#অর্পিতার_ব্লগার_এবং_জার্মানির_পেন_স্কলার_হয়ে_ওঠার_গল্প
#অর্পিতার_লাশ_হয়ে_ঘরে_ফেরার_গল্প
[ বিশেষ দ্রষ্টব্য: আর্টিকেল টি আকার-আকৃতিতে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। তাই দুটি পর্বে ভাগ করে ফেইসবুকে পাবলিশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তথাকথিত মুক্তমনা, নারীবাদী ও হিপোক্রেট সাহিত্যিকদের ভণ্ডামির অংশটা থাকবে ২য় পর্বে। ]
আমরা অর্পিতাকে (অর্পিতা রায়চৌধুরী) ফিরে পেলাম গত ৩ ফেব্রুয়ারি,২০১৯। এর প্রায় সপ্তাহ তিনেক আগে জার্মান ক্রিমিনাল পুলিশ ও ফরেনসিক বিভাগ থেকে অর্পিতার পরিবারকে জানানো হয়েছিল যে,অর্পিতার মৃতদেহ দীর্ঘসময় বাথটাবে পানির মধ্যে থাকা, পোস্টমর্টেম ও বিভিন্ন ফরেনসিক পরীক্ষার কারণে তাঁর মরদেহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিধায় জার্মানি থেকে বাংলাদেশে এতো দীর্ঘপথে মৃতদেহ বহন করা সমীচিন হবে না। জার্মানির ক্রিমিনাল পুলিশ ও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা অর্পিতার মৃতদেহ বার্লিনে শবদাহ করে তার ছাইভষ্ম বাংলাদেশে তাঁর পরিবারের নিকট পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছিল। সেমতে জার্মান পেন সেন্টার অর্পিতার পরিবারের প্রতি গভীর শোক ও দুঃপ্রকাশ করে জানিয়েছিলো,
“…আপনারা অনুমতি দিলে আমরা পেন সদস্য, অর্পিতার ক্লাসমেট বন্ধু-বান্ধব ও এখানের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে অর্পিতার সৎকার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে তাঁর ছাইভষ্ম বিমানযোগে আপনাদের কাছে প্রেরণ করবো…”
(সূত্র: অর্পিতার পরিবার)
সন্তানহারা পরিবার এই সংবাদ জানার পরে ভীষণভাবে হতাশ এবং মুষরে পড়ে। পরিবার থেকে জার্মানিতে অবস্থানরত পেনের স্কলার অপর বাংলাদেশী লেখককে অনুরোধ করে যাতে তাঁর মরদেহ বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এরপরে অর্পিতার পরিবার থেকে জার্মান পেনে চিঠি লিখে অনুরোধ করা হয় মরদেহ যেমনই থাকুক অর্পিতা আমাদের সন্তান, আমাদের সন্তানকে আমাদের কাছে পাঠালে পরিবার কৃতজ্ঞ থাকবে।
অর্পিতার বাবা ও বোনের চিঠির প্রেক্ষিতে জার্মান পেন সেন্টার ক্রিমিনাল পুলিশ, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ও আইনবিভাগের সাথে যোগাযোগ করে তাঁর মরদেহ অতি দ্রুত বাংলাদেশে প্রেরণের উদ্যোগ নেয়। ইতিমধ্যে অর্পিতার মৃত্যুর পিছনে অন্য কোনো ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা, এবং তিনি সুইসাইড করেছেন কিনা তার তদন্তও শেষ হয়ে গেছিল। অর্পিতার পরিবারকে জানানো হয় যে, তাঁর অপমৃত্যু হয় নি। এবং তাঁর মৃত্যুর পিছনে কোনো ব্যক্তির সংশ্লেষ নেই। (সূত্র: অর্পিতার পরিবার ও পেনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতি)
অর্থাৎ ঠিক কি কারণে আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে সেটাও ফরেনসিক পরীক্ষায় শতভাগ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় নি। হতে পারে সাডেন ডেথ, হতে পারে এনিমিয়ার কারণে হঠাৎ রক্ত সঞ্চালনে বিঘ্ন হয়ে বাথটাবে অজ্ঞান হবার কারণে, হতে পারে হার্ট এটাক, হতে পারে ব্রেইন স্ট্রোক কিংবা অজানা কারণে। যেহেতু অপমৃত্যু নয়, সেহেতু এটা স্বাভাবিক মৃত্যু (সূত্র: অর্পিতার পরিবার)।
অর্পিতার পরিবারের অনুরোধে গত ৩ তারিখ বেলা ১টা ৫৫ মিনিটে টার্কিশ এয়ারের ফ্লাইটে তাঁর মরদেহ শাহজালাল বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। অর্থাৎ অর্পিতা ফিরে এলো তাঁর জন্মভূমিতে।
অর্পিতাকে নিয়ে জার্মানিতে নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দারের একটি লেখা গত ২০ ডিসেম্বর বাংলা ট্রিব্রিউনে প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটি আমি পড়েছিলাম। ওই লেখায় কবি দাউদ হায়দার উল্লেখ করেছিলেন,
“আর-পাঁচজন লেখক থেকে আলাদা। প্রশ্নের সঙ্গে যুক্তি, যুক্তির সঙ্গে বিশ্লেষণ, বিশ্লেষণে ইতিহাস-দর্শন-রাজনীতির বিপুল সমাহার, তথ্য। ফাঁকি কোথাও নেই। তথাকথিত নারীবাদী ‘লেখিকা’ নন। কেউ-কেউ নারীবাদী ‘লেখিকা’ যেমন বাগাম্বড়ে নিজেকে জাহিরে দিশেহারা। অর্পিতার লেখা পড়লেই বোঝা যায়, নারী হয়েও নারীবাদীর ঊর্ধ্বে, বিস্তর লেখাপড়া তাঁর। পড়া নয় কেবল, পড়ার সঙ্গে চিন্তা, বুদ্ধির সংযোজন।“
(সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন, ২০ ডিসেম্বর ২০১৮, লিংক: কমেন্ট বক্সে)
অর্পিতা তাঁর কর্মযোগ্যতায় জার্মান সরকার প্রদত্ত ‘Writers-in-Exile‘ স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। জার্মান সরকারের এই প্রকল্পটি দেখভাল করে জার্মান পেন সেন্টার। এখানে উল্লেখ্য যে, সমগ্র বিশ্বে লেখকদের জন্য প্রদত্ত এতো উচ্চমানের ও দীর্ঘমেয়াদী স্কলারশিপ আর কোথাওই নাই। জার্মান পেন সেন্টারের এই স্কলারশিপকে তাই বলা হয় লেখকদের জন্য সবচেয়ে অভিজাত স্কলারশিপ। অনেকেই হয়তো জানেন না, তাই এখানে উল্লেখ করছি- এই লেখাটা যখন লিখছি তখন পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষে (ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান) মাত্র ৩ জন লেখক এই স্কলারশিপ প্রাপ্ত হয়েছেন, তিনজনই বাংলাদেশের। প্রথমজন প্রয়াত অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ, এরপরে ২০১৬ সালে জোবায়েন সন্ধি এবং ২০১৭ সালে অর্পিতা রায়চৌধুরী। পাঠক নিশ্চয় অনুধাবন করতে পারছেন আর কোনো ব্যক্তি অর্থাৎ যাঁরা এই স্কলারশিপের জন্য ধর্না দিয়েও পাননি, তাঁরা স্বভাব্তই স্কলারশিপপ্রাপ্তদের ওপরে ঈর্ষান্বিত ও মনোবেদনায় ভূগছিলেন। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি তারা এখনো মর্মবেদনায় ভূগছেন। তার প্রমাণ অর্পিতার মৃত্যুসংবাদ জানার পরপরই তাদের কর্মকাণ্ড।
গতবছর (এপ্রিল ২০১৮) পেন জার্মানির বাৎসরিক কংগ্রেসে পেনের প্রেসিডেন্ট রেগুলা ভেন্সকে তাঁর বক্তৃতায় অর্পিতা রায়চৌধুরী সম্পর্কে বলেছিলেন-
“অর্পিতা রায়চৌধুরী হলেন আমাদের গতবছরের ক্রিসমাস উপহার।”
“Arpita Roychoudhury – sie heißt eigentlich anders, aber die bekennende Atheistin, die über Themen wie die Diskriminierung von Frauen und Minderheiten schreibt, veröffentlicht ihre Texte unter Pseudonym. Trotz dieser Vorsichtsmaßnahme war sie in ihrer Heimat extrem gefährdet und musste sich 2016 nach schweren Gewalterfahrungen über ein Jahr in Indien versteckt halten. Im vorigen Sommer kehrte sie nur zurück nach Dhaka/Bangladesch, um das Visum für die Ausreise nach Deutschland zu beantragen. Seit August wartete sie und hofften wir darauf, dass die deutsche Botschaft in Dhaka ihr endlich das nötige Visum für Deutschland erteilen würde. Aber aus unerfindlichen Gründen warteten und bemühten wir uns zunächst vergeblich – während sie Todesdrohungen erhielt.
Am 23. Dezember konnte meine Kollegin Nora Bossong, gemeinsam mit Zobaen Sondhi, Arpita Roychoudhury am Berliner Flughafen in Empfang nehmen – ein Weihnachtsgeschenk.“
বক্তব্যটি মূল জার্মান ভাষা থেকে উদ্ধৃত করে দিলাম, এবং পাঠকদের সুবিধার্থে গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্যে ইংরেজিও করে দিলাম-
“Arpita Roychoudhury – her real name is different, but the self-confessed atheist, who writes on topics such as discrimination against women and minorities, publishes her texts under a pseudonym. Despite this precaution, she was extremely vulnerable in her homeland and had to hide in India for over a year in 2016 after having suffered severe violence. Last summer she only returned to Dhaka/Bangladesh to apply for a visa to leave for Germany. Since August she waited and we hoped that the German Embassy in Dhaka would finally grant her the necessary visa for Germany. But for unknown reasons we waited and tried in vain – while she received death threats.
On December 23, my colleague Nora Bossong, together with Zobaen Sondhi, received Arpita Roychoudhury at Berlin Airport – a Christmas present.”
পেন সভাপতির এই বক্তব্য ইন্টারনেটে গুগলসার্চ করলেই পাওয়া যায়। পাঠক চাইলে তার লিংকও দেয়া যাবে।
অর্পিতাকে নিয়ে পেন সভাপতির এমন বক্তব্য থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে অর্পিতা রায়চৌধুরীকে জার্মান লেখকরা কতোটা সম্মান করে।
অর্পিতা রায় চৌধুরী প্রথমদিকে তমালিকা সিংহ নামেই লেখালেখি করতেন। চমৎকার লিখতেন তিনি। দেশে সরকারি দলের ছায়ায় মৌলবাদী গোষ্ঠীর উপরে অমানুষিক নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে পুরোপুরি বদলে যায় তাঁর জীবন। নির্যাতনের সময় ভয়ে মুছে ফেলেন তাঁর সকল লেখা। পরবর্তীতে একসময় তিনি ‘অর্পিতা রায়চৌধুরী’ ছদ্মনামের আড়ালে লেখালিখি করতে বাধ্য হন তিনি।
প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে নিজের কিছু চিন্তাভাবনা, গতানুগতিক স্রোতের বিপরীতে বয়ে যাওয়া কিছু অনুভূতি অনলাইনে লেখার জন্য রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা একত্রিত হয়ে অর্পিতার উপর নানানরকম নির্যাতন চালায়। এই ননস্টপ নির্যাতনের শিকার হয় অর্পিতার পরিবারের প্রতিটি মানুষ। অবশেষে জীবন বিপন্ন হবার আশংকায় টাংগাইল ও নেত্রকোণা ছেড়ে অজ্ঞাত পরিচয়ে মাসের পর মাস টুলে বেদেনীর মতো তিনি পালিয়ে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের অসংখ্য জায়গায়, অসংখ্য ঘরে।
অর্পিতা লিখেছিলেন বাংলার মাটিতে সমাজ ও ধর্মের নিয়মানুসারে মেয়েদের অধিকার, কর্তব্য এবং অবস্থান নিয়ে। বিভিন্ন ধর্মে, ধর্ম বইয়ে কোথায়-কিভাবে মেয়েদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে, কেড়ে নেওয়া হয়েছে মেয়েদের মানবাধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা ইত্যাদি। ধর্মের ইতিহাসে উল্লেখিত কোন্ কোন্ কথিত মহাপুরুষ শেষ পর্যন্ত অর্পিতার চোখে অত্যাচারী, স্বার্থপর এবং চরিত্রহীন হিসেবে ধরা পড়েছে, এসব বিষয়াদিই রেফারেন্স সহকারে তাঁর সুনিপুণ হাতের লেখায় আলোচিত হতো। নবযুগ ব্লগে লেখালেখির সূত্র ধরেই জার্মানিতে প্রবাসী নবযুগ ব্লগের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক জোবায়েন সন্ধির সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়।
একইসময় সরকারীদল বাক-স্বাধীনতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে মুক্তচিন্তার ব্লগারদের বিরুদ্ধে কিছু কালো আইন প্রণয়ন করছিলেন। কালক্রমে টাংগাইলে ‘ইসলাম রক্ষা কমিটি‘ নামক ‘ছাত্রলীগ’ নামধারী একদল যুবক অর্পিতাকে ট্র্যাক করে একদিন তাঁর মেসে ঢুকে ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন এবং টাকা পয়সা কেড়ে নিয়ে যায়। এরপর একদিন তাঁকে তাঁর ল্যাপটপ-মোবাইল ফেরৎ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। সেখানে তারা অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালায় তাঁর উপর এবং হুমকি দেয় যে, ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করার অপরাধে অর্পিতাকে তাদের দ্বারা প্রায়শই এভাবে অত্যাচারিত হতে হবে। একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মেয়ে হওয়ার জন্য তাঁর বাড়ির এলাকাতেও (এলাকার নাম উল্লেখ থেকে বিরত থাকলাম) অনেকদিন অনেকরকমভাবে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উগ্রবাদীদের দ্বারা শারীরিক-মানুষিক অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছিলো অর্পিতাকে। এস.এস.সি পাস করার পরে একটা কম্পিউটার কোর্সে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন অর্পিতা। ক্লাসে যাওয়ার সময় প্রতিদিন ধর্মীয় উগ্রবাদি কিছু ছেলে পথিমধ্যে তাঁকে উত্যক্ত করতো। সারাপথ তাঁকে অনুসরণ করতো, টিজিং করতো, গায়ে হাত লাগাতো। এছাড়াও নানাভাবে তাঁকে হয়রানি করতো। একদিন ছেলেগুলো অর্পিতার ক্লাসের ভেতর ঢুকে সকল সহপাঠীদের সামনেই তাঁকে অকথ্য-অশ্লীল ভাষায় উত্যক্ত করতে শুরু করে, অর্পিতা সেদিন আর আবেগ সামলাতে না পেরে ওই গ্রুপের একটা ছেলের গালে সজোরে চড় মারে। ফলশ্রুতিতে ওইদিনই রাতের বেলা বখাটে ছেলেরা দলবেঁধে এলাকার কিছু মুসলিম মুরব্বি ব্যক্তিবর্গ অর্পিতার বাড়িতে হামলা করে এবং মুসলিম পুরুষের গালে এই চড় মারার বিচার করতে তারা একটা শরিয়া-আইনি আদালত বসায় সেখানে।
পরবর্তীতে অবস্থা এমনই হয়েছিল যে, তারা প্রায়ই রাতেরবেলা অর্পিতার বাড়িতে গিয়ে হাজির হতো এবং তাঁর বাবা-মাকে সেখানথেকে সরিয়ে দিয়ে তাঁর সাথে জরুরী আলাপ করতে হবে বলে অর্পিতাকে একলা রেখে অন্যঘরে যাবা দাবী জানায়। ফলাফল খুব ভয়াবহ হতে পারতো,কিন্তু সেদিন কিছু প্রতিবেশীর সহায়তায় সেবার রক্ষা পান অর্পিতা। এদিকে লেখালেখি ও মুসলিম ছেলেদের গালে চড় মারার কারণে এই ঝামেলা সৃষ্টি হওয়ায় পরিবারও অর্পিতার উপরে দোষারোপ করে বসে। কারণ ওই পরিবারে আরও ২ জন কিশোরী কন্যা সন্তান রয়েছে।
এরপরই জীবন অভিশপ্ত হয়ে ওঠে অর্পিতার কাছে। মুসলিম ছেলেগুলো ধারাবাহিকভাবে তাঁর বাড়িতে হামলা করতে শুরু করে। তাঁর উপর শারীরিক নির্যাতন ধারাবাহিকভাবে চলতেই থাকে। অত:পর বাড়ি থেকে পালিয়ে অন্য একটি জেলায় আশ্রয় নেন অর্পিতা। তখন তাঁকে এলাকায় ও টাংগাইলে তাঁর কলেজে খুঁজে না পেয়ে তাঁর ছোট বোনের উপর একইরকম অত্যাচারের চেষ্টা করে ধর্মীয় উগ্রবাদী পাষণ্ডরা। এতো বিপর্যয়ের মধ্যে অর্পিতার পরিবার পুলিশ প্রশাসনের কাছে যাওয়ার সাহস পান নি। কারণ অপরাধীরা তো ক্ষমতাসীন দলের। তাদের সাথে লড়াই করে কোনোভাবেই টিকতে পারবেন না তারা।
এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাবার পরে শুরু হয় অর্পিতার আরেক দুর্বিষহ জীবন। ইতিমধ্যে তাঁর লেখালিখি ও নির্যাতনের কাহিনী ছড়িয়ে পড়েছিলো নানান জায়গায়। একাকী নারী হওয়ার কারণে কেউই তাঁকে আশ্রয় দিতে চাইতোনা। নবযুগ ব্লগের একজন সম্পাদকের রেফারেন্সে তিনি আশ্রয় নেন ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, যশোরসহ বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্নজনের বাড়িতে। দূর্ভাগ্যজনক হলো প্রতিটি জায়গায়ই তিনি দীর্ঘদিন থাকতে পারেন নি। অধিকাংশ মানুষই সেসময় তাঁকে আশ্রয় দিতে কার্পণ্য করেছে। এমনকি দেশের কথিত নারীবাদী, সাংবাদিক, অন্যান্য মুক্তচিন্তার লোকজনরা কেউই তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন নি।
অবশেষে বাধ্য হয়ে পরিবার ও নিকটজনের পরামর্শে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ভারতে পালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু সেসময় তাঁর পাসপোর্টই ছিল না। সীমান্তের দালালদের সহযোগিতায় টাকা খরচ করে অবৈধভাবে তাঁকে ভারতে পাঠানো হয়। সেসময় তিনি ভারতে কিছু মুক্তমনা লেখকদের আশ্রয়ে ছিলেন। অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের কারণে তিনি স্বাভাবিক চলাফেরা কিংবা নিজের জন্য আলাদা কোনো ঘর ভাড়া নিতে পারেন নি। নবযুগ ব্লগের উদ্যোগে তাঁকে বিভিন্ন মানুষের সহযোগিতা নিয়ে আশ্রয়ে থাকতে হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে এই সময়টা তাঁর মোটেও ভালো কাটেনি। তাছাড়া এভাবে পালিয়ে থাকার কারণে তাঁর লেখাপড়াও বৃঘ্নিত হচ্ছিল। এদিকে অর্পিতার অনার্স পরীক্ষা ঘনিয়ে আসায় তিনি টাংগাইলে ফিরে আসতে বাধ্য হোন। প্রথমদিকে ভারতে অবস্থানকালীন সময়ে পশ্চিমবঙ্গের এক রাজনীতিকের বাড়িতে তাঁকে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। রাজনীতিকের মেয়ের সূত্রেই সেখানে আশ্রয়। কিন্তু অর্পিতার কপাল মন্দ! রাজনীতিক বাবা কলকাতার একজন নামকরা রাজনীতিবিদ। তাই তিনি রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নষ্ট না হবার কারণেই হোক বা প্রবাদপ্রবচনের মতো পশ্চিমবঙ্গের হাড়-কিপটা বাঙালির ঐতিহ্য রক্ষার্থেই হোক, যেকোন কারণেই তিনি অর্পিতাকে সহ্য করতে পারতেন না। প্রায়ই নানান কথার ছলে তিনি স্পষ্ট বুঝিয়ে দিতেন যে, অর্পিতা চলে গেলে তাঁর বড্ড উপকার হয়।
কোথাও থাকার আশ্রয় না পাবার প্রেক্ষিতে একটু মানসিক শান্তিতে যাতে থাকতে পারেন সে ভরসায় তিনি কলকাতায় অবস্থানরত ওই ব্লগারের বাড়িতেই আশ্রয় প্রার্থনা করে বসেন। কারণ ওই ব্লগার যে বাড়িতে থাকতেন সে বাড়ি বেশ বড় ও নিরাপদ ছিল, যা তাঁর জানা ছিল। এখানে থাকাকালীন অর্পিতা মাঝে মধ্যেই দেশে ফেরৎ যেতেন ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় এটেন্ড করার জন্য। অর্পিতা ফিরে গেলেন বাংলাদেশে পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য। বাংলাদেশে ফেরার পর আবারও ওই পাষণ্ডদের খপ্পরে পড়েন তিনি। অবর্ণনীয় চাপে পড়ে পাগল হবার মতো দশা হয়ে পড়ে । তাঁর এই সমস্যার কথা তাঁর কাছের মানুষজন ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনে বার বার জানাতে থাকেন ও কিছু একটা করার তাগিদ দিতে থাকেন।
ভারতে অবস্থানরত ওই ব্লগার অর্পিতাকে দ্রুততম সময়ে পাসপোর্ট তৈরি করে ভারতীয় ভিসা নিয়ে ভারতের কোনো ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া শুরু করার পরামর্শ দেন। অর্পিতা পাসপোর্ট তৈরি ও ভারতীয় ভিসা জোগাড় করতে সক্ষম হোন।
আমি তখন জার্মানিতে, আমার নিজেরও জার্মান সরকারের সাথে জার্মানিতে থাকা না থাকার বিষয়ে ঝামেলার মধ্যে দিন যাচ্ছে। দূর থেকে শোনা ছাড়া অর্পিতার জন্য আমার কিছু করার ক্ষমতাও ছিল না। ইতিমধ্যে তাঁর অনার্স থিওরি পরীক্ষা শেষ, প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার তারিখও নির্ধারণ হয় নি। এদিকে পাষণ্ডদের উপর্যুপরি চাপ, শেষতক অর্পিতার সামনে দুটো পথ-
এক. লেখাপড়া বন্ধ করে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়া, অথবা
দুই. তাদের হাতে নিয়মিত পাশবিক নির্যাতনের বলি হয়ে নিজের জীবনকে ধ্বংস করা।
অবশেষে তিনি চূড়ান্ত ডিসিশন নেন স্থায়ীভাবে ভারতে আশ্রয় নেয়ার। কিন্তু আর্থিক সামর্থ ও একা একা কিভাবে সবকিছু সামলাবেন তিনি! এদিকে গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট হত্যাকাণ্ডের কারণে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রি এক্সপ্রেস দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। পরিস্থিতির উন্নতির পর যেদিন মৈত্রি এক্সপ্রেস প্রথম যাত্রা শুরু করে সেদিনই অর্পিতা বাংলাদেশ থেকে ভারতে রওনা দেন, এবং ভারতে পৌছান। পরদিন ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক, টাইমস অব ইন্ডিয়ার ফ্রন্টপেইজে অর্পিতা রায়চৌধুরীর বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। (এই পোস্টের নিচে ওই নিউজের ওয়েবসাইট লিংকও দেয়ার চেষ্টা করবো)
অর্পিতা ভারতে গিয়েছিলেন দীর্ঘসময় থাকবেন বলে। সাথে টাকা পয়সাও নেই। স্বাভাবিক কারণেই জোবায়েন সন্ধির ভাড়া নেয়া এপার্টমেন্টে আশ্রয় নিলেন। একইসময় সেই বাড়িতে ৮৪ হিটলিস্টের আরও একজন বাংলাদেশী ব্লগার আশ্রিত ছিলেন (এই মূহুর্তে তার নাম মনে পড়ছে না)। ইতিমধ্যে সন্ধির জার্মানির ভিসাপ্রাপ্তি এবং কলকাতা থেকে বার্লিনের ফ্লাইট চূড়ান্ত হওয়ার কারণে অর্পিতার ভারতে থাকার বিষয়টা অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়। অর্পিতার যেন দূর্গতি আর ভোগান্তির শেষই হয় না! কারণ বাড়ি ভাড়ার টাকা নাই, বাড়ি পেলেও বাড়ি ভাড়া পাওয়া একটা অসম্ভব ব্যাপার।
সন্ধি বার্লিনে রওনা দেয়ার আগে অর্পিতার জন্য কলকাতায় একটা নিরাপদ বাড়ি খোঁজাখুঁজি করেও ব্যর্থ হোন বলে শুনেছি। এবং এও শুনেছিলাম যে তিনি কলকাতায় স্থানীয় কিছু মুক্তমনা লেখককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল অর্পিতার জন্য সুলভে একটি ভাড়ি ভাড়া খোঁজার জন্য। সিদ্ধান্ত ছিল বাড়ি পাওয়ামাত্রই তিনি সেটা বুকিং দিয়ে রাখবেন এবং অর্পিতাকে জানানো হবে। এরকম উভয়সংকট অবস্থার মধ্যে অর্পিতা আবারও বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এবার তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্নজনের আশ্রয়ে সময় অতিবাহিত করতে থাকেন, যাতে ভারতে বাড়ি ভাড়া কনফার্ম হলেই তিনি ভারতে ঢুকে পড়তে পারেন।
অর্পিতা যে বাংলাদেশেই আছেন সে খবরটা কিভাবে যেন ওই চক্র জেনে গিয়েছিল। তারা অর্পিতার পরিবারের সদস্যদের কাছে নিয়মিত জেরা করা, মোবাইল কললিস্ট চেক করা থেকে শুরু করে হেন নির্যাতন নাই যা তারা করেনি।
সেইসময় আমাকে কয়েকবার মেসেজ করেছিলেন অর্পিতা। অতোদূর থেকে আমি কিছু করতে পারবোনা এটা জানার পরেও তিনি আমাকে অনুরোধ করেছিলেন কিছু হেল্প করা যায় কিনা। হেল্প বলতে তিনি কখনোই আমার কাছে আর্থিক সহায়তা চাননি। তাঁর অনুরোধ ছিল তাকে একটা সেইফ জায়গার ব্যবস্থা করে দেয়া। সত্যি বলতে আমি তাঁকে কোনো সাহায্যই করতে পারিনি।
সেসময় জার্মানীতে আসা জোবায়েন সন্ধি উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে জানতে পেরেছিলাম। তিনি সমমনা বিভিন্ন বন্ধু-বান্ধবদের সাথে এ নিয়ে পরামর্শ করেন এবং তাঁকে দ্রুত ভারতে পাঠানোর চেষ্টা করেন। ওইসময় তাঁর উদ্যোগে আমরা কয়েকজন মিলে অল্প কিছু টাকা সংগ্রহ করে বাংলাদেশে পাঠাই। যাঁরা তাঁকে আর্থিক সহায়তা করেছিলেন তাঁদের সংখ্যা খুবই নগণ্য- আমেরিকা থেকে ২ জন ব্যক্তি এবং কানাডা থেকে একজন নারী ও পুরুষ লেখকও সামান্য কিছু টাকা ঢাকায় একজন সাংবাদিকের মাধ্যমে অর্পিতার কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। এই টাকার পরিমাণ ছিল সম্ভবত ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে। ঢাকা-কলকাতা বিমানের টিকিটের ব্যবস্থাও করা হয় অতি দ্রুত। এটাই অর্পিতার চূড়ান্ত দেশত্যাগ। অর্পিতা ভারতে যাবার পরপরই তাঁর ছোটবোনকেও ভারতে পাঠাতে বাধ্য হয় তাঁর পরিবার। দুই বোনের লেখাপড়া কন্টিনিউ করার জন্য সেখানে ভর্তির চেষ্টা চলতে থাকে। কলকাতার মুক্তমনা লেখকরা অর্পিতাকে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য নানানরকম চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু নানানরকম আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও ভারতের শিক্ষা বিভাগের অসহযোগিতার কারণে তিনি এবং তাঁর বোন কেউই ভর্তি হতে পারেন নি।
যাঁরা তাঁর ভর্তির বিষয়ে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নামোল্লেখ না করলেই নয়। যেমন- বিজ্ঞান লেখক ও হেতুবাদী পত্রিকার সম্পাদক সাধন বিশ্বাস, প্রখ্যাত বিজ্ঞান লেখক সুরেশ কুণ্ডু ও বাম রাজনীতিক রবিন দাস অন্যতম। কোন ইউনিভার্সিটিতে বা কলেজে ভর্তি হতে ব্যর্থ হওয়ায় অর্পিতা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। কোনভাবেই যেন অর্পিতার দুর্দিনের শেষ হয় না! এসময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সেক্যুলার রেসকিউ সংগঠনও অর্পিতার পাশে এসে দাঁড়ায়। পাশে দাঁড়ায় কলকাতার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম কর্মীরা। তাঁরা অর্পিতাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিরাপদ কোনো দেশে স্থানান্তরের জন্য কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। এরমধ্যে একদিন হঠাৎ করে জার্মান পেন সেন্টার অর্পিতাকে স্কলারশিপের প্রস্তাব দিয়ে তাঁকে ইমেল করে। ৫ দিনেও অর্পিতা সেই ইমেইলের রিপলাই দিচ্ছিল না দেখে জার্মান পেন সেন্টার চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং তারা জোবায়েন সন্ধির নিকট জানতে চায় অর্পিতার কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা!
সন্ধি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন অর্পিতা অসুস্থ থাকায় কলকাতার পিয়ারলেস হসপিটালে চিকিৎসাধীন থাকায় অনলাইন থেকে দূরে ছিলেন এবং তাঁর সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। অর্পিতার বাড়িওয়ালীর মোবাইল ফোনে ফোন করে অর্পিতার সাথে যোগাযোগ করে জানানো হয় ইমেল পেয়েছেন কিনা। এরপর ইমেল ওপেন করে যখন তিনি জানতে পারেন যে তিনি পেন এর স্কলারশিপ পেয়েছেন তখন তিনি সাথে সাথে সম্মতি জানিয়ে পেনকে চিঠি লিখেন।
জার্মানির ভিসার ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য তিনি সতর্কভাবে বাংলাদেশে যান। কিন্তু তিনি তাঁর বাড়ি বা পরিবারের কোনো সদস্যদের সাথে দেখা কিংবা যোগাযোগ করার মতো সুযোগ-পরিবেশ পাননি। সারাক্ষণই ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে কাটছিল তাঁর। জার্মানির কিছু ব্লগারের বিরূপ মতামতের কারণে ঢাকাস্থ জার্মানির দূতাবাস দীর্ঘদিন অর্পিতার ভিসা আটকে রেখেছিলো। পরবর্তীতে জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে জার্মান দূতাবাস অর্পিতাকে ১ বছরের ভিসা প্রদান করেন এবং তাঁকে বিমানের টিকিট পৌঁছে দেয়া হয়। অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে তিনি জার্মানির বার্লিনে আশ্রয় পান।
শুভাকাঙ্খীদের আন্তরিক চেষ্টায় কালক্রমে অর্পিতার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসে পেন-এর Writers-in-Exile স্কলারশিপ। পেন স্কলারশিপের সুবাদে তাঁর জন্য ফুল ফার্নিশড ফ্লাট পান রাজধানী বার্লিনের প্রাণকেন্দ্রে। খাবার, পোশাকাদি আর অন্যান্য হাত খরচের জন্য প্রতিমাসে পর্যাপ্ত অর্থসহ, চিকিৎসা, ওষুধপত্র তো রয়েছেই। তার পাশাপাশি তিনি পেয়েছিলেন দুঃশ্চিন্তামুক্ত নিরাপদ জীবন, যেখানে নেই জীবনঘাতের কোন আশংকা, আছে মুক্তভাবে কথা বলার, মুক্তভাবে লিখে যাওয়ার অফুরন্ত স্বাধীনতা। আছে সম্মান ও অহংকার, চারিপাশের মুখগুলিতে অকৃত্রিম হাসি।
কিন্তু প্রকৃতির নির্মম পরিহাস! প্রকৃতি তাঁকে এনিমিয়া রোগের অভিশাপ দেয়। এই রোগের ফলে অর্পিতার শরীরে পর্যাপ্ত রক্ত উৎপাদন হতো না। রক্তশুন্যতা ও মানসিক ট্রমা তাঁকে যেন ঘিরে ধরেছিল। ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছিলেন বেশি করে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার, পুষ্টিকর পানীয় পান করার, নিয়মিত ওষুধপত্র খাওয়ার জন্য আর শরীরে নিয়মমাফিক রক্ত নেওয়ার জন্য। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে অন্যরকম একটা উদাসীনতা আচ্ছন্ন করে রাখতো অর্পিতাকে। হয়তো নির্যাতনের দিনগুলোর সেই নৃশংস স্মৃতি তাঁকে ঘুমে-জাগরণে সবসময় তাড়া করে ফিরতো। হয়তো প্রকৃতি এবং পৃথিবীকে আর বিশ্বাস করতোনা, কিংবা হয়তো ভাবতো উদাসীনতায় ডুবে থাকলেও সবকিছু আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যাবে, ঠিক হওয়ার সময় হলে। অথবা ঠিক-বেঠিক, বাঁচা-মরা কোনকিছুতেই আর কোনকিছু এসে যেতোনা তাঁর। সবকথার আগেই আমি ‘হয়তো’ শব্দটা যোগ করছি, কারণ কারও সাথেই কোন কিছু শেয়ার করতেন না অর্পিতা। কেন তিনি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতেন না, খাবার খেতেন না, কেনইবা ওষুধপত্র ঠিকমত নিতেন না, আর কেনই বা নিয়মিত চেক-আপ করাতে হাসপাতালে যেতেন না, এর কোন সুনির্দিষ্ট কারণ আমরা কেউই জানি না। আমরা কেউ ধারণাও করতে পারিনি যে, অর্পিতার নিজের প্রতি এই উদাসীনতা এতো দ্রুত হঠাৎ করেই তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটিয়ে দেবে।
গত ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮ রাতে অর্পিতার এপার্টমেন্টের দরজা খুলে, বাথরুমের বাথটাব থেকে জার্মান পুলিশ অর্পিতার মৃতদেহ উদ্ধার করেন। পুরো এপার্টমেন্টে ইলেকট্রিক লাইটস এর সুইচ বন্ধ এবং পোশাক পরিহিত অবস্থায় তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়। অন্ধকার ঘর ও বাথটাবে পোশাক পরিহিত অবস্থায় মৃতদেহ পাওয়ায় কেউ কেউ প্রচার করেছিলেন যে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। অনেকে এটাও বলেছিলেন যে, হয়তো কোন বিশেষ ধর্মীয় জংগী বাহিনীর দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে।
তদন্তের পরবর্তীতে জানা গেল অর্পিতার মৃত্যু দিনেরবেলায় ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ তিনি সবসময় এনার্জি সেভিংস নীতি মেনে চলতেন। যে এপার্টমেন্টে তিনি বাস করতেন সেখানে দিনেরবেলা কোনো আলো জ্বালানোর প্রয়োজন পড়তো না। ১৩ ডিসেম্বর তারিখ হোয়াটসএপে তাঁর ছোট বোনের সাথে টেক্সট মেসেজও করেছিলেন তিনি। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাথী ছোটবোনের এইচ,এস,সি ফরম ফিলাপের জন্য ১৭ ডিসেম্বর ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর কথাও জানিয়েছিলেন। দূর্ভাগ্য, অর্পিতার জীবনে আর ১৭ ডিসেম্বর আসে নি!
অর্পিতার একটি অভ্যাস ছিল- বাথরুমে দীর্ঘসময় ধরে স্নান করা। বাথটাবের গরম জলে শরীর ডুবিয়ে বাথটাবের পাশের সেলফে কিংবা ওয়াশিং মেশিনের উপরে মোবাইল রেখে ইউটিউবে গান শোনা। পরিচিত অনেকেরই এই অভ্যাস রয়েছে বলে জানি। কিন্তু দূর্ভাগ্য, তদন্তকারী পুলিশ অর্পিতার মৃতদেহ উদ্ধারের সময় তাঁর ব্যবহৃত মোবাইলটা বাথটাবের পানিতে পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে জার্মান ক্রিমিনাল পুলিশের তদন্ত এবং ফরেনসিক মেডিসিন চ্যারিটি ইনস্টিটিউট – মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় বার্লিন-এর ফরেনসিক (পোস্টমর্টেম) রিপোর্টে হত্যা বা অপমৃত্যু হয়েছে এমন সম্ভাবনা নেই বলে জানানো হয়। (সূত্র: অর্পিতার পরিবার)।
আমি ইতিপূর্বে আগের ফেসবুক পোস্টসমূহে লিখেছিলাম যে, বাঙালি ফ্যান্টাসিপ্রিয় জাতি। ব্লাকহোল, বিবর্তনবাদ মেনে না নিলেও সমুদ্রের পানি মন্ত্রের গুণে দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাবার গল্প, কোনপ্রকার পাওয়ার সাপ্লাই, অক্সিজেন মাস্ক ছাড়াই একজন ব্যক্তির মিল্কিওয়ে বা এন্ড্রোমিডা ঘুরে আসার মতো মুখরোচক ও গাঁজাখুরি গল্প এরা অনায়াসে গিলে ফেলে। তার পাশাপাশি বাঙালি হচ্ছে গুজব ছড়ানোর জৈবিক মেশিন। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে অথবা সিগারেট টানার সময় মাথায় কোন উদ্ভট কাহিনী চলে এলে সেই কাহিনীকে এরা মনগড়া কল্পকথা হিসেবে ছড়াতে পছন্দ করেনা বরং সত্যিকার ঘটনা বা ইতিহাস বলে চালিয়ে দিতে চায়। তখনই মূল সমস্যাটা ঘটে। বাঁকি জনতা বাস্তব চিন্তা থেকে সরে এসে ওই কল্পকথাকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করে। দেশের অনেক বড় বড় সেক্টরে তার প্রভাব পড়ে।
অর্পিতার মৃত্যু সংবাদ জানার পরে অনলাইনে, বিশেষত ফেসবুকে সংঘবদ্ধভাবে যেসব গুজব আর অপপ্রচার চালানো হয়েছে তার সবটাই মৃত অর্পিতাকে বার বার অপমানিত ও হত্যা করার সামিল। এমন একজনের পোস্টও আমার নজরে পড়েনি যেখানে অর্পিতাকে সম্মান করা কিংবা অর্পিতার প্রতি দেশে যে অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়েছিল যার প্রতিবাদ কিংবা বিচার দাবি করা হয়েছে। অর্থাৎ জীবিত থাকা অবস্থায় অর্পিতা যাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন অর্পিতার দুঃখজনক মৃত্যুর পর কেবলমাত্র ব্যক্তিবিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য কিছু সোকল্ড ‘মুক্তমনা‘ ও ‘প্রগতিশীল‘ নামধারী ফেসবুক ফেইমসিকার কল্পনাপ্রসূত গল্প হাজির করে অর্পিতা রায়চৌধুরীকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করে গেছেন। তাদের বিষয়ে আগামীতে ক্রমান্বয়ে লিখবো।
সত্য বড় নির্মম ও কঠিন হলেও সত্য এই যে, অর্পিতা আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু ক্ষণজন্মা অর্পিতা তাঁর এই ক্ষুদ্রসময়ের জীবনে যে আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করে তা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেমেছিলেন সেই সংগ্রামকে স্যালুট ও সম্মান জানাই। এই লেখাটা শুরু করেছিলাম ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসে, উদ্দেশ্য ছিল অর্পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এই লেখাটি পোস্ট করবো। মোবাইলে টাইপ করা ও নানানরকম ব্যস্ততার কারণে পোস্ট করতে বিলম্ব হয়ে গেলো। অর্পিতার জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়েই এই পোস্ট।
ভালোবাসা জানবেন অর্পিতা।