১৮৩৯ বার পঠিত
আজকে আমাদের সাধারণ মানুষদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার দিন। কীভাবে, এমন প্রশ্নটা জাগা স্বাভাবিক। কারণ আমরা ক্রমেই ইতিহাস বিমুখ হয়ে পড়ছি। আমরা ভুলে গেছি আমাদের পূর্ব-পুরুষদের অপমানের সেই অসীম লজ্জার কথা। জমিদারদের বাড়ির সামনে দিয়ে গেলে, জুতো খুলে ছাতা গুটিয়ে, মাথা নিচু করে সেই বাড়ি পাড়ি দেয়ার লজ্জা।
আজ জমিদারতন্ত্র উচ্ছেদ দিবস। আজকের দিন সাধারণ মানুষের মুক্তির দিন। স্বাধীন ভাবে বাঁচার শুরুর দিন। আমার অঞ্চলে এই জমিদারতন্ত্র উচ্ছেদের অন্যতম নায়ক ছিলেন আমার নানা খোন্দকার আব্দুল লতিফ। নিজে সে সময় কলকাতা পুলিশে চাকরি করতেন। চাকরি শেষে জুরি বোর্ডের সদস্য হয়েছিলেন। ছিলেন অসম্ভব প্রতাপশালী একজন মানুষ। বলা যায় জমিদারদের সমকক্ষ। যখন এ দেশের মানুষ জমিদারদের বাড়ির সমুখ দিয়ে যেতে জুতা খুলে, ছাতা গুটিয়ে যেতেন, তখনও আমার নানার জায়গা হতো জমিদারদের পাশের চেয়ারে।
সেই সময়ের নিগৃহিত মুসলমানদের মধ্যে এমন ‘সম্মান’ পাওয়াটা ছিলো বিরল। তখন জমিদাররা এ দেশের মুসলমানদের দলিত হিন্দুদের চেয়েও নিচু জাতের মনে করতো। তাদের ছায়াও তারা মাড়াতো না। পাইক-পেয়াদাদের অত্যাচার ছিলো সেই মুসলিম রায়তদের উপর নিত্যনৈমিত্তিক। তখনও আমার নানা ছিলেন মাথা উঁচু করে। না, তিনি একা মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাননি। তিনি অন্য মুসলিম ও দলিত হিন্দুদের প্রতি এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
আমার মা’র বান্ধবীরা ছিলেন তখন জমিদার কন্যা। মিত্রবাড়ী বলে যে জমিদারটি আমাদের নানার গ্রামের বাড়ির পাশেই ছিলো, সে বাড়িতে মার ছিলো অবাধ যাতায়াত। একজন মুসলমান কন্যা জমিদার কন্যার বান্ধবী হবেন, সে সময়ে সেটা ছিলো অনেকটা অসম্ভবের কল্পনা। তারপরেও খোন্দকার সাহেবের মেয়ে বলে মা’র সেই বন্ধুত্বের সম্পর্কটা সম্ভব হয়েছিলো।
এতকিছুর পরেও, এত ‘সম্মান’ দেয়ার পরেও জমিদার বিরোধী আন্দোলনে নানা ছিলেন অগ্রভাগে। মার মুখে শুনেছি জমিদাররাও তখন আশ্চর্য হয়েছিলেন নানার এমন সক্রিয় বিরোধীতায়। কারণ জমিদারদের আনুকূল্য পাওয়া এবং সেই আনুকূল্যের সুপারিশে ইংরেজদের কাছ থেকে ‘বাহাদুর’ পদবি পাওয়া অনেকের জন্যই তখন লোভনীয় ছিলো। কিন্তু নানা সেই লোভটাকে অবলীলা-অবহেলায় ত্যাগ করেছিলেন। এমন ত্যাগী মানুষদের ইতিহাস আজকে আমরা ভুলতে বসেছি। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছু নয়।
আমার দাদা শেখ বন্দে আলী’র কথা সেই সাথে একটু বলে যাই। জমিদার আমলে ‘ইঁদারা’ যা মূলত আঞ্চলিক ভাষায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ‘ইন্দিরা’, অর্থাৎ পানির উৎস বাঁধানো বড় কুয়া। সেই ‘ইঁদারা’ তৈরি সাধারণ মানুষদের জন্য নিষেধ ছিলো। ‘ইঁদারা’ তৈরির অধিকার ছিলো শুধু জমিদারদের। আমার দাদা জমিদারদের সেই নিষেধ না মেনে নিজ বাড়িতে ‘ইঁদারা’ তৈরি করিয়েছিলেন। এটাও ছিলো জমিদারদের হুকুমতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। সেই ‘ইঁদারা’টি এখনো আছে আমার দাদা বাড়িতে। এখনো সাক্ষ্য দিচ্ছে জমিদারতন্ত্রের বিরোধীতার।
আমরা আজ প্রতিরোধটা ভুলতে বসেছি। অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি সমস্ত অন্যায়ে। মেনে নিয়ে ঘাড় গুঁজে সয়ে চলেছি সব। যার ফলে চারিদিকে বাড়ছে অন্যায়। এই আধুনিক সমাজেও গড়ে উঠছে জমিদারতন্ত্র। যে তন্ত্রের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলেই পড়তে হচ্ছে তাদের রোষাণলে। জান-জবান আজ বিপন্ন। সেই বিপন্নতার বিরুদ্ধে আজকের দিন ১৬ মে হয়ে উঠতে পারে প্রতিরোধের আরেক শপথের দিন। অত্যাচার আর অবিচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠার দিন।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন