০
৮১১ বার পঠিত
অবস্থান ধর্মঘট করতে চাই
লেখালেখি করে কোন কাজ হচ্ছেনা। তাই মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, শহীদ মিনারের সামনে ধর্মঘটে বসি একটা সাইনবোর্ড নিয়ে। তাতে লেখা থাকবে, “শিক্ষার্থী নির্যাতন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে যাবনা।”
আরেকটা সাইনবোর্ডে আমার এই দাবীগুলো লেখা থাকবে :
১। অবিলম্বে সৃজনশীল পদ্ধতি বাতিল করতে হবে। (কেননা সৃজনশীল পদ্ধতি না বোঝার কারণে এখনকার বাচ্চারা সব বিষয়ে প্রাইভেট পড়ে। ধর্ম, সমাজ, এমন কি মাতৃভাষা বাংলাও। যে ছাত্র বা ছাত্রী ক্লাসে প্রথম হয়,
সেইই সবচেয়ে বেশী প্রাইভেট পড়ে। অর্থাৎ রেজাল্টের কৃতিত্ব ছাত্রের নয়, প্রাইভেটের।
৪ এপ্রিল ২০১৭ এর দৈনিক যুগান্তরের রিপোর্টে দেখলাম, স্কুলে ও প্রাইভেটে পড়ার করণে তৃতীয় শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীকে রোজ গড়ে ১২/১৩ ঘণ্টা, এবং এসএসসি-এইচএসসি র শিক্ষার্থীকে স্কুল-কোচিং বাসা- সব মিলিয়ে গড়ে ১৪/১৫ ঘন্টা পড়তে হয় । এবার ভাবুন, এত বেশী পড়ার চাপ সহ্য করতে হলে ছেলেমেয়েদের মানসিক অবস্থা কেমন হবার কথা। এটা অমানবিক। এটা কোমলমতি শিশুদের প্রতি রীতিমত মানসিক নির্যাতন!
আরো ভয়াবহ বিষয় হলো, পড়ার এত চাপের কারণে তারা খেলার, বিনোদনের সুযোগ পায়না। ফলে তাদের শারীরিক, মানসিক, আবেগিক, নৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি সবধরণের বিকাশ বিঘ্নিত হচ্ছে। আগে বার্ষিক পরীক্ষার পর ছেলেমেয়েরা বেড়াতে যেত, গল্পের বই পড়ত, খেলত, শখ করে কোনকিছু শিখত। তাতে তাদের বিনোদন ও সবধরণের বিকাশ হত। এখন পরীক্ষা শেষ হবার পরের দিন থেকেই ছেলেমেয়েরা প্রাইভেট পড়ে। ফলে শিক্ষার্থী, অভিভাবক কেউই বেড়ানোর সময় পান না, এত বেশী পড়তে পড়তে শিক্ষার্থীরা পড়ায় কোন আনন্দ খুঁজে পায়না। পড়া এদের কাছে একঘেঁয়ে ও বিরক্তিকর মনে হয়। ফলে তারা মন থেকে কিছুই শিখছেনা। আমাদের ছেলেমেয়েদের উপর অতিরিক্ত পরীক্ষার চাপ ও বয়সের তুলনায় পাঠ্য বিষয়ের আধিক্য তাদের মেধার উপর চাপ ফেলে। এত বেশী পড়ার চাপ পড়ার প্রতি শিশুদের আগ্রহ কমাচ্ছে। এর কুফল আমরা প্রতিনিয়তই পাচ্ছি। গোল্ডেন এ প্লাসের ছড়াছড়ি। কিন্তু তারা শুদ্ধভাবে বাংলায় একটা প্যারা লিখতে পারেনা। আমরা একটা বিকলাঙ্গ প্রজন্ম তৈরী করছি। এর পরিণতি ভয়াবহ।
এখন শিক্ষার্থীরা পড়া, কোচিং, গাইড বই, ভর্তি পরীক্ষার চাপে মানবিক বোধ হারিয়ে ফেলছে। প্রতিটা পাবলিক পরীক্ষার পর অনেক শিক্ষার্থী ভাল ফলাফল করতে না পেরে আত্মহত্যা করে । প্রশ্ন ফাঁসের কারণে আমাদের শিশুরা হতাশ হচ্ছে, এদের মধ্যে দেশ, সমাজ, শিক্ষকের প্রতি অশ্রদ্ধা তৈরী হচ্ছে।)
২। শিশু শ্রেণীতে ও প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা তুলে দিতে হবে। লটারীর মাধ্যমে আসনসংখ্যা অনুযায়ী স্কুলগুলোতে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করতে হবে। (কারণ ভর্তি পরীক্ষার কারণে স্কুলে যাবার আগেই শিশুদের অনেক কিছু শিখতে হয়, যা তার স্কুলে আসার পর শেখার কথা। এতেও শিশুদের মন ও মেধার উপর জুলুম হয়।)
৩। পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিল করতে হবে।পরীক্ষা কমাতে হবে, ক্লাস পরীক্ষা কমাতে হবে। কারণ পরীক্ষার চাপ শেখার আনন্দ নষ্ট করে, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনে তীব্র চাপ সৃষ্টি করে। তাই ভাল হয়, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শুধু বার্ষিক পরীক্ষা, ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে শুধু অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষা নিতে হবে। (আমাদের সময়ে তাই ছিল। তাতে আমরা কিছু কম শিখেছি বলে মনে হয়না। ঐ পড়াতেই আমাদের শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার,… হতে কোন সমস্যা হয়নি।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে শিশুদের যাতে স্কুল ও পড়াভীতি তৈরী না হয় সেজন্য প্রথম ছয় বছর খেলাধুলা, ছবি আঁকা, গল্প করা, নাচ, গান এসব করানো হয়। পরীক্ষাভীতি শিশুদের শেখার আগ্রহ নষ্ট করে। তাই ফিনল্যান্ডে স্কুলে যাবার পর প্রথম ছয় বছর কোন পরীক্ষা হয়না। ১০ বছর পর শিশুরা প্রথম বড় ধরণের কোন পরীক্ষা দেয়। আর আমরা পাবলিক পরীক্ষা, ক্লাস পরীক্ষা বাড়াই।)
৪। অবিলম্বে অব্জেক্টিভ প্রশ্ন তুলে দিতে হবে। (অবজেক্টিভে শুধু টিক দিয়ে নম্বর পাওয়া যায়। ফলে কোনকিছু পড়ে, বুঝে নিজের মত করে লেখার ও বলার ক্ষমতা শিশুদের দিন দিন কমছে। ফলে তারা কোনকিছুই ভালভাবে শিখছে না। যাও বা শিখছে, তা তারা দ্রুত ভুলে যাচ্ছে।
এবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজী বিভাগে
অব্জেক্টিভ পরীক্ষায় কোয়ালিফাই করা ৮০০ জন ছাত্রছাত্রীর লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়। তাতে পাস করে মোটে ৪২ জন!!!! যতদিন লিখিত পদ্ধতি ছিল, ততদিন ছেলেমেয়েরা অনেক ভাল শিখতো। আমরা যতদিন লিখিত পরীক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি করেছি, ততদিন ভাল ছাত্র পেয়েছি। আমি ভাত খাই এর ইংরেজী, “আই রাইস ইট” বলা ছাত্রকে এবারও ভর্তি করা হয়েছে রাবিতে। এ দুঃখ রাখি কই? এখনকার শিক্ষার্থীরা পর পর তিনটা ইংরেজী বাক্য শুদ্ধ করে লিখতে বা বলতে জানেনা। কি করুণ অবস্থা!!!)
৫। বিষয় সংখ্যা ও প্রতিটা বিষয়ের কন্টেন্ট কমাতে হবে। (আমরা এসএসসিতে পড়েছি ১০ টা বিষয়। এরমধ্যে কন্টেন্টও কম ছিল বলে আমরা সবটাই শিখতে পারতাম। এখন এসএসসিতে ১৪ টা বিষয় এবং প্রতিটা ক্লাসের প্রতিটা বইতে কন্টেন্ট অনেক বেশী বাড়ানো হয়েছে যেগুলো শিখতে গিয়ে শিশুদের মেধার উপর চাপ পড়ছে, তাদের ভয়াবহ কষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে পারেনা। অতিরিক্ত বিষয় পড়া, বয়সের তুলনায় অনেক বেশী কন্টেন্ট আত্মস্থ করা ও পরীক্ষার চাপে শিশুরা বইয়ের সব কন্টেন্ট আত্মস্থ করতে না পারার কারণে ভাল করে কিছুই শেখেনা।)
৬। শিক্ষার্থীদের সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে। (এখন উত্তর সঠিক না লিখলেও শিক্ষকদের নির্দেশনা দেয়া হয়, নম্বর বেশী দেবার জন্য যাতে পাসের হার ও জিপিএ বাড়ে। এ এক অদ্ভুত সিস্টেম! এসব ফাজলামো বন্ধ করতে হবে।)
৭। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর মত বিভিন্ন ক্লাসে শিশুদের ফলাফলের ভিত্তিতে ক্রমান্বয়ে উপরের ক্লাসে, এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ভর্তির সুযোগ তৈরী করতে হবে।
৮। ভর্তি কোচিং, গাইড বই – এসব তুলে দিতে হবে।
৭। শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। (প্রাইভেট পড়তে গিয়ে ছেলেমেয়েদের সময় কমে যাচ্ছে। যে পড়া ক্লাসেই পড়ানোর কথা, তা না পড়িয়ে শিক্ষক টাকা নিয়ে পড়াচ্ছেন, প্রশ্ন ফাঁস করে দিচ্ছেন। এভাবে শিক্ষকরা অনৈতিক কাজ করছেন। এতে আমাদের শিক্ষার্থীরা অন্যায় হজম করতে শিখছে, তাদের নৈতিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, শিক্ষকদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা, ভালবাসা কমছে। প্রশ্ন ফাঁস, বৃত্তি প্রদানে অনিয়ম, নকল, .. এসব রোধ করা যাচ্ছেনা বলে দেশের প্রতি তাদের ভালবাসা কমছে। অভিভাবকরা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন জোগাড় করে ছেলেমেয়েদের দিচ্ছেন। এতে উভয়ে অন্যায় করছে।)
সামগ্রিকভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যে ধ্বস নেমেছে সেটা রদ করতে হলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রায়ই শুনি, প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা, কোচিং, প্রাইভেট, গাইড বই- এসব তুলে দেয়া হবে। এসবের কার্যকর কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনা।
তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করছি, আগামী পয়লা জানুয়ারীর আগেই উপরের যৌক্তিক দাবীগুলো কার্যকর করে এদেশের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সকল আপামর জনসাধারণকে “শিক্ষামূলক নির্যাতন” থেকে মুক্তি দিন। বিজয়ের মাসে আমাদের শিক্ষার্থীরা আর একবার “মুক্তি” পাক। দেশ ও জাতি আজীবন শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় আপনাদের মনে রাখবে।
শুভ বিজয়!!!!!!!
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন