তাহাদের কথা
মহল্লায় কেউ মারা গেলে আজান আলি মোটামুটি খুশিই হয়। অবশ্য সচেতনভাবে নিজের কাছেই সেই কথাটা অস্বীকার করে। সব মানুষই করবে। কিন্তু সত্যি কথাটা হচ্ছে– সে খুশি হয়। বেশ খুশি হয়। কেননা মহল্লার কোনো মানুষের এন্তেকালের সঙ্গে তার নগদপ্রাপ্তির যোগ আছে। মহল্লার কেউ মরলে তার দু’পয়সা আয় হয়। এটা তার সাইড ব্যবসা। কিংবা বলা যায় চাকরির উপরি আয়।
মানুষের মৃত্যুর ব্যাপারটা আমাদের কাছে দুঃখের। কিন্তু মুর্দাকে নিয়ে যার ব্যবসা, যেমন ‘বিদায় ঘর’ এর মালিক, কোনো লোক না মারা গেলে তার ব্যবসা লাটে উঠবে না! তার দোকানে কাফনের কাপড়, আগরবাতি, কর্পূর, চা-পাতা, গোলাপজল যদি সারাদিনে অন্তত একটা সেট বিক্রি না হয়, তাহলে কি তার মন খারাপ করবে না? আর যদি পর পর সাতদিন বিক্রি না হয়, তাহলে তো তার চেহারা ডায়রিয়া রোগীর মতো দড়কচা মেরে যাবে। নিশ্চয়ই যাবে। কেননা দোকানে মাল বিক্রি হোক না হোক বাড়িতে চুলা জ্বলবেই, মেয়ের ভার্সিটির খরচ, ছেলের কলেজ যাওয়া, হাতখরচ, বউয়ের ব্লাডপ্রেসারের ওষুধ– এসব তাকে জোগাড় করতে হবেই। তার সঙ্গে আছে দোকানভাড়া, পাখা-বাতির বিল, কর্মচারির বেতন, ক্যাডারের হপ্তা। এসব না দিয়ে তো সে পার পাবে না। কাজেই মহল্লার লোক না মরলে তার বেঁচে থাকাই মুশকিল।
লোক না মরলে আজান আলিকে অবশ্য ততটা চিপিতে পড়তে হয় না। কেননা সে ব্যবসায়ী নয়। তার আছে চাকরি। মাইনে বাঁধা। লোক মরুক না মরুক তাকে দিনে-রাতে পাঁচবার আজান দিতে হয়। গত ছয় বছর ধরে সে ঢাকা শহরের এই মহল্লার মুয়াজ্জিন। বেতন মাসে দুই হাজার টাকা। থাকার ব্যবস্থা মসজিদেই। কাজেই ঢাকার মতো শহরেও তার চলে যায় এই টাকায়। তবে কোনো শখ পূরণ কিংবা বাড়িতে টাকা পাঠাতে হলে উপরি আয়ের ওপর নির্ভর করতেই হয়। কিন্তু সে তো আর ইমাম সাহেব নয় যে হপ্তায় গণ্ডাখানেক মিলাদ পড়িয়ে হাজার হাজার টাকা পাবে। তার উপরি আয় বলতে মহল্লায় কেউ মরলে তার মৃত্যু সংবাদ মসজিদের মাইকে প্রচার করা।
এই কাজটায় অবশ্য দুই পক্ষেরই লাভ। মাইক ভাড়া করে মহল্লায় সংবাদ প্রচার করতে গেলে খরচ অনেক। মাইকভাড়া, রিকশা ভাড়া, ঘোষকের পয়সা– সব মিলিয়ে দেড়-দুই হাজার টাকার ধাক্কা। তার চেয়ে আজান আলিকে জানালেই হলো। সে মসজিদের মাইক থেকে পাঁচ-দশ মিনিট অন্তর অন্তর ঘোষণা দিয়ে যাবে। আর তার বলার ভঙ্গিটাও বেশ ভালো। শোক মেশানো। কাব্য করে বলা যায়– বেদনাবিধূর। থেমে থেমে শোকছড়ানো থমথমে গলায় আজান আলি ঘোষণা দেবে– মহল্লার অমুক রোডের অত নম্বর বাড়ির বাসিন্দা জনাব/জনাবা অমুক গতকাল রাত বারোটায় হৃদযন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হইয়া এন্তেকাল করিয়াছেন। মরহুমের/মরহুমার নামাজে জানাজা আজ বাদ জোহর মহল্লা মসজিদের চত্বরে অনুষ্ঠিত হইবে। ফজরের নামাজের পর থেকে সে ঘোষণা দেওয়া শুরু করবে। থেমে থেমে চালাবে বেলা নয়টা পর্যন্ত। তারপর আবার শুরু করবে সাড়ে বারোটার দিকে। সর্বশেষ ঘোষণাটি হবে জোহরের নামাজের শেষে জানাজা শুরুর ঠিক পাঁচ মিনিট আগে।
অর্থাৎ আজান আলি সার্ভিস দেয় খুব সুন্দরভাবে। আবার টাকা-পয়সার ব্যাপারেও সে কোনো হুজ্জোতি করে না। কেউ দুই শ দিলে তাই-ই সই, দেড় শ দিলেও, এমনকি এক শ দিলেও। মহল্লার লোকজন, বিশেষ করে মুসল্লিরা তার ওপর বেশ সন্তুষ্ট। বাইরের লোক অবশ্য শুধু নগদ টাকার ব্যাপারটাই খেয়াল করে। আজান আলির হিসাবে আরো কিছু যোগ হয়। যেমন মৃত্যুর তিনদিনের মাথায় মিলাদ। সেখানে তাকে বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হয়। গোলাপজল ছিটানো থেকে সিন্নি বিলানো পর্যন্ত। দু-দশ টাকা তার জোব্বার পকেটেও ঢুকিয়ে দেওয়া হয় অনেক ক্ষেত্রে। তারপরে আছে চল্লিশা। এই শহরের চল্লিশাও এক আলীশান কারবার। তাদের গাঁয়ের চেয়ারম্যানের ছেলের বিয়ের চাইতেও এই শহরের চল্লিশার জৌলুস অনেক বেশি। সেদিনও তার খানাপিনা জোটে অঢেল। সব মিলিয়ে বেশ ভালোই আছে আজান আলি।
গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ফুটানির বাজার গ্রামের আহছান আলি বা আছান আলি বা আজকের আজান আলির ছয় বছর আগে সম্পদ বলতে ছিল ভ্যানরিকশা চালানোর দক্ষতা আর সুরেলা গলা। ওদের এলাকার পুরুষদের সঙ্গতি থাকুক আর না থাকুক, বিয়ের পর বিয়ে করতে তারা ওস্তাদ! ওদের গাঁয়ের খাঁ গোষ্ঠীর সাত ভায়ের চোদ্দ বউ। এমনও মরদ আছে যার নিজের এক পয়সা উপার্জনের মুরোদ নেই কিন্তু বউ তার তিনজন। মজার ব্যাপার হচ্ছে তিন বউ কাজ-কর্ম করে সোয়ামীকে খাওয়ায়-পরায়। তো আজান আলির ঘরেও সৎ মা। সৎ ভাইবোনও। নিজের মায়ের পেটঝাড়া একমাত্র সন্তান সে-ই। একমাত্র সন্তান। গরিব অশিক্ষিত মা যতখানি পেরেছে আদর-যত্ন দিয়ে মানুষ করেছে ছেলেকে। বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছেও ছেলে ল্যাগব্যাগ করত, কোমরে-হাতে-পায়ে জোর কম, গায়ে-গতরে গোশত কম। তাই দেখে মায়ের দীর্ঘশ্বাস পড়ত– ছোলেক ভালো-মন্দ কিছু কী খিলাবার পারিছি যে ছোলের গায়েত শক্তি হবি!
তা সেই ছেলের গায়েও যৌবনের ধর্মে কিছুটা শক্তি এলো। সে ভ্যান-রিকশা চালানো শুরু করল। ফুটানির বাজার থেকে গোলাপবাগ। তার সঙ্গে গান! ফিল্মের গান, ভাওয়াইয়া, মাদারের গান। তবে দুটো জিনিস তার গলায় খুব ভালো খেলত। একটা হলো ‘আমার সোনার বাংলা’ গান, আরেকটা হলো আজান। তো যে সময়ে তার ভ্যান-রিকশা চালানোর ক্যারদানি আর কণ্ঠের সুরেলা কসরতে যুবতী মেয়েরা তার দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করেছে, তখনই একদিন তার মা ঝপ করে মরে গেল।
সব্বোনাশের ওপর সব্বোনাশ!
মা মরার পরে মাসকানেক বিবাগী হয়ে ঘুরল আজান আলি। ভ্যান-রিকশার প্যাডেল ছোঁয়নি একবারও। গানের মধ্যে গেয়েছে শুধু মর্সিয়া। কিন্তু তার দুঃখে তো জগত থমকে থাকে না! ভ্যান-রিকশা কেনা হয়েছিল ব্র্যাক থেকে ঋণ নিয়ে। হপ্তায় হপ্তায় কিস্তি দেবার কথা। চার কিস্তি বাকি পড়তেই ব্র্যাকের ম্যানেজার দলবল নিয়ে এসে ভ্যান-রিকশা বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে চলে গেল। সেইসঙ্গে আগে জমা দেওয়া টাকাগুলোও গেল।
ততদিনে অবশ্য তার শোক প্রায় থিতিয়ে এসেছিল। তার ওপরে ভ্যান-রিকশা বাজেয়াপ্ত হওয়ায় পুরো হুঁশ ফিরে এলো। সাহায্য চাওয়ার মতো আছে একমাত্র বাপ। তার কাছে টাকার জন্য ধর্না দিলে বাপ হাঁপানির হাপরটানা বুকে শ্লেষ মিশিয়ে বলল– ক্যান বাহে! তুমি গান গায়্যা রাস্তাত রাস্তাত ঘুরেক। ট্যাকা হাঁটি হাঁটি ঘরোত আসপি।
এই শ্লেষও সে হজম করে ফেলেছিল প্রায়। কিন্তু বাপের পরের বাক্যে তার মাথায় আগুন ধরে গেল– কত ঢঙ করবার লাগিছ! মাও জানি আর কারো মরে না বাহে।
তুই কি বুঝবু শালা মা মরার কষ্ট! শালা মাদারচোদ মাগিখোর! তোর বউ মরিছে, তুই তো খুশি। আরেকখান মাগি ঘরোত নিবার পারবু।
বাপের মুখের ওপর কথাগুলো বলে ফেলে সে নিজেই হতবাক হয়ে গিয়েছিল। আর বাপ তো হা বন্ধ করতেই পারছিল না। যখন কথা বলতে পারল, শব্দ নয়, বেরুল আষাঢ় মাসের মেঘের গর্জন– বার হয়া যা শুয়োরের ছোল! হামার ঘরোত যানি তোক আর না দেখি।
তৎক্ষণাৎ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো আজান আলি। ভ্যান-রিকশায় সোজা মহিমাগঞ্জ স্টেশনে। উঠে বসল ঢাকা মেইলে।
দুই)
তার দুই-চারজন শুভাকাঙ্ক্ষী আগেই বলেছিল যে সে যদি রিকশাই চালাতে চায়, তাহলে তার ঢাকাতেই যাওয়া উচিত। এই গাঁও-গেরামে মানুষ ভাড়া আর কয় ট্যাকা দেয়। তোমার রিকশা টানতে পুটকি ফাট্ ফাট্ করে, কিন্তু এক চালানে ভাড়া উঠে চার কী ছয় ট্যাকা। আর ঢাকার টাউনোত প্যাডেল ঘুরালেই বিশ ট্যাকা। ওটিত যা। ট্যাকা কামাবার পারবু। আর ট্যাকা কামালে বাকি সুখ সুড়সুড় করিয়া ঘরের মাগির মতোন ঘরোত ঢুকবি।
তো রাগ করে সে ঢাকা চলে এলো বটে, কিন্তু ঢাকা তো আর সবার জন্য আঁচল পেতে বসে থাকে না। কত ধাক্কা-গলাধাক্কার বিড়ম্বনা সহ্য করে সে এই মসজিদে থিতু হলো, আছান আলি থেকে আজান আলি হলো সেসব ভিন্ন উপাখ্যান। শুধু বলা যায়, সে এখন ভালোই আছে। অন্তত যতটুকু ভালো থাকাকে তাদের দৃষ্টিতে ভালো থাকা বলে, সে ততটুকু ভালো আছে নিশ্চয়ই।
ফুটানির বাজারের সেই অপুষ্ট তরুণ, যার গায়ে দাদ-চুলকানি-ঘামাচির রাজত্ব, পরনের ময়লা গেঞ্জি যার গায়ে সাদাটে কর্দমের মতো লেপ্টে থাকত, তার পরনে এখন পরিষ্কার লুঙ্গি-জোব্বা-টুপি। থুঁতনিতে নূর। চামড়ায় পরিচ্ছন্নতার জেল্লা।
তার আগের মুয়াজ্জিন ইয়াসিন মোল্লা, নোয়াখালী জেলার মানুষ, সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সে নিজের এলাকায় ফিরে গেছে। তার ছেলেরা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। ছেলেদের কথাতেও বুড়ো বাড়িতে ফিরত না। কিন্তু যখন শুনেছে যে গাঁয়ের লোকে তাকে এখন মোটামুটি বড়সড় আলেম মনে করে, তারা এখন তাকে গাঁয়ের মসজিদের ইমাম বানাতে চায়, তখন আর বুড়ো না গিয়ে পারেনি। আজান আলি এখন বোঝে, একজন মুয়াজ্জিনের সারা জীবনের স্বপ্ন ইমাম হওয়া। সেই প্রমোশনের খুশিতে বুড়ো আজান আলিকে দান করে গেছে নিজের তোষক আর বালিশ।
গত তিনদিন মহল্লায় কোনো মানুষ মরেনি। তা নিয়ে অবশ্য মন খারাপ হয়নি আজান আলির। আজ দুপুরে আছে মস্ত জেয়াফত। মহল্লার এক প্রভাবশালী পরিবারের প্রধানের এন্তেকালের আজ চল্লিশার খাওয়া দুপুরে। কোনো জেয়াফত না থাকলে আজান আলি তিনবেলাই খায় বিহারির হোটেলে। ঢাকা শহরের হিসাবে সস্তাই বলতে হবে হোটেলের খানা। আজ সকালে নাস্তা করতে গেলে মুমতাজ বিহারি হেসে বলল– আইজ ছক্কালে না খাওনই ভালো মুয়াজ্জিন ছাব। হুনছি মোড়ল ছাবের কুলখানিতে অ্যায়ছা খানা-পিনার এন্তেজাম হইতাছে যে একবেলা খাইলে মেহমানের আর তিনদিন খাওন লাগব না।
আজান আলি হাসল। রসিকতা তো রসিকতাই। একবেলায় আর কতই খাওয়া যায়! একসঙ্গে পেটে যদি তিনবেলার খাবার আঁটানো যেত, তাহলে কে আর তিন বার খাবারের কথা ভাবত। সে রোজকার মতোই দুটো চাপাতি খেল বুটের ডাল দিয়ে। ঢেকুর তুলে বলল– শোকর আলহামদুলিল্লাহ!
আরে অহনই যদি আলহামদুলিল্লাহ কন তাইলে চল্লিশা খাওনের পর কইবেন কী? তখনকার লাইগা ইস্পেশাল দোয়া একখান রেডি কইরা রাখেন।
বাদ জোহর চল্লিশায় হাজির হয়ে আজান আলি মনে মনে ভাবল মুমতাজ বিহারি ঠিকই বলেছে। ডাল-রুটি খাওয়ার পর যদি শুকরিয়া আদায় করতে হয়, তাহলে এইসব শাহীখানার পরে নিদেনপক্ষে সেজদায় যাওয়া উচিত।
আর মেহমানদেরও যা শান-শওকত! বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে অন্তত শ’ দেড়েক। এই গলিতে আর কোনো গাড়ি দাঁড়ানোর জায়গা তো নেই-ই, মোড়ের মাথাতেও জ্যাম লেগে গেছে। তা লাগুক। কার ক্ষমতা আছে জ্যামের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করবে! অন্তত দুইজন ফুলমন্ত্রী আছে মেহমানদের মধ্যে, হাফ আর কোয়ার্টার মন্ত্রী জনা পাঁচেক, সচিব-উপসচিব-সরকারি নেতা-বিরোধী নেতা মিলিয়ে বাংলাদেশের মাথাটাই আজ এই কুলখানি মাহফিলে। কী তাদের আভিজাত্য আর জেল্লা! আর মেয়েমানুষ! মাশাল্লাহ। এত রূপসী যে বাংলাদেশে আছে ঢাকা শহরে না এলে জানাই হতো না আজান আলির। বিভিন্ন মাহফিলে রূপসী দেখা যায়। কিন্তু আজকের মাহফিল এদিকেও সেরা। আহা, বেহেশতী হুরের যে বর্ণনা ইমাম সাহেব দেন, এরা বোধহয় তারাই। ‘হুরদের পরনে সত্তর পর্দা কাপড় থাকিবে, তবু তাহাদের সৌন্দর্য-সম্পদ পরিষ্কার দেখা যাইবে।’ আহা সেই বয়ানের চাক্ষুষ প্রমাণ এখানে পাওয়া যাচ্ছে। কী মাছি পিছলানো ত্বক তাদের। চলনে-বলনে যেন করতোয়ার ঢেউ। যে কোনো জনের দিকে চোখ পড়লেই আজান আলির কান দিয়ে ভাপ বের হয়। তার বুকের মধ্যে সিরসির করে। আস্তাগফেরুল্লা। আল্লা, তুমি মোর চোখ-কান জেনা হইতে রক্ষা করেন! কিন্তু চোখ-কান আল্লার দোহাই মানে না। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে খানা খায় আজান আলি। বাড়ির বড় ছেলে স্বয়ং মন্ত্রী-সচিবদের খাওয়া তদারক করার ফাঁকে এসে তার এবং ইমাম সাহেবের খানা ঠিকমতো হচ্ছে কি-না খোঁজ নিয়ে যায়। তবু আজান আলি প্রাণ খুলে খেতে পারে না।
বিদায় নেবার সময় তার জোব্বার পকেটে গুঁজে দেওয়া হলো নগদ পাঁচ শ টাকার নোট। ইমাম সাহেবকে নিশ্চয়ই আরো বেশি। এত টাকা হাদিয়া পেয়ে আজান আলির খুশিতে বাগ বাগ হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু সে পুরোপুরি খুশি হতে পারে না। টাকা গুঁজে দেওয়া মানে তাকে এখন বিদায় নিতে বলা। কিন্তু আজান আলির এখন বিদায় নিতে ইচ্ছা করে না। এইসব হুরপরীদের রেখে চলে যেতে তার পা সরে না। আহা, হুরেরা যখন গাড়িতে উঠে বসে তখনো কী শোভা! ড্রাইভার গাড়ির দরজা মেলে ধরে। আর তারা শাড়িটা একটু গুটিয়ে নেয় গাড়ির দরজায় পা তোলার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে ধবধবে বিজলি চমকায়। তারপরে একটু বাঁকা হয়ে একটু কাত হয়ে কোমরে ঢেউ তুলে তারা গাড়ির মধ্যে ঢুকে নরম সিটের ওপর নরম নিতম্ব ধপাস করে ফেলে দেয়। আজান আলির ইচ্ছা করে শেষ হুর বিদায় নেওয়া পর্যন্ত সেখানে থাকতে। কিন্তু একদিকে তাকে বিদায় নেবার সংকেত দেওয়া হয়েছে, দ্বিতীয়ত আছরের আজান দেবার সময় হয়ে আসছে বিধায় তাকে বিদায় নিতে হবেই। এই প্রথম আজান আলি আজান দেবার ব্যাপারে মনে মনে নিদারুণ বিরক্তি অনুভব করে।
সেই রাতেই এক হুর আসে তার মসজিদে।
প্রথমে সে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিল।
মসজিদে মেয়েমানুষ! তা-ও আবার রাতের বেলায়! ভয়ে সে ঢাকাইয়া বুলি ভুলে নিজের ভাষায় প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে– কে বাহে? বেটি ছোল এত আইতত মজ্জিদে ক্যা?
দেখা যায়, তার প্রায় চেঁচিয়ে ওঠাতেও ভড়কায় না হুর। বরং মুখে আঁচল পেঁচিয়ে ফিক করে হাসে।
আজান আলির শরীর ব্যেপে জ্বর আসে। ঘাম নামে দরদরিয়ে। গলা মুহূর্তের মধ্যে শুকিয়ে কাঠ। কয়েকবার ঢোক গিলে চিঁ চিঁ করে বলে– অ্যাংকা চুপ ক্যা? তুমি মজ্জিদে ঢুকিছেন ক্যা?
হুর এবারও উত্তর দেয় না। তবে মুখের আঁচল সরিয়ে তার দিকে মুখোমুখি তাকায়।
আজান আলি আবারও চমকায়। এ যে কোহিনূর! তাদের গ্রাম ফুটানির বাজারের কোহিনূর।
মা বেঁচে থাকতে কোহিনূরের সাথে তার বিয়ে দিতে চেয়েছিল। সেই শ্যামলা কিশোরী এখন পুরোপুরি হুরের ছুরত পেয়েছে!
ক্বো-কোহিনূর! তুমি ক্যাংকা করা ঢাকার শহরোত আসলা? ক্যা আসল্যা?
আপনেক খুঁজতে?
ক্যা?
ক্যা আসিছি বুজেন না?
না।
সত্যিই বুজেন না?
নাহ্!
এবার কোহিনূর আজান আলির আরো কাছে এগিয়ে আসে। দাঁড়ায় প্রায় বুকে বুক মিশিয়ে। তারপরে কোনো নোটিশ না দিয়েই ঢলে পড়ে তার গায়ে। এই জন্য!
ঢং ঢং করে দেয়াল ঘড়িতে পাঁচটা বাজে।
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে আজান আলি। অন্যান্য মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসছে। হায় হায় কী বদখোয়াব দেখল আজান আলি। তার লুঙ্গি ভেজা। গোসল করা দরকার। কিন্তু আজান দিতে দেরি করাও চলে না। একটু দ্বিধা করে আজান আলি ঐ অবস্থাতেই টুপি মাথায় মাইকের সামনে দাঁড়ায়। আল্লা মাফ করুক!
তিন)
তারপর থেকে কী হয়, আজান আলি সর্বত্র কোহিনূরকে দেখতে থাকে। রাতে মসজিদে নাপাকি শরীরে ঘুমভাঙা তো আছেই, দিনের বেলায় পথে বেরুলেই সে শুধু কোহিনূরকে দেখতে পায়। গার্মেন্টের মেয়েরা কাজে যাচ্ছে কিংবা কাজ শেষে ফিরছে, তাদের মধ্যে কোহিনূর। দূরে দেখা যায় কয়েকটা মেয়ে রাস্তা পার হচ্ছে, তাদের মধ্যে কোহিনূর। সুপার মার্কেটের সিঁড়ি দিয়ে নামছে কোহিনূর। গোলাপ শাহের মাজারে মোমবাতি দিতে এসেছে কোহিনূর। টেম্পোর সিটে কোহিনূর। পাজেরোতে কোহিনূর। নিশান পেট্রোলে কোহিনূর। অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে সে নামাজে সেজদাতে গিয়ে চোখ বুঁজলেও কোহিনূরকে দেখতে পায়।
উপায়-অন্তর না দেখে সে ইমাম হুজুরের শরণাপন্ন হয়। হুজুর তাকে তাবিজ দেন। কিন্তু মুখে বলেন– এই গুলান খালি তাবিজ-কবজের কাম না। যে বয়সের যে ধর্ম। অহন বয়সের ধর্ম তোমারে পাইয়া বসছে। শাদি করা তোমার জরুরি হইয়া পড়ছে। দ্যাশে যাও। ভালো পাত্রী দেইখা শাদি কইরা ফালাও। মাসখানেকের ছুটি নাও।
ইমাম সাহেবের শেষের কথা তার পক্ষে পালন করা অসম্ভব। তাছাড়া যতই কণ্ঠে মধু মিশিয়ে বলুক, ইমাম সাহেবের দূরভিসন্ধি সে ঠিকই টের পায়। বহুদিন থেকেই ইমাম সাহেব চেষ্টা করছে তার টাইটেল-ফেল ভাতিজাকে মুয়াজ্জিনের পদে বসাতে। আজান আলির সুরেলা আজানই শুধু তাকে স্বপদে বহাল রেখেছে। কিন্তু মাসখানেকের জন্য গ্রামে গেলে ফিরে এসে আর চাকরি ফেরত পাওয়া যাবে না।
দিন যায়, সপ্তাহ, মাস গড়িয়ে যায়, তাবিজে কোনো কাজ হয় না।
কিন্তু তাকে যে বিপদ থেকে মুক্তি পেতেই হবে!
মানুষ মরিয়া হয়ে কোনো সমস্যার পেছনে লাগলে সমাধান একটা না পেয়েই যায়। আজান আলিও পেল। সমাধান পেল নাজিমুদ্দিনের কাছ থেকে।
নাজিমুদ্দিনও তারই মতো মুয়াজ্জিন। লালমাটিয়া মসজিদের। পাশাপাশি এলাকার মসজিদ, তাই চিন-পরিচয় ছিলই। তদুপরি দুইজন একই বয়সের। দুজনের সম্পর্ক মোটামুটি ভালোই। এতদূর ভালো যে ঠেকা-বেঠেকায় পরস্পর পরস্পরকে ধার-কর্জও দেয়। তাবিজে ফল না পেয়ে নাজিমুদ্দিনকে সে সমস্যার কথা বলতে বাধ্য হলো। হায় আল্লা! তার এতবড় সমস্যার সমাধান এক ফুৎকারে বাতলে দিল নাজিমুদ্দিন। কাজ হবেই। গ্যারান্টি দিল নাজিমুদ্দিন। কারণ একই সমস্যায় কিছুদিন আগে নিজেও ভুগেছে সে।
কিন্তু সমাধান শুনে আঁতকে উঠেছিল আজান আলি। সর্বনাশ! কেউ জেনে ফেললে?
দূর কে জানব!
তাচ্ছিল্যভরে উদ্বেগ উড়িয়ে দিয়েছিল নাজিমুদ্দিন।
ঐসব জাগাত কেউ কাউরে চিনে না। হক্কলেই নিজেরে লুকাইতে ব্যস্ত। কেউ কারু দিকে তাকাইবার ফুরসত পায় না।
কিন্তু তাদের পরনে জোব্বা। মুখে নূর।
জোব্বার বদলে হাওয়াই জামা পইরা যাই। দাড়ি ঢাকি গামছা দিয়া।
চার)
সোডিয়াম বাতির আলো গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে বেশিদূর যেতে পারে না। আর কেউ কারো মুখ খুব ভালো করে দেখতেও পায় না। তবু বুকের ঢিব ঢিব থামে না আজান আলির। কিন্তু নাজিমুদ্দিন নির্বিকার। অভ্যস্ত হাতে টাকা দেয় দালালকে। দালালের টাকা আলাদা। পুলিশের টাকা আলাদা। পুলিশ দুজন বসে আছে সিমেন্টের বেঞ্চে। হাত পঁচিশেক দূরে। পুলিশের ভাগটা দালালই দিয়ে আসে। তাদের দিকে ইঙ্গিত করে। পুলিশ নিস্পৃহ চোখে তাদের দিকে তাকায়। তারপর হাতের ইশারা করে ভেতরে ঢুকতে। তারা দুজন এবার গেট পেরিয়ে পার্কে ঢোকে। এখানে আলো-আঁধারি আরো গাঢ়। পায়ের নিচে লম্বা ঘাস। আজান আলির গোড়ালিতে সুড়সুড়ি লাগে। অল্প দূরে দূরে ঝোপ। প্রতিটি ঝোপের ওপর ছাতার মতো দাঁড়িয়ে আছে মেহেদি, কিংবা বেলি কিংবা শেফালি গাছ। সেই গাছের নিচে গাছের মতোই প্রায় অনড় দাঁড়িয়ে একটা মেয়েমানুষের কাঠামো। দালাল তাদের দুইজনকে দুটি ঝোপ দেখিয়ে দেয়। আজান আলিকে কাছের ঝোপটার দিকে পাঠিয়ে দিয়ে নাজিমুদ্দিন এগিয়ে যায় অপর ঝোপটির দিকে।
আজান আলির পা যেন পাথর। সে নড়তেই পারে না। ঝোপের পাশ থেকে অসহিষ্ণু চাপা গলা ভেসে আসে– কী হইল দেরি করেন ক্যান? চইলা আহেন!
অমোঘ মন্ত্রের মতো ডাক। আজান আলি এগিয়ে যায়। সে হাত তিনেকের মধ্যে পৌঁছুনোর সঙ্গে সঙ্গে রমণী চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে ঘাসে বিছানো পলিথিনের ওপর। আজান আলি আরো ছোট ছোট দুই ধাপ এগোয়। তখন রমণী নিজের শাড়ি নিজেই একটানে গুটিয়ে নেয় কোমর পর্যন্ত। আজান আলি আবার ভূত দেখার মতো চমকায়। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার সমস্যার সমাধানের দিকে। রমণী এবার চাপা গলাতেই খলখলিয়ে হাসে– খালি চাইয়া চাইয়া দেইখাই রাইত কাবার করবা! নাগর নতুন নিহি?
রমণীর শরীর যেন সাপুড়ের বীন। আজান আলির গলার কাছে দলা পাকানো দ্বিধা। তবু যেন মাধ্যাকর্ষণের অমোঘ টানে নিজেকে সে নিক্ষেপ করে রমণী শরীরের ওপর। তার শরীরের সবগুলো পেশি কেঁপে কেঁপে উঠছে, দাঁতের ওপর থেকে সরে গেছে ঠোঁট, গলা দিয়ে বেরুচ্ছে গড়গড় আওয়াজ। সে সবলে জড়িয়ে ধরে রমণীকে। অস্ফুটে বলে ওঠে– কোহিনূর! হামার কোহিনূর!
মুহূর্তে তার বুকের নিচের নারীদেহটি শক্ত হয়ে যায়। শক্ত এবং ঠান্ডা। যেন বরফ। আজান আলির খোঁয়াড়ি তখন চটকে গেছে। সে আবার দেহমিলনে তৎপর হতে চায়। কিন্তু মিলনসঙ্গিনী একইরকম শক্ত এবং ঠান্ডা। আজান আলি নিজের শরীরের উষ্ণতা দিয়ে বরফ গলাতে চায়। অস্ফুটে বলে– হামার জান!
এবার শব্দ জাগে নারীদেহে। খলখল করে হেসে ওঠে নারী।
আর কী আশ্চর্য! সঙ্গে সঙ্গে ডান পাশের ঝোপ থেকেও একই ধরনের হাসির শব্দ আসে।
তারপর বামপাশের ঝোপ থেকে।
তারপর ঝিলের অন্যপাড়ের ঝোপগুলি থেকে। একের পর এক এক।
একই রকম হাসির শব্দ। যেন একটা আরেকটার প্রতিধ্বনি।
আজান আলি থমকে যায়। জীবিত নারীর হাসির শব্দ কি এমন হতে পারে?
যখন নিশ্চিত হয় যে এমন খোনা গলায় কোনো জীবিত মানুষ হাসতে পারে না, তখন আাজান আলি থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে। এই উদ্যান, এই ঝোপঝাড়, এই সোডিয়াম বাতির আলো-আঁধারি– সবকিছুই আজান আলির কাছে অপার্থিব মনে হয়। মনে হয় সে পথভুলে মৃতের রাজ্যে এসে পৌঁছেছে।
একসঙ্গে এত মুর্দার মৃত্যুঘোষণা সে কেমন করে দেবে!