আমি যতোবার অভিজিতের লাল পাঞ্জাবি পরা রক্তাক্ত দেহ দেখি, ততোবার নিজের ছবি দেখি। আমি যতোবার বন্যার রক্তাক্ত, ভয়ার্ত চোখ দেখি ততোবার তৃষ্ণার মুখ দেখতে পাই। আমি ঘুমুতে পারি না, চোখ বন্ধ করতে পারি না। গ্রন্থ প্রকাশের কী বিশাল আনন্দ নিয়ে যে যুগল জন্মভূমিতে গেল তাদের জীবন এক নিমেষে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। না কোন দূর্ঘটনায় নয়, কোন রোগে নয়, বরং মানুষ নামের কিছু পশুর হাতে অভিজিতের জীবন প্রদীপ নিভে গেল; বন্যা আর অভিজিতের সুখের সংসার লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল।
সেবছর ফেব্রুয়ারির শেষ এক সপ্তাহ ফোন-কম্পিউটার-ইন্টারনেট থেকে দূরে ছিলাম। গিয়েছিলাম বাহামা দীপপুঞ্জে, ছিলাম আনন্দে, সমুদ্রের বিশালতার কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে জীবনকে উপলদ্ধি করতে। ভাবছিলাম ফিরেই সেই আনন্দের ভাগ নেবো। আমারও বইমেলায় যাবার কথা ঠিক অভিজিত যে সময়ে গেছেন তখন। শেষ মূহুর্তে প্রকাশক বললেন, আপনার পাণ্ডুলিপি দেরিতে পেয়েছি এদিকে প্রেসের কর্মঘণ্টা কম তাই দেরি হচ্ছে। ইউনিভার্সিটি থেকে ছুটি নেয়া ছিল সেই ছুটি হারাতে চাই নি তাই বাংলাদেশে না গিয়ে গেলাম বাহামায়। কিন্তু অভিজিৎ বাবার নিষেধ সত্ত্বেও বইমেলার টানে ঢাকায় গিয়েছিলেন। কেউ কী জানতো তার জন্যে অপেক্ষা করছে এমন নিষ্ঠুরতা যা তাঁর জীবন কেড়ে নেবে?
শনিবার সকালে বন্দরে নোঙ্গর করলো জাহাজ আর আমি মুঠোফোন চালু করতেই অজস্র নোটিফিকেশন, তার মধ্যে একটি ঠাস করে চোখে পড়ে- ‘সেজান দেশে আসবেন না, অভিজিৎ’কে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে।’ আমি খবর দেখি, চিৎকার করে তৃষ্ণাকে ডাকি। ও সব শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। আর আমি ডুকরে কেঁদে উঠি। ছোট ছেলে বলে “বাবা কেন কাঁদে?” তৃষ্ণা ওকে বুঝানোর চেষ্টা করে, বলে একজন লেখক, আমাদের বন্ধুকে মেরে ফেলেছে। ও বাংলায় লিখতো, ধর্ম নিয়ে, বিজ্ঞান নিয়ে যা বাংলাদেশের অনেকে পছন্দ করতো না’। ছোট ছেলে বলে, “দেন হোয়াই ডিড হি রাইট ফর দোজ স্টুপিড পিউপল?” ছোট্ট মানুষের কী ছোট্ট কিন্তু বিশাল প্রশ্ন!
কেনো লিখতো অভিজিৎ, আমরা কেন লিখি? কেন মুক্তমনা হবার জন্যে এই লেখা জরুরী? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্য দিয়েই অভিজিতের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। সাপ্তাহিক ‘যায় যায় দিন’-এ কলাম লিখেছিলাম ‘সহনশীলতা বনাম আত্নঘাতী উগ্রতা‘ শিরোনামে, লেখাটি নবযুগ ব্লগে পূন:প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে এই উগ্রতার পরিনাম কী, সহনশীলতা কেন জরুরী তা নিয়ে লিখেছিলাম। সেটা পড়ে অভিজিৎ ই-মেইল করেছিলেন ভালোলাগা জানিয়ে। আরও জানাতে যে তিনি ‘মুক্তমনা’ নামের ওয়েবসাইট শুরু করেছেন যেখানে একটা পাতায় আমার সব কলাম আপলোড করেছেন। সেখানে যেনো লিখি। তারপর আরও জানা, আরও কথা। অভিজিতের স্ত্রী বন্যা আবার তৃষ্ণার ছোটবেলার বান্ধবী, সেই ভিকারুননেসা নুন স্কুল থেকে, তা বের হয়ে গেল। ওদের মধ্যে আরও কথা হয়। ওরা থাকে আটলান্টায়, আমাদের থেকে মাত্র চার ঘণ্টা দূরে। ওহ!
কী লিখতে চাইছি আর এইসব কথা মনে পড়ে যাচ্ছে! অভিজিৎ কলমযোদ্ধা ছিলেন, সহযোদ্ধাও। ‘সহনশীলতা বনাম আত্নঘাতী উগ্রতা’ কলামে লিখেছিলাম যখন ফরাসি রসায়নবিদ ল্যাভয়শিয়ে’কে গিলোটিনে হত্যা করা হয়, সেই হত্যা যেই করুক, তা ফরাসি বিপ্লবী, কিম্বা বিপ্লবীদের দিয়ে গীর্জার ধর্ম-পণ্ডিতদের পরোক্ষ নির্দেশ এবং যোগসাজশে, কিম্বা মতান্বরে আরেকজন বিজ্ঞানীর যড়যন্ত্রে, তখন আরেক পণ্ডিত জোসেফ লুই ল্যাগ্রাঞ্জে বলেছিলেন,
‘এই মাথাটি কাটতে ওদের মাত্র এক পলক লেগেছে, অথচ হয়তো একশ বছরেও এমন একটি মাথার জন্ম হবে না’।
হ্যাঁ, মাত্র দু’মিনিটে অভিজিৎকে কাপুরুষের মতো পেছন থেকে কুপিয়ে মেরেছে নরপিশাচেরা অথচ আরেকজন অভিজিৎ তৈরি হতে হয়তো আগামি এক যুগ পার হয়ে যাবে। অভিজিৎ মেধাবী ছিলেন, বুয়েটে পড়া ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। কিন্তু তা তো অনেকেই আছেন। মেধাবী হওয়া আর সেইসঙ্গে মুক্তচিন্তার অধিকারী হওয়া তো এক কথা না। আবার মুক্তচিন্তার অধিকারী হওয়া আর তা প্রকাশ করার সৎসাহস থাকা এক কথা না। অভিজিৎ ধীরে ধীরে নিজেকে একটি মুক্তচিন্তার প্রতিষ্ঠানের মতো বানিয়ে ফেলছিলেন। আর তা সহ্য করতে পারছিল না এইসব মধ্যযুগীয় বর্বরেরা।
মানুষের অগ্রগামী চিন্তার সঙ্গে পশ্চাৎপদ চিন্তার সংঘাত তো নতুন নয়। হাজার হাজার বছর আগে সক্রেটিসকে হত্যা করা হয়েছিল, গ্যালিলিও এবং কোপার্নিকাসকেও হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল, ইবনে সিনাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল নিজ ভূমি থেকে। কিন্তু লক্ষ্য করুন সেই হাজার হাজার বছর আগেও অন্তত প্রহসনের বিচার করে তারপরে হত্যা করেছিল বা শাস্তি দিয়েছিল। কিন্তু অভিজিৎকে মারা হলো কাপুরুষের মতো অন্ধকারে, পেছন থেকে। আমরা কী মধ্যযুগের আগেরও আগের চেয়ে অধঃপতনে যাচ্ছি না?
অভিজিৎ আর বন্যার একটি পারিবারিক ছবি আমার খুব প্রিয়। আভিজিৎ ছিলেন একজন ভালবাসাময়, স্বপ্নময় পারিবারিক মানুষ। সেই নিউইয়র্ক বইমেলায় যখন প্রথমবার দেখা হয়েছিল আমার কাছে এগিয়ে এসে হাত ধরে বলেছিলেন ‘সেজান ভাই, আমি অভিজিৎ’। আর আমি ভেবেছিলাম হয়তো নিউইয়র্কে বাস করা কোন প্রবাসী কেউ। ভিড়ের মধ্যে ভাবতেও পারি নি যে এই সেই ‘মুক্তমনা’র অভিজিৎ যার সঙ্গে কতো কথা, কতো ই-মেইল লেখা হয়েছে। তাই শুধু বলেছিলাম ‘তাই, কেমন আছেন?’ এই নিয়ে কী ছেলেমানুষী অভিমান ছিল- ‘আপনি বিখ্যাত মানুষ, আমাকে চিনবেন কী করে?’ আমি লজ্জিত হয়েছিলাম। সেবার সেখানে ছিলেন সংগীত শিল্পী কানাডা প্রবাসী মণীকা রশীদ। তার কাছে থেকে শুনে নিজের লজ্জা কাটাতে ফোন করি, ক্ষমা চাই। শেষমেষ রফা হলো যে আমরা ড্রাইভ করে আটলান্টায় বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দিয়ে প্রায়ঃশ্চিত্ত করবো এই ভুলের। আমাদের সেই আড্ডা আর হবে না! অভিজিৎ আর বন্যার মেয়ে ‘তৃষা’ আমার ছেলের মতোই কী প্রশ্ন করবে ‘দেন হোয়াই ডিড হি রাইট ফর দোজ স্টুডিপ পিউপল?‘ আমি আমার ছেলেকে বুঝিয়ে বলি, বাংলাদেশের সবাই তো আর ওইরকম না। দেখো কতো মানুষ প্রতিবাদ করছে, মিছিল করছে, ভালবাসা জানাচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষই তো সত্যকে জানতে চায়। তারপরও লজ্জিত হই, শুধু লেখার জন্যে একজনকে প্রাণ দিতে হলো? এই লজ্জা, কষ্ট কোথায় রাখি? ‘তৃষা’ কী আমাদের ক্ষমা করবে কোনদিন?
জাহাজ থেকে নেমে তিন ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে বাসায় এসেছি কীভাবে বলতে পারবো না। চোখ ভিজে ঝাঁপসা হতে হতে ভুল পথে চলে যাবার মতো হয়েছে। কী লিখছি তাও মনে মনে গোছাতে পারছি না। কেন মরতে হবে একজন মানুষকে শুধু লেখার জন্যে, চিন্তার ভিন্নতার জন্যে? তার ওপরে ফেসবুকে মানুষের কী নির্মম, ভয়ঙ্কর রূপ প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। যারা এই হত্যাকে কোন রকমের ‘কিন্তু’ ‘আসলে’, ‘হয়তো’ এইসব শব্দরাজি দিয়ে প্রচ্ছন্ন সায় দিচ্ছেন, যৌক্তিকতা দিচ্ছেন তাদের জন্যে আরও করুণা হচ্ছে। কেউ কেউ তাঁকে হিন্দু বানানোর অপচেষ্টায় নিয়োজিত।
যারা এই ধর্মান্ধতার মধ্যে তারা কী কখনো অভিজিতের কোন বই পড়েছেন? পড়েছেন কিন্তু হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন? কোথাও অভিজিতের বইতে কী কোন গালি বা অপমানজনক কোন কথা ছিল? ছিল না। অভিজিৎ কোন একটি ধর্মকে আক্রমণ করেন নি। করেছেন একটি বিশ্বাসকে, ঈশ্বরের বিশ্বাসকে। আর তার বিপক্ষে বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা দেবার চেষ্টা করেছেন। আমি দাবি করতে পারি পৃথিবীতে জানা মতে যতো আলোচনা, সমালোচনা হয়েছিল ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে তা পড়েছি। বিজ্ঞানী এবং ধর্মীয় পণ্ডিতদের যতো তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল তা-ও পড়েছি। ধার্মিকেরা পৃথিবীর কোথাও যেমন কোন প্রমাণ দিতে পারে নাই, পারে না যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে, তেমনি বিজ্ঞানীরাও পারে না একশ ভাগ নিশ্চিত করে বলতে যে ঈশ্বর নেই। বরং বিজ্ঞানীদের যুক্তির পেছনে আছে প্রমাণ আর ধার্মিকদের দাবীর পেছনে শুধুই বিশ্বাস। তাই যেখানে দু’পক্ষেরই পঞ্চাশ ভাগ ঠিক হবার সম্ভাবনা সেখানে শুধু বিশ্বাসের জোরে একজন আরেকজনকে খুন করতে হুমকি দিবে কেন? খুন করবেই বা কেন? এই অধিকার তো স্বয়ং ঈশ্বরও কাউকে দেন নি।
যারা দূর পরবাসে থেকে বাংলায় সাহিত্যচর্চা করেন, লেখালেখি করেন তারা একদিক থেকে দূর্ভাগা। তাদের দেহ থাকে এক দেশে আর মন পরে থাকে আরেক দেশে। তারা না ঘরকা না ঘাটকা। তবু জন্মস্থানের প্রতি প্রগাঢ় মমতায় সেই ভূখণ্ডের মানুষের জন্যে লেখেন, জ্ঞানচর্চা করেন কেউ কেউ। আর তা করতে গিয়ে কত না আত্মত্যাগ, বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বাংলায় একটি বই লিখতে যে সময় যায় সেই সময়ে আমেরিকায় বসে কুড়ি থেকে তিরিশ হাজার ডলার আয় করা যায়, আমার মতো কেউ তা করতে পারেন। কিন্তু টাকার জন্যেও তো সেই বইগুলো লেখা হয় না। লেখা হয় ভাষার জন্যে, ভাষাভাষি মানুষের জন্যে। আর নিজের অস্তিত্বকে সেই ভাষার মানুষের মধ্যে অনুভব করতে, আবিস্কার করতে।
এই যে বিশ্বময় রাজনৈতিক অস্থিরতা, অস্তিত্বের সংকট তা নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম, ‘হারাম ও অন্যান্য গল্প‘ গ্রন্থে তা ছাপা হয়েছিল ২০০৯ সালে। গল্পের নাম ‘আমি আছি আমি নেই‘। মুক্তচিন্তার জন্যে, মুক্তবুদ্ধির চর্চার জন্যে যে আমি জন্মভূমিতে ধর্মাদ্ধদের শক্র, সেই আমি জন্মসূত্রে একটি মুসলমান নামের অধিকারী এ জন্যে অন্যদেশে হয়ে উঠি ‘টেরোরিস্ট‘। এই যে অস্তিত্বের সংকট তা যেন একবার বলে আমি আছি, একবার বলে আমি নেই। এই ছিল গল্প। এই সংকটের চূড়ান্তরূপ যেন অভিজিৎ তাঁর জীবন দিয়ে তৈরি করে গেলেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় দুঃখ যে অন্যদেশে বা প্রবাসে যেখানে জীবনের শঙ্কা বেশি হবার কথা সেখানে নয়, তাঁর জীবন নষ্ট হলো নিজ জন্মভূমিতে, যেখানে নিজভাষায় লেখার জন্যে এতো পরিশ্রম আর ত্যাগ করতে হয়েছিল তাঁকে।
নষ্ট হলো কেন বলছি, অভিজিৎ এর অনেক সম্ভাবনা ছিল বাংলাদেশকে অনেক কিছু দেবার। আজ যারা মনে করছেন আমরা মডারেট মুসলমান, আমরা তো আর নাস্তিক না, আমরা নিরাপদে আছি এবং নিরাপত্তার ওম নিয়ে আরাম পাচ্ছেন, মনে রাখবেন এইসব ধর্মান্ধরা আপনাদেরও ছাড়বে না। আজকে নাস্তিকতার জন্যে কাউকে হত্যা করছে, কালকে বোরকা না পরার জন্যে কাউকে মারবে, পরশু পাশ্চাত্যের শিক্ষা নেয়ার জন্যে কাউকে মারবে, তারপর গান গাওয়ার জন্যে মারবে, এভাবে ওরা পিছনেই নিতে চায়। নিজেদের স্বার্থেই এদেরকে প্রতিহত করুন। হুমায়ূন আজাদ, রাজীব আর অভিজিৎদের জীবনের ত্যাগ থেকে এটুকু শিক্ষা না নিতে পারলে সবটুকুই বৃথা হয়ে যাবে। আমরা কিন্তু শুধু স্বাধীনতা অর্জন করিনি, আমরা মুক্তি লাভ করেছিলাম। ‘মুক্তি‘ শব্দটার অর্থ অনেক গভীর, এই মুক্তি যেমন অর্থনৈতিক, তেমনি মানসিক মুক্তি – সমস্ত বদ্ধতা, অজ্ঞানতা, অন্ধকার থেকে মুক্তি। এই মুক্তির জন্যে মরণকেও ভয় পাওয়া উচিত না, যেমন পায় নি মুক্তিযোদ্ধারা!
আজকে আমি চোখ বুঁজে শুধু ক্ষমা চাই অভিজিৎ-বন্যার কন্যা তৃষা’র কাছে। আমাদের তুচ্ছতাকে, দীনতাকে ক্ষমা করো মা। আমরা তোমার বাবার হত্যাকারী। কিন্তু একদিন দেখো একটা একটা জীবন-ইটের আস্তরণে নির্মিত হবে এক অনিবার্য অট্টালিকা যার নাম হবে ‘প্রগতির বাংলাদেশ, মুক্তমনের বাংলাদেশ’। আর সেই অট্টালিকার একটি ইটের পাঁজরে লেখা থাকবে তোমার বাবার নাম-অভিজিৎ রায়! আজকে অভিজিৎ’এর জন্মদিনে এটুকুই বলতে চাই – অভিজিতের মৃত্যু নেই, মুক্ত জ্ঞানেরও মৃত্যু নেই!
– সেজান মাহমুদ
ফ্লোরিডা, আমেরিকা