০
১৫৯৫ বার পঠিত
মানুষের ইতিহাস অভিবাসনের ইতিহাস। প্রকৃতিতে মানুষ ছাড়া অন্যান্য পশুপাখীরাও স্থান পরিবর্তন করে, প্রয়োজনে নতুন আবাসস্থলে বসতি স্থাপন করে।
যাযাবর জীবনে শিকারী মানুষ কয়েক লক্ষ বছর যাবত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে। খাবার যেখানে পেত সেখানে আবাস গড়ত আবার খাবার কমে আসলে পাততাড়ি গুটিয়ে খাবারের সন্ধানে নতুন এলাকায় যেত। আজকে মানুষের যেই ধারাটি টিকে আছে সেটা আফ্রিকা থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়েছে।
কৃষিভিত্তিক সমাজেও মানুষ অভিবাসী হয়েছে। খরা, দূর্ভিক্ষ ছাড়াও রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে যুগে যুগে মানুষ অভিবাসী হয়েছে। দেশে দেশে প্লেগ, ওলাওঠার কারণে মানুষ এক এলাকা ছেড়ে আরেক এলাকায় গিয়ে বসতি গেড়েছে। ইতিহাসে কত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, আবার মিলিয়েও গেছে, সেগুলো স্থায়ী হয়নি, মানুষ সেসব জায়গা থেকে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়েছে। এখন সেগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
আজ থেকে প্রায় ১০-১২ হাজার বছর আগে মানুষ অস্ট্রেলিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাতে এসে বসতি স্থাপন করে।
অভিবাসনের কারণে মানুষকে অনেক কিছু পেছনে ফেলে আসতে হয়, চলার পথেও তার জীবন থেকে অনেককিছু ঝরে পড়ে যায়। নতুন কিছু পেতে পুরাতন অনেক কিছু চাইলেও ধরে রাখা যায় না। পলিনেশিয়ান ভাষাগোষ্ঠির (কোকোনাট ল্যাঙ্গুয়েজ) মানুষগুলো পানিতে ভেসে পুরো প্রশান্ত মহাসাগরে ছড়ায়। মজার ব্যাপার হলো মূল ভূখন্ড থেকে তারা যতদূরে গিয়েছে ততো তাদের ব্যঞ্জন বর্ণের সংখ্যা কমেছে। মনে হচ্ছে যেন তাদের নৌকা বেশি ব্যঞ্জন বর্ণের ভার বহন করতে পারেনি। যার কারণে পলিনেশিয়ান ভাষাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দূরের হাওয়াইয়ান ভাষায় সবচেয়ে কম ব্যঞ্জন বর্ণ আছে।
মূসা নবী প্রমিজড ল্যান্ডের খোঁজ করতে ওনার জাতিকে নিয়ে অভিবাসী হয়েছিলেন। আজও ইহুদী ধর্মের মানুষেরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হয়ে আছে। নবী মোহাম্মদকেও তাঁর নিজের এলাকা ছেড়ে হিজরত করে ইয়াতরিব নগরে চলে যেতে হয়। আধুনিক যুগে মরমন ধর্মের নবী জোসেফ স্মিথকে তার অনুসারীদের নিয়ে আমেরিকার পূর্ব উপকূল, নিউ ইংল্যান্ড এলাকা থেকে পালিয়ে ইউটাহর মরুভূমিতে বসতি স্থাপন করতে হয়।
ইওরোপ আমেরিকাতে রোমা জনগোষ্ঠি নামে কিছু মানুষ আছে যারা বিভিন্ন শহরে যাযাবরের জীবন যাপন করে। আজ থেকে ১৫০০ বছর আগে এরা ভারতবর্ষ থেকে অভিবাসী হয়ে বেরিয়ে পড়ে।
অভিবাসন কাছাকাছি অঞ্চলে হলেও সেটার পীড়া, মর্মযন্ত্রণা কোন অংশে কম নয়। অভ্যন্তরীন অভিবাসন হলে যে দুঃখ কম হবে সেটা বলা যাবে না। বাংলাদেশে যারা নদীর ভাঙন, সমুদ্রের জলোচ্ছাস থেকে বাঁচতে দেশের অভ্যন্তরে নানা জায়গায় অভিবাসী হয়েছেন তারাও কম গঞ্জনার শিকার হন না।
গত দুই-তিনশ বছর ইওরোপ সারা দুনিয়ায় উপনিবেশ বানিয়ে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকাতে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে।আইরিশ মনোকালচারের কারণে ব্যাপকহারে মানুষ আমেরিকাতে অভিবাসী হয়, যেটা ইতিহাসে পটেটো ফ্যামিন নামে পরিচিত। ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে, ভাগ্যের সন্ধানে অসংখ্য মানুষ নিউ ওয়ার্ল্ডে আসে। এছাড়া ফোর্সড মাইগ্রেশান, দাস ব্যবসার কারণে মানুষ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্থানান্তরিত হয়েছে।
অভিবাসন একটি চলমান প্রক্রিয়া। বর্তমানে আমেরিকা-ইওরোপে প্রতিবছর লক্ষ-লক্ষ মানুষ অভিবাসী হচ্ছেন। প্রতিদিন আফ্রিকা থেকে, যুদ্ধাক্রান্ত মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, ইউক্রেইন থেকে মানুষের স্রোত অন্যত্র যাচ্ছে। এই মূহুর্তে আমেরিকান সীমান্তের বাইরে মেক্সিকোতে ২ লক্ষ মানুষ অপেক্ষা করে আছে সরকারি সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হলে তারা আমেরিকাতে প্রবেশ করবে। এরা লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে জীবন বাঁচাতে, নতুন জীবনের সন্ধানে আমেরিকার দ্বারপ্রান্তে এসে হাজির হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে একসময় মানুষ আরাকানে গিয়েছে। এখন রোহিঙ্গা শরণার্থী/অভিবাসীরা বাংলাদেশে আসছে। গত ৫০ বছর প্যালেস্টাইনের মানুষ আরবের বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তু হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
বর্তমান বিশ্বে অভিবাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। ইওরোপ, আমেরিকার দেশগুলো অভিবাসন সমস্যার মোকাবেলা করতে আসল জায়গায় হাত না দিয়ে সীমান্ত সুরক্ষিত করছেন। সর্বত্র ডানপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসছে, পাশ্চাত্যের মাল্টিকালচারিজমের শিক্ষা কোন কাজে আসছে না। উপনিবেশ শাসিত দেশগুলো থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ইওরোপ-আমেরিকার সীমান্তে হাজির হচ্ছে। এম্পায়ার স্ট্রাইকস ব্যাক!
বাংলাদেশে অভিবাসীদের মূল্যায়ন করা হয় না, সেটা হোক সিজনাল, সাংবাৎসরিক বা স্থায়ী। অভিবাসী হওয়াটাই যেন দোষের। দেশের ভেতরে অভিবাসী হলে তাদের ‘আবাদী’ বলা হয়, বিদেশে গেলে বলা হয় ‘প্রবাসী’। বিদেশেও সমাজে, রাজনীতিতে জায়গা করে নেয়া অভিবাসীদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। সবসময় একটা দোটানার মধ্যে থাকতে হয়।
মানুষের ইতিহাস অভিবাসনের ইতিহাস। আগেও মানুষ এসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। এখনকার বিশ্বায়নের যুগে বরং অভিবাসন অনেক সহনশীল। সারা দুনিয়া এখন কতগুলো ডায়াস্পোরার সমষ্টি। আগের সেই জাতীয়তাবোধ এখন ভিন্ন রূপ নিয়েছে। নতুন জায়গার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা অভিবাসী মানুষরা সবসময় অনাগত সময়ের জন্য নিজেদের নতুনভাবে প্রস্তুত করেছে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন