#কুলদা_রায়_সুপ্রীতি_ধর_অদিতি_ফাল্গুনী_গায়েন_এবং_নিধিরাম_সর্দার_দের_জ্বালাপোড়া
#মীর_মোনাজ_হকের_ভীমরতি
অর্পিতা মারা যাবার পর যারা মিথ্যা অপপ্রচার ও প্রপাগাণ্ডা চালিয়েছিলেন:
ফেইসবুকে কিছু পারভার্ট মানুষ বিশেষ করে মির মোনাজ হক, সুইডেনে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনাকারী ‘উমেনচ্যাপ্টার’ ওয়েবপোর্টালের মালিক কথিত নারীবাদী সুপ্রীতি ধর, সুপ্রীতি ধরকে সুইডেনে নিয়ে গিয়ে “বাংলাদেশে সুপ্রীতির জীবন বিপন্ন হবে” এরকম মিথ্যে তথ্য দিয়ে এসাইলাম আবেদনে সহযোগিতাকারী তাসলিমা মুনশেখ নামক এক নারী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রাপ্ত ‘গল্পপাঠ’ নামক সোকল্ড সাহিত্য পত্রিকার মালিক কুলদা রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নামধারী প্লেবয় ও অসংখ্য নারী কেলেংকারীর হোতা ‘তীরন্দাজ’ নামক সাহিত্য পত্রিকার মালিক ড. মাসুদুজ্জামান, নরওয়েতে আইকর্ন এর সহযোগিতায় এসাইলামপ্রাপ্ত রতন সমদ্দার ওরফে ‘সন্ন্যাসী রতন’, জার্মানীতে এসাইলামপ্রাপ্ত ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন নামক ব্লগারসহ বেশকিছু ‘মুক্তমনা’ নামধারী মানুষ (অন্যান্যদের নাম পরিচয় আগামীতে আস্তে আস্তে প্রকাশ করা হবে) অর্পিতার মৃতদেহ উদ্ধারের সংবাদ জানামাত্রই অর্পিতা রায়চৌধুরী খুন অথবা আত্মহত্যা করেছেন এবং এর জন্য জোবায়েন সন্ধিকে দায়ী করে অনবরত প্রচার প্রপাগাণ্ডা চালিয়েছেন।
‘অদিতি ফাল্গুনী গায়েন’, নামের একজন নারী লেখক গুজব ওঠান যে, অর্পিতা রায়চৌধুরী ‘উচ্চাভিলাসী, লোভী ও বিদেশে পাড়ি দেয়ার লোভে পড়ে দেশ ছেড়েছিলেন। অর্পিতা পড়াশোনা জানতেন না, অর্পিতা দেশে থাকতে তাঁতের শাড়ি পরতেন এবং বিদেশে গিয়ে মডার্ন ড্রেস পরতেন এমনকি অর্পিতা কম্পিউটার চালাতে জানতেন না বলেও মিথ্যা প্রপাগাণ্ডা চালিয়েছেন।
লোকমুখে শুনেছি, মেয়েরা একে অপরকে অনেক বেশি হিংসে করে। অদিতি ফাল্গুনী গায়েন বোধহয় তারই আরেকটি বড় প্রমাণ রেখেছেন অর্পিতার প্রতিভা এবং পেনের স্কলারশিপ পাওয়ার হিংসায় পুড়ে। ফাল্গুনী গায়েনের মনে রাখা উচিত ছিলো যে, জার্মান পেন কোন বাংলাদেশি সংগঠনের মতো ভুদাইদের আস্তানা নয় যে অযোগ্য অশিক্ষিত কাউকে উচ্চমানের লেখিকার মর্যাদা দেবে।
অপরদিকে ‘নিধিরাম সর্দার’ নামক ফেইক আইডিধারী মৃতব্যক্তির ব্যক্তিগত ছবি প্রকাশ করে প্রচার চালান যে, নবযুগ ব্লগ এবং অংশুমালী সাহিত্যপত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক জোবায়েন সন্ধিই হলেন অর্পিতার হত্যাকারী। তিনি শুধু তার ফেইসবুক ওয়ালে এই দাবী জানিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি। আরও অনেকের ফেইসবুক পোস্টে মন্তব্যের মাধ্যমে অন্যদেরকেও প্রাণপনে উৎসাহিত করেছেন তার দ্বারা সৃষ্ট এই গুজব গিলে খাওয়ার জন্য। এবং সবক্ষেত্রেই অতি উৎসাহী হয়ে অপপ্রচার, প্রপাগাণ্ডা ও উস্কানি দেয়ার কাজে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত ছিলেন বার্লিনের মীর মোনাজ হক।
ইতিমধ্যে জার্মান ক্রিমিনাল পুলিশ এবং ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত তদন্তে অর্পিতার অপমৃত্যু হয় নি। অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর পেছনে ৩য় কোনো ব্যক্তির সংশ্লেষ বা কারণ নেই, এটা প্রকাশ হবার পরপরই অনেকে তাদের মিথ্যা তথ্যে ভরপুর লেখাগুলো ফেসবুকের ওয়াল থেকে অনলি মি, কেউবা ফ্রেন্ডস অনলি, কিংবা কেউবা সরিয়ে ফেলেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো অর্পিতার মৃত্যুর পরে তাদের এই হিংসাত্মক আচরণের কারণ কী? তবে কি পেন-এর স্কলারশিপ বঞ্চিত হওয়া? তবে কি জার্মানিতে যেতে না পারার দুঃখবোধ ও হতাশা?
জার্মানিতে বসবাসকারী কে এই মীর মোনাজ হক?
বার্লিন প্রবাসী নিজেকে ’মুক্তিযোদ্ধা‘ দাবীকারী একজন স্যোশাল টাকা সেবী (যারা সরকারের কাছ থেকে পেনসন ও থাকা খাওয়ার নামে কিছু টাকা ও একটি ঘর ভিক্ষা হিসেবে নিয়ে থাকে), যার নাম ‘মীর মোনাজ হক’। তিনি অর্পিতার মৃত্যুর সংবাদ জানামাত্রই একে আত্মহত্যা কিংবা হত্যাকাণ্ড বলে প্রচার প্রপাগাণ্ডা চালিয়ে জোবায়েন সন্ধিকে ফাঁসাতে চেয়েছেন রহস্যময় কারণে। আমি বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পেরেছি, মীর মোনাজ হক অনেকদিন ধরেই নানানভাবে অর্পিতার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে এসেছিলেন। বার্লিনে প্রায়শই তাঁকে বিরক্ত করতেন। এমনকি মাঝেমধ্যে অর্পিতার এপার্টমেন্টের নীচে কলিংবেলে পর্যন্ত টোকা দিয়েছেন। কিন্তু অর্পিতা তাকে কখনোই একজন পরিচিত লোকের মতো পাত্তা দেন নি। হতে পারে, সেই জায়গা থেকে সৃষ্ট কোন জ্বালাপোড়ার দরুণ মিস্টার মোনাজ হক অর্পিতা এবং তার ঘনিষ্ঠজন জোবায়েন সন্ধি সম্পর্কে এধরনের অশ্লীলতা ছড়ানোর প্রয়াস পেয়েছেন।
৬৮ বছর বয়সী এই মীর মোনাজ হক এ পর্যন্ত কাগজে-কলমে ৫টি বিয়ে করেছেন। কাগজ-কলমের বাইরে লিভিং টুগেদার করেছেন ২ ডজনেরও অধিক নারীর সঙ্গে। কাগজ-কলমে বিয়ে করা প্রত্যেকটি স্ত্রীই কোন না কোন সময় তাকে ছেড়ে চলে গ্যাছে, তার চরিত্রগত সমস্যার কারণে। তার চার নাম্বার স্ত্রী ছিলেন একজন টার্কিশ (তুরস্কের বংশোদ্ভূত) নারী। এই ঘরে মীর মোনাজের ২টি কন্যা রয়েছে। টার্কিশ এই নারী (মোনাজের সাবেক স্ত্রী) মীর মোনাজ হককে যে কি পরিমাণ নাকানিচুবানি খাইয়ে গিয়েছে, সে গল্প অন্য একদিন করবো। হয়তো বর্তমান ৫ নাম্বার বউয়ের (মোনাজ হকের দীর্ঘ বিবাহিত ও লিভিং টুগেদার জীবনে এখনোব্দি টিকে থাকা তিনিই একমাত্র বাঙালি) পাশাপাশি তিনি অল্পবয়সী তরুণী অর্পিতার প্রেমে পড়েছিলেন আবার, যাকে বলা যায়, বুড়ো বয়সে ভীমরতি।
হিংসাত্মক আচরণ হোক, ঠাণ্ডা মাথার ষড়যন্ত্র হোক, আর গুজব ছড়ানোর পৈশাচিক আনন্দ থেকেই হোক। উদ্দেশ্য যাইহোক না কেন এই ধরনের মিথ্যাচার সমাজে অনেক বড় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। বিশেষ করে সেইসব মানুষ যারা কিনা অর্পিতাকে চেনেইনা, জোবায়েন সন্ধিকেও ঠিকমতো চেনে না, জানেনা, তারা অনায়াসেই বিশ্বাস করবে যে অর্পিতার মৃত্যু একটি হত্যাকাণ্ড কিংবা আত্মহত্যা! অর্থাৎ জোবায়েন সন্ধিই অর্পিতার ‘খুনি‘। তারা হয়তো সারাজীবনই এই ধারণা নিয়ে বেঁচে থাকবে, কারণ সত্য উদঘাটনের পরবর্তী খবরগুলো কোনভাবে তাদের নজরে আনতে দিবে না এইসব মীর মোনাজ হকের মতো মানুষরা।
২০১৯ সালে ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে টার্কিশ এয়ারলাইনের একটা এয়ারক্রাফটে বার্লিন থেকে অর্পিতার মৃতদেহ কফিনে মুড়ে স্পেশাল ফ্রিজিং কম্পার্টমেন্টে ঢুকিয়ে ঢাকা পর্যন্ত পাঠানোর ব্যবস্থা করে জার্মানির বার্লিনের বিখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠান মৃতদেহ সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক পরিবহণে নিয়োজিত কাজে নিয়োজিত। এই প্রতিষ্ঠান থেকে মৃতদেহ বাংলাদেশে পাঠানোর যাবতীয় অফিসিয়াল কাজকর্ম শেষ করে গতমাসে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ টার্কিশ এয়ারলাইনের একটা এয়ারক্রাফটে বিশেষ ব্যবস্থায় অর্পিতার মৃতদেহ কফিনে মুড়ে বার্লিন থেকে ঢাকার উদ্দেশে প্রেরণ করে। ফ্লাইট শিডিউল অনুযায়ী অর্পিতার মরদেহের কফিন ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছার কথা ২ ফেব্রুয়ারি বেলা ১টা ৫৫ মিনিটে। সে অনুযায়ী অর্পিতার পরিবার কফিন গ্রহণের জন্য নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই বিমান বন্দরে উপস্থিত হোন। সাথে ছিলেন জার্মান পেন সেন্টার থেকে অর্পিতার কফিন তাঁর পরিবারের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্বে নিয়োজিত জনাব মুজিবুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি পারভেজ হাশেম, অংকুর ও চারদিক প্রকাশনীর প্রকাশক ও মালিক মেসবাহউদ্দিন আহমেদ, সংখ্যালঘু ও উপজাতীয় সম্প্রদায় সংগঠনের নেতা সমীরণ সিংহ, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক ইমাম গাজ্জালী, এবং আমরা কয়েকজন ব্লগার। ছিল অংশুমালী সাহিত্য পত্রিকার সাথে যুক্ত বন্ধুরা। আমরা সবাই অর্পিতার প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন ও এয়ারপোর্টে অর্পিতার পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য পরিকল্পনা করেছিলাম।
যথাসময়ে টার্কিশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ল্যান্ড করলো শাহজালাল এয়ারপোর্টে। আমরা এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আগেই জেনেছিলাম যে, প্রথমে নামবেন যাত্রীরা, তারপর ব্যাগেজ এবং অন্যান্য মালামাল নামানো হবে, সবশেষে নামবে মৃতদেহের কফিন। মৃতদেহ রিসিভ করতে ভেতরের অফিস পর্যন্ত যেতে পারবেন শুধুমাত্র অর্পিতার বাবা এবং তাঁকে সহযোগিতা করার জন্য একজন ব্যক্তি।
সঙ্গতকারণেই অর্পিতার বাবার সাথে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পারভেজ হাশেম গেলেন হ্যাঙার গেইটের ভেতরকার অফিসে। আর আমরা সবাই বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে অর্পিতার বাবা এবং পারভেজ হাশেম শূন্য হাতে বাইরে বেরুলেন। তাঁদের কাছ থেকে এটা জেনে খুবই অবাক হলাম যে, অর্পিতার মৃতদেহ এই এয়ারক্রাফটে আসেনি। কেন আসেনি, এসব প্রশ্নের কোন উত্তর পাওয়া গেলোনা। এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ এবং বিমানের কেবিন ক্রু, এদের কেউই কোন খোঁজ খবর দিতে পারলেন না। তখনকার সেই অনাকাঙ্ক্ষিত জটিল পরিস্থিতিতে বুকের বাম পাশে এক অচেনা ধরনের অসহায়বোধ করছিলাম, যে অসহায়ত্ব একেবারেই নতুন ছিল আমার জন্য, সে এক অজানা অনুভূতি। অতঃপর আমরা টার্কিশ এয়ারলাইন্স-এর অথরাইজড অফিসে (গুলশানে) ফোন করলাম। তাদের কাছেও কোন সন্তোষজনক জবাব পেলাম না।
ওদিকে জার্মানিতে অবস্থানরত অর্পিতার কফিন প্রেরণকারী অফিসও সাপ্তাহিক হলিডের (শনিবার) কারণে বন্ধ থাকায় আমরা ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ি। জার্মানিতে ফোন করে জানতে পারি, মরদেহ পরিবহণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান শুক্রবার সকালেই অর্পিতার কফিন বিমানে তুলে দিয়ে বার্লিন পুলিশকে নিশ্চিত করেছে। তার মানে পরদিন (শনিবার) বাংলাদেশ সময় বেলা ১টা ৫৫ মিনিটে বাংলাদেশে পৌঁছানোর কথা। ঢাকাস্থ টার্কিশ এয়ারলাইন্স থেকেও অর্পিতার বাবাকে পূর্বাহ্নে ফোন করে ফ্লাইট নম্বরসহ একই তথ্য নিশ্চিত করে যথাসময়ে বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়ে কফিন গ্রহণের অনুরোধ করা হয়েছিল। অথচ নির্ধারিত বিমানে অর্পিতার কফিন নেই!
আমরা টার্কিশ এয়ারলাইন্স-এর গুলশান অফিসে আবারো আলোচনা করলাম এবং এই আশা নিয়ে কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার অভিনয় করলাম যে, হয়তো তুরস্কের ইস্তানবুলে ট্রানজিটের সময় কোন কারণে কফিনটি পরবর্তী প্লেনে ওঠানো হয়নি বা ছাড়া পড়েছে। তবে আগামীকাল একইসময়ের একইফ্লাইটে কফিন পৌঁছে যাবে ঢাকায়। অর্পিতার পরিবার সেদিন কয়েকটন দুঃখ নিয়ে ফিরে যান তাদের গ্রামের বাড়ি মফস্বলে। পরেরদিন বাংলাদেশ সময় সকাল ৭ টায় এডভোকেট পারভেজ হাশেম টার্কিশ এয়ারলাইন্স অফিসে ফোন করে জানতে পারলেন যে, তুরস্কের ইস্তানবুল এয়ারপোর্ট থেকে বাংলাদেশগামী ফ্লাইটে একটা কফিন তোলা হয়েছে। তবে কফিনে থাকা মৃতব্যক্তির নাম তারা জানাতে পারেন নি। অর্থাৎ শতভাগ নিশ্চিত হওয়া না গেলেও মনের কোণে ক্ষীণ আশা নিয়ে আমরা আবারও উপস্থিত হলাম এয়ারপোর্টের সেই হ্যাঙার গেইটে।
৩ ফেব্রুয়ারি বেলা ১টা ৫৫ মিনিটে টার্কিশ এয়ারক্রাফটটি যখন ঢাকা এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলো, তখন আমাদের মনে সঞ্চিত ক্ষীণ আশার প্রদীপ আবারও বড় শিখায় রূপ নিলো। গতদিনের মতোই অর্পিতার বাবা এবং এডভোকেট পারভেজ হাশেম হ্যাঙার গেইট দিয়ে বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকে গেলেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর তাঁরা অর্পিতার কফিন নিয়ে বাইরে বের হলেন। অর্পিতা বাবা তাঁর মেয়ের মৃত্যুর খবর পেয়েছিলেন আরও দেড়মাস আগে। তাই তিনি ওইসময় তাঁর বুকের উপচে পড়া আবেগটা হয়তো ভেতরেই ধরে রাখতে পেরেছিলেন, হয়তো যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যই তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন।
পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে অর্পিতাকে বাংলাদেশের মাটিতে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। অর্পিতার বাড়ি পর্যন্ত লাশ বহনের জন্য জার্মান পেন সেন্টারের ব্যবস্থাপনায় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের ফ্রিজিং এম্বুলেন্স প্রস্তুত ছিল। অর্পিতার বাবা ও পরিবারের সদস্যদের বহনের জন্য আলাদা মাইক্রোবাস প্রস্তুত ছিল। কিন্তু অর্পিতার বাবা কোনভাবেই মেয়ের কফিন আলাদা গাড়িতে ছেড়ে দিয়ে অন্য গাড়িতে চড়তে রাজি হলেন না। তিনি কফিনবাহী এম্বুলেন্সে চড়েই বাড়ি পর্যন্ত ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাই আমরা তাঁকে লাশবাহী ফ্রিজিং এম্বুলেন্সে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বিদায় নিলাম। আর অর্পিতার মামা ও পরিবারের অন্যান্যরা অন্য মাইক্রোবাসে চড়ে অর্পিতার বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলেন।
এদিকে অর্পিতার বাবা উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় আগে থেকেই তাঁদের এলাকার শ্মশানে অর্পিতার মরদেহ দাফন করার জন্য জায়গা বরাদ্দ করে রেখেছিলেন। তিনি অর্পিতার মৃতদেহ দাহ করতে দিতে রাজি নন। কারণ, তাঁর মেয়ে ধর্মীয় এসব প্রথায় বিশ্বাসী ছিলেন না। মেয়ের বিশ্বাসের প্রতি সম্মান জানিয়ে সকলপ্রকার বিধিনিষেধকে উপেক্ষা করে তিনি অর্পিতাকে মাটিতেই সমাধিস্থ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাঁর স্বপ্ন, অর্পিতার সমাধির ওপর একটা মনুমেন্ট তৈরি করা। মরদেহ বাড়িতে পৌঁছার পর নেত্রকোণার উপজেলা নির্বাহী অফিসার, পুলিশ সুপার এবং থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে অর্পিতার মৃতদেহ দাফনের কার্যক্রম শুরু করা হয়।
কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে এলাকার কিছু মুসলিম যুবক আকস্মিকভাবে অর্পিতার কফিনের কাছে এসে গণ্ডগোল ও ঝামেলা সৃষ্টি করে। তারা অর্পিতার কফিন খোলার জন্য চাপ দিতে থাকে। পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে গেলে প্রশাসন ও পুলিশের সহযোগিতায় অর্পিতার কফিন খুলতে বাধ্য হয় তারা।
জার্মানী থেকে একাধিকবার অর্পিতার কফিন খোলা কিংবা তাঁর মরদেহ না দেখার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল। তারা হয়তো চেয়েছিলেন অর্পিতার স্বজনদের স্মৃতিতে যেন তাঁর উজ্জ্বল হাস্যময়ী মুখখানিই থাকুক, ক্ষতিগ্রস্থ লাশের চেহারা দেখে তাঁরা যেন নতুন করে কোনো মানসিক আঘাত না পান। কিন্তু স্থানীয় মুসলিম ধর্মীয় উগ্রবাদীদের চাপে পড়ে অর্পিতার বাবা বাধ্য হোন কফিন খুলে সবাইকে অর্পিতার মৃতদেহ দেখাতে। এরপর ওইসব ধর্মীয় উগ্রবাদীরা উপস্থিত হিন্দুদেরকেও উস্কানি দিয়েছিলো হিন্দুর মেয়েকে কেন কবর দেয়া হবে, তারা যেন অর্পিতার বাবাকে বাধ্য করে এই মৃতদেহ শ্মশানে পুড়িয়ে ফেলার জন্য। অবশেষে পুলিশ ও প্রশাসনের আন্তরিক সহযোগিতায় অর্পিতার পরিবার সফল হোন তাঁদের মেয়ের মৃতদেহ নির্ধারিত জায়গায় দাফন করাতে। অর্পিতা পরকালে বিশ্বাস করতেন না, তিনি বিশ্বাস করতেন না কোনো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। কিন্তু এলাকা ও সমাজের কারণে তাঁর পরিবার তাঁদের মানসিক স্বস্থির জন্য মেয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কোনরকম বাধা-বিঘ্ন ছাড়াই সফলভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন।
১৮ ডিসেম্বর অর্পিতার লাশ উদ্ধার করা হয়। জার্মান পেন সেন্টারের ওয়েবসাইটের ১০ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে সর্বপ্রথম জার্মান পুলিশ ও ফরেনসিক রিপোর্টের আলোকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে, যেখানে তারা অর্পিতার মৃত্যুর পেছনে দ্বিতীয় বা তৃতীয় কোন ব্যক্তির ভূমিকা নেই বলে জানানো হয়।
আপনারা যারা ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮ থেকেই প্রচার করে আসছেন যে, অর্পিতার মৃত্যুর পেছনে জোবায়েন সন্ধি বা অন্য কোন তৃতীয় পক্ষের হাত আছে, অথবা অর্পিতা আত্মহত্যা করেছে। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে যে, অর্পিতার মৃত্যু সংবাদ প্রকাশের সাথে সাথে আপনারা কিসের ভিত্তিতে এই অপপ্রচার চালিয়ে আসছিলেন? অনেককেই দেখেছি কিছু ফেইম সিকারের মনগড়া কথাকে বিশ্বাস করে, নিজের চিন্তাশক্তি ব্যবহার না করেই আপনারা গতানুগতিক স্টাইলে আমাদের সামনে যে বলদামি উপস্থাপন করলেন, তারপরও কি আপনারা নিজেদেরকে মুক্তমনা প্রগতিশীল বলে দাবী করবেন?
দু’একজন গুজব ছড়িয়েছে। আর বাকি শতশতজন আবালের মতো সেই গুজব গিলে ফেলেছেন। গিলে ফেলার পাশাপাশি তারা দ্বিগুণ আগ্রহে সেইসব গুজব প্রমোট করেছেন সামাজিক গণমাধ্যমে। আপনারা কি যে কোন অজুহাতেই বিবেক-মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে আলোচনায় উঠে আসতে চান শুধুমাত্র নিজের নাম ফলানোর জন্যে? আপনাদের মাথার ভেতরে কোন সৃষ্টিশীলতা নেই সেটা নাহয় বুঝলাম, কিন্তু তাই বলে একটা সহজ-সরল বিষয়কে ত্যানা পেঁচিয়ে বিকৃত ও অশ্লীল বানিয়ে ছাড়বেন? এসব বাদ দিয়ে নিজের সৃষ্টিশীলতাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করুন, কাজে দেবে। ভণ্ডামি না করলেও আলোচনায় উঠে আসা যায়। যারা দাবী করেছিলেন যে, অর্পিতা অশিক্ষিত মেয়ে ছিলো, কম্পিউটারও চালাতে পারতোনা। আপনারা কি জানেন যে আপনারা যাদের কথা শুনে নাচানাচি করেন, সেইসব ব্লগার লেখকরা অর্পিতার মতো স্কলারশিপ পায় নি? পৃথিবীর অন্যতম মেধাবীদের দেশ জার্মানির কর্তাব্যক্তিরা একজন অশিক্ষিত, কম্পিউটারে অদক্ষ কোনো মানুষকে (অর্পিতাকে) স্কলারশিপ দিয়ে দেবে কোন মান বিচার না করেই? এধরনের কথা শুধু আপনাদের মতো ভুদাই শ্রেণীর লোকের মুখ দিয়েই বের হতে পারে। ছি!!
অর্পিতা যখন বাংলাদেশে সমস্যার মধ্যে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন, তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? এমনকি অর্পিতার মৃতদেহ জার্মানি থেকে বাংলাদেশে ফেরৎ আনার জন্য কি আপনারা কোনপ্রকার সাহায্য করেছেন? ওর মরদেহ জার্মানিতে দেড় মাসেরও অধিকসময় ধরে সংরক্ষিত ছিলো। এই সংরক্ষণের পেছনে প্রতিদিন যে কাড়ি কাড়ি অর্থ খরচ হয়, সে খবর নিয়েছেন? জার্মান পুলিশ ও ফরেনসিক বিভাগ অর্পিতার মৃতদেহ সেখানেই সৎকার করে তাঁর ছাই পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন অর্পিতার পরিবারকে। কিন্তু এই পরামর্শকে নাকচ করে মৃতদেহ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সে বিষয়ে আপনাদের বিন্দুমাত্র ধারণা আছে? সৎসাহস থাকলে জানাবেন।
সাধারণত বিদেশ থেকে আসা কোন মৃতদেহ মৃতব্যক্তির বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয়না। ব্যতিক্রম ছিল অর্পিতা রায়চৌধুরীই। কারণ অর্পিতার মরদেহ বিশেষভাবে যত্ন করে তাঁর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সবকিছুর বন্দোবস্ত করেছে জার্মান পেন সেন্টার। অনুরোধ, আপনারা প্রগতিশীল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন। অযথা ত্যানা না পেঁচিয়ে অন্তত সত্য উদঘাটন হওয়া পর্যন্ত তাদের কর্মকাণ্ডের উপর ভরসা রাখুন। হিংসার বদলে ভালবাসতে শিখুন।
অর্পিতার দাফন কার্যাদি শেষ হবার পরেও অনলাইনের নামধারী কিছু ফেসবুকার তাঁর পরিবারকে ফোন করে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছে এই বলে যে, জার্মান পুলিশ ও জার্মান ফরেনসিক এক্সপার্টদের রিপোর্ট সঠিক নাও হতে পারে, তাই তাদের উচিত বাংলাদেশেও তাঁর মৃতদেহের পোস্টমর্টেম করা এবং পাশাপাশি জার্মান পেন-এর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা দায়ের করা।
একটা জিনিস আমরা সকলেই জানি, জার্মান পুলিশ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ ও সৎ ও কঠোর বাহিনী। জার্মান চিকিৎসা শাস্ত্র, চিকিৎসা প্রযুক্তি এবং চিকিৎসকরাও পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠদের অন্যতম। আর যে দেশে ২০০ টাকা ঘুষ দিলেই জীবিত মানুষের ডেথ সার্টিফিকেট পাওয়া যায়, যে দেশের পুলিশ বাহিনী টাকা খেয়ে নিজেরাই সাত-সাতজন নিরপরাধ মানুষকে অবলীলায় মেরে ফেলতে পারে, অথচ সেই দেশের প্রশাসন এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাকে তুলনা করছেন জার্মান পুলিশ ও চিকিৎসকদের সাথে!!! এটা শোনার পর আমি হস্তমৈথুন করার মতো শিহরিত হয়ে উঠেছিলাম। আপনাদের যদি নিতান্তই দু’এক বেলা মাংস ভাত খেতে ইচ্ছে হয়, তাহলে আমাকে জানাবেন। আমিই দু’তিন কেজি মাংস কিনে পাঠিয়ে দেবো আপনাদের। দয়া করে ছ্যাঁচড়মি আর আবলামি করা থেকে বিরত থাকুন।
আমি একইসঙ্গে হতবাক হয়েছি, হতাশ হয়েছি, আর ঘৃণা করতে শিখেছি নিজের রক্তকে। যখন আমাদের দেশের সুবিধাবাদী সোকল্ড মুক্তমনা নামক ব্লগারদের ভণ্ডামি দেখেছি। জার্মান ক্রিমিনাল পুলিশ হচ্ছে বাস্তব পৃথিবীর পুলিশ। আর আপনারা যারা ফেইসবুকিও পুলিশের রোলে অভিনয় করেন, আপনাদের ছেলেমানুষিপনা, যুক্তিবাদ ও দূরদর্শিতার দৌড় আমার কাছে যতোটা হাস্যকর মনে হয়েছে ঠিক ততোটাই আপনাদের হিংসার বহিঃপ্রকাশ আমাকে চরমভাবে আহত করেছে। একইসাথে একইসময়ে আপনারা তিন-চারটা নৌকায় পা দিয়ে রাখেন। দ্বিমুখী সাপও আপনাদের পাশে নিরীহ গোবেচারা বনে যায়। বাংলার চটি লেখকদের মতোই আপনাদের বিশেষণ আমি দিতে পারি বিশিষ্ট গুজব লেখক।
যারা সরাসরি নিজেদের ফেইসবুক ওয়ালে কোন পোস্ট লেখেননি, তাদেরও দেখেছি অন্যদের বিভ্রান্তিমূলক পোস্টের নিচে নিজেদের অপরিণত চিন্তা থেকে উঠে আসা মন্তব্যগুলো বমি করতে। আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু,গুরুজন এবং প্রিয় নারীবাদীদেরকেও দেখেছি তাদের ইমম্যাচিউরিটি প্রাকটিস করতে। অশিক্ষিত হুজুগে বাঙালির মতো প্লাস্টিকের মুলার পেছনে দৌড়ে মরেছেন।
আমার জার্মানিতে অবস্থানকালীন সময়ে মাঝে মধ্যেই অর্পিতার সাথে ফোনে আলাপ হতো। অর্পিতা বেশ কয়েকবার আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন ‘মীর মোনাজ হক‘ নামের লোকটাকে আমি চিনি কিনা। আমি মীর মোনাজ হক সম্বন্ধে যা জানি তা অর্পিতার সাথে শেয়ার করেছিলাম। বলেছিলাম মীর মোনাজ একজন চাটুকার স্বভাবের লম্পট ও ধান্দাবাজ লোক, তার কাছ থেকে দূরে থাকতে। আরও বলেছিলাম মীর মোনাজের নারীপ্রীতি এবং বৈচিত্র্যময় বৈবাহিক ও লিভিং টুগেদারের জীবন সম্পর্কে। উত্তরে অর্পিতাও আমাকে বলেছিলেন যে, তাঁর ষষ্ঠইন্দ্রিয় একটু বেশিই প্রখর,তাই মোনাজ হকের কথা বার্তা ও চোখের চাউনিতে তিনি একইরকম আন্দাজ করতে পারতেন, ঠিক যেরকম তিনি দেখতে পেতেন বাংলাদেশের ছাত্রলীগ নামধারী ওই ধর্মীয় নরপিশাচগুলির চোখে, যারা তাঁকে বাংলাদেশে পাশবিক নির্যাতন করেছিলো।
আমি জার্মানি ছাড়ার আগেই জেনেছিলাম, অর্পিতাকে মীর মোনাজ হক প্রায়শই অনুসরণ করতেন,তার সাথে ফ্ল্যার্ট করার চেষ্টা করতেন। অর্পিতা যে এলাকায় থাকতেন, মীর মোনাজ হকও নাকী সেখানে ওৎ পেতে থাকতেন অর্পিতার সাথে দেখা কিংবা কথা বলার জন্য, অথচ মোনাজ হক বার্লিন শহর থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টার দূরত্বে বসবাস করতেন। অর্থাৎ অর্পিতার সাথে মোনাজ হকের দেখা হবার কোনো সম্ভাবনা জিরো পার্সেন্ট ছিল, যদিনা মোনাজ হক নিজে থেকে অর্পিতার সাথে দেখা করার জন্য তাঁর পেছনে ওৎ পেতে থাকেন। অর্পিতাকে কফি এবং লাঞ্চ অফার করতেন প্রায়ই। অর্পিতা কফি খেতে আপত্তি জানিয়ে ‘কাজ আছে‘ বলে মোনাজ হককে এঁড়িয়ে যেতে চেষ্টা করতেন, তখন মনাজ হক উ-বান স্টেশন (জার্মান আন্ডারগ্রাউন্ড রেলস্টেশন) পর্যন্ত অর্পিতার সাথে হেঁটে যেতেন। অর্পিতার সাথে ফোনে আলাপের সময় আমার মনে হতো তিনি আতংকে রয়েছেন মীর মনাজকে নিয়ে।
কারণ অর্পিতার কাছ থেকে আমি এটাও শুনেছি যে, মোনাজ হক নাকি অর্পিতার বাসার কলিংবেলে নক কছিলেন। অর্পিতা তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো তিনি কখনোই দরজা খোলেননি। এরপর পথেঘাটে দেখা হলেই মোনাজ হক অর্পিতার কাছে তাঁর মোবাইল ফোন নাম্বার চাইতেন। ‘মোবাইল সিম কিনিনাই‘ কিংবা ‘মোবাইল নং ইউস করিনা‘ ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে অর্পিতা এঁড়িয়ে চলতেন মোনাজ হককে। এরপর এই লোক অর্পিতার ফ্লাটের টেলিফোন নম্বর নেওয়ার চেষ্টাও চালিয়েছিলেন, কিন্তু অর্পিতা তাকে কখনই ফোন নং জানান নি। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে তাঁর উপর মানসিক নির্যাতন চালিয়ে আসছিলেন মীর মনাজ হক, যা রীতিমতো একটা ক্রিমিনাল অফেন্স।
সংগতকারণেই যখন আমি অর্পিতার মৃত্যু সংবাদ জানতে পাই, তখন প্রথমেই আমার সন্দেহ হয়েছিলো যে এটা আত্মহত্যা হলেও হতে পারে। জার্মানিতে দীর্ঘদিন ধরে সিকিউরিটি ফোর্স এবং মানবাধিকার বিষয়ক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকায় আমার স্পষ্ট জ্ঞান ছিলো জার্মান ক্রিমিনাল পুলিশের তদন্তের ধরন ও ক্ষমতা সম্পর্কে। তাই অন্ততপক্ষে পুলিশ তদন্ত ও ফরেনসিক রিপোর্ট পাওয়ার আগ পর্যন্ত কোনভাবেই আমি আন্দাজে নিজের চিন্তা ভাবনাকে গুজবের মতো ছড়িয়ে দেওয়াটাকে সমীচীন মনে করিনি। আমি অপেক্ষা করেছিলাম জার্মান ক্রিমিনাল পুলিশের তদন্ত শেষ ও ফরেনসিক রিপোর্ট জানার জন্য। ফরেনসিক রিপোর্ট কিংবা ক্রিমিনাল পুলিশ যদি এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে ঘোষণা করতো, তবে আমার প্রথম সন্দেহের তালিকায় থাকতেন মীর মোনাজ হক নামের এই ব্যক্তি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম যে, তাঁর মৃত্যু যদি আত্মহত্যা হয়ে থাকে তাহলে জার্মান ক্রিমিনাল পুলিশকে আমি আমার সন্দেহের ব্যাপারে অবগত করবো। আমার আরেকজন বন্ধুর সম্পর্কেও অর্পিতা প্রায় একইরকম ধারণা পোষণ করেছিলেন, যা আমাকে একইসঙ্গে অনেক অবাক ও আহত করেছিলো। সেই মানুষটিকেও অর্পিতা অনেকদিন ধরে এঁড়িয়ে চলছিলেন। বার্লিনের ‘জুওলোগিশার গার্টেন‘-এ আমার সেই বন্ধুর সাথে অর্পিতার আকস্মিকভাবে দেখা হওয়ার পর অর্পিতা আমার ওই বন্ধুটিকে না দেখার ভান করে সটকে পড়েছিলেন। যা আমার সাথে নভেম্বর মাসেই জানিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, আমার ওই বন্ধুটিকে দেখলে তিনি নাকি অস্বস্থিবোধ করেন। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর অস্বস্থির কারণ আজও জানতে পারিনি।
জার্মানি থেকে আমি দেশে আসার আগে অর্পিতা বলেছিলেন আমাকে, “দাদা, আপনি তো চলে যাচ্ছেন, আর কখনওই বোধহয় দেখা হবেনা।” প্রত্যুত্তরে আমি বলেছিলাম, দেখা হবে। হয়তো জার্মানিতে, নাহয় অন্য কোন দেশে। আমি আবার ফিরে আসবো ইউরোপে, তখন দেখা হবে।
অর্পিতার এই মর্মান্তিক পরিণতি আমার কাছে কল্পনাতীত ছিলো। অর্পিতার কথাই সত্যি হয়েছে। আমি আর দেখতে পাইনি তাঁকে। এয়ারপোর্টে কফিন খুলে অর্পিতাকে দেখার কোন উপায় ছিলোনা। কফিন না খুলতে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল জার্মানির ফরেনসিক বিভাগ থেকে। তাছাড়া মৃত অর্পিতার মুখ দেখার মতো মানসিক শক্তিও ছিলো না আমার। দাফনকাজ সম্পন্ন হবার সময় তাঁর এলাকার সেইসব উগ্র ধর্মীয় পাণ্ডারা অর্পিতার বাবাকে জোর করে বাধ্য করে কফিন খুলতে। অর্পিতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হবার অপেক্ষা করছিলাম। যদিও আমি, অর্পিতা বা আমরা মুক্তমনারা কেউই এই প্রথায় বিশ্বাসী নই। তবে অর্পিতার বাবা, তাঁর পরিবার বিশ্বাস করে এই প্রথায়। এজন্য তাদের কর্মকাণ্ডে কোন বিঘ্ন ঘটুক আমি-আমরা কখনওই তা চাইনি।
যেসকল হিপোক্রেট ব্লগার দুঃসময়ে দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের ব্যর্থতার গ্লানি ঢাকতে কিংবা নিজেদের বিফলতার জ্বালাপোড়ায় ঠাণ্ডা পানি ছিটাবার ভ্রান্ত লক্ষ্যে একজন মৃত ব্যক্তির আবেগ ও সম্মান নিয়ে নোংরা খেলায় মত্ত হয়েছিলেন, তাদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন করবো আমি। জবাব দিতে হবে আপনাদের প্রত্যেকটা পদক্ষেপের।