৪৭৮ বার পঠিত
ডিসক্লেইমার: কোন পেশা বা শ্রেণীকে হেয় করার মানসে এ লেখা নয়। অনুরোধ রইল, কেউ লেখাটিকে সেভাবে নেবেন না।
এ লেখাটিকে নির্ভেজাল ব্লগর ব্লগর বা গল্প হিসাবেও ভাবতে পারেন বটে।
এটা খুবই সাধারন এক বাঙালি মেয়ের জীবনের গল্প।
আমার এক বান্ধবী, নাম… নামটা নাহয় উহ্যই থাক। তো, সেদিন আমায় মোবাইল করে বললে, তোমার কি দু-একদিনের মধ্যে কিছুটা অবসর সময় হবে? তোমার সাথে একটু গল্প-গুজব করবো! কথাটা বললে বটে, তবে তা ঐ বলার জন্যেই বলা। দিনক্ষণ সবই সে ঠিক করলে। জায়গাও ঠিক হলো, ঢাকা থেকে একটু দূরেই,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
মনে পড়লো, প্রথম যেদিন আমাদের পরিচয়, আমায় জিজ্ঞেস করেছিলো, আমি কোথা থেকে এসেছি! প্রশ্নটা শুনে আমার মাথার ঘিলুতে কেমন যেন জট পাকিয়ে গিয়েছিলো, চট করে কোন উত্তর দিতে পারিনি। সাধারণভাবে বললে কেউ হয়তো বলতো, ঢাকা, খুলনা, বগুড়া, কোলকাতা এরকমই কিছু। আমি ভাবতে বসলাম, তাইতো আমি কোথা থেকে এসেছি! আমার ঊর্ধ্ব-তদূর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ কারা? এ এক বিরাট প্রশ্নবোধক প্রশ্ন বটে! একটু সামলে নিয়ে বললাম, যশোর।
যাক সে কথা, তো সময়মতোই আমরা পৌঁছলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। জায়গাটা বেশ! ছিমছাম, সুন্দর। গাছপালায় ভর্তি শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশ। দেখেশুনে একটা জায়গা
বেছে নিয়ে আমরা বসে পড়লাম।
শুরু হলো তার কথা, বললে, ‘কদিন ধরেই মনটা বড্ড উথালপাথাল করছে। কতযে কথা মনের মাঝে ঘুরপাক খেয়ে মরছে! কারও সাথে শেয়ার করার কথা ভাবতেই তোমার কথাই মনে এলো। কেন এলো, তা আমি নিশ্চিত করে জানিনে। তবে হ্যাঁ, (লাভ না হলেও) কোন ক্ষতি যে আমার হবেনা, এটা জানি।’
আমি তার কথা কাটতে চাইছিলাম না তাই হুঁ, হ্যাঁ কিছুই বলিনি। সে বলে চললো, ‘জানোতো, ছ’বছর হলো আমার সংসার ভেঙেছে। মেডিকেলে পড়ার সময় আমরা চুটিয়ে প্রেম করেছি। পাশ করার পরে দুজনেই একটু স্থিত হয়ে বিয়ে। চার বছর সংসার করেছি। ঝগড়াঝাঁটি আমাদের মাঝে খুব একটা হতোনা। সময় কই! দুজনেই খুব ব্যাস্ত। অফিস, প্র্যাকটিস, পড়াশুনা, যার যার দিকের আত্মীয়-স্বজন। দিনশেষে বড্ড ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত।
এভাবেই কয়েকটা বছর কেটে গেলো। জীবনটা কেমন যেন একঘেয়ে ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছিলো। শেষমেশ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের স্মরণাপন্ন হলাম। তাঁর কাছে মেডিকেলের দিনগুলোর
স্মৃতিচারণ করতাম। কী অফুরান আনন্দময় দিনগুলোই না ছিলো!
ডাক্তার একদিন কথাপ্রসঙ্গে আমায় বলেছিলেন, ‘প্রেম – সে হচ্ছে রোমান্স, রোমান্স আর রোমান্সে ভরপুর, অল্প-স্বল্প সেক্সও থাকতে পারে বটে, আর বিয়েতে থাকে শুধুই সেক্স, রোমান্স একেবারে উবে যায়। পরে সেটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়। তবে সংসারে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পরিপূরকও বটে।’
আমাদের সংসারটা ভাঙল ক্যারিয়ার, ক্যারিয়ার করে। আমি বাচ্চা নিতে চাইছিলাম। পরামর্শটা অবশ্য সেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের। আর ও এই সময়ে একেবারেই রাজী নয়। সে চায় ক্যারিয়ার তৈরি করতে। বাচ্চার জন্য সময় দেবার মতো সময় তার নেই। আমার পিড়াপিড়িতে সে বললে, ‘তাহলে তুমি চাকরি-বাকরি ছেড়ে দাও। তারপর বাচ্চা পয়দা করে তাকে মানুষ করো। আয়া-বুয়ার হাতে আমি আমার বাচ্চার ভার দেবনা।’
সে নিজেও বাচ্চাকে সময় দেবেনা আবার আয়া-বুয়ার কাছেও বাচ্চার দেখাশোনার ভার ছাড়বেনা। যা কিছু সব আমাকেই ছাড়তে হবে! এই নিয়ে শুরু হলো আমাদের মনোমালিন্য, ঝগড়াঝাঁটি। তা ঝগড়াঝাঁটি করবারইবা সময় কই? তাই তড়িঘড়িই একটা নিষ্পত্তি হয়ে গেল। ডিভোর্স, বিবাহবিচ্ছেদ।
আমাদের, এই মেয়েদের অবস্থাটা দেখ, বিয়ের আগে নামের লেজের দিকে বাবার নাম জড়িয়ে থাকে, বিয়ের পর স্বামীর আর এখন দেখ কেমন ন্যাংটো হয়ে গিয়েছি!
জানো, আমি যখন সবেই উঠতি যুবতী আমার মেডিকেলের বন্ধুরা বলতো, চেহারায়, চলনে-বলনে আমি নাকি একেবারে রাজকন্যে! আমাদের সাহিত্যে সুন্দরীর সংজ্ঞায় যেমনটা বলা আছে, উজ্জল গাত্রবর্ণ, ক্ষীণকটি, গুরুনিতম্ব, পীনোন্নত পয়োধর, সুগঠিত জঙ্ঘা, পক্ক বিম্বোধর, সুডৌল পদযুগল, অজানুলম্বিত কেশরাশি, মৃগনয়ন ইত্যাদি, ইত্যাদি। তা বাপু আমার গায়ের রং গৌরবর্ণ ছিলো বটে, তবে অনেকেই বলতো, আমার বুকটা নাকি একটু চাপা! তা যেমনই হোক এসব নিয়ে আমার কোন ক্ষেদ ছিলনা। এখনও নেই। আর এটাকে আমি নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্য হিসেবেই বিবেচনা করি। মানুষের সত্যিকার সৌন্দর্য থাকে তার অভ্যন্তরে!
জানোতো, কিছুকাল হলো আমার বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। তো, সেদিন বাথরুমে ঢুকে শরীরের সব কাপড়-চোপড় খুলে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। আয়নায় বেশ কিছুটা সময় ধরে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি, আর আয়নার ওপাশের আমিকে বলছি, আফসোস করছো কেন? বিশ বছর আগের সেই আমিতো আর নেই কোনভাবেই নেই। আমার শরীরের নিম্নাঙ্গ ভারী হয়েছে, তলপেটে মেদ জমেছে, কোমরের পরিধি বেড়েছে। উদ্ধত স্তনযুগল নিম্নমুখি হয়েছে, ত্বকের সে ঔজ্জ্বল্যও আর নেই। আরও দশ বছর পরের কথা ভাবনায় এলো। তার-ও দশ বছর পরে! নাহ্, আর ভাবতে পারছিলাম না।
পেশাগত কারণে প্রতিদিনই নতুন নতুন মানুষের সাথে যোগাযোগ, কথাবার্তা হয়। তাদেরই কারও কারও সাথে অলক্ষ একটা সম্পর্কও তৈরি হয়। তারপরও ইদানিং নিজেকে বড্ড একা মনে হয়।
প্রতিদিন কাজ শেষে শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই মায়ের সেই একই কথা, ‘এরকম করে আর কতদিন চলবে? আমিইবা আর কতদিন থাকবো? নতুন করে সংসার কি
আর কেউ করছেনা! ভুল নাহয় একবার করেইছিলি তা বলে জীবনভর ভুলের বোঝা বয়ে বেড়াবি নাকি!’
আমারও কিন্তু যে মা হতে বড্ড সাধ হয়গো! মনের মাঝে এক প্রচণ্ড আকুতি, আমি এ জগতে আমার বংশধর রেখে যেতে চাই। তার মাঝেই আমি বেঁচে থাকতে চাই। অতীতের কথা ভেবে আবার সংসার করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। মনে হয় আমার আর নতুন করে প্রেম করা হবেনা। যদি জোর করে কেউ আমায় বেঁধে নিতো, ভালই হতো বোধহয়।
মাঝেমধ্যে মনে হয় বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা। আচ্ছা, এমন যদি হয় যেমনটা আমাদের এই সমাজে অহরহই হচ্ছে। যেমনটা আমার মা-বাবা, দাদা-দাদীর হয়েছে। ঘটক ধরে, কনে দেখে বিয়ে! তাঁদের সংসারতো টিকেও গেছে।
ইদানিং কাজশেষে বাড়ি ফেরারও তাগিদ অনুভব করিনা। বাড়িতে একটা ছোট্ট খোকা-খুকি থাকলে নে হয় ভালই হতো। বাড়ি ফিরলেই শুরু হবে মায়ের সেই বকবকানি। মা যে শুধু বকবানিই করে তা কিন্তু নয়। কোন কোন দিন এমনও হয়েছে, আমি চোখ বুজে শুয়ে আছি, মা আমার শিয়রে বসে কপালে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ করে চোখ খুলে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি, বিমর্ষ এক চেহারা, জল ছলছল চোখ! আমার কিন্তু বাপু একদমই ভাল লাগেনি। আমাদের মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল সমাজের মায়েরা ভাবে, স্বামী-সংসার না থাকলে মেয়েরা বুঝি সমাজ সংসারে বড্ড অসহায়! কেন বাপু, আমি কি করে-কম্মে খাচ্ছিনে!
আরে, অন্ধকার হয়ে এলোযে! আমরা বোধহয় অনেকটা সময় পার করে ফেলেছি, না! ‘কেন, অন্ধকারে ভয় করছে,’ আমি বললাম। উত্তরে বললে, ‘তা ভয়তো একটু করছেই, তবে তোমাকে নিয়ে নয়, আমার নিজেকেই। না জানি কোন্ বিশ্রি কান্ড ঘটিয়ে বসি!’
চল, ওঠা যাক।।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন