০
১০৩৭ বার পঠিত
এবাবের বইমেলায় আমার একটা বই থাকছে। আমার বন্ধু কবি রোমান জাহান তার আইডিতে আমার বইয়ের প্রচার দিয়ে দিয়েছেন, আমি সাহস পাইনি। কারণ বইটি কবিতার। আমি নিজেও অনেকবার বইমেলায় কবিতার বই প্রকাশ নিয়ে লিখেছি। বলেছি, প্রায় দুই হাজার কবিতার বই প্রকাশ হয়, এমন অবস্থায় ‘কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি’ কথাটি সত্য হয়ে যায়। কথাকার মঈনুল আহসান সাবের, সাবের ভাই তো কবিদের হাতে হারিকেন ধরিয়ে দিতে একপায়ে দাঁড়ানো। যার ফলে নিজের বইয়ের প্রচার দিতে আর সাহস পাইনি।
বাংলাদেশে কবি হিসেবে পরিচয় দেয়া এক বিশাল ঝক্কির ব্যাপার। সাথে লজ্জারও একটা ব্যাপার আছে। লজ্জার ব্যাপার কেন বলি। বাংলাভাষী কবিদের একটা চিকন চলন আছে। তাদের বেশির ভাগ হাঁটেন র্যাম্প মডেলদের মতন, হেলেদুলে। কথা বলেন চিকন মানে ন্যাকা সুরে। প্রায় সবকথাই প্যাঁচিয়ে ত্যানা করে ছাড়েন। আর ইউনিফর্ম তো আছেই। পাঞ্জাবি, পাজামা, চটি, ঝোলা- কমন চিত্র। অন্তত ঝোলাটি থাকবেই। মনে হয় কবিতা সব ঝোলার ভেতর থাকে যখন ইচ্ছে বের করে নেয়া যায়। এই কবিগণ এতটাই ঘোরের মধ্যে থাকেন যে, আশেপাশের লোকজন তাদের নিয়ে কী বলছে, সে খবর আর রাখা হয় না।
আশেপাশের লোক কী বলে, এটা ভাবতে গেলে অবশ্য কবি হওয়া যাবে না। বাংলাভাষী কবি মানে উড়াধুরা পাবলিক। যার দৃষ্টি আসমানে, যার মাথার চুল উস্কোখুস্কো, কাপড়চোপড়ও তাই। যাকে আশেপাশের লোকজন বলেন ‘আধপাগলা’। আমার জেলার এক কবি, যিনি শিক্ষকও, কলেজে পড়ান। একবার তার বাসা খুঁজতে গিয়ে বিপাকে পড়লাম। যাও বাসা পাওয়া গেলে কিন্তু সদর দরোজায় তালা। যাকে জিজ্ঞেস করি সেই বলে, ‘কবির কথা কন তো, আধাপাগলা মানুষ কখন কই থাকে’, বোঝেন অবস্থা। আমি তখন সদ্য পড়াশোনা শেষ করা মানুষ। পরনে জিন্স, টি-শার্ট। পায়ে উঁচু বুট, চোখে সানগ্লাস, চুল অনেক লম্বা হলেও উস্কোখুস্কো নয়, তাই হয়তো আমাকে প্রশ্ন করার সাহস পায়নি, আমিও কবি কিনা। কিন্তু কবিদের প্রতি তাদের সেই অবজ্ঞা আমি অনুভব করেছি। সেদিন থেকে নিজে যে কবিতা লিখি এ বিষয়টি পারতপক্ষে চেপে যাই।
আমাদের দেশের মুশকিলটা হলো, ভান ধরা। আপনি লেখক হতে যান, আপনাকে ভান ধরতে হবে। আর বুদ্ধিজীবী হতে গেলে ভানই মূলকথা। যে যত ভান করতে পারবেন সে তত সফল। ব্যাপার অনেকটা মাজারে মাজারে ঘোরা পাগলদের মতন। যার চুলে যত বেশি জটা, যে যত বেশি উদ্ভট কাপড় পরবে সে তত হিট। টকশোগুলো দেখলে বুঝতে পারবেন, কী অবস্থা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের। যে টকশোতে বাটপার সাহেদও আলোচক ছিলেন। যার ফলে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতটা ক্রমেই ‘ফানি’ হয়ে ওঠেছে। তারমধ্যে চলে এসেছে আবার তালিকা করার মতন হাস্যকর ব্যাপারটি। রোহিঙ্গাদের মতন বাংলাভাষী বুদ্ধিজীবীদেরও তালিকা হয়। যেন তারাও উদ্বাস্তু কোনো।
অবশ্য পাবলিকের চোখে উদ্বাস্তু না হলেও আলাদা সম্প্রদায় যে তা নিশ্চিত। বাংলাদেশে তালিকা মানেই অ্যালিয়েন টাইপ একটা কিছু, যাদের আলাদা চোখে দেখে আমজনতা। আর সেই চোখ অবজ্ঞার আর সন্দেহের। শুধু প্রকাশ করে না, ভয় পায় বলে। কারণ ‘জনগণই ক্ষমতার উৎস’ এই কথাটি এখানে দারুণ রকম উপেক্ষিত। সাম্প্রতিক আলোচিত তালিকা বিষয়ে সাবের ভাই মানে মঈনুল আহসান সাবের লিখলেন, ‘তালিকায় এত এত পিপীলিকা!’ বোঝেন অবস্থা তালিকায় নাম উঠলে, কাহিনী কী দাঁড়ায়।
শেষ কথা : বই প্রকাশ নিয়ে বলছিলাম। কবিতার বই প্রকাশিত হচ্ছে আমার এ নিয়ে বড় শরমিন্দা অবস্থার মধ্যে আছি। আছি এই ভেবে যে, সাধারণ মানুষের অবজ্ঞা আর উপেক্ষার দৃষ্টি পড়বে এখন আমার উপরও। বলবেন, ‘এইডাও তো দেখি আধপাগলা’। এখন ওই গানটা সঙ্গী করতে হবে। ওই যে, ‘পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না’। দুনিয়া না চললেও আমাদের ভূখণ্ড চলে না, এটা অস্বীকার করার আপাত সঙ্গত কোনো কারণ নেই।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন