১৩৭৩ বার পঠিত
একজন কবি, লেখক, রাজনীতি বিশারদ ফেসবুকারকে চিনি, দেখি। উনি সবার সমালোচনা করেন। কেউই তার কাছে ভালো না। সম্ভবত হঠাৎ তার নিজের নামটা বলে, তিনি কেমন জিজ্ঞাসা করা হলে, বোঝার আগেই বলে দিবেন ‘মহা বদ’। এমন ভদ্রলোকের সমালোচনার ধারাতেও একটা নরম জায়গা রয়েছে। সেই জায়গা থেকে যাদের সমালোচনা করা হয়, সেখানে তাদের ভালোচনাও থাকে। মানে, তাদের প্রথমে মৃদু ভৎসনা করা হয়। তারপর তাদের কর্মটি কোন অর্থে সহি বলে বিবেচনা করা যেতে পারে সে সম্পর্কে একটা নিবিড় গাইড লাইন থাকে। সম্ভবত মহাশয় আইন পেশার সাথে সম্পৃক্ত। সঙ্গত তার লেখার কৌশল ও তর্কের মারপ্যাঁচ সে কথাই বলে। আর গদ্যটাও নিঃসন্দেহে ভালো।
আমি অনেক বছর আগে সাংবাদিকতার একটা কোর্স করেছিলাম। সেখানে আইনের একটা চ্যাপ্টার ছিলো। ক্লাশ নিচ্ছিলেন বিটিভিতে তৎকালীন সময়ে আইন বিষয়ক একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সারাদেশে পরিচিত এবং বিখ্যাত একজন আইনজীবী। ‘দবির’ আর ‘খবির’ নাম দুটি যার আলোচনার মাধ্যমে প্রসিদ্ধে হয়ে উঠেছিলো। তিনি বলতেন, ‘মানুষ তার অভ্যাসের বশেই নিজের পছন্দের বিষয়গুলোকে ডিফেন্ড করতে চায়, সমর্থন করতে চায়। এটা তার স্বভাব। এই স্বভাবের প্রকাশটা হয় বেশির ভাগ অশিক্ষিত ও কম শিক্ষিত মানুষের ক্ষেত্রে। তারা না বুঝেই এটা করতে চায়। একে ঠিক অন্যায় বলা যাবে না, ভুল বলতে হবে। তবে যারা বুঝে-শুনে এমন কান্ড-কর্ম করেন সেটা অন্যায়।’
যে ভদ্রলোকের কথা দিয়ে শুরু করেছি তার ব্যাপারটাও অনেকটা তেমনি। উনি যে মোটিভেশনাল গদ্য লিখেন, তা পরোক্ষে সে অন্যায়-অপকর্মের সহযোগিতাই। যা অপকর্মীদের পরোক্ষে উৎসাহিত করে। ভলতেয়ার’কে উদ্ধৃত করে অনেকে বলেন, ‘আমি কারো মতকে সমর্থন না করলেও তার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য জান কবুল করতে পারি’। চমৎকার কথা। উনিও এ কথাটি বলেন, সাথে সুন্দর করে প্রকাশিত মত ও মত প্রকাশকারীর কারণে কী কী ক্ষতি হয়েছে এবং সেই ক্ষতির সম্ভাব্য শাস্তি কী তাও বয়ান করেন। যা প্রকারান্তরে মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিপক্ষে এবং মত প্রকাশকারীর বিরুদ্ধেই যায়। অনেকটা ঢাকার ভানু’র কৌতুকের মতন, ‘ঘটনা ঠিক, কিন্তু দুইখান কথা আছে।’
এই ভদ্রলোকের লেখা আমি আগ্রহ নিয়ে পড়ি। এর একটা বড় কারণ, তার গদ্যটা চমৎকার। ঈশ্বর খুব বেশি মানুষকে এ ধরণের লিখার ক্ষমতা দেন না। দেন না এই কারণে, যদি মানুষ সেই ক্ষমতার গলদ ইস্তেমাল করে। বেশির ভাগই মানুষই তাই করে। ওই ভদ্রলোকও করেন। মানুষকে বিভ্রান্ত করেন। তিনি কলমকে দু’ধারি তলোয়ার হিসাবে দেখেন। একটা দিয়ে নিজের এবং নিজের সমমনাদের রক্ষা করার চেষ্টা করেন, অন্য ধার দিয়ে অন্যদের কতলের।
ছোটবেলার কথা। আমাদের বাসার পাশে এক পরিবার ছিলো। তাদের তিন সন্তানই বখে যাওয়া। প্রায় প্রতিদিনই পাড়া-প্রতিবেশিরা বিচার নিয়ে আসতেন। একদিন কান্নারত একটি বাচ্চাকে নিয়ে নিয়ে এলেন একজন। বললেন, ‘আপনাদের ছেলে আমার বাচ্চাটিকে চড় মেরেছে’। বখে যাওয়া বড় সন্তানের কান্ড এটা। মা সেই বখাকে বললেন, ওই হারামজাদা পোলাটারে মারছস ক্যান, আর হালায় ঠিকমতো মারবারও পারছ নাই। গালে দাগও বয় নাই।’ বোঝেন অবস্থাটা। আমাদের সেই ভদ্রলোকও তেমন।
হালে আমাদের ফেসবুকে এমন ভদ্রলোকের অভাব নেই। যারা নিজের সত্যিকার রূপটাকে আড়াল করতে, নানা কায়দার মুখোশ পড়েন। ও, মুখোশের কথা মনে করতে জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের মুখোশ মিছিলের কথা মনে পড়ে গেলো। আজই দেখছিলাম ফেসবুকে। তারা মুখোশ পড়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মিছিল করছেন। এই প্রতীকী প্রতিবাদটি বড় ভালো লেগেছে। মুখোশধারী এবং মুখোশ পড়ার ব্যাপারটিকে তারা এড্রেস করতে পেরেছেন। এটা একটা গুড সাইন।
আমাদের দেশে নানা সময় নানা মুখোশের মানুষজন আমাদের ঘাড় মটকেছেন। কেউ ধর্মের নামে, কেউ নিরপেক্ষতার নামে, কেউ প্রগতির নামে। সাথে উন্নতি আর উন্নয়নের গল্পতো আছেই। আইয়ুব খানের আমল থেকেই সেটা প্রকাশ্যে প্রকট হয়েছে। আমরা ফুটন্ত কড়াই আর জ্বলন্ত উনুনের রসায়নে ক্রমেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। আর যারা এর বিরোধীতা করেছেন, সত্যিকার অর্থেই নিরপেক্ষ থেকেছেন বা থাকার চেষ্টা করেছেন, তারা আক্রমনের শিকার হয়েছেন উভয় শিবিরেরই। যারা সরাসরি কন্ঠরোধ করতে চান তারা প্রকাশ্যেই, আর যারা ঘাপটি মারা তারাও ইনিয়ে বিনিয়ে। ওই ভদ্রলোকও সেই শেষোক্ত ধারারই।
কথা বলতে দিতে বাধা কোথায়। বলতে দিন। আপনিও বলুন। কেউ যদি বলেন, দুই দুইয়ে পাঁচ হয়। আপনি অঙ্ক করে দেখিয়ে দিন দুই যোগে চার হয়। অসুবিধাটা কোনখানে। অসুবিধা হলো, অঙ্কটা আপনি জানেন না, বোঝাবেন কী করে। না জানার ফাঁকটা পূরণ করতে চান কথার কথামালায়, শাস্তির উন্মত্ততায়। লেখার হাত, বলার গলা থাকলেতো সোনায় সোহাগা। আপনিও তারেক মনোয়ারের মতন অক্সফোর্ডের সেরা শিক্ষক হয়ে যেতে পারবেন কিংবা শরিয়ত বয়াতির মতন আরেক জনের বোনের সাথে গালির মাধ্যমে সম্পর্ক গড়তে পারবেন।
আরে ভাই, মানুষ এখন আর অত বোকা না। তারা হয়তো বলে না, লিখে না। কিংবা তাদের বলার কায়দা বা লেখার ভাষাটা রপ্ত নেই, কিন্তু মগজটা ঠিকই ধারণে সক্ষম। সুতরাং মানুষের নিশ্চুপতাকে যদি এইসব ভদ্রলোকগণ বোকামি ভাবেন তবে উনারাই যে মহাবোকা সেটা নিশ্চিত। একবার রাস্তার পার্শ্বের চায়ের দোকানে অথবা মোড়ের আড্ডায় কান পাতেন, তাহলে বুঝতে পারবেন আপনাদের কথা কী বলে মানুষ। সেই কথা শোনার সাহস থাকাটাও নিরপেক্ষতার অন্যতম বোধ। আর এই বোধই নিজেকে বোধি হতে সহায়তা করে। তাই বলি, বোধি মানে বোধের যোগ্য মানুষ হওয়ার জন্য নিজের কথা বলার আগে মানুষের বলা কথা শুনুন আত্মস্থ করুন। তবেই না–
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন