে পুরুষের মুখের বদল হচ্ছে, অবস্থানের নয়। একজন পুরুষ আমার জীবনে রাজত্ব করছে অন্য একজন পুরুষের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে।
আমার পরিচয় আমি ভীরু, দুর্বল, ভঙ্গুর, আমি একজন অবলা নারী। এই অদ্ভুত চক্রে কিছু নারীকে আবার ব্যাবহার করা হচ্ছে পুরুষের স্বার্থরক্ষায়। যেমন শাশুড়ি, ননদ। এদের দিয়ে স্বামী নামক পুরুষটির ১০০ ভাগ আদায়, এবং তার হয়ে নজরদারটি পাকাপোক্ত করা হচ্ছে। অন্যটি হচ্ছে লক্ষ্মী মেয়ের তকমা গেলা কিছু মেয়েরা। সমাজে বিভিন্নরূপে তারাও অবাধ্য মেয়েদের পুরুষের হয়ে সাইজ করে যাচ্ছে। এরা নিজেরাও বুঝতে পারছে না যে, তারা ব্যবহৃত হচ্ছে।
ছোট একটি উদাহরণ দিই- Wasfia Nazreen -এর এভারেস্ট জয়ের পরে, ফেইসবুকে তাকে নিয়ে হৈ চৈ হচ্ছে, তার সুন্দর দেখতে একটি ছবি নিয়ে একজন লেখিকার একটি স্ট্যাটাস নজর কাড়ে। তিনি ছবিটির সাথে তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন
“এই মেয়েকে দেখলে মনে হয় রবীন্দ্রসংগীত গায়। আর সে কীনা এভারেস্টে চড়ে বসল। ধন্যি মেয়ে, দস্যি মেয়ে।”
(আমার যতটুকু মনে আছে, হুবহু না হলেও, এরকমই ছিল)
আপাতত দৃষ্টিতে এই নিরীহ স্ট্যাটাসের মধ্যে আমাদের শত শত বছরের কালচারাল মাইন্ড সেটের একটি বিষয় লেখিকার মত স্পর্শ কাতর মনকেও ফাঁকি দিয়ে গেছে। এভারেস্টের চূড়ায় যেতে একজন মানুষের কী পরিমাণ শারীরিক সুস্থতা, সহনশীলতা, শৃঙ্খলা, মানসিক শক্তি এবং ইস্পাতের মত স্নায়ুর প্রয়োজন, তা শুধুমাত্র পর্বতারোহীরাই জানেন। সাত হাজার মিটারের পরে প্রতিটি ধাপ মৃত্যুর দিকে হেঁটে যাবার সাথে তুলনা করা হয়। এর জন্যই একে বলা হয় ডেথ জোন। অথচ তাকে প্রশংসার করবার সময় সেই ক্ষমতা খোঁজা হচ্ছে না। সবচাইতে আগে উঠে আসছে সে নারী, শুধু নারী নয়, সুন্দরী নারী এবং সে স্পষ্টভাবেই দস্যি। ওই যে ছোট বেলা থেকে শেখা, চার-দেয়ালে থাকা নারী নম্র-সভ্য, ঘরের বাইরে পা দেওয়াটি দস্যি। মুসা ইব্রাহীম এর আগে যখন একই কাজ করলেন, কেউ কিন্তু খুঁজতে যায়নি সে সুপুরুষ কীনা, বা তার চরিত্রে দস্যুতার ভাব আছে কীনা। এককথায় সে পেল বীরের মর্যাদা।
নারী শুধু অবলাই নয়, সুখাদ্য মাংসও বটে। বাড়ীর চাকর থেকে শুরু করে অফিসের বসের একেই ধারনা। তাই নারীর মেধা মনন নয় বা মনুষ্যত্ব নয়, সে হয়ে উঠে শুধুই শারীরিক নারী। তার স্ফীত বুক, বিস্তৃত নিতম্ব আরাধ্য কিন্তু ভয়ংকরও বটে। এই সুখাদ্য নারী নামক মাংস পিণ্ডটি দেখলে দু-পায়ের মাঝখানের অঙ্গটিকে ধরে রাখা দায়। সংযম বড় কঠিন জিনিস। বরং একে (নারীর শরীর) আবৃত করে রাখাই সহজ। এখানে আমার বরের একটি উক্তি উল্লেখ করবার প্রয়োজন বোধ করছি।
জেনেভাতে, গ্রীষ্মের এক দুপুরে, একজন মরক্কান মুসলিম ছেলে একটি স্বল্পবসনা ইউরোপিয়ান মেয়ের দিকে আঙ্গুল তুলে আমার স্বামীকে প্রশ্ন করল-
“এদের এইভাবে দেখলে তোমাদের সমস্যা হয় না?”
আমার হাবি ফরাসি ভাষায় ছেলেটিকে যে উত্তর দিল তা বাংলা করলে দাঁড়ায় এরকম,
“আমি যখন শর্টস পড়ে আমার সুগঠিত অর্ধ-নগ্ন শরীরে ঘুরে বেড়াই, আমি তখন চিন্তা করিনা, কোন মেয়ের আমাকে দেখে আমার উপড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বার বাসনা হয় কীনা। তেমনি একজন মেয়ে যখন স্বল্পবসনায় রাস্তা দিয়ে হেটে যায় আমার ধারনা সেও মনে করে না কোন পুরুষ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমাদের সমাজ সবাইকে তার শরীর নিয়ে কি করবে সেই স্বাধীনতাটি দিয়েছে। আমরা এইভাবেই অভ্যস্ত। তুমি যেহেতু এখানে, তোমার দেশে নয়, তোমার জন্যেও মঙ্গল হবে তুমি যত তাড়াতাড়ি শিখ তোমার দুপায়ের মাঝখানের যন্ত্রটিকে কিভাবে কনট্রোলে রাখা যায়।”
প্রতিনিয়ত নারীকেও ভুলতে দেয়া যাবেনা সে প্রকৃতির তৈরি পুরুষের ভোগ্য বস্তু। তাকে কামিজের উপর একটি ওড়না নিয়ে ঘুরতে হবে, কামিজকে নিচের দিকে একটু বাড়িয়ে দিয়ে ঢাকতে হবে শরীররে লোভনীয় অঙ্গ। লজ্জাবতী ভীরু নারী, ধীরলয়ে চলা তার অলংকার। তাকে পেঁচিয়ে থাকতে হবে ১২ হাতি শাড়ীতে। চমৎকার গতিরুদ্ধের সংস্কৃতির অস্ত্র। শত শত বছরের বাঙালির সংস্কৃতির ঐতিহ্য। সেটা তো নারীকেই ধরে রাখতে হবে। পুরুষ প্রয়োজনে ধুতি/লুঙ্গি থেকে পশ্চিমা শার্ট-প্যান্টে থেকে সুট-টাইয়ে নেমেছে। গরমের প্রয়োজনে শর্টস পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফ্যাশনের তাগিদে আজকের কিশোর হিপ হপের স্টাইলে পেনটি দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। সংস্কৃতির কোন হের ফের হচ্ছে না। বাঙালির সংস্কৃতির ঐতিহ্য তখনও অটুট। এই অটুটে তখনি ভাটা পড়ে যখন একজন কিশোরী বা নারী পশ্চিমা কাপড় পড়তে যায়। নারীর সুবিশাল কাঁথে শুধুই কী ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব, তাকে রক্ষা করতে হবে পুরুষের চাপিয়ে দেয়া ধর্মটিও। পর্দানশীন হলে স্বামী খুশি, সমাজ খুশি, উপরে আল্লা খুশি। সব রক্ষা শুধু কয়েক-গজ কাপড়ের তৈরি ভয়ংকর বোরকা নামক বস্তুতে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কী চমৎকার কৌশলী সংস্কৃতির চর্চা! লজ্জাবতীর তকমা দিয়ে নারীর কণ্ঠ রুদ্ধ। ভীরু, দুর্বলের আড়ালে তার সাহসকে স্তব্ধ করবার পায়তারা। বাঙালি ললনার সুবেশের আড়ালে তার গতি রুদ্ধ। আর ধর্মীয় অনুশাসনে তাকে চার-দেয়ালে বন্দি।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন