বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ৩৯ বছর পার করে চল্লিশে পা দিয়েছে। গত ১ সেপ্টেম্বর চার দশক পার করা দলটি জন্মদিন উদ্যাপন করেছে মোটামুটি নীরবে। অনেক বছর ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে থাকার কারণে দলটির জৌলুশ অনেক কমে গেছে। তারপরও বিএনপি এখন সংবাদ শিরোনাম হয়। কেননা, এ দেশের রাজনীতিতে দলটি এখনো প্রাসঙ্গিক। একাধিকবার সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দলটি ভবিষ্যতে আবারও সরকার গঠনের আশা রাখে।
বাংলাদেশ নিয়ে বাইরের দুনিয়ার আগ্রহ কিংবা হস্তক্ষেপ সব সময়ই জন-আলোচনার বিষয়। বিদেশি ষড়যন্ত্র নিয়ে অভিযোগ এখানে নৈমিত্তিক ব্যাপার। রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই তাদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো বিদেশি রাষ্ট্র বা গোয়েন্দা সংস্থার আঁতাত আছে, এই অভিযোগ করে থাকে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি সবল না হলে কোন বিদেশি শক্তি লাভবান হবে, তা নিয়ে অনেক আলোচনা ও বিশ্লেষণ গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। এক-এগারোর সময়ে কারাগারে যাওয়া বিএনপির নেতা মওদুদ আহমদের সোজাসাপটা মন্তব্য ভারতকে নিয়ে। বিএনপির রাজনীতিতে ভারত-প্রসঙ্গ এক অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ দুর্বল হলে তার সুফল ভোগ করবে কে? অবশ্যই ভারত। আর দুর্ভোগ পোহাবে আপামর জনসাধারণ। এ সময়ে হাসিনা বা খালেদার যে দুর্বলতাই থাকুক না কেন, তাঁরা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে নির্বাচিত নেতা এবং সর্বদা দেশ ও জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্যই তাঁদের ক্ষমতায় অভিষিক্ত করা হয়েছে। যে কারণেই ১৯৯৬-২০০১ সালে ক্ষমতায় থাকাকালীন শেখ হাসিনা ভারতকে তাদের প্রত্যাশিত সবকিছু দিতে রাজি ছিলেন না বলে ভারত কিংবা তার গোয়েন্দা বাহিনী “র” শেখ হাসিনার ওপর খুব একটা সন্তুষ্ট ছিল না। তাদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের প্রয়োজন এমন একটা নতজানু সরকার, যা সব সময় ভারতীয় নীতিমালা বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। হাসিনা তাদের যা দিতে পারেননি, জেনারেল মইন উ আহমেদের মাধ্যমে সম্ভব হয় কি না তা ভারত অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখবে। তাদের পরিকল্পনা অনুসারে যৌথ বাহিনীর বেপরোয়া কার্যক্রম একসময় সেনাবাহিনী ও জনগণকে করে তুলবে মুখোমুখি এবং এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটবে যে সরকার নিরাপত্তার খাতিরে ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করবে। এখানেই কবর রচিত হবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের।’ (সূত্র: কারাগারে কেমন ছিলাম, ইউপিএল)।
মওদুদের ইঙ্গিত খুবই খোলামেলা। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার মন্তব্যে মওদুদের কথার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। শেখ হাসিনা প্রকাশ্য বক্তৃতায় বলেছেন, ভারতে গ্যাস রপ্তানি করতে রাজি না হওয়ার কারণে ‘সিআইএ’ এবং ‘র’ ২০০১ সালে বিএনপিকে ক্ষমতায় এনেছিল। মওদুদের বক্তব্যে এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকারের পেছনে ভারতের ইন্ধন বা মদদ আছে বলে মনে হয়। যদিও পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের আলাপ–আলোচনার কথিত ‘কফি গ্রুপে’ ভারত দৃশ্যত নেই, কিন্তু বাংলাদেশের যেকোনো রাজনৈতিক সংকটে ভারত-প্রসঙ্গ স্বাভাবিক নিয়মেই উঠে আসে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মওদুদ এক-এগারোর সময় অভিযোগ করেছিলেন, ‘এখন যাঁরা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ধ্বংস করে দিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল কিংবা নয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতির আপ্তবাণী উচ্চারণ করছেন, তাঁরা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দুর্বল করে বাইরের হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিচ্ছেন।’
এক-এগারোর দুই বছর মেয়াদি সরকারের পরপেরিয়ে গেছে অনেক বছর। কিন্তু এক-এগারোর ভূত এখনো বাংলাদেশের রাজনীতিকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। রাজনীতির অ্যামেচার আড্ডায় কিংবা চায়ের স্টলে একটা বিষয় বারবার ঘুরেফিরে আসে, আগামী নির্বাচন ঠিকঠাকমতো হবে তো? বিদেশিরা আবার হস্তক্ষেপ করবে না তো? ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। রাজনীতিবিদদের অনেকেরই দেশের নাগরিকদের রায়ের প্রতি দায় কিংবা আস্থা কম, বরং বিদেশিদের আনুকূল্যের প্রতি আগ্রহ যেন বেশি। এ নিয়ে চলছে নানান জল্পনা–কল্পনা।
এখন এটা মোটামুটি পরিষ্কার যে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ চেয়েছিল বিএনপি যেন নির্বাচনে না আসে।
বিএনপির ‘থিংক ট্যাংক’কে একটা তত্ত্ব গেলানো হয়েছিল যে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নেবে। বিএনপির নেতৃত্ব এটা বিশ্বাস করেছিলেন। এই থিংক ট্যাংকের একটি অংশ এখনো আগের অবস্থানেই আছে বলে মনে হয়।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে বিএনপি তো ৩৯ বছর পার করল। বিএনপি সেনানিবাসে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার উদ্যোগে কিংবা আশ্রয়ে জন্ম নেওয়া দল—এ রকম একটি ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও ১৯৮০-এর দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি একটি রাজনৈতিক দলের বৈধতা পেয়ে যায় এবং রাজনীতিতে একটি পরাশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে সমর্থ হয়। গত ৩৯ বছরে বিএনপির বড় অর্জন হলো, এরশাদ সাহেব বিএনপিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করার চেষ্টা করেও সফল হননি। গৃহবধূ বেগম খালেদা জিয়া দলের ঝান্ডা ১৯৮৪ সাল থেকে লাগাতার বয়ে বেড়িয়েছেন এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ভালো সুবিধাপেয়েছেন। ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারির অনাকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনটি বাদ দিলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি দু-দুবার নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করেছিল। বিএনপির ইতিহাসে এটাই সম্ভবত তাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। পাশাপাশি এখান-ওখান থেকে তুলে আনা সামরিক-অসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী ও সুশীলকে এক ছাতার তলায় এনে জিয়াউর রহমান যে জোড়াতালির দল তৈরি করতে পেরেছিলেন, তা আজও টিকে আছে।
বিএনপির টিকে যাওয়ার প্রধান শর্ত ছিল আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি বা সমান্তরাল আরেকটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা। এর একটি রাজনৈতিক উপযোগিতা ছিল। সেই উপযোগিতা এখনো বহাল আছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ থাকলে তার একটি বিকল্প বা প্রতিপক্ষ থাকবেই এবং চার দশক ধরে বিএনপি নিজেকে ওই অবস্থানে নিয়ে এসেছে। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে কথাবার্তায় যতই নাকচ করে দিক না কেন, বিএনপি টিকে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতারা স্কুলের চালে টিন লাগানো, কালভার্ট উদ্বোধন কিংবা মসজিদে চুনকাম করা উপলক্ষে যেকোনো অনুষ্ঠানে বা সমাবেশে পাঁচ মিনিট বক্তৃতা করলে সাড়ে চার মিনিট বরাদ্দ থাকে বিএনপির সমালোচনায়। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ কে, এটা খুঁজে বের করার জন্য জনসাধারণকে আর পরিশ্রম বা মেধার অপচয় করতে হয় না। আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি শুনলে এবং পড়লেই যথেষ্ট।
বিএনপির মূল সংকটটা শুরু হয় ২০০৬ সালে। পরবর্তী নির্বাচনে জয় পেতে বিএনপি যেভাবে সবকিছু গুছিয়ে আনতে চেয়েছিল, তা ফসকে যায় এক-এগারোর অভ্যুত্থানে, যাকে কখনোই রাজনীতির লিটারেচারে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্যুদেতা বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি আরও গভীর সংকটে পড়ে। উঠতি ধনিক শ্রেণির এ রকম একটি দল দীর্ঘদিন সরকারের বাইরে থাকলে এবং ‘উন্নয়নের’ দুধের সর খাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকলে অগুনতি নেতা-কর্মীর দলের প্রতি আনুগত্যের জোরটা কমে যায়, এটা বিএনপি নেতৃত্বের না বোঝার কথা নয়। যদ্দুর জানা যায়, বিএনপি এবার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য মরিয়া।
গত চার দশকে বিএনপি জনভিত্তি ধরে রাখতে পারলেও দলটি নানা কারণে অগোছালো হয়ে পড়েছে। বিএনপির ইতিহাসে ২০০৮ সালের নির্বাচনে তারা সবচেয়ে খারাপ ফল করেছিল। তবু ওই নির্বাচনে তারা ভোট পেয়েছিল ৩৩.২ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের এক-তৃতীয়াংশ ভোটার চরম দুর্দিনেও বিএনপির ওপর আস্থা রেখেছিলেন। এ রকম জনসমর্থন ধরে রাখাটাই হলো বিএনপির সবচেয়ে বড় অর্জন।
বিএনপির কয়েকজন নেতা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘সংলাপ’ করতে খুবই আগ্রহী। এই ‘সংলাপ’ ব্যাপারটা নির্বাচনের গন্ধ নাকে এলেই পালে বাতাস পায়। এতে যে খুব একটা লাভ হয়, তা নয়। আমার মনে হয়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির এখনকার যে সম্পর্ক, তাতে সংলাপের সুযোগ ও সম্ভাবনা খুব কম।
মাঝখানে দুটো বড় বাধা হলো ১৯৭১ ও ১৯৭৫। এ নিয়ে এই দুই দলের মধ্যে কোনো ধরনের রিকনসিলিয়েশন বা আপস-মীমাংসার সম্ভাবনা আমি দেখি না। নাগরিক সমাজের একটি অংশ অবশ্য এ রকম একটি সংলাপ অনুষ্ঠানের পক্ষে এবং এ নিয়ে তারা প্রায়ই বিবৃতি দেয়, কথাবার্তা বলে। আমার ধারণা, ১৯৭১ ও ১৯৭৫ নিয়ে বিএনপির চিন্তাধারায় কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত সংলাপের পক্ষে গীত গাওয়ার কোনো মানে হয় না।
একসময় যাঁরা আওয়ামী লীগকে ডোবানোর কাজে নিয়োজিত ছিলেন, তাঁরাই বিএনপির জনভিত্তি তৈরি করে দিচ্ছেন। বিএনপি ওই অবস্থান থেকে সরে এলে ওই জনগোষ্ঠীর কাছে বিএনপির কি কদর থাকবে? আর বিএনপি যদি তার অবস্থান না বদলায়, ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ও তারপরের ব্যাপারগুলো নিয়ে নিজের অবস্থান খোলাসা না করলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের বৈরিতা কমার আমি কোনো সুযোগ দেখি না।
এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, নির্বাচন যথাসময়েই হবে। সংশয়বাদীরা অবশ্য নানান কথা ইথারে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তার সারমর্ম হলো, অনেক সিদ্ধান্ত হয় নেপথ্যে। সেখানে গুটি চালায় দেশের বাইরের কিছু ছোট-বড় পরাশক্তি। শেষ হাসিটা তারাই হাসে। সেখানে সমীকরণটা কেমন হবে, তা নিয়ে আছে নানান জল্পনা ও গুজব। ইতিমধ্যে ‘র’ নিয়ে আমাদের নেতারা কথা বলেছেন। ১৯৯০-এর দশক থেকেই ‘টুইজডে গ্রুপ’ বা ‘কফি গ্রুপে’র কথা আমরা শুনে আসছি। এক-এগারোর সময় তো কোনো রাখঢাক ছিল না। সুতরাং, ভবিষ্যতে কার ভাগে কল্কে জুটবে তার আগাম পূর্বাভাস দেওয়া মুশকিল।
বিএনপি কেন ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রথম দিকে রাজি হয়নি, তার কারণটা মোটামুটি বোঝা যায়। তারা ধরে নিয়েছিল, ফলাফল পূর্বনির্ধারিত। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা কী বুঝে নির্বাচনে থাকল না, তা নিয়ে দলের মধ্যে নিশ্চয়ই হিসাব–নিকাশ হচ্ছে। ভবিষ্যতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তারা অংশ নিয়ে কতটুকু পেলে সন্তুষ্ট থাকবে, এ নিয়ে নানান মহলে চাপা কথাবার্তা হচ্ছে। চার দশক বয়সের এই দলটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে কতটুকু সক্ষমতা অর্জন করেছে, তা বোঝা যাবে আগামী নির্বাচনে।
আমার এই নিবন্ধটি আজ দৈনিক প্রথম আলো‘য় প্রকাশ হয়েছে।