আগ্রাসী চীনা পুঁজিকে নির্ভরশীল ভারত কীভাবে প্রতিহত করবে? সামরিক যুদ্ধ, নাকি বাণিজ্যিক?
ভারত ও চীন মুখোমুখি। চীনের আক্রমণে, মধ্যযুগীয় অস্ত্র ব্যবহার করে ভারতের ২০ সেনাকে হত্যা করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ১০ জনকে ধরেও নিয়ে গিয়েছিল চীন। যদিও ভারত তার দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র মিত্র দেশ বাংলাদেশের সীমান্তে প্রতিনিয়ত পাখির মত গুলি করে মানুষ হত্যা করে। কিন্তু চীন ও ভারত সীমান্তে ৬২ সালের পর এতবড় সংঘর্ষ আর হয়নি।সেখানে আগ্নেয় অস্ত্র থাকলেও ব্যবহার হয় না। চীনের এরকম আক্রমণে হতবিহব্বল ভারত, দেশটির মিডিয়াগুলো ভয়াবহ প্রেসার দিচ্ছে ভারত সরকারকে চীনের এই হত্যার বদলা নিতে। একইসঙ্গে মিডিয়া থেকে আওয়াজ ওঠেছে চীনা পন্য বর্জন করতে। মিডিয়ার এই জাতীয়তাবাদী যুদ্ধের উশকানিতে কী ভারত আদৌ যুদ্ধ শুরু করবে, নাকি চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করবে। সেটাই এই বড় লেখাতে খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি।
চীনা পুঁজির আগ্রাসনে ভীত বুনিয়াদী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো চীনা পুঁজি ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাতে কারখানা কিনে না নিতে পারে তার জন্য বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই এসব দেশ নানান ধরণের বিধি নিষেধ তৈরি করে। এর কারণ হলো চীনা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রীত পুঁজিবাদ এতোই শক্তিশালী যে বিনিয়োগ তাদের কাছে বাধা নয়, অর্থ তাদের কাছে কেবল সংখ্যা। জার্মানির সব থেকে প্রেস্টিজিয়াস রোবটিক কারখানা কোকো কিনে নেয় ২০১৬ সালে। মানুষ ছাড়া যন্ত্রের মাধ্যমে এখান থেকে ভসকওয়াগান তৈরি হয়। এরপর জা্র্মানিরা নড়েচড়ে বসে। ফলে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দুষলেই হবে না, সারা দুনিয়ার ধনি দেশগুলো চীনা পুঁজির ভয়ে এখন তটস্থ। ভয় এই পর্যায় পৌছেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি কোয়ালকম বিক্রির জন্য দরপত্র আহবানের পর চীনা বিনিয়োগ ভয়ে ট্রাম্প প্রেসিডেন্টশিয়াল হস্তক্ষেপ করেছে। কারণ মোবাইলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মোবাইল নেটওয়ার্ক হেন কোনো টেক রিলেটেড কাজ নেই যা এই জায়ান্ট কোম্পানিটি করে না। যুক্তরাষ্ট্রের এই কোম্পানিটি ব্রডকম নামের একটি কোম্পানি ১১৭ বিলিয়ন ডলারে কিনে নিতে চেয়েছিল।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর ২০১৮ সালের ১২ মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্রডকম সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি মালিকানাধীন কোম্পানি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটিকে সিঙ্গাপুরভিত্তিক চীনা কোম্পানি হিসেবে দাবি করেছেন। যদিও কোম্পানিটি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে হেড কোয়াটার। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাহী ক্ষমতাবলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় কোয়ালকম কিনতে পারেনি ব্রডকম। কিন্তু সারা দুনিয়াতে প্রতি বছর চীনা বিনিয়োগের পরিমান কত? আন্দাজ করাও কঠিন। ২১ জানুয়ারি ২০২০ সালে রয়টার্সের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা দুনিয়াতে চীন প্রতি বছর ১৩৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। এটি অবিশ্বাস, অকল্পনীয়। এতে দুনিয়াজুড়ে বাড়ছে চীনা প্রভাব।
পুঁজিবাদের অর্থনীতিবিদ ও তার প্রিচাররা সর্বদা প্রচার করেন যে, পুঁজির চরিত্রের কারণেই বিশ্বায়ন বা গোলকায়ন হয়েছে। এখন সেই পুঁজি কালো বা সাদা সেটি বিষয় না। তার কাজ হলো জব তৈরি করা, পন্যের মাধ্যমে মানুষকে সেবা দেওয়া এর বদলে খুবই যৌক্তিকভাবে মুনাফা করা। ফলে কোনো দেশ বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগে বাধা তৈরি করতে পারে না। পুঁজিবাদীদের নিজেদের বানানো এই সেট রুলস কিন্তু ভেঙ্গে পড়ছে। তারা নিজেরাই পুঁজিবাদী দেশ হয়ে সমাজতান্ত্রিক প্রটেকশন মডেল এখন ফলো করছে। করোনা ভাইরাস আক্রান্তের পর সারা দুনিয়ার অর্থনৈতিক মন্দা এখন মহামন্দায় পরিণত হচ্ছে। ইতিমধ্যে করোনার কারণে বৈশ্বিক জিডিপি ২.৩ শতাংশ পড়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে চীন ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব্ এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি কেনার জন্য আক্ষরিক অর্থে ডলারের বস্তা নিয়ে ওত পেতে আছে। ওয়ার্র্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডব্লিউটিও) নীতি অনুযায়ী বিদেশী বিনিয়োগ বাধা তৈরি করা যাবে না।
বিষয়টি এতোদুর গড়িয়েছে যে চীন যাতে কোনভাবে ইউরোপের কোম্পানিগুলো কিনতে না পারে সে জন্য ইউরোপিয় ইউনিয়নের মেম্বার স্টেটগুলো বৈঠকে বসেছে সম্প্রতি। গত ৭ এপ্রিল ব্লুমবার্গ জানাচ্ছে, জার্মানি তার এফডিআই (ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট) বা বিদেশী বিনিয়োগের নীতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতালি ও স্পেন চীনা বিনিয়োগ ঠেকানোর সব ব্যবস্থা নিয়েছে। এই ভয়ের কারণ ইউরোপের শেয়ারবাজার পড়ে মাঠির সাথে মিশে যাওয়ায় চীনা কোম্পানিগুলো বড় অংশ শেয়ার কেনার ব্যাপারে নানান চেষ্টা তব্দির চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে ফ্রান্সের জুয়েলারি ব্রান্ড ডিজুলার ৫৫.৪ শতাংশ কেনার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে চীনের সাংহা টুরিস্ট ইয়াউন মার্টের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ফুসান।
ভারত চীনা পুঁজি ঠেকাতে এফডিআই নীতির পরিবর্তন করেছে করোনা ভাইরাসের আগেই ভারতে একটা চর্চার বিষয় ছিল চীনা বিনিয়োগ। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে চীনা পুঁজির বিষয়টি রিতিমত ফোবিয়াতে রুপান্তিরত হয়েছে। ভারতের এফডিআই নীতি অনুযায়ী পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দেশটিতে বিনিয়োগে বড়রকম বাধা পেতো। এটাও দারুন একটা লক্ষ্যনীয় বিষয় যে, ভারত বাংলাদেশের দক্ষিণ এশিয়াতে একমাত্র বন্ধু ও মিত্র রাষ্ট্র। অথচ মিত্রের সাথে ভারতের আচারণ মোটেও মিত্রতাসুলভ না। ভারতের ডাবর, গোদরেজ, ম্যারিকো, ইয়ারেটল কত কোম্পানি কাজ করছে বাংলাদেশে। আর বাংলাদেশে ভারতের টাটা ও অশোকার ট্রাকের বড় বাজার, বাজার রয়েছে ভারতের মটরসাইকেলের, প্রসাধনীর কতকিছুর। কিন্তু বাংলাদেশের যে কোন একটা কোম্পানির একটা সেলস অফিস ভারতে ওপেন করে দেখুন বাংলাদেশ থেকে সেখানে কর্মী পাঠাতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়। এরপর নানান হ্যাঙ্গামাতো রয়েছে। ফলে মুক্তবাজার অর্থনীতি বললেও বাস্তবে সেটি মুক্ত নয়।
থাক সে প্রসঙ্গ। ফিরি চীনে। ভারত করোনাকালে তাদের এফডিআই পলিসি চেঞ্জ করে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের নাম যুক্ত করে দিয়েছে। যদিও চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এভাবে একটি দেশকে লক্ষ্য করে বাণিজ্য বিস্তার ঠেকানোকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতির বিরোধীতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু ভারত হঠাৎই বা কেন চীন ভিতিতে পড়ল?
দ্য হিন্দুর সহযোগী মিডিয়া ডেইলি বিসনেস লাইন ১৯ এপ্রিল প্রকাশিত তথ্যমতে, ভারতের ৩০টি স্টার্ট আপ অনলাইনভিত্তিক উদ্যেগের ১৮টিতে চীনা বিনিয়োগ রয়েছে।বিদেশ বিষয়ে ভারতের থিংক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান Gateway House: Indian Council on Global Relations এর মতে, ভারতের টেকনোলজি খাতে চীনা বিনিয়োগ রয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। ভারতের অ্যাপসগুলোর তথ্য চীনাদের হাতে। এটির কিন্তু একটি সামরিক ও কৌশলগত দিক আছে যা ভারতকে নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।
চীনের আলিবাবার মালিকানা রয়েছে ভারতের পেটিএম, বিগবাস্কেট ও জুমাতোতে। চীনের টিনসেন্টের বিনিয়োগ রয়েছে ভারতের ওলা, ফিলিপকার্ট ও বাইজুতে। পিউপলস ব্যাংক অব চীনের শেয়ার রয়েছে ভারতের এইচএফডিসি ব্যাংকে। ভারতের গ্লান্ড ফার্মা কিনে নেয় চীনের ফুসন। এটিই এখন পর্যন্ত এককভাবে বড় বিনিয়োগ ১.১ বিলিয়ন ডলার। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ২০ এপ্রিল দেওয়া তথ্যমতে, ভারতে চীনা মোবাইল শাওমির কারখানা বসছে। সম্মিলিতভাবে চীনের মোবাইল ফোন ভারতে বিক্রি হয় বছরে এখন প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা (৭.২ বিলিয়ন ডলার)। চীনা কোম্পানি ভারতে দেশটির এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ স্ট্রিল মিল স্থাপন করতে যাচ্ছে।
ভারতের কোম্পানি কিনতে চীন নানান ধরণের কৌশল নেয়। এর মধ্যে প্রধান কৌশল হলো সিঙ্গাপুর ও মরিসাসের অফসোর কোম্পানি। এখাকার কোম্পানিগুলো ভারতে বিনিয়োগ করছে যার পেছনে চীনা বিনিয়োগ থাকে।
ভারত কি চীনা নির্ভরশীলতা কাটাতে পারবে ?
ভারত ও চীনের মধ্যে বছরে বাণিজ্য হয় ৮১ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে চীন থেকে ভারত পন্য আমদানি করে ৬৫ বিলিয়ন ডলার, আর ভারত থেকে ১৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে চীন। এই ফিগারটি দেখে অনেকের মনে হতে পারে তাহলে চীনের বড় বাজার ভারত, চীনই ভারতের ওপর নির্ভরশীল। এমনটি বিভিন্ন বিদেশী ইংরেজি পত্রিকার প্রতিবেদনের নিচে ভারতীয়রা মন্তব্য ঘরে লিখছেনও। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন বিষয়টি এতো স্বস্তা জাতীয়তাবাদ না।
১৯ জুন ২০২০ দ্য হিন্দু এ চীনা নির্ভরশীলতা ভারত আদৌ কাটাতে পারবে কিনা এটি নিয়ে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মুখোমুখি করেন। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ সব প্রশ্ন করেন হিন্দুর রিপোর্টার অনন্ত কৃষান। এ আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির the Institute of South Asian Studies অধ্যাপক Amitendu Palit ও Jawaharlal Nehru University এর the Centre for Economic Studies and Planning অধ্যাপক Biswajit Dhar। এই মুখোমুখি আলোচনায় অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় ওঠে এসেছে।
সেখানে দেখা যাচ্ছে, ভারতের বাজারে চীনা পণ্যর বড় অংশই হলো ভারতের নিজস্ব বাজারে যেসব পণ্য প্রয়োজন হয় তার কাঁচামাল। এর মধ্যে বড় একটি অংশ ওষুধের কাঁচামাল। ভারতের মত এতোবড় জনসংখ্যার দেশে (১৩৫ কোটির বেশি) যতো ওষুধ লাগে সস্তায় তার কাঁচামালের নিরবচ্ছিন্ন যোগান চীন ছাড়া আর কোনো দেশের পক্ষে দেওয়াই সম্ভব না। অর্থাৎ চীনের বাজারের বাইরে যদি ভারত ওষুধের জন্য অন্য দেশ থেকে কাঁচামাল আনতেও যায় তাহলে পৃথিবীর কোনো দেশের এতো সাপ্লাই দেয়ার সক্ষমতা নাই। এর অর্থ হলো ভারতের সবথেকে বড় স্বাস্থ্যখাত, যা এখন ভারত মেডিকেল ট্যুরিজম বলছে; সেটি দাঁড়িয়েছে আছে চীনের কাঁচামালের ওপর। বাংলাদেশসহ ভারতের পাশ্ববর্তী দেশগুলো থেকে ভারতে চিকিৎসা নিতে যায় প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ।
ভারতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন FICCI ও সিএনএনের দেওয়া তথ্যমতে, গত বছর ভারত ৯ বিলিয়ন ডলার মেডিকেল ট্যুরিজম খাত থেকে আয় করেছে। FICCI দাবি এটি বৈশ্বিক মেডিকেল ট্যুরিজমের ২০ ভাগ। আর সিএনএন বলছে, ভারতে প্রতি বছর ২০০ শতাংশ হারে মেডিকেল ট্যুরিজম বাড়ছে। সিএনএনের কাছে ভারতের পর্যটন মন্ত্রী কেজি আলফনস দাবি করেছেন, কম খরচে ভারতে ভালো চিকিৎসা হয়।’ ২০১৫ সালেও ভারতে মেডিকেল ট্যুরিজম থেকে আয় ছিল ৫ বিলিয়ন ডলার। ভারতে কম খরচের পেছনে ওষুধ ও চিকিৎসা সংক্রান্ত সরঞ্জামের ব্যয় কম যার কাচামাল ও বহু ইন্টারমিডিয়েট যন্ত্রাংশ আনা হয় চীন থেকে আমদানি করে।
নিজের অভিজ্ঞতা বলি। বয়স্ক মানুষের কমন একটি রোগ হাড় ক্ষয়। যদি হাড়ের ডেনসেটি মারাত্মক আকারে কমে যায় তখন একটি ইঞ্জেকশন দিতে হয়, এটি অনেকটা ডায়াবেটিক পেশেন্টদের ইনস্যুলিন নেবার মত। প্রতিদিন করে নিলেও একবার একটি এক মাস যায়। এরকম একটির দাম বাংলাদেশে এখন ২৩/২৪ হাজার টাকা। অথচ এই জিনিষ আমি কলকাতা থেকে তিনটি কিনেছি (৩ মাসের জন্য কিনেছিলাম) ওখানকার ১৪ হাজার রুপির মত। এবার নিজেই হিসাব করুন। এর কারণ হলো, কমদামে আনা চীনা কাঁচামাল।
শুধু কী ওষুধ? ভারতের কোনো প্রসাধনী ধরুন তার কাঁচামাল আসছে চীন থেকে। এখন ভারত অনেক প্রসাধনী বাংলাদেশ সহ তার পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে রপ্তানি করে, সেসবতো চীনের কাঁচামাল দিয়ে তৈরি। শুধু কী ওষুধ কিংবা প্রসাধনী? ভারতের অধিকাংশ পণ্যের কাঁচামাল আসে চীন থেকে। চীন একটি পরিপূর্ণ সাপ্লাই চেন ব্যবস্থা তৈরি করেছে। আপনি যদি চীনের পণ্য ব্যবহার না করেন কিন্তু চীনের এই সাপ্লাই চেনের বাইরে আপনি যেতে পারবেন না। আর যেসব দেশ বেশি বেশি রপ্তানীর দিকে ঝুকে থাকে তাদের জন্য বিষয়টি আরো চ্যালেঞ্জিং। কারণ পন্যের দাম ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তাকে নিরবচ্ছিন্ন ও সাশ্রয়ীমূল্যের ইন্টারমিডিয়েট কাঁচামালগুলো আমদানি করতে হয়। এটির জন্য চীনের বিকল্প নেই।
ভারতের কৃষির জন্য যে সার প্রয়োজন সেটাও আসে চীন থেকে।
এরকম একটি পরিস্থিতিতে চীনের সঙ্গে ভারত কী পাল্লা দিতে পারবে? বা চীন কী আদৌ চায় যুদ্ধ হোক? অথবা ভারত কী চায় বড় না মাঝারি না এমন কী ছোট আকারে কোনো যুদ্ধ বাধুক?
যারা চীন ভারতের সামরিক দিকটা খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তারা জানেন, চীনের সাথে যুদ্ধ বাধানোর ফল ভারতের জন্য একদম বিপদ ডেকে আনা। কারণ এর আগের ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনা সেনা ভারতের নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার আসাম পর্যন্ত চলে এসেছিল। ভারতের চেয়ে চেয়ে দেখার বেশি কিছু করতে পারেনি। চীনের লাল ফৌজ বা পিউপলস লিবারেশন আর্মির এমন ক্ষীপ্রতার কথা ভারত ভালো করেই জানে। সেবার চীন ভারতের বড় একটা অংশ দখল করে আকসাই চীন নাম দিয়ে সেটা নিজের বলে পাকাপাকি করে নিয়েছে। আকসাই চীন বহুকাল ধরেই চীন তার নিজের বলে দাবি করলেও ৩৭ হাজার কিলোমিটারের এ সামরিক কৌশলগত স্থানটি ৬২টির পর পাকাপাকি দখলে নেয়। এবার যুদ্ধ বাধলে চীনের মানচিত্র ভারতের আরও ভেতরে প্রবেশ করবে কিনা সেটা বলা মুশকিল। কারণ ইতিমধ্যে চীনা কৌশলে নেপাল তিনটি বিরোধপূর্ণ জায়গা নিজের দাবি করে সরকারি মানচিত্র ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান জন্ম থেকে ভারতের শত্রু। বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে মাত্র ১৬ কিলোমিটারের একটি বিভাজক হলো শিলিগুড়ি যা মুরগির গলা বা চিকেন নেক বলা হয়। এমনিতেই ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যে সশস্ত্র আন্দোলন চলছে, এর একটি অংশের সাথে চীনের সীমান্ত রয়েছে। ফলে ভারত কতখানি সামনে যাবে সেটা অনুমান করা যায়। কারণ চীন পাকিস্তান না, যে একটি কথিত সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে পাকিস্তানের খোলা প্রান্তরে কিছু গাছ ফেলে দিয়ে ঘোষণা দেওয়া হলো ২০০ জঙ্গি নিহত। চীনের ক্ষেত্রে এরকম ঘটনা ভারত ঘটাবে না সেটা বোঝা যাচ্ছে।
কিন্তু ভারতের পত্রিকাগুলো যেভাবে জাতীয়তাবাদ উশকে দিচ্ছে তাতে রাজনৈতিক চাপ বিজেপির ওপর বাড়বে। সেই রাস্তায় বিজেপি পাড়া দিলে যোলকলা পূর্ন্য হবে। আম ও ছালা দুটিই যাবে। ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা সঙ্গিন। সীমান্তে চীন যখন প্যারেকওয়ালা কাঠ দিয়ে ২০ সেনাকে হত্যা করেছে চীন আরও ১০ জনকে ধরে নিয়ে গেছে ঠিক তখন চীনা প্রভাবধানী এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক থেকে ভারত ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। এটাই হলো ভারতের অর্থনীতি ও ভারতের বাস্তবতা।
ফলে কলম ও কিবোর্ড দিয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ প্রচার ও প্রসার ঘটিয়ে টিভি, পত্রিকা ও মিডিয়ার বিসনেস হতে পারে কিন্তু তা দিয়ে আদৌ চীনের সঙ্গে না সামরিক না অর্থনৈতিক টেকসই যুদ্ধ হবে। আর হলেও তার পরিণতির ফল গিয়ে কোথায় দাড়ায় সেটা প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদেরও ভেবে রাখা দরকার। কারণ যুদ্ধ একটা নিকৃষ্ট ব্যবস্থা। সেটি চীন ও ভারত যেই করুক।