০
১৪৩০ বার পঠিত
বিজ্ঞান মানুষের মনকে করেছে বিস্তারিত। মগজকে করছে শানিত। চেতনাকে করেছে প্রসারিত। অজ্ঞানতার অন্ধকারে জ্বেলেছে মঙ্গল আলো। তাই বিজ্ঞানী হয়েছে মানবজাতির সভ্যতার, মানবতার দিশারী।
ধর্ম মানুষকে করেছে অবচেতন। মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে করেছে রুদ্ধ। মানুষের মনকে করে রেখেছে অবরুদ্ধ। অদৃশ্য অসত্যকে প্রচারের মাধ্যমে মানবজাতিকে করে রেখেছে প্রগতি ও সভ্যতার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। মানুষের জ্ঞানের উন্মেষকাল থেকেই তাই মূঢ় মানব বিজ্ঞানকে আঘাত করে আসছে অন্ধের মতো। বিজ্ঞানীকে পুড়িয়ে মেরেছে, পাথরচাপা দিয়ে এসেছে, হেমলক বিষ পান করিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে এসেছে প্রাচীনকাল থেকেই।
আজ থেকে আড়াই বছর আগে ২০১৫ সালে বাংলাদেশে একুশের বইমেলায় সেই একই ধারার মৃত্যু কাফেলায় নিক্ষিপ্ত হয়েছেন আধুনিক কালের প্রিয় লেখক ব্লগার ড. অভিজিৎ রায়।
বিদেশে উচ্চতর লেখাপড়া করে বাংলাদেশের কৃতি বিজ্ঞান লেখক ড. অভিজিৎ রায় হয়ে উঠছিলেন বিশ্বের একজন আলোচিত ব্যক্তিত্ব। ২০০১ সালে শুরু করেছিলেন ‘মুক্তমনা’ ব্লগ। মুক্ত মনে কী বলতে চেয়েছিলেন তিনি?
তাঁর ‘অবিশ্বাসের দর্শন’, ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ ইত্যাদি গ্রন্থগুলো পড়লেই বুঝা যায় তাঁর জ্ঞানের পরিধি।
এ জ্ঞান সত্যকে উপলব্ধি করার, মানুষের মানবিক শক্তির বিকাশকে উপলব্ধি করার, জলকে জল আর দুধকে দুধ হিসেবেই চেনার জ্ঞান। দুধ আর জলের মিশ্রণে তৈরি মিকচার কিংবা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর জ্ঞান নয়।
২০১৫ সালে আমিও লন্ডন থেকে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম বইমেলাকে সামনে রেখে। প্রায় প্রতিবছরই দেশে যাই কবিতা উৎসব এবং বাংলা একাডেমির বইমেলায় যোগ দিতে। সেবছর ১ ফেব্রুয়ারি টিএসসির সামনে কবিতা উৎসবের মঞ্চে আমার কবিতাও পড়েছিলাম।
অভিজিতের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলনা। পরিচয় ছিল তাঁর লেখার সাথে। নইলে হয়ত আমিও থাকতাম সেদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর পাশে। হয়তো প্রত্যক্ষ করতে হতো সেই লোমহর্ষক অমানবিক বিভৎস দৃশ্য।
সেই পথ দিয়েই তার কিছু পূর্বে বেরিয়ে গিয়েছিলাম মেলা থেকে, যে পথে জিহাদি ঘাতক হত্যা করেছিল অভিজিৎকে। এটা ঘটনার পরে জেনেছিলাম! আহত হয়েছিল তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী স্বনামধন্য লেখক ও ব্লগার রাফিদা আহমেদ বন্যা!
কী ছিল তার অপরাধ?
মুক্তমনের লেখালেখি! অন্ধ বিশ্বাসের আগুনে নিষ্পেষিত মানবতার প্রতি মমত্ববোধের লেখালেখি! সেই প্রাচীনকালের জ্ঞানি গুনীদের মতোই সত্য প্রচারের লেখালেখি! এই একমাত্র গ্রহে মানুষের আবির্ভাব, জন্তু জানোয়ারের আবির্ভাব, কীট পতঙ্গের আবির্ভাব, জলবায়ুর আবির্ভাব, এমনকী মহাবিশ্বের আবির্ভাব ইত্যাদি নিয়ে লেখা তাঁর গ্রন্থগুলোই তার অপরাধ!
ঘাতক জিহাদি মৌলবাদি আক্রমণকারীরা তাঁকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। বন্যাকেও কুপিয়েছিল, তাঁর হাতের তর্জনি কেটে ফেলেছিলো, মাথায় কুপিয়েছিল। ভাগ্যিস ততোক্ষণে ঘাতকরা দৌড়ে চলে গিয়েছিল, নইলে বন্যাও আজ আমাদের মাঝে জীবিত থাকতেন না!
প্রাচীনকালে ‘অবিশ্বাস’ এর অধিকার ছিল না মানুষের। মানবজাতির সভ্যতার সেই অন্ধকার সময়ে ঈশ্বর-বিশ্বাস ছিল অবশ্য করণীয় (এখনো তাই)! সমাজপতিরা তাদের শাসন পোক্ত রাখার জন্যই ঈশ্বর উপাসনাকে নানাবিধরূপে মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে প্রতিষ্ঠিত করতো! ঈশ্বরে বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাসকে চর্চায় রাখার জন্য উপাসনা ধর্ম প্রচার, নানা ধরনের উপাসনালয় স্থাপন ইত্যাদি তাই সমাজ ব্যবস্থার অঙ্গ হয়ে উঠলো। সেই ধারাবাহিকতায় গোষ্ঠী, গোত্র, ক্লোন, সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল ধর্ম। গড়ে উঠল ধর্ম সংস্কার। কিন্তু যেহেতু এর উৎসই হল মিথ্যা থেকে, সন্দেহ থেকে, সংশয় থেকে এবং এর বিস্তার হল ক্ষমতাকে জিইয়ে রাখার জন্য, সেহেতু সংস্কারের প্রায় সবটাই রূপান্তরিত হয়ে আসলো কুসংস্কারে। সুতরাং বিশ্বাসের ভীত প্রতিষ্ঠিত হল একটা মিথ্যা দর্শনের ওপর। সেই অর্থে বিশ্বাসের কোন বাস্তবতা নেই!
প্রকৃতির বৈচিত্র্য এবং ক্রিয়াকাণ্ড দর্শনে অনুমান, সংশয় ইত্যাদি থেকে মানুষের মন ও মগজে যেসব সিদ্ধান্ত এসেছিল সেকালে, সেগুলোই বিশ্বাস। আর কালের স্রোতে অবধারিত পরিবর্তনে মানুষের চৈতন্যে প্রকৃতির যে সত্য বিজ্ঞানাকারে আরোপিত হল সেটাই হল অবিশ্বাস। এই অবিশ্বাস যে ধারণ করে সে হয় বিশ্বাসীদের কাছে নাস্তিক। ঈশ্বরে অবিশ্বাস তাই মানবজাতির মেধা ও মননে এক বিপ্লব। উপাসনা-দর্শন মানুষকে ঠেলে দিয়েছিল অন্ধকারে আর বিজ্ঞান-চেতনা মানবজাতিকে উদ্ধার করেছিল সেই অন্ধকার থেকে। অভিজিৎ-অনন্ত-রাজিবরা এই সত্যগুলোই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তাঁদের লেখায়।
অভিজিতের লেখা ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ গ্রন্থের কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করছি-
“প্রকৃতি এক সময় মানুষের কাছে ছিলো অজ্ঞাত। তাই প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার কাছে মানুষ ছিল চরম অসহায়। মানুষ ভাবতো এসব ঈশ্বরের, দেবতাদের ইচ্ছার প্রতিফলন।”
“…কিন্তু এখন দিন পাল্টেছে- প্রান্তিক এই সমস্যাগুলোর অনেকগুলোরই নিখুঁত সমাধান হাজির করতে পারে বিজ্ঞান। গতানুগতিক দর্শন নয় বরং বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের দার্শনিকরাই আজ গহীন আঁধারের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। আজকের দিনে কয়েকজন বিখ্যাত দার্শনিকের নাম বলতে বললে হকিং, ওয়াইনবার্গ, ভিক্টর স্টেংগর, ডকিন্স-এদের কথা সবার আগেই চলে আসে। এরা কেউ প্রথাগত দার্শনিক নন, কিন্তু তবুও দর্শনগত বিষয়ে তাঁদের অভিমত যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।”
“সবসময়ই দর্শন আমাদের জ্ঞান চর্চার মধ্যমণি। কিন্তু প্রথাগত দর্শনের স্বর্ণযুগে প্রকৃতিবিজ্ঞান ছিল তার সহচরী। এখন দিন বদলেছে-বিশ্বতত্ব, জ্ঞানতত্ব এমনকি অধিবিদ্যার জগতেও প্রকৃতিবিজ্ঞান বিশেষ করে পদার্থবিদ্যা শুধু প্রবেশ করেনি, প্রথাগত দর্শনকে প্রায় স্থানচ্যুত করে দিয়েছে।…”
“আমরা জানি, মহাবিশ্বের উৎপত্তি আর পরিণতি নিয়ে একজন প্রথাগত দার্শনিক কিংবা বেদ জানা পন্ডিত কিংবা কোরান জানা মৌলভির চেয়ে অনেক শুদ্ধভাবে বক্তব্য রাখতে সক্ষম হবেন একজন হকিং কিংবা ওয়াইনবার্গ।”
বর্তমান প্রজন্মের তারুণ্যকে ছুয়েছে অভিজিৎরা। টনক নড়ে উঠেছে মৌলবাদের। তারা প্রমাদ গুনতে শুরু করলো! তাদের ক্যাডাররা খুঁজাখুঁজি শুরু করে দিল অভিজিৎদের। রক্ত পিপাসু মৌলবাদী জিহাদি গোষ্ঠী তাদের ক্যাডার নিযুক্ত করে দিল অভিজিৎদের গলা কাটার কাজে। বুঝিয়ে দিল যে বেদ্বীনকে হত্যা করলেই বেহেশতের নসিব! ইসলামে সেই পুরষ্কার ঘোষিত!
ড. অভিজিৎ এবং রাফিদা আহমেদ সুদুর আমেরিকা থেকে এসেছিলেন একুশের বইমেলা দর্শনে। কিন্তু মিথ্যা ঈশ্বর-দর্শনের হায়েনাদের চাপাতির কোপে লুটিয়ে পড়লেন বইমেলার জনারণ্যে! আহত হয়েও বেঁচে গেলেন প্রিয় পত্নি বন্যা। হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস নিলেন অভিজিৎ। আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়লেন বাঙালি সব ব্লগাররা। কিন্তু তাই বলে থেমে যাবেনা বিজ্ঞান, থেমে যাবেনা মুক্তমনাদের মানবতার চাষ। থেমে যাবেনা মানব প্রগতির ধারা। বরং অভিজিতের স্মৃতি নিয়ে আরো দ্বিগুণ জ্বলে উঠবেই মৌলবাদ বিরোধী তারুণ্যের মশাল।
১২ই সেপ্টেম্বর অভিজিৎ রায়ের জন্মদিনে তাই তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার এই নৈবেদ্য। তাঁর ফেলে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে সম্পন্ন হোক এই প্রজন্মের মুক্তমনা তরুণ লেখক ব্লগারদের দ্বারা, এটাই আমার কাম্য।
– গোলাম কবির
লন্ডন, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন