০
১৭৫০ বার পঠিত
মানুষ আবেগপ্রবণ। আমাদের কথা, দৈনন্দিন কাজকর্ম থেকে শুরু করে জীবনযাপনের সর্বত্রই রয়েছে এই আবেগের প্রভাব। আমরা কান্নায় ভেঙে পড়ি, ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হই, ঈর্ষায় ডুবে যাই, ঘৃণায় কুঁকড়ে থাকি অথবা উল্লাসে ফেটে পড়ি।
পনেরো দিন আগেও যাকে চিনতেন না, তাকেই পাবার জন্য আপনি সব আপনজন ছাড়তে রাজী হয়ে যান। একসময় যাকে ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব মনে হত, বিয়ের পর সেই স্ত্রীর গায়েই হাত তুলতেও আপনার বিন্দুমাত্র বাধেনা। পুরো পৃথিবীতে একসময় যাকে আপনি সবচেয়ে বেশী ভালবাসতেন, যাকে ছাড়া এক মিনিট থাকতে পারতেন না, তাকেই এখন আপনি সবচেয়ে বেশী ঘৃণা করেন, তাকেই সরিয়ে দেন বহূ বহূদূরে।
কেন? কেন এমন হয়? কখনও ভেবে দেখেছেন কি?
মানুষের এই যাবতীয় আচরণের পিছনে কারণ হলো, আমাদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক আবেগ যা পরস্পর বিপরীতধর্মী। অর্থাৎ প্রতিটা আবেগের বিপরীতে আরেকটি বিপরীতমুখী আবেগ থাকে। যেমন – আনন্দের উল্টো পিঠে থাকে দুঃখ। ভালোবাসার উল্টো পিঠে থাকে ঘৃণা। মানুষের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হলো- কোন মানুষ কারো প্রতি একই সঙ্গে দুটি বিপরীতমুখী আবেগ অনুভব করতে পারেনা। এজন্যই ভালবাসার মানুষকে ঘৃণা করা যায়না বা যাকে ঘৃণা করি, তাকে ভালবাসা যায়না। আবার ভালবাসার মানুষের প্রতি মন উঠে গেলে তাকে আর ভালবাসাও যায়না। ফলে তাকে আঘাত করতে, তালাক দিতে, এমনকি খুন করতেও আমাদের বাধেনা।
ইতিবাচক আবেগ (যেমন- ভালোবাসা, আনন্দ, সুখ, কৌতুহল, বিস্ময়, ইত্যাদি) মানুষের ভালো থাকার ইন্ধন জোগায়, অন্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করে। অন্যদিকে নেতিবাচক আবেগের (লোভ, হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, সন্দেহ, রাগ ইত্যাদি) কারণে ভালো থাকার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে। দূরত্ব বাড়ে সম্পর্কের। এভাবে নেতিবাচক আবেগের কারণেই জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট হলে সম্পর্ক ভেঙ্গেও যায়।
কখন একজন মানুষ কোন বিশেষ আরেকজন মানুষের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বা বিকর্ষণ (ইতিবাচক বা নেতিবাচক আবেগ) বোধ করে, যা সে আর কারো প্রতি করেনা?
কোন ব্যক্তির আবেগের সাথে প্রেষণা যুক্ত হলে তখন সে কোন বিশেষ আরেকজন মানুষের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। কেননা আবেগ (Emotion) ও প্রেষণা (Motivation) পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। তাই আবেগের সাথে প্রেষণা যুক্ত না থাকলে এর বিপরীত অবস্থা ঘটে।
আবেগ হলো মানুষের এমন এক আভ্যন্তরীণ আলোড়িত অবস্থা যা তার অনুভূতি, আচরণ ও শারীরিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়। আর
প্রেষণা হলো এমন একটি তাড়না যা প্রাণীর মধ্যে আভ্যন্তরীণভাবে সৃষ্ট হয়ে প্রাণীকে উদ্দেশ্য সাধনের দিকে পরিচালিত করে। প্রেষণার ভেতর থাকে চাহিদা, আগ্রহ, উৎসাহ যা মানুষকে কোন আচরণ বা কাজ করতে বাধ্য করে বা কোন লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করে।
প্রথমে আমাদের মনে আবেগ সৃষ্টি হয়। পরে এর সঙ্গে প্রেষণা (চাহিদা, আগ্রহ, উৎসাহ) যুক্ত হয়ে সৃষ্টি করে নিয়ন্ত্রিত আচরণ। যেমন – যখন কোন মানুষ অন্য আরেকজন মানুষের কোন বিশেষ আচরণ, গুণ বা বৈশিষ্ট্যের কারণে তাকে পছন্দ করে, এই পছন্দ করাটা আবেগ। এই আবেগের সাথে যদি তার প্রেম করার বা বিয়ে করার প্রেষণা থাকে (চাহিদা, আগ্রহ, উৎসাহ), তাহলে সে ভালবাসার সম্পর্কে জড়াবে (নিয়ন্ত্রিত আচরণ করবে), নাহলে নয়। ঠিক একইভাবে যখন কোন মানুষের কারো প্রতি আবেগ ও প্রেষণা (চাহিদা, আগ্রহ, উৎসাহ) থাকেনা বা শেষ হয়ে যায় (অপরপক্ষ যত ভালোই বাসুক বা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করুক), তখন মানুষ তার সাথে সম্পর্ক (ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি যেকোন সম্পর্ক) টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনা। ফলে মানুষ সম্পর্ক চুকিয়ে দেয়।
তারমানে আবেগ ও প্রেষণা দুটোই আভ্যন্তরীনভাবে সৃষ্ট। এদু’টো থাকলেই কেবল যে কোন সম্পর্ক তৈরি হয়, টিকে থাকে বা থাকেনা। এদু’টো কারো মধ্যে জোর করে সৃষ্টি করা যায়না। তাই কেউ ভাল না বাসলে তার মধ্যে ভালবাসার অনুভূতি তৈরি করা যায়না। আবার কেউ কাউকে ভালবাসলে তার থেকে তাকে দূরে সরানো কঠিন। অর্থাৎ, কারো প্রতি ভালবাসা তৈরি হলে ঘৃণা বা ঘৃণা তৈরি হলে তা ভালোবাসায় বদলানো যায়না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নিজে সেটা অনুভব করে। এজন্যই দীর্ঘদিন ভালবাসার পরেও যখন কোন একপক্ষ অপরপক্ষের প্রতি আর কোন আকর্ষণ বোধ করেনা বা ইতিবাচক আবেগ অনুভব করেনা, তখন সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়। সহজ কথায়,
ইতিবাচক আবেগ অনুভব না করার মূল কারণ হলো, প্রেষণা না থাকা বা ঐ সম্পর্কের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া।
অতিরিক্ত আবেগের কারণেই কখনও কখনও আমাদের মধ্যে যুক্তি কাজ করেনা। তখন আমরা প্রিয়জনের দোষ খুঁজে পাইনা বা অপছন্দের মানুষের ভাল গুণ দেখতে পাইনা।
অতিরিক্ত আবেগের কারণেই মানুষ প্রমাণ পাওয়ার পরেও মনে করে, তার প্রিয়জন নির্দোষ। তাহের স্যারের খুনি মহিউদ্দিনের স্ত্রী আমার বান্ধবী। ফাঁসির রায় হবার পরেও সে বলে, তার স্বামী নির্দোষ। ষড়যন্ত্র করে তাকে ফাঁসানো হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী বা সব অপরাধীর আত্মীয়দের তাই ধারণা। মওদুদ আহমেদ নিজে ব্যারিস্টার হয়েও মামলায় হেরে বাড়ী হারিয়ে তিনি ও তাঁর সমর্থকরা বলেছিলেন, তিনি ন্যায়বিচার পাননি।
বেগম খালেদা জিয়ার সাজা নিয়েও গতকাল থেকে মানুষের নানারকম আবেগ দেখতে পাচ্ছি যা খুবই স্বাভাবিক। তাঁর বিরোধী পক্ষ আনন্দিত। উল্টোদিকে তাঁর নিজের লোকজন দুঃখভারাক্রান্ত। কারণ তাঁরা ভাবছেন এবং বলছেন যে, তাঁর প্রতি আক্রোশের কারণে তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। আবার এই দুই পক্ষের বাইরের তৃতীয় পক্ষ আশান্বিত হচ্ছে এই ভেবে যে, এভাবে একদিন সব অপরাধীদেরই বিচার হবে, তা সে যে দলেরই হোক না কেন। কারণ ইতিহাস বলে, অন্যায়কারীর শাস্তি হবেই, আজ বা কাল। চতুর্থ পক্ষ নিরাশ এই ভেবে যে, ক্ষমতাসীনরা সবসময় বিরোধীদলের লোকেদের বিচার করে। কখনোই নিজের দলের লোকেদের অপরাধের বিচার করেনা। বরং নিজের দলের লোকেদের বাঁচানোর চেষ্টা করে।
এ বিষয়ে একটা কৌতুক শুনুন। এক কৃপণ লোক এক রিক্সাওয়ালাকে বলল, “সামনে মন্দিরে যাবে?” রিক্সাওয়ালা বলল, “যাব।” শুনে সেই লোক বলল, “বেশ, যাও। আমি এখানেই বসে থাকবো। আসার সময় আমার জন্য মন্দিরের প্রসাদ নিয়ে এসো।”
শুনে রিক্সাওয়ালা হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো। এ ব্যাটা বলে কী? ভাড়া না দিয়েই কাজ আদায়? মন্দিরে না গিয়েই প্রসাদ? পূণ্য না করেই বেহেস্ত? কাজ না করেই বেতন? ইলেকশনে না জিতেই ক্ষমতা? পাপ না করেই জেল? পাপ করেও দিব্বি বহাল তবিয়তে?
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন