আকাশ মালিক কিছুদিন যাবত তাঁর গবেষণার ফল ‘হিন্দুধর্মের ইতিবৃত্ত’ নামে লম্বা সিরিজে প্রকাশ করছিলেন। আকাশ মালিক একজন বিখ্যাত ধর্ম-গবেষক, তাই তাঁর লেখায় বেশ কিছু অংশ বোধগম্য না হলেও আশায় ছিলাম যে আগামী পর্বগুলিতে সম্ভবত তিনি সেই সমস্যাগুলির সমাধান দিতে পারবেন। সম্প্রতি তাঁর সিরিজটি সমাপ্ত হওয়ায় সে সম্ভাবনা আর থাকছে না। তাই ঐ লেখাটি বিষয়ে আমার মনে যেসব সংশয়ের উদয় হয়েছে সেগুলি জনসমক্ষে পেশ করছি। আশা রাখি পণ্ডিত ব্যক্তিরা সমবেতভাবে সেগুলির সমাধান করে দেবেন।
১) প্রথম সংশয় হিন্দুধর্ম শব্দটি নিয়ে। লেখক যে অর্থে হিন্দুধর্ম শব্দটি ব্যবহার করেছেন সেটি আদৌ কোনো ধর্মগ্রন্থে সে অর্থে প্রযুক্ত হয় না। আদি অর্থ অনুসারে যারা ইন্দ্রপূজক তারাই হিন্দু। কিন্তু ইন্দ্রদেবতার পূজা বহুকাল আগেই লুপ্ত হয়ে যাওয়ায় ‘হিন্দুধর্ম’ শব্দটিই অর্থহীন হয়ে গেছে। বর্তমান লেখাটিতেও আকাশ মালিক ইন্দ্রপূজকদের ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা করেননি। বস্তুত তার প্রয়োজনীয়তাও ছিলনা।
লেখক যাকে ‘হিন্দুধর্ম’ বলে চিহ্নিত করে আলোচনা করেছেন তা আসলে একাধিক ধর্মের সমাহার, যারা প্রত্যেকেই নিজেদের হিন্দুধর্ম বলে দাবী করে ঠিক যেমন ইসলাম নিজেকে ইব্রাহিমের ধর্ম দাবী করে থাকে।
২) ইতিবৃত্ত শব্দটিও লেখার সঙ্গে অনুকূল নয়। লেখক যেভাবে সময়ানুসারী না হয়ে এবং স্থানকালের উল্লেখ ছাড়াই ধর্মীয় আলোচনাটি চালিয়েছেন তা ধর্মালোচনা হয়ে দাঁড়ালেও ইতিবৃত্ত হতে পারেনি।
তবে এসব আলোচনা ভাষাবিদ এবং ইতিহাসবিদদের জন্যই তোলা থাকুক। আমার বোঝার সমস্যা সতীদাহ আর বিধবা বিবাহ নিয়ে। এখানে আকাশ মালিক যাকে হিন্দুধর্ম বলে ধরেছেন তাকেই হিন্দুধর্ম হিসেবেই উল্লেখ করব। এতে আলোচনার সুধিধা হবে। আপাতত কেবল তাঁর ইতিবৃত্ত থেকে প্রথম পর্ব নিয়েই কিছু প্রশ্ন রাখছি। বাকি পর্বগুলির প্রশ্নও আলাদা আলাদা পর্বেই পোস্ট করা হবে। আকাশ মালিকের লেখাটির প্রথম পর্ব পাওয়া যাবে এখানে হিন্দু ধর্মের ইতিবৃত্ত, পর্ব ১
—————–
প্রথমেই একটি সমস্যা নিয়ে শুরু করা যাক। ধরুন আপনি একটি দেশের একজন আইন প্রণেতা। আপনি একটি আইন চালু করলেন যাদের মাথায় টাক আছে তারা শিক্ষক হতে পারবে না। এবার যেহেতু দেশের সংবিধান আপনাকে এমন আইন করার ক্ষমতা দেয়না কাজেই আপনার প্রথম লক্ষ্যই হবে যাতে টাকমাথার লোকেরা সংবিধানের লেখাটি পড়তে না পারে। অতএব টাক মাথার মানুষেরা সংবিধান পড়তে, শুনতে এমনকি স্পর্শ করতে পারবে না এমন একটা নিয়মও আপনাকে জারী করতেই হবে। কিন্তু যদি সংবিধানে আপনাকে এমন আইন করার ক্ষমতা দেওয়া থাকত সেক্ষেত্রে আপনি নিজেই সেটি সবাইকে পড়ার সুযোগ করে দিতেন যাতে আপনার আইনের বৈধতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে।
এবার আসি আকাশ মালিক এর লেখায় বেদ থেকে একলাফে মনুসসংহিতায় এসে পড়াকে। মনুসংহিতায় এমন বহু নিয়ম আছে যা পুরোপুরি বেদের বিরুদ্ধে যায়। যেমন বংশানুক্রমিক বর্ণপ্রথা, নারীদের অবরুদ্ধ করা ইত্যাদি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেদ বিরোধী হলেও এটি নিজেকে হিন্দুধর্মের মহান শাস্ত্র বলে দাবী করে। তাই এই ফাঁকি যাতে ধরা না যায় সঙ্গত কারণেই বেদ পাঠ নারী ও শুদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
প্রশ্ন উঠবে তাহলে মনুসংহিতা বা মনুস্মৃতির নিয়মগুলি এল কোথা থেকে। এর উত্তর প্রায় সমস্ত হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞানীরাই জানেন। লম্বা বৌদ্ধযুগের পর গুপ্ত সম্রাটদের রাজত্বে যখন ব্রাহ্মণধর্ম ক্ষমতায় আসে তখন ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের নিয়ে একটি কমিটি গড়া হয় লুপ্ত হিন্দুশাস্ত্র পুনরুদ্ধার করার জন্য। এই কমিটি বিভিন্ন পন্ডিতের যেটুকু মনে ছিল সেখান থেকে অল্পে-অল্পে সংগ্রহ করে এই গ্রন্থটি সংকলন করেন। স্মৃতি থেকে উদ্ধার করার ফলেই একে মনুস্মৃতি বলা হয়। একেবারে ইসলামের হাদিস সঙ্কলনের মতোই। উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মণদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। কোরান যেমন মহম্মদের তথা আরবদের স্বার্থে রচণা করে আল্লার নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে তেমনই এই কেতাবখানি মনুর নামে চালানো হয়েছিল। বেদ-উপনিষদ এবং মনুস্মৃতি পাশাপাশি যারাই পড়েছেন তাঁরাই এ কথা জানেন। তবে ধর্ম-ব্যবসায়ী ব্রাহ্মণরা সেটা স্বীকার করেন না। কোরান যেমন নিজেকে সর্বকালের সর্বযুগের সম্পূর্ণ জীবন বিধান দাবী করলেও আদতে তা আরবদের স্বার্থে তৈরি ধর্ম তেমনই মনুস্মৃতি নিজেকে সহি হিন্দুশাস্ত্র দাবী করলেও আদতে তা ব্রাহ্মণ্যধর্মের শাস্ত্র।
মনুসংহিতা ছাড়াও লেখক আরো কয়েকটি সংহিতার নাম উল্লেখ করেছেন। সংহিতা শব্দের অর্থভেদ করলে পাওয়া যায় যে গ্রন্থে বিধিগুলিকে সংহত করা (জমানো) হয়েছে যেহেতু এই কালেকশনের কাজগুলি সবই গুপ্তযুগের ব্রাহ্মণদের কর্ম, তাই তারা যে তাদের নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের অনুকূল বিধানগুলিই কালেকশন করবে তাতে সংশয় নেই। আকাশ মালিকের মত নিরপেক্ষ গবেষকই যখন শাস্ত্র খুঁজে খুঁজে শুধুমাত্র নিজের মতের স্বপক্ষে যাওয়া বিধানগুলি এক লেখায় সংহত করেছেন তখন সুবিধাবাদী ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় সে সুযোগ পেয়ে ছাড়বে কেন?
————-
এরপর লেখকের দ্বিতীয় বিষয় সতীদাহ প্রথা। যেহেতু আগেই দেখানো হয়েছে মনুস্মৃতি একটি বেদ বিরোধী গ্রন্থ, যা লেখা হয়েছিল ব্রাহ্মণ্যধর্মের স্বার্থে, তবুও এটুকু জানানো উচিত যে মনুস্মৃতির বিধানে সহমরণের সমর্থন পাওয়া যায়না। সেখানে বিধবাদের জন্য ব্রহ্মচর্য পালনের বিধান দেওয়া আছে। বাকি থাকে বেদ, রামায়ণ, মহাভারত।
বেদঃ
—————–
প্রথমেই একটি সমস্যা নিয়ে শুরু করা যাক। ধরুন আপনি একটি দেশের একজন আইন প্রণেতা। আপনি একটি আইন চালু করলেন যাদের মাথায় টাক আছে তারা শিক্ষক হতে পারবে না। এবার যেহেতু দেশের সংবিধান আপনাকে এমন আইন করার ক্ষমতা দেয়না কাজেই আপনার প্রথম লক্ষ্যই হবে যাতে টাকমাথার লোকেরা সংবিধানের লেখাটি পড়তে না পারে। অতএব টাক মাথার মানুষেরা সংবিধান পড়তে, শুনতে এমনকি স্পর্শ করতে পারবে না এমন একটা নিয়মও আপনাকে জারী করতেই হবে। কিন্তু যদি সংবিধানে আপনাকে এমন আইন করার ক্ষমতা দেওয়া থাকত সেক্ষেত্রে আপনি নিজেই সেটি সবাইকে পড়ার সুযোগ করে দিতেন যাতে আপনার আইনের বৈধতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে।
এবার আসি আকাশ মালিক এর লেখায় বেদ থেকে একলাফে মনুসসংহিতায় এসে পড়াকে। মনুসংহিতায় এমন বহু নিয়ম আছে যা পুরোপুরি বেদের বিরুদ্ধে যায়। যেমন বংশানুক্রমিক বর্ণপ্রথা, নারীদের অবরুদ্ধ করা ইত্যাদি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেদ বিরোধী হলেও এটি নিজেকে হিন্দুধর্মের মহান শাস্ত্র বলে দাবী করে। তাই এই ফাঁকি যাতে ধরা না যায় সঙ্গত কারণেই বেদ পাঠ নারী ও শুদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
প্রশ্ন উঠবে তাহলে মনুসংহিতা বা মনুস্মৃতির নিয়মগুলি এল কোথা থেকে। এর উত্তর প্রায় সমস্ত হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞানীরাই জানেন। লম্বা বৌদ্ধযুগের পর গুপ্ত সম্রাটদের রাজত্বে যখন ব্রাহ্মণধর্ম ক্ষমতায় আসে তখন ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের নিয়ে একটি কমিটি গড়া হয় লুপ্ত হিন্দুশাস্ত্র পুনরুদ্ধার করার জন্য। এই কমিটি বিভিন্ন পন্ডিতের যেটুকু মনে ছিল সেখান থেকে অল্পে-অল্পে সংগ্রহ করে এই গ্রন্থটি সংকলন করেন। স্মৃতি থেকে উদ্ধার করার ফলেই একে মনুস্মৃতি বলা হয়। একেবারে ইসলামের হাদিস সঙ্কলনের মতোই। উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মণদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। কোরান যেমন মহম্মদের তথা আরবদের স্বার্থে রচণা করে আল্লার নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে তেমনই এই কেতাবখানি মনুর নামে চালানো হয়েছিল। বেদ-উপনিষদ এবং মনুস্মৃতি পাশাপাশি যারাই পড়েছেন তাঁরাই এ কথা জানেন। তবে ধর্ম-ব্যবসায়ী ব্রাহ্মণরা সেটা স্বীকার করেন না। কোরান যেমন নিজেকে সর্বকালের সর্বযুগের সম্পূর্ণ জীবন বিধান দাবী করলেও আদতে তা আরবদের স্বার্থে তৈরি ধর্ম তেমনই মনুস্মৃতি নিজেকে সহি হিন্দুশাস্ত্র দাবী করলেও আদতে তা ব্রাহ্মণ্যধর্মের শাস্ত্র।
মনুসংহিতা ছাড়াও লেখক আরো কয়েকটি সংহিতার নাম উল্লেখ করেছেন। সংহিতা শব্দের অর্থভেদ করলে পাওয়া যায় যে গ্রন্থে বিধিগুলিকে সংহত করা (জমানো) হয়েছে যেহেতু এই কালেকশনের কাজগুলি সবই গুপ্তযুগের ব্রাহ্মণদের কর্ম, তাই তারা যে তাদের নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের অনুকূল বিধানগুলিই কালেকশন করবে তাতে সংশয় নেই। আকাশ মালিকের মত নিরপেক্ষ গবেষকই যখন শাস্ত্র খুঁজে খুঁজে শুধুমাত্র নিজের মতের স্বপক্ষে যাওয়া বিধানগুলি এক লেখায় সংহত করেছেন তখন সুবিধাবাদী ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় সে সুযোগ পেয়ে ছাড়বে কেন?
————-
এরপর লেখকের দ্বিতীয় বিষয় সতীদাহ প্রথা। যেহেতু আগেই দেখানো হয়েছে মনুস্মৃতি একটি বেদ বিরোধী গ্রন্থ, যা লেখা হয়েছিল ব্রাহ্মণ্যধর্মের স্বার্থে, তবুও এটুকু জানানো উচিত যে মনুস্মৃতির বিধানে সহমরণের সমর্থন পাওয়া যায়না। সেখানে বিধবাদের জন্য ব্রহ্মচর্য পালনের বিধান দেওয়া আছে। বাকি থাকে বেদ, রামায়ণ, মহাভারত।
বেদঃ
আকাশ মালিক অথর্ববেদ থেকে রেফারেন্স দিয়ে লিখেছেনঃ
অথর্ববেদে রয়েছে, “আমরা মৃতের বধু হবার জন্য জীবিত নারীকে নীত হতে দেখেছি।” (১৮/৩/১,৩)।
এখানে ১ থেকে ৩ অবধি ইংরাজী অনুবাদ তুলে দিলাম। অনুবাদটি নেওয়া হয়েছে
Hymns of the Atharva Veda, by Ralph T.H. Griffith, [1895]থেকেঃ
1. Choosing her husband’s world, O man, this woman lays herself down beside thy lifeless body.
Preserving faithfully the ancient custom. Bestow upon here both wealth and offspring.
2. Rise, come unto the world of life O woman: come, he is lifeless by whose side thou liest.
Wifehood with this thy husband was thy portion who took thy hand and wooed thee as a lover.
3. I looked and saw the youthful dame escorted, the living to the dead: I saw them, bear her.
When she with blinding darkness was enveloped, then did I turn her back and lead her homeward.
এই শ্লোকগুলির রেফারেন্স যখন আকাশ মালিক নিজেই দিয়েছেন তখন নিশ্চিতই তিনি এগুলি পড়ে দেখে অনুবা্দ মিলিয়ে নিয়েছেন। আকাশ মালিক সংস্কৃত বা ইংরাজীতে আমার চেয়েও কাঁচা এমন দাবী করার দুঃসাহস আমার নেই, তাই উক্ত শ্লোক গুলির বাংলা নিজে করার চেষ্টা না করে সে দায়িত্ব পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিলাম। তাঁরা নিজ দায়িত্বে অভিধান খুলে দেখে নেবেন,
Bestow upon here both wealth and offspring অর্থাৎ সম্পদ ও সন্তান দান করা মৃত দম্পতির ক্ষেত্রে সম্ভব কীনা?
Rise, come unto the world of life O woman এর অর্থ স্বামীর চিতায় প্রাণত্যাগ করার নির্দেশ কীনা?
Then did I turn her back and lead her homeward. বলতে নারীকে তার স্বামীর চিতায় উঠিয়ে দেওয়া বোঝায় কীনা?
ইয়ং নারী পতি লোকং বৃণানা নিপদ্যত উপত্বা মর্ত্য প্রেতম্।
ধর্মং পুরাণমনু পালয়ন্তী তস্মৈ প্রজাং দ্রবিণং চেহ ধেহি।।
(অথর্ববেদ ১৮।৩।১)
হে মনুষ্য! এই স্ত্রী পতিলোককে অর্থাৎ বৈবাহিক অবস্থাকে কামনা করিয়া মৃত পতির পরে তোমার নিকট আসিতেছে সনাতন ধর্মকে পালন করিয়া তাহার জন্য এই লোকে সন্তান কে এবং ধর্মকে ধারন করাও।
অপশ্যং যুবতিং নীয়মানাং জীবাং মৃতেভ্যঃ পরিণীয়মানাম্।
অন্ধেন যত্তমসা প্রাবৃতাসীৎপ্রাক্তো অপাচীমনয়ং তদেনাম।।
(অথর্ববেদ ১৮।৩।৩)
আমি দেখেছি জীবিত বিবাহিত যুবতীকে মৃতের অনুগামী হতে এবং মৃতের নিকট হতে নিয়ে যেতে কারন সে গভীর অন্ধকারে আবৃত ছিলো অতঃ তাহাকে সামনে থেকে [মৃত পতির সামনে হতে] দূরে আনয়ন করি।
সতীদাহের বিরোধী হিন্দুরা এইভাবেই বাংলা অনুবাদ করে থাকেন। গ্রিফিথ সাহেবের ইংরাজী অনুবাদ অথবা এই বাংলা অনুবাদই ঠিক এবং আকাশ মালিক অনুবাদে ভুল করেছেন এমন দাবী আদৌ করছি না। কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল সেই প্রশ্নটুকুই পেশ করে রাখছি কেবল। যদিও আকাশ মালিক কেবলমাত্র ৩য় শ্লোকের প্রথম লাইনটির বাংলা অনুবাদ রেফারেন্স হিসাবে দিয়েছেন। যেহেতু তিনি ১ থেকে ৩ অবধি শ্লোক পুরোটাই রেফারেন্স হিসাবে উল্লেখ করেছেন অথচ তার যে অনুবাদ আমি পেয়েছি তা তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করে না, তাই পুরো তিনটি শ্লোকেরই বাংলা অথবা ইংরাজী তাঁর কাছ থেকে আশা করছি।
অথর্ববেদের আগে আকাশ মালিক ঋগবেদ থেকেও একটি রেফারেন্স দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি মূল শ্লোকটি উল্লেখ না করলেও ইংরাজী অনুবাদটি দিয়েছেন। তবে আমি মূল শ্লোকটিকেই আগে পেশ করতে চাইঃ
ইমা নারীরবিধবাঃ সুপত্নীরন্জনেন সর্পিষা সংবিশন্তু।
অনশ্রবোনমীবাঃ সুরত্না আরোহন্তু জনয়ো যোনিমগ্রে।।
(ঋগবেদঃ ১০।১৮।৭)
সতীদাহ বিরোধী হিন্দুরা একে অনুবাদ করেন এইভাবে
(ইমাঃ) এই (অবিধবাঃ) পতিযুক্ত (নারী) স্ত্রী (সুপত্নি) উত্তম পত্নি হয়ে (আঞ্জনেন) অঞ্জন আদি পদার্থ এবং (সর্পিষা) ঘৃত আদি সুগন্ধিত পদার্থ দ্বারা শোভিত হয়ে (সংবিশন্তু) নিজ গৃহ মধ্যে প্রবেশ করবে। তথা (অনশ্রবঃ) দুঃখরহিত (অনমীবাঃ) রোগরহিত (সুরত্নাঃ) উত্তম রত্ন আদি দ্বারা সুসজ্জিত হয়ে (জনয়ঃ) উত্তম সন্তানকে উৎপন্ন করতে সমর্থ স্ত্রী (অগ্রে) প্রথমে (যোনিম্) গৃহ মধ্যে (আরোহন্তু) প্রবেশ করবে।
গ্রিফিথ সাহেব এই শ্লোকের অনুবাদ করেছেন এইভাবে –
7 Let these unwidowed dames with noble husbands adorn themselves with fragrant balm and unguent.
Decked with fair jewels, tearless, free from sorrow, first let the dames go up to where he lieth.
8 Rise, come unto the world of life, O woman: come, he is lifeless by whose side thou liest.
Wifehood with this thy husband was thy portion, who took thy hand and wooed thee as a lover.
এটি পড়ে আমার মনে হয়েছে সাত নম্বর শ্লোকে অবিধবা নারীদের সুসজ্জিত হয়ে গৃহে প্রবেশ করে স্বামীর সয্যায় আরোহন করে পাশে শুয়ে পড়তে বলা হয়েছে আর আট নম্বর শ্লোকটিতে বিধবা নারীকে বলা হয়েছে মৃত স্বামীর পাশ থেকে উঠে আসতে। এতদিন এরকমই ধারণা ছিল। কিন্তু আকাশ মালিক দাবী করছেন এতে অবিধবা নারীদের চিতায় তুলে দেবার কথা আছে। তিনি নিজেই সাত নম্বর শ্লোকটির ইংরাজী অনুবাদ দিয়েছেন এইভাবে
বর্তমানকালের তথাকথিত ‘মডারেট’ হিন্দুরা স্বীকার করতে চাইবেন না, অথবা অনেকেই জানেন না তাদের ধর্মগ্রন্থে ‘স্বামী মারা গেলে বিধবাকে স্বামীর চিতায় আগুনে পুড়ে মরে সতী হওয়ার’ সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। প্রমাণ চাই তো, দেখুন ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১৮নং সূক্তের ৭ নং শ্লোক(১০/১৮/৭) শ্লোকটির ইংরেজি হচ্ছে: Let these women, whose husbands are worthy and are living, enter the house with ghee (applied) as collyrium (to their eyes). Let these wives first step into the pyre, tearless without any affliction and well adorned.
pyre অর্থাৎ চিতার কথা কিন্তু গ্রিফিথ সাহেবের অনুবাদে নেই। অনুবাদের এই তফাত থাকার কারণেই মূল শ্লোকটি কপি করে দিতে হয়েছে। গ্রিফিথ সাহেব বা আমিই ঠিক জানি এমন দাবী করতে চাই না। তবুও আকাশ মালিকের নিজের দেওয়া ইংরাজী পড়েও কোনোভাবেই বুঝলাম না যে যাদের স্বামী জীবিত (গ্রিফিথ সাহেবের ভাষায় unwidowed, আকাশ মালিকের রেফারেন্স মতো whose husbands are worthy and are living, মূল সংস্কৃত অনুযায়ী অবিধবা) তাদের সঙ্গে সতীদাহের সম্পর্কটা কোথায়। enter the house এর পরে কীভাবে step into the pyre ঘটানো যায়? আর যদি আকাশ মালিকের অনুবাদটাই সঠিক হয় তাহলেও তো সমস্যা কমছে না। সপ্তম শ্লোকে যদি নারীকে চিতায় উঠতেই বলা হয়েও থাকে অষ্টম শ্লোকে তাকে বলা হয়েছে মৃত স্বামীর কাছ থেকে উঠে এসে জীবনে প্রবেশ করতে। তাহলে সহমরণের সুযোগ কোথায় রইল? অবশ্য আকাশ মালিক অষ্টম শ্লোকের কোনো অনুবাদ দেননি বলে গ্রিফিথ সাহেবের অনুবাদটাই ধরা হয়েছে। এ সমস্যা সমাধান তখনই হবে যখন আকাশ মালিক অষ্টম শ্লোকটির অর্থ কী পেয়েছেন তা জানাবেন।
রামায়ণ
রামায়ণেও দেখা যায় রামের মিত্র সুগ্রীব তার বড়ভাই বালীর মৃত্যুর পরে বালীর মহারাণিকে বিয়ে করে রাজত্ব করছে। এই বিবাহ ঘটেছে কথিত হিন্দু অবতার শ্রীরামের উপস্থিতিতেই। এরপর লঙ্কার যুদ্ধে রাবণ নিহত হলে আবার দেখা যায় রাবণের মহারানী মন্দোদরীর সঙ্গে পরবর্তী লঙ্কারাজ বিভীষণের বিবাহ। এটিও স্বয়ং রামের উপস্থিতিতে এবং অনুমোদনেই হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেক্ষ্য, রাবণ ছিল ঋষিপুত্র এবং শৈবধর্মের অনুসারী, যা কালেকটিভ হিন্দুধর্মেরই অংশ। অর্থাৎ ক্ষত্রিয় রাজা রামের অনুমোদনে ব্রাহ্মণপুত্র বিভীষণের সঙ্গে একটি বিধবার বিবাহ আমরা রামায়ণেই দেখতে পাই। এছাড়াও রামায়ণে আমরা দেখি দশরথের পত্নীরা সহমরণে না গিয়ে বহাল ছিলেন। কোনোক্ষেত্রেই তাতে স্বর্গে যেতে সমস্যা হয়েছে এমন উল্লেখ দেখিনা।
মহাভারতঃ
মহাভারত থেকে লেখক বেশ কয়েকটি সতীদাহের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বিরুদ্ধ উদাহরণগুলি তাঁর নজর এড়িয়ে গেছে। পান্ডুরাজার মৃত্যুর পরে তাঁর দুই রাণীর একজন সহমরণে গেলেও দ্বিতীয়জন তা করেননি। তাছাড়া তিনি যেভাবে পাঁচ পুত্ত্রের উপর হুকুম চালাতেন তাতে মনুর বিধান- “বার্ধক্যে নারী থাকবে পুত্ত্রের অধীন” কোনোভাবেই সমর্থিত হয় না। এক্ষেত্রেও এসবই ঘটেছিল তথাকথিত অবতার বাসুদেব কৃষ্ণের উপস্থিতিতেই।
এখন প্রশ্ন যে লেখক কি বালীপত্নী তারা কিম্বা রাবণপত্নী মন্দোদরীর কাহিনীর সঙ্গে পরিচিত নন? কিন্তু এ যুক্তিও দাঁড়ায়না কারণ তাঁর লেখার ৮-পর্বে তিনি একটি শ্লোক রেফারেন্স হিসাবে দিয়েছেন
‘অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তি, তারা, মন্দোদরী তথা।
পঞ্চ কন্যাং স্মরেন্নিত্যং মহাপাতক নাশনম্ ।।
এই যে পঞ্চকন্যার পবিত্র নামের নিত্য স্মরণে মহাপাতক নাশ হয় তাদের মধ্যেই আছেন কুন্তী, তারা এবং মন্দোদরী। এনাদের তিনজন বিধবা হয়ে সহমরণে যাননি। শেষ দুজন বিধবা হবার পর দ্বিতীয়বার বিবাহও করেছিলেন। লেখক অষ্টম পর্বে এই শ্লোকটি উল্লেখ করলেন বটে, তারপর দ্বিতীয় কন্যা দ্রৌপদীকে নিয়েই পুরো পর্বটি লিখে গেলেন। কুন্তী, তারা, মন্দোদরীর কাহিনীর উল্লেখমাত্র করলেন না। আশা ছিল পরবর্তী কোনো পর্বে তাদের কথা আসবে। কিন্তু লেখাটি সমাপ্ত হয়ে যাওয়ায় প্রশ্নটি রাখতেই হল।
পর্ব ১১ তে লেখক আরও একটি মহাভারতীয় ঘটনা উল্লেখ করেছেনঃ
“শান্তনু রাজার পুত্র বিচিত্রবীর্য যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়ে অপুত্রক অবস্থায় মারা যান। ফলে তার মাতা মৎস্যগন্ধা (পরবর্তীকালে সত্যবতী) বংশরক্ষার জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েন।
এখানে বিচিত্রবীর্য নাহয় পুত্রহীন অবস্থায় মারা যাওয়ার কারণে তাঁর পত্নীরা চিতায় আরোহন করলেন না। যেহেতু বংশরক্ষা করতে হবে। কিন্তু এই যে মাতা সত্যবতী, ইনি কি নিজ পতির চিতায় সহমরণে গিয়েছিলেন? তখন তো বংশরক্ষার চিন্তা আসেনি।
লেখক আরও জানিয়েছেন
মহাভারতের মৌষল পর্বে আমরা দেখি, ভগবান কৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাঁর চার স্ত্রী রুক্কিণী, রোহিণী, ভদ্রা এবং মদিরা তাঁর চিতায় সহমৃতা হয়েছিলেন। এমন কি বসুদেবের আট পত্নীও তাঁর মৃত্যুর পরে সহমরণে গিয়েছিলেন।
কিন্তু কৃষ্ণের এই চারজন ছাড়াও পত্নী ছিলেন। ১৬ হাজার পত্নীর কাহিনী বাদ দিয়েও তাঁর প্রধানা মহিষী হলেন রুক্মিনী, অন্যরা হলেন কালিন্দী, মিত্রবিন্দা, সত্যা, জাম্ববতী, সুশীলা, সত্যভামা, লক্ষ্মণা- এই আট জন।
(পোস্টের মন্তব্য থেকে আরেকটি তথ্য যোগ করছি।) মহাভারতের মৌষল পর্বে লেখা আছে “তখন তাঁহার দেবকীপ্রভৃতি পত্নীচতুষ্টয় তাঁহাকে প্রজ্বলিত চিতাতে আরোপিত দেখিয়া তদপুরি সমারূঢ় হইলেন।” অর্থাৎ বসুদেবের চারজন পত্নী সহমরণে গিয়েছিলেন, আটজন নয়। এছাড়া কৃষ্ণপত্নীদের মধ্যে রোহিণী, ভদ্রা বা মদিরা নাম পাওয়া যায় না। বস্তুত এই তিনজন আদৌ কৃষ্ণের স্ত্রী ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন কৃষ্ণের পিতা বসুদেবের স্ত্রী। এর মধ্যে রোহিণী ছিলেন বলরামের মাতা। কৃষ্ণের স্ত্রী রুক্মিনীও সহমৃতা হয়েছিলেন এমন প্রমাণ নেই, বরং অর্জুন এসে তাঁকে দ্বারকা থেকে নিজের রাজ্যে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি প্রাণত্যাগ করেন, কৃষ্ণের চিতায় নয়। এই তথ্যটি পেলাম “জগত” এর দেওয়া মন্তব্য পড়ার পর মহাভারত মিলিয়ে দেখে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুল করার জন্য পাঠকের কাছে ক্ষমা চাই। সেইসঙ্গে সমস্ত পাঠকের কাছেই এইরকম তথ্যমূলক আলোচনায় যোগ দেবার আবেদন করছি।
আকাশ মালিক যেহেতু দাবী করেছেন বেদসহ সব শাস্ত্রেই সহমরণে যাবার সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে তবে কৃষ্ণের বাকি পত্নীরা কেন সহমরণে গেলেন না? তাঁদের কী তবে শাস্ত্র থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশ জানাবার কেউ ছিলনা?
এতক্ষণ যেসব প্রশ্ন পেশ করলাম তা এই অধম মূর্খের সামান্য পড়াশুনার ফল। আকাশ মালিকের মত গবেষকের সঙ্গে তর্কে নামার মত যোগ্যতা আমার আছে বলে মনে করিনা। কিন্তু প্রখ্যাত গবেষক আকাশ মালিক কি রামমোহন বা বিদ্যাসাগরের নামের সঙ্গেও পরিচিত নন? রামমোহন নিজে বৈদিক ধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন এবং তৎকালে যা হিন্দুধর্ম নামে পরিচিত ছিল (অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যধর্ম) ত্যাগ করে ব্রাহ্মসমাজ গঠন করেছিলেন যেখানে বেদমন্ত্র দিয়ে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা চলত। এই রামমোহন এবং ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগেই সতীদাহ প্রথা হিন্দুশাস্ত্রবিরোধী প্রমাণ করে নিসিদ্ধ করা হয়েছিল। তাঁরা কিন্তু বেদ-উপনিষদ থেকে রেফারেন্স দিয়েই সতীদাহ প্রথাকে শাস্ত্রবিরোধী প্রমাণ করেছিলেন এবং সেকালের বহু ব্রাহ্মণ্যপন্ডিত তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই সতীদাহ প্রথাকে হিন্দুশাস্ত্রসম্মত প্রমাণ করতে গিয়ে চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এ ইতিহাস স্কুল স্তরের ছাত্ররাও জানে। এছাড়াও রামমোহন প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মধর্মে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ অনুমোদিত ছিলনা। নারীশিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠাতেও তাঁর অবদানও উল্লেখযোগ্য। লাঠি দিয়ে পিটিয়ে নারীদের দুর্বল করে রাখার মত মহান কর্ম তিনি বা তাঁর অনুসারীরা কখনও করেছেন বলে জানা যায়না। আকাশ মালিক এর বক্তব্য সঠিক হলে বলতে হয় রামমোহন রায় বেদ বুঝতেন না।
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (বিদ্যাসাগর) যে শুধু বিধবা বিবাহকে শাস্ত্রসম্মত প্রমাণ করেছিলেন তাইই নয়, তিনি সংস্কৃত কলেজের শিক্ষার দরজা অব্রাহ্মণদের জন্যও খুলে দিয়েছিলেন। সেখানেও শতশত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের বিরোধিতাকে তিনি শাস্ত্রীয় রেফারেন্স দিয়েই পরাজিত করেন। নারীশিক্ষার জন্য বহু স্কুল তিনি তাঁর কার্যকালে প্রতিষ্ঠা করে গেছিলেন। কাজেই হিন্দুশাস্ত্রের নির্দেশে ‘শুদ্র ও নারীরা বিদ্যাশিক্ষা করতে পারবে না’ লেখকের এই দাবীও তেমন জোরালো হচ্ছেনা। অবশ্য যদি বিদ্যাসাগর ঠিকমতো শাস্ত্র না বোঝেন তবে অন্যকথা।
নারীশিক্ষা, সতীদাহ, বিধবা বিবাহ, বাল্যবিবাহ ইত্যাদির ঘটনায় সাধারণত রামমোহন এবং বিদ্যাসাগরের নাম প্রায় সকলেরই জানা। লেখক যে তাঁদের নামমাত্র উল্লেখ এই টপিকে করলেন না, এটা সত্যিই অবাক করার মতই বিষয় মনে হয়েছে। হয়ত তাঁর কাছে এমন কিছু প্রমাণ আছে যাতে তিনি প্রমাণ করতে পারবেন যে এনারা ভুলই করেছিলেন। সেক্ষেত্রে আমার মত অজ্ঞ পাঠকের বোধগম্য ভাষায় সেসব তথ্যপ্রমাণ প্রকাশ করতে লেখকের কাছে আবেদন করছি।
ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৭; ৬:৪৮ পূর্বাহ্ন
আকাশ মালিকের লেখার ভাল একটা খণ্ডায়ন হয়েছে। আকাশ ভাইয়ের জবাব আশা করছি।
ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৭; ১১:৩৭ পূর্বাহ্ন
জবাব আশা করে একটা প্রশ্ন আমিও করেছিলাম একেবারে প্রথম পর্বেই। বেদ আমার পড়া নেই, মূল রামায়ণ বা মহাভারতও পড়া হয়নি। তবে রামমোহন এবং বিদ্যাসাগর ভুল ছিলেন কিনা সে প্রশ্ন আকাশ মালিককে করেছিলাম।
প্রথম পর্বে করা সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও আসেনি। যদিও তার পরে লেখক আরো পর্ব লিখেছেন, মোট কুড়িটি লিখে সিরিজ শেষও করে ফেলেছেন। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর আজও পেলাম না।
এই লেখা অন্য কেউ লিখলে মনে করতাম কোনো মোল্লার সাইট থেকে কপিপেস্ট করা হয়েছে। প্রথম পর্বের মন্তব্যে যা বলেছিলাম সেটা এখানেও বলছি। আকাশ মালিক হিন্দুধর্মের যুক্তিপূর্ণ আলোচনার জন্য আদৌ লিখছেন না। হিন্দুশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনারও প্রয়োজন মনে করছেন না। ইসলাম আর মহম্মদকে এতদিন গালাগালি করে এবার কেবল ব্যালান্স করার জন্য হিন্দুধর্মকে ধরেছেন।
সেই প্রথম পর্ব থেকে আমিও জবাবের আশায় আছি। আপনাকে দলে পেয়ে খুব ভাল লাগল।
ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৭; ৯:৪৩ পূর্বাহ্ন
কোন পর্ব্বে লিখেছিলেন, মনে নেই। উনি আর্য্য আগমন তত্ত্বকে মেনে নিয়েই, সমালোচনায় মুখর হলেন। যার অস্তিত্বই নেই, তাকে সামনে দাড় করিয়ে সমালোচনা করা কতটা যুক্তি সঙ্গত , আমার জানা নেই। আর একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, যে কোন গবেষণামূলক লেখায়; হাল আমলের তত্ত্ব/তথ্যগুলোর খোঁজ খবর নিয়ে, আলোচনা করলে ভাল হয়। বলতে চাচ্ছি, শ্রীকলিম খান এবং রবি চক্রবর্তী দীর্ঘদিনের গবেষণায় দেখিয়ে দিচ্ছেন, রামায়ণ, মহাভারত, বেদ – অর্থাৎ ঐ সময়ের লেখাগুলো ছিল ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায়। যেকারণে প্রতীকী ভাষায় অর্থগুলো বড় গোলমেলে মনে হয়। আমি নিজেও ভগবান-এর অর্থ নিয়ে বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ধন-সম্পদের মালিককেও ভগবান বলা হয়, আবার জগতের মালিকও ভগবান। ভগিনীগণও সে সাক্ষ্যই বহন করছে। শিবকে কেন ভগবান বলা হয় না, কলিম খানের এ প্রশ্নের উত্তর এখনো কারও কাছ থেকে পাইনি।
বিষ্ণুকে দেবতা বানিয়ে গালাগাল করে আমরা যে সুখ পাই, সেই সুখের মুখে আগুন দিয়ে দিয়েছিলেন, কার্ল মার্ক্স, বলেছিলেন, বিষ্ণ, দ্যা ক্যাপিটালিস্ট। বর্ণপ্রথা নিয়ে কথা বলি, কিন্তু বহু আগেই ঘটে যাওয়া শ্রম বিভাজনের ইতিহাস আমাদের জানা নেই।
ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৭; ৭:৪১ অপরাহ্ন
ক্রিয়াভিত্তিক অনুবাদের ব্যাপারে অনলাইনে সামান্য কিছু পড়েছি। সেটুকু জ্ঞান নিয়ে লেখালেখি করার সাহস হয়না। বস্তুত এটাও কোনো গবেষণামূলক লেখা লিখছিনা। আকাশ মালিক তাঁর লেখায় রেফারেন্স হিসাবে বেদ, রামায়ণ, মহাভারত থেকে যা উল্লেখ করেছেন সেইগুলির মূল এবং স্বীকৃত অনুবা্দ পড়ে মনে হয়েছে সেগুলি আকাশ মালিকের দাবীকে সমর্থন করেনা। তিনি যে অর্থ ধরে আলোচনা করেছেন সেই অর্থেও সমর্থন করেনা। তাই এই প্রশ্নগুলি পেশ করেছি, আপনারা সমাধান দেবেন এই আশায়।
ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় শাস্ত্র আলোচনার গুরুদায়িত্ব এখনই নিতে সক্ষম নই। এ নিয়ে বরং আপনারা লিখুন, আমি সেখান থেকে কিছু শেখার আশায় থাকলাম। দয়া করে আলোচনায় সক্রিয় থাকুন, আমার মত জিজ্ঞাসু পাঠকদের নিরাশ করবেন না।
ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৭; ৮:২৭ পূর্বাহ্ন
আমিও জবাব দেখার জন্য অপেক্ষায় রইলাম। দুই নাস্তিকের কাজিয়া দেখতে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগবে। বিশেষ করে দুজনের একজন যখন আধুনিক কালের বিদ্যাসাগর হতে চলেছেন।
ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৭; ৮:২৫ অপরাহ্ন
আপনার এই লেখাটা পড়ার পর মনে হল মহাভারত একবার খুলে দেখা উচিত। বেছে বেছে শেষ দিকটাই খুললাম কারণ স্বর্গলাভের ব্যাপারটা শেষ দিকেই থাকে। কৃষ্ণের যদুবংশ ধ্বংস হবার সময় কী হয়েছিল একটু দেখুন।
এই অবধি আকাশ মালিক রেফারেন্স দিয়েছেন কিন্তু তার পরের অংশ, যা কিনা পাতা ওল্টালেই পাওয়া যায়, বেমালুম চেপে গেছেন।
যাদবনারীগণসহ অর্জ্জুনের হস্তিনাযাত্রা
মহাত্মা অর্জ্জুন এইরূপে শাস্ত্রানুসারে বৃষ্ণিবংশীয়দিগের প্রেতকার্য্য সম্পাদন করিয়া সপ্তম দিবসে রথারোহণে ইন্দ্রপ্রস্থাভিমুখে যাত্রা করিলেন। তখন বৃষ্ণিবংশীয় কামিনীগণ শোকার্ত্ত হইয়া রোদন করিতে করিতে অশ্ব, গো, গর্দ্দভ ও উষ্ট্রসমাযুক্ত রথে আরোহণ পূর্ব্বক তাঁহার অনুগমনে প্রবৃত্ত হইলেন। ভৃত্য অশ্বারোহী ও রথীগণ এবং পুরবাসী ও জনপদবাসী লোকসমুদায় অর্জ্জুনের আজ্ঞানুসারে বৃদ্ধ, বালক ও কামিনীগণকে পরিবেষ্টন করিয়া গমন করিতে লাগিল। গজারোহিগণ পর্ব্বতাকার গজসমুদায়ে আরোহণ পূর্ব্বক ধাবমান হইল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয় বালকগণ, বাসুদেবের ষোড়শ সহস্র পত্নী ও পৌত্ত্র বজ্রকে অগ্রসর করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশের যে কত অনাথা কামিনী পার্থের সহিত গমন করিয়াছিলেন, তাহার আর সংখ্যা নাই। এইরূপে মহারথ অর্জ্জুন সেই যদুবংশীয় অসংখ্য লোক সমভিব্যাহারে দ্বারকা নগর হইতে বহির্গত হইলেন।
বজ্রের হস্তে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যভার-অর্পণ (মুষল পর্ব)
অনন্তর তিনি (অর্জুন) সেই হৃতাবশিষ্ট কামিনীগণ ও রত্নরাশি সমভিব্যাহারে কুরুক্ষেত্রে সমুপস্থিত হইয়া হার্দ্দিক্যতনয় ও ভোজকুলকামিনীগণকে মার্ত্তিকাবর্ত নগরে, অবশিষ্ট বালক, বৃদ্ধ ও বনিতাগণকে ইন্দ্রপ্রস্থে এবং সাত্যকিপুত্ত্রকে সরস্বতীনগরীতে সন্নিবেশিত করিলেন। ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যভার কৃষ্ণের পৌত্ত্র বজ্রের প্রতি সমর্পিত হইল। ঐ সময় অক্রূরের পত্নীগণ প্রব্রজ্যাগ্রহণে উদ্যত হইলে, বজ্র বারংবার তাঁহাদিগকে নিষেধ করিতে লাগিলেন; কিন্তু কিছুতেই তাঁহারা প্রতিনিবৃত্ত হইলেন না। রুক্মিণী, গান্ধারী, শৈব্যা, হৈমবতী ও দেবী জাম্ববতী ইঁহারা সকলে হুতাশনে প্রবেশ পূর্ব্বক প্রাণত্যাগ করিলেন। কৃষ্ণের অন্যান্য পত্নীগণ তপস্যা করিবার মানসে অরণ্যে প্রবিষ্ট হইয়া ফলমূল ভোজন পূর্ব্বক হিমালয় অতিক্রম করিয়া কলাপগ্রামে উপস্থিত হইলেন। অনন্তর মহাত্মা ধনঞ্জয় দ্বারকাবাসী লোকদিগকে যথোপযুক্ত স্থানবিভাগ প্রদান করিয়া বজ্রের হস্তে সমর্পণ করিলেন।
************************************
রোহিণী যে রাজা বসুদেবের পত্নী এবং বলরামের মা, এ তথ্য সকলেই জানে। অথচ আকাশ মালিক দুম করে তাকে কৃষ্ণের বিবি বানিয়ে ফেলেছেন। তার চেয়েও বড় কথা, এই সমালোচনার লেখক পর্যন্ত এত বড় একটা ভুল দেখতে পেলেন না। আকাশ মালিক নামটা মানুষকে কতখানি প্রভাবিত করে তার এক বিরাট উদাহরণ। কিন্তু এই জাতীয় মোহ যুক্তিবাদীদের মানায় না। এই লেখা পড়ে যদি মালিকের অন্ধ ভক্তরা একটু চোখ মেলে তাঁর রেফারেন্স গুলি ক্রস-চেক করতে শিখত তাহলেই খুশি হতাম। আমি মনে করি তাঁর ইসলাম বিষয়ক লেখার রেফারেন্সও একইভাবে ক্রস-চেক করা দরকার আছে।
ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৭; ৯:১৯ অপরাহ্ন
অনেক ধন্যবাদ এরকম একটি ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। আপনার দেওয়া তথ্য পোস্টে যোগ করে দেওয়া হয়েছে। আমার লেখাটি পড়ে আপনি মহাভারত পড়তে শুরু করেছেন জেনে খুবই ভাল লাগল। আপনাদের সহযোগিতায় এভাবেই ভুলত্রুটি সংশোধন করে চলতে পারলেই আমার পরিশ্রম সার্থক মনে করব।