৫
১৩০৩ বার পঠিত
আমেরিকা যখন ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে পরিপূর্ণ সৈন্য প্রত্যাহারের দিকে এগুচ্ছে, তখন দশ হাজার কোটি ডলার খরচ ও ২,০০০ আমেরিকানের মৃত্যুর শুভফল হিসাবে দেখানোর মত কিছুই নেই। আফগানিস্তানে আমেরিকার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল একটা স্থিতিশীল ও অশত্রু-ভাবাপন্ন সরকার ও সামরিক বাহিনী প্রতিষ্ঠা, যাতে সন্ত্রাসী দলগুলো আফগান ভূখণ্ডকে তাদের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের দিন প্রায় শেষ হয়ে আসছে এবং গণহারে সৈন্যদের দলত্যাগ দ্রুত জাতীয় সামরিক বাহিনীর পতন ঘটাতে পারে। এমতাবস্থায় কেবল জেনারেল জন এ্যালেনের মত ভাবাতুর নাছোড়বান্দা-ই বলতে পারেন যে, আমেরিকা জয়ী হবেই। প্রকৃতপক্ষে তালেবানরা জয়ের গন্ধ শুকতে শুরু করেছে।
আমেরিকার ব্যর্থতা অনেক দাড়িওয়ালা এবং ইমরান খানের বিবেক-বিবেচনাহীন সমর্থকদেরকে উল্লসিত কোরে তোলে। দেশে-বিদেশে অবস্থানরত অনেক বামপন্থী পাকিস্তানীকেও আনন্দিত করে তোলে, কেননা সাম্রাজ্যবাদকে নাস্তানাবুদ করা হয়েছে। অনেক কমরেডরা কল্পনা করে যে, আমেরিকা বেরিয়ে যেতে না যেতেই এক কাল্পনিক আফগান “শ্রমিক শ্রেণী” – জানিনা তা দিয়ে কি বুঝায় – শুন্য থেকে জেগে উঠবে এবং তালেবানরা আসার আগেই ক্ষমতা দখল করে নিবে। তারা কি গ্রীষ্মে বরফপাতের প্রত্যাশা করে।
বিদেশী দখল সাধারণত নিষ্ঠুর। এবং আমেরিকা কিভাবে সার্জেন্ট বেইলসের হত্যাকাণ্ড, কোরান পোড়ানো ও শুন্য থেকে বিবাহ অনুষ্ঠানে বোমা ছুড়া ইত্যাদির মাধ্যমে আফগানদের আস্থা হারিয়েছে, সেটা অনুধাবনযোগ্য। সবাই প্রত্যাশা করতে পারে যে, আমেরিকা যেন কখনোই এ অঞ্চলে না আসতো, বিশেষত পাকিস্তান যেন তাদের সোভিয়েত-বিরোধী অভিযানে ইচ্ছুক চেলা না হোতো।
ইতিহাসে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আজ আফগানিস্তানের সামনে মাত্র দু’টো নিষ্ঠুর উপায় রয়েছেঃ অব্যাহত আমেরিকান উপস্থিতি অথবা তালেবান শাসন। অবশ্য কোন অলৌকিকতার বলে আমেরিকান বিমান শক্তির সাহায্যে আফগান সামরিক বাহিনী টিকে থাকতে পারে। কিন্তু তা সম্ভব করে তোলার জন্য জন্য স্বয়ং পরম করুনাময়কেও কষ্টে পড়তে হবে।
কমরেডগণ, এটা স্বীকার করঃ আমেরিকা আফগানিস্তানে যে দুষ্কর্ম করেছে, তা পূর্বের ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের তালেবান শাসনকালের অপকর্মের কাছে কিছুই না। যা পাকিস্তানের সোয়াতবাসীরাও দেখেছে যে, এসব যুদ্ধপতিরা সমাজকে অকথ্য বর্বরতায় পর্যবসিত করেছে। তারা গান-বাজনা ও খেলাধুলা বন্ধ করেছে, দাড়ি কাটার জন্য মানুষকে কঠোর শাস্তি দিয়েছে, মহিলা যাত্রী বহন করার জন্য ট্যাক্সী চালকদেরকে চাবুক মেরেছে, অসুস্থ মহিলাদেরকে পুরুষ ডাক্তার কর্তৃক চিকিৎসা বন্ধ করেছে, এবং মেয়েদেরকে স্কুল থেকে ও মহিলাদেরকে কর্মস্থল থেকে নির্বাসিত করেছে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা দখলের পর তালেবানরা বিরোধীদের মরদেহ কাবুলের ল্যাম্প-পোস্টে কয়েকদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখে। এবং বামিয়ান প্রদেশে ৫,০০০ শিয়া মুসলিমকে হত্যার পর ইরান পাকিস্তান-সমর্থিত এ নতুন বিজয়ীদেরকে “ধর্মোনমত্ত মধ্যযুগীয় তালেবান” বলে নিন্দা করে।
তালেবান ইসলামের ইতিহাসের সর্বাধিক ঘৃণিত রাজনৈতিক আন্দোলন। অথচ আজ পাকিস্তান মিলিটারী হেডকোয়ার্টার প্রতি প্রীতিপূর্ণ দৃষ্টিধারী কিছু কিছু টেলিভিশন ভাষ্যকার বুলি উড়ান যে, আজকের নতুন তালেবান পুরানা তালেবান থেকে ভিন্ন। এসব পুরোই ফাকা বুলি। প্রতিদিনই তাদের নৃশংসতার খবর শোনা যায়। আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানে যেখানেই তালেবান শক্তিশালী, সেখানে তারা তাদের চিরাচরিত বর্বর অভ্যাস, যেমন বাছ-বিচারহীন হত্যা, মহিলা ও পুরুষদেরকে পাথর-ছুড়ে হত্যা এবং হাত কাটা ইত্যাদি অপকর্মে মগ্ন। গুগলে গিয়ে দেখুন তালেবানরা কিভাবে তাদের নৃশংস কর্মকাণ্ডের ভিডিও বানিয়ে গর্বের সাথে তা প্রচার করে বেড়াচ্ছে।
যেসব বন্ধুরা আমেরিকার আফগানিস্তান ত্যাগের দিন ইসলামাবাদ, লাহোর কিংবা লন্ডনে শ্যাম্পেনের বোতল খুলে উল্লাস করতে চান, তাদের জন্য আমার একটা সহজ বাহাস (চ্যালেঞ্জ) : আপনাদের আয়েশের আবাস ছেড়ে তালেবানের অধীনে বাস করে দেখুন। আপনি যদি সৌভাগ্যবশতঃ ফিরে আসতে সমর্থ হন, দয়া করে আপনার অভিজ্ঞতার কথা জানাবেন। আপনি যদি শিয়া, হাজারা, মহিলা কিংবা স্বেচ্ছাচার নিষ্ঠুরতা দেখে চুপ থাকতে অপারগ হন, তাহলে যাওয়ার আগে প্রিয়জনকে চির বিদায় জানিয়ে জানাতে ভুলবেন না যেন।
আমাদের কমরেডগণ তালেবানের পরিবর্তে নিম্নোক্ত যে কাউকে চয়ন করতে পারেনঃ হেজব-এ-অয়াহদাত, হেজব-এ-ইসলামি, জামিয়াত-এ-ইসলামি কিংবা অন্যান্য। কোনটা চয়ন করো, তাতে কিছুই আসে-যায় না। তাদের শাসনাধীনে বাস করলে কমরেড ভাইদের সাম্রাজ্য-বিরোধী বুলি দ্রুত উবে যাবে নিঃসন্দেহে।
আন্তর্জাতিক গোষ্ঠিকে যত পার গালি দাও। কিন্তু আফগান মহিলারা আজ এক দশক আগের তুলনায় গড়ে ১৫ বছর বেশী আয়ু লাভ করেছে ভালতর স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি ও বাড়তি আয়ের ফলে। আমাদেরকে জানাও দাড়িওয়ালারাও তৎপরিবর্তে কি উপহার দিবে?
সুতরাং ২০১৪ সালের পর আফগানিস্তানের ভবিষ্যত কি?
একটা ধর্মনিরপেক্ষ বহুদলীয় গণতন্ত্রের সম্ভাবনা একেবারেই শুন্য। প্রাচীন সম্মান ও লজ্জার ধারনার নিগড়ে বাধা গোষ্ঠি-ভিত্তিক আফগান সমাজ খুব সম্ভব বহু প্রজন্ম ধরে অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দলে টুকরো-টুকরো হবে। আফগানরা ইতিমধ্যেই ২০১৪ সালের পর গৃহযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
একমাত্র প্রশ্ন হচ্ছেঃ সবচেয়ে কম খারাপ ফলাফল কি হতে পারে? যেহেতু আমরা পাকিস্তানীরা প্রতিবেশী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে চাইব, আমরা কেবল-ই আশা করতে পারি যে, বর্বর শাসন না এসে একটু নমনীয় শাসন আসুক।
আমেরিকা-উত্তর আফগানিস্তানের একটা তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের জন্য দরকার হবে রাজনৈতিক ক্ষমতা দেশটির পাশ্তুন, তাজিক, হাজারা, উজবেক ইত্যাদি গোষ্ঠির দ্বারা বহুদলীয়ভাবে শেয়ার করা। নইলে সেখানে বিরাজ করবে অন্তহীন কাটাকাটি।
আঞ্চলিক শক্তিগুলো সেটা রোধ করতে পারে ও তাদেরকে সেটা করতে হবে। সেই সাথে রুখতে হবে তালেবান নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি। তা অর্জনের জন্য পাকিস্তানকে “কৌশলগত গভীরতার” আকাঙ্ক্ষা ছাড়তে হবে, আমেরিকা-কর্তৃক ইরানকে সহায়ক শক্তি হিসেবে প্রেক্ষাপটে আনতে হবে, ইন্ডিয়াকে আফগানিস্তানে এমন হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে যা পাকিস্তানের প্রতিকূল হয়, এবং খনিজ সম্পদ আহরণের অধিকারের জন্য তালেবালকে অর্থ-সাহায্য দেওয়ার ইঙ্গিত থেকে চীনকে বিরত থাকতে হবে।
এগুলোর কোনটাই বাস্তবে সম্ভব নয়। তথাপি হতাশার সাগরে ডুবলে কখনো কখনো মানুষ চাঁদকেও পেতে চায়।
—
[[{“type”:”media”,”view_mode”:”media_large”,”fid”:”36″,”attributes”:{“alt”:””,”class”:”media-image”,”height”:”100″,”style”:”width: 100px; height: 100px; float: left; “,”typeof”:”foaf:Image”,”width”:”100″}}]]পাকিস্তানী প্রফেসর পারভেজ হুদভয় পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সাইন্স ও কায়েদে আজম ইউনিভার্সিটিতে পড়ান। লেখকের অনুমতিক্রমে লেখাটি ইংরেজী থেকে বাংলা অনুবাদে ছাপানো হলো।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
জুলাই ২৬, ২০১২; ৯:৩৪ অপরাহ্ন
প্রথম মন্তব্য।
পরীক্ষা করে দেখছি সবকিছু ঠিকমত কাজ করে কিনা।
জুলাই ২৬, ২০১২; ১০:৫১ অপরাহ্ন
আমেরিকার বিকল্প আসলেই কিছূ নেই এখন আফগানিস্তানে। আর আমেরিকাও হাড়ে হাড়ে বুঝছে ইসলামী উগ্রপন্থীদের হাতের পুতুল করা সম্ভব নয়, যা তারা ভেবেছিল। এখন সত্যি কথা বলতে কি আফগানদের সামনে কোন ভবিষ্যত নেই, কারন তারাও ইসলামের কট্টর সমর্থক। আজ যদিও বা তালেবানদের উৎসাহে ভাঁটা পড়ে, যে কোনদিন ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মসতো তা জেগে উঠবে আর লাভায় বিষাক্ত করবে চারপাশ।
জুলাই ২৬, ২০১২; ১১:১৪ অপরাহ্ন
ভাই রুশদী; খুবই গুরুত্বপুর্ণ কাজ করেছেন।
এখন সত্যি কথা বলতে কি আফগানদের সামনে কোন ভবিষ্যত নেই, কারণ তারাও ইসলামের কট্টর সমর্থক।
আমি অনেক আফগানি ছাত্রকে পড়িয়েছি এবং পড়াচ্ছি। এরা খুব ভদ্র, অমায়িক এবং নিষ্ঠবান, যদিও পড়াশোনায় তেমন আহামরি কিছু নয়।
তবে একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করেছি–ধর্মের, মানে ইসলামের ব্যাপারে এরা খুবই অনড়। এদের সাথে ধর্ম-নিরপেক্ষতা বা ধর্মহীনতা নিয়ে আলোচনা করা বৃথা। এই সাধারণ আফগান এবং তালিবানদের সাথে খুব তফাৎ নাই। শুধু যে তফাৎ দেখেছি তা হচ্ছে তালিবানরা সৎসাহস দিয়ে ইসলামের আসল চেহারা উন্মোচন করছে–আর এই সব সাধারণ আফগানিরা ইনিয়ে বিনিয়ে ইসলামের পবিত্রতা প্রচারে মত্ত। এদের হাতে অস্ত্র-শস্ত্র ধরিয়ে দিলে এরাও তালিবান হয়ে যাবে।
জুলাই ২৬, ২০১২; ১১:২২ অপরাহ্ন
প্রফেসর হুদভয়ের মার্ক্সবাদের আসন থেকে পতন ঘটেছে দেখা যাচ্ছে।
নিজ স্বার্থ সবাই দেখে কমিউনিস্ট কিংবা পুজিবাদী। কিন্তু পুজিবাদী বিশ্ব যে কেবল-ই লুটপাটে বিশ্বাসী — এ উদ্ভট মার্ক্সিস্ট ধারনা থেকে প্রফেসর হুদভয় বেরিয়ে এসেছেন নিঃসন্দেহে।
ইসলামের মত মার্ক্সবাদের অন্ধগলি থেকে বের হয় কঠিন। পারভেজ হুদভয়ের মত দু’চার জন অতি-মেধাবী মার্ক্সসিস্ট বিনা বাকীরা সেটা পারেনা।
জুলাই ২৭, ২০১২; ৯:০৫ অপরাহ্ন
প্রফেসর হুদভয় ওসামা/তালেবানের লাননে আমেরিকার মদদের কথা একেবারেই উপেক্ষা করেছেন।
তবে এটাও ঠিক যে, আমার কৃতকর্মের দায়ভার মূলত আমাকেই নিতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি প্রফেসরের সাথে একমত। আমেরিকার জন্য আফগানিস্তানের অব্যাহত উপস্থিতি প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। আর বিকল্প নির্ঘাত তালেবান শাসনের পুনরাবৃত্তি।