অরিন্দম দা’র সাথে প্রথম যেদিন সাক্ষাৎ হয় সেদিন দাদা খুবই এক্সাইটেড ছিলেন। আমাকে বার বার ফোন করে অস্থিরতা প্রকাশ করছিলেন। যখন দেখা হলো তখন আমি বেশ ক্ষুধার্ত ছিলাম, দাদাকে বলছিলাম ‘আমি একটু ওদিক থেকে ৫/৭ মিনিট কাজ সেরে আসছি, আপনি অয়েট করুন’। দাদা ঠিকই বুঝে ফেলেছিলেন আমি কী কারণে কোথায় যেতে চাইছি। আসলে আমি একটা রেস্টুরেন্ট খোঁজ করছিলাম যেখানে শর্টকাট হালকা কিছু খেয়ে নিতে পারি। দাদা আমার হাত ধরে হুড় হুড় করে টেনে নিয়ে গেলেন একটা হোটেলে। সেখানে পারলে দোকানের সবকিছুই আমার জন্য অর্ডার করেন এইরকম দশা। আমি স্রেফ শাদাভাত, সবজি ও চিকেন দিয়ে ভাত খেলাম। উনি আমাকে খেতে বসিয়ে বাইরে সিগারেট টানতে গিয়েছিলেন। খাবার দ্রুত শেষ করে আমি যখন ক্যাশ কাউন্টারে বিল দিতে গেলাম, তখন জানলাম আমার খাবারের বিল আগেই পরিশোধ করা হয়েছে! কিন্তু আমি স্পষ্ট খেয়াল করেছিলাম দাদা আমাকে বসিয়ে দিয়ে সোজা বাইরে চলে গিয়েছিলেন, তাহলে বিল পরিশোধ করলো কোনসময়? আসল বিষয়টা অনেক পরে টের পেয়েছিলাম। আমি যখন ক্যাশ কাউন্টারে বিল দেয়ার জন্য দাঁড়িয়েছি, তখন উনি ইশারায় আমার বিল নিতে বারণ করেছিলেন। যে কারণে আমিও বুঝতে পারছিলাম না, বিল কখন দিলো আর আমি কী খেয়েছি তার বিল কতো হলো সেটা তিনি জানলেনই বা কীভাবে!
যাই হোক এটা হলো অরিন্দম দা’র সাথে একদিনের ঘটনা। তাঁর সাথে এরকম অনেক অনেক ঘটনার সাক্ষী আমি। সেবার লেকটাউনে আমার সার্জারি ছিল। আমি চিন্তিত ছিলাম এ কারণে যে অপারেশনের পরে অন্ততপক্ষে ২ দিন আমাকে আইসিইউতে থাকতে হবে। অথচ কলকাতায় আমি একা, আমার দেখাশুনার জন্য কেউ নাই। দেখাশুনা বলতে একজন মানুষের হসপিটালে সার্জারি হবে অথচ কোন এটেনডেন্ট নাই এটা ভারত বা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করা বেশ কঠিনই বৈকী!
কলকাতায় আমার বেশকিছু বান্ধবী ছিল। আমার সুস্থতার সময় তারা আমার সাথে দিনেরপরদিন সময় কাটিয়েছে, ভারতবর্ষের বিভিন্নস্থানে আমার সাথে ভ্রমণ করেছে। একটা কালারফুল সময় অতিবাহিত করেছিলাম সেসময়। কিন্তু আমি যখন হসপিটালে ভর্তি হলাম, আমার সার্জারির ডেট ফিক্সড হয়ে গেল; তখন সেইসব বান্ধবীদের দু’য়েকজনকে বলেছিলাম হসপিটালে আমার অফিসিয়াল এটেনডেন্ট হতে। আমার অবর্তমানে ওষুধ, স্যালাইন, হসপিটালের বিল পে করা, দেশ থেকে আত্মীয়-স্বজনদের ফোন রিসিভ করাসহ অন্যান্য কাজগুলোতে সহযোগিতা করতে। এদের বেশিরভাগই আমার সাথে হসপিটালে যেতে ভয় পেয়েছিল। বিশেষ করে অপারেশনের আগে হসপিটাল কর্তৃপক্ষের একটা কাগজে (যেখানে লেখা থাকে ‘কোন কারণে রোগির মৃত্যু ঘটলে কর্তৃপক্ষকে দায়ি করা হবে না… ইত্যাদি’) সিগনেচার করার কথা শুনেই হয়তো ভয় পেয়েছিল। এমনিতেই আমি সেসময় কলকাতায় আত্মগোপনে, পালিয়ে ছিলাম। তার ওপরে ক্লিনিকে আমি যদি মারা যাই সেক্ষেত্রে আমার মৃত্যুর কারণে তারা আইনগত কোন ঝুট ঝামেলায় জড়াতে রাজি হয় নি। এসবকিছুই অবশ্য আমার ধারণাগত মতামত, কারণ এছাড়া অপারেশনের সময় তাদের পলায়নপরতার অন্য কোন ন্যায়সঙ্গত কারণ খুঁজে পাই নি।
যা বলছিলাম, অরিন্দম দা সেসময় আমাকে আশ্বস্থ করলেন এই বলে যে,
“কলকাতায় তুমি একলা নাকী? তুমি হসপিটালে পইড়া থাকবা আর আমরা কলকাতায় বইসা মাছি মারবো? কোন চিন্তা করোনা, সবকিছু আমি সামলাবো।”
টালিগঞ্জের বাড়ি থেকে যখন আমি হসপিটালে পৌঁছুলাম, গিয়ে দেখি আমার অনেক আগেই দাদা সেখানে হাজির। হসপিটালের অফিসিয়াল পর্ব সারলাম তাঁর সাথেই। বেশকিছু কাগজে সাক্ষর করতে হয়েছিল, সবকিছু অরিন্দম দা নিজেই সারলেন। আমার পাসপোর্ট, টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন সবকিছু অরিন্দম দা’র কাছেই রইল। এরপর আমার জ্ঞান-হুশ (স্বাভাবিক স্মৃতি ও ঘোরকাটা) ফিরেছে সম্ভবত ৩ দিন পরে। প্রয়োজনীয় ওষুধসামগ্রী, বাংলাদেশে আমার আত্মীয়-স্বজন (এমনকী কলকাতার বন্ধু-বান্ধবী) দের ফোনকল মেইনটেইন করাসহ সবকিছু অরিন্দম দা দারুণভাবে সামাল দিয়েছেন।
যেদিন ক্লিনিক থেকে ছাড়া পেলাম, সেদিন আরেক কাহিনী। অরিন্দম দা সম্ভবত তাঁর অফিসের কাজে খুব কঠিন ঝামেলায় ছিলেন। একবার ক্লিনিক একবার অফিস এরকম দৌড়ঝাঁপ করছিলেন। ওইদিন আমাকে দেখভাল করা ও আমাকে নিরাপদে টালিগঞ্জের বাড়িতে পৌছে দেয়ার জন্য আরেক মহতীর ঘাড়ে দায়িত্ব চেপে দিয়েছিলেন। তিনি আর কেউ নন, আমাদের কাছের মানুষ; বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী লেখক, হেতুবাদী সাময়িকীর সম্পাদক সাধন বিশ্বাস। ওইদিন সাধন দা ‘ওলা’ ট্যাক্সিতে করে আমায় বাড়িতে পৌছে দিয়ে আমার জন্য খাবারের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। প্রয়োজনীয় বাজার সদাই, পানীয় জলসহ সবকিছু কেনাকাটা করে রেখে তবেই তিনি তাঁর ব্যারাকপুরের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন।
সাধন দা আমাকে ফেলে চলে যাবার পরে আমি হয়ে গেলাম একা। নতুন চিন্তা ভর করল, আহারের চিন্তা। শরীরের যে দূর্বল অবস্থা তাতে কিচেনে রান্না করে খাওয়ার মতো শারীরিক অবস্থা নেই। বাড়িওয়ালা বৌদি নরম ভাত, ডাল ও ফ্রাইড মাছ দিয়ে গিয়েছিলেন, সেটা সাবার করলাম নিমিশেই। সন্ধ্যায় অরিন্দম দা’কে মোবাইলে টেক্সট করলাম, ৩ দিন ভাত খাইনি, ক্ষুধা লেগেছে; এখন খাবো কী? উনার ফিরতি মেসেজে একটু ধমকের সুর ছিল! যার মোদ্দা কথা হলো- আমাকে কোন কিছু নিয়ে টেনশন করতে হবে না, সময় হলে সবকিছু হয়ে যাবে। আমি এই মেসেজটার অর্থই বুঝিনি তখন, ‘সময় হলেই’ মানে কী? এটা বুঝতে অবশ্য বেশি সময় লাগে নি, এপার্টমেন্টের কলিং বেল বাজার শব্দে দরজা খুলে দেখি অপরিচিত এক ব্যক্তি; তার হাতে বিশাল সাইজের একটি স্টেইনলেস স্টিলের টিফিন ক্যারিয়ার। বুঝলাম এসব অরিন্দম দা’র কারসাজি!
এভাবে রোজ তিনবেলা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে একজন লোক আসতো আমার বাড়িতে, আর খাবার দিয়ে চলে যেতো। ঠিক দুইদিন পরে অরিন্দম দা এলেন আমার কাছে। তখন হসপিটালে থাকাকালীন সময়ের অনেক গল্প জানলাম। হসপিটালে থাকা অবস্থায় কী কী ঘটেছে সব আদ্যোপান্ত জানালেন। সেসময় বাংলাদেশ থেকে সৈয়দ জামাল ভাই এসেছিলেন কলকাতায়। জামাল ভাইয়ের সাথে অরিন্দম দা’র অনেক আগে থেকেই বন্ধুত্ব, অরিন্দম দার কাছে আমার অসুখের খবর জেনে আমাকে দেখতে তিনিও হসপিটালে এসেছিলেন। এদিকে কলকাতার অন্যান্য লেখক একটিভিস্টরাও আমাকে দেখতে হসপিটালে এসেছিলেন, যখন আমি সংজ্ঞাহীন ছিলাম। সকলের নাম মনে নেই। কয়েকজনের নাম মনে আছে, বিজ্ঞান লেখক সুরেশ কুণ্ডু, ডা. ভবানীপ্রসাদ সাহু, সাংবাদিক সুদীপ মৈত্র প্রমুখ।
যা বলছিলাম, এই মানুষটার ভিতরে একটা পাগলাটে ভাব ছিল। কোনকিছু একবার মাথায় ঢুকলে সেটা নিয়েই পড়ে থাকতেন। কলকাতায় যতোবারই আমরা আড্ডা দিয়েছি, আসর মাতিয়ে রাখতেন সারাক্ষণ। যতোবারই তাঁর মোটরবাইকের পিছনে চেপে কলকাতা ঘুরেছি, যতোবারই তাঁর প্রাইভেট কারে চেপে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি, ততোবারই আমাকে জড়িয়ে ধরে মোবাইলে সেলফি তুলেছেন। রাস্তার লোকজনদের ডেকে তাঁর মোবাইলে আমাদের দু’জনের ছবি তুলে দিতে বলেছেন। ছবি তোলা হয়তো তাঁর নেশা ছিল না, কিন্তু কেন জানি আমার সাথে যৌথ ছবি তোলার ব্যাপারে তাঁর অদম্য আকাঙ্ক্ষা ছিল, ছিল একধরনের পিপাসা। আমি তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম, ভারতবর্ষ ত্যাগ করার আগে কোনভাবেই যেন আমার ছবি ফেসবুকে পাবলিশ না করা হয়। উনি আমার অনুরোধ রেখেছিলেন, আমি ইউরোপ আসার আগে কোথাওই কোন ছবি তিনি পাবলিশ করেন নি।
হঠাৎ-ই হার্ট এটাকে আক্রান্ত হয়ে যেদিন মুমূর্ষ অবস্থায় হসপিটালে ভর্তি হলেন অরিন্দম দা, তার কয়েকদিন আগেই আমি ইউরোপ চলে এসেছি। এখানে এসে কলকাতায় প্রথম ফোন করেছিলাম অরিন্দম মুন্সিকেই, এরপর সাধন বিশ্বাসসহ অন্যান্য হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধুদের। অরিন্দম দা যখন হসপিটালে মৃত্যুর সাথে শেষ লড়াই করছেন তখন আমার ফোন ব্যস্ত থাকতো সাধনদার ফোনের সাথে। সাধন দার গলার স্বরেই বুঝতে পেরেছিলাম, অরিন্দম দা’র সাথে আমার আর কোনদিন কথা হবে না। আমি অলৌকিকতায় বিশ্বাসী নই, নই ঈশ্বরে বিশ্বাসী। তারপরও ওইসময় বার বার চাইছিলাম অরিন্দম দা সুস্থ হয়ে ফিরে আসুক আমাদের মাঝে। আবারও ফোন করে ধমক দিয়ে বলুক, ‘অ্যাই সন্ধি খুব সাবধানে থাকবে, বেশি বাড়াবাড়ি করার দরকার নাই, অপরিচিত কাউকে তোমার ঠিকানা দিবেনা…’! আমিও উনার সাথে পাল্লা দিয়ে ঝগড়া বাধিয়ে দিয়ে বলতাম, ‘ভালো ডাক্তার দেখান দাদা, সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিন, নিয়ম করে চলুন, আর হোয়াটস অ্যাপে ঘন ঘন মেসেজ দিবেন না’ ইত্যাদি হরেকরকম খেজুরে প্যাচাল…।
চলে আসার সময় অরিন্দম দার মেয়ের রেজাল্ট হয়েছিল, খুব ভালো রেজাল্ট। ভালো কলেজে ভর্তিও হয়েছিল জানিয়েছিলেন দাদা। আমি উনাকে বলেছিলাম আপনার মেয়ে এতো কষ্ট করে লেখাপড়া করে ভালো রেজাল্ট করেছে, তাকে আমি কিছু দিতে চাই। দাদার সাথে এ নিয়ে বিস্তর ক্যাচালও হয়েছিল ফোনে। তাঁর কথা, তুমি আমার মেয়েকে একটু আদর করে দিলেই অনেক খুশি হবো। উত্তরে বলেছিলাম, দাদার মেয়ের জন্য সবসময়ই আদর থাকবে। আমি স্পেশাল কিছু ওকে দিতে চাই। দাদা জানতেন আমিও কম জেদি নই, দিতে যখন চেয়েছি তখন দিয়েই ছাড়বো। অগত্যা রাজি হয়ে বলেছিলেন ‘ঠিকাছে দিও, তবে ভারত থেকে নয়; ইউরোপ থেকেই পাঠাতে হবে’।
হসপিটাল থেকে অরিন্দম দা আর বাড়িতে ফিরে যেতে পারেন নি, ফিরেছে তাঁর নিথর দেহ; লাশ। অরিন্দম দা নেই, মাঝে মাঝে এটা বিশ্বাসই হয় না। অরিন্দম দা’র বোনরা আছেন, এই ফেসবুকেই। বোনদের সাথে আমার কখনো সাক্ষাৎ হয় নি, তবে ফোনে কথা হয়েছে। আমি কল্পনায় বোনদের মাঝেই অরিন্দম দাকে খুঁজে ফিরি। ফেসবুকে আরও আছে অরিন্দম দা’র কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এঁদের প্রায় সকলের সাথেই আমার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। তাঁদের সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ থাকলেও এঁদের কারুর কাছেই আমি আমার মনের কথা শেয়ার করতে পারি না, পারি না কোন অভিযোগ-অনুযোগ জানাতে।
ক’দিন আগে দাদার বন্ধুরা মিলে কলকাতায় স্মরণসভার আয়োজন করেছিলেন। রবিন দাস চাপ দিচ্ছিলেন স্মরণসভা উপলক্ষে যে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হবে তাতে যেন আমি অবশ্যই একটা লেখা দিই। অরিন্দম দা’র বিষয়ে কোন কথা আমি ফেলতে পারবো না, এটা হয়তো রবিন দাও জানতেন; তাই এমনভাবে দাবি করেছিলেন। প্রচণ্ড অসুস্থতার মধ্যে থাকায় সে ক্রোড়পত্রে অংশ নিতে পারিনি আমি। তবে দাদার স্মরণে প্রতিটি কর্মকাণ্ড নিয়মিতই চোখে চোখে রেখেছিলাম। অনুভবে ছিল অরিন্দম, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। অরিন্দম মুন্সিকে নিয়ে যেটুকু আজ লিখলাম এটা একটা সূচনামাত্র। অনেক অনেক স্মৃতি, অনেক অনেক জমানো কথা রয়েছে তাঁকে ঘিরে; সেগুলো আমাকে লিখতেই হবে। কারণ আমি যে অরিন্দম মুন্সির কাছে আজীবন ঋণি।