আমার বাবা শুধু আমার জনক নন। তিনি আমার আদর্শ। তার কাছেই শিখেছি মানুষকে শুধুমাত্র মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করতে। তিনি আমাকে গীতা, ত্রিপিটক, বাইবেল, কোরান এবং মার্ক্সবাদ পড়িয়েছেন। নারী-পুরুষ তো বটেই সকল মানুষের সাম্যতে বিশ্বাস রাখতে বলেছেন। তিনি বলতেন প্রতিটি মানুষের নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি এবং সমাজ ও বিশ্বপ্রকৃতির প্রতি কর্তব্য রয়েছে। নারী বা পুরুষ যাই হোক তাকে শুধু নিজের পরিবার, টাকা উপার্জন বা নিজের নাম খ্যাতি নিয়ে থাকলে চলবে না। তাকে সমাজ ও প্রকৃতির প্রতিও দায়িত্ব পালন করতে হবে। এটাই মানবধর্ম।
লেখার শুরুতেই কমরেড তকীয়ূল্লাহ সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। জ্ঞানতাপস ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর চতুর্থ পুত্র আবুল জামাল মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ। আমাদের সমাজে কোনো কোনো মানুষ আছেন যাঁরা তাঁদের সততা, নিষ্ঠা ও আদর্শের আলোয় চারপাশকে আলোকিত করেও রয়ে যান প্রচারের পাদপ্রদীপের আড়ালে। ফোকাসের বাইরে থাকা এমনি একজন মানুষ মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ।
ভাষা আন্দোলনকে যারা সংগঠিত করেছেন এবং এই আন্দোলনের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ তাদের অন্যতম। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ এবং এল এল বি পড়ার সময় তিনি এদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হন। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন অফিসার হিসেবে নিয়োগের জন্য ইন্টার সার্ভিস সিলেকশন বোর্ড (আই এস এস বি)কর্তৃক তিনি বাঙালি হিসেবে প্রথম নির্বাচিত হয়েও ভাষা আন্দোলনের কর্মী হিসেবে জড়িয়ে পড়ায় সেনাবাহিনীতে যোগ দেননি।
১৯৪৯ সালে রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত হন এবং তার নামে হুলিয়া বের হওয়ায় আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যান।১৯৫০ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেপ্তারের জন্য পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।
আমাদের ভাষা ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রগতিশীল ছাত্র ও যুব সমাজকে সংগঠিত করার জন্য ১৯৫১ সালে যুবলীগ প্রতিষ্ঠায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি তখন কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৬-৫৮ সালে যুবলীগ কার্য নির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ। ১৯৫১-৫৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দী ছিলেন। ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার বিরোধী গণ-আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আবার গ্রেপ্তার হন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, তাজউদ্দিন আহমেদ প্রমুখের সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২৬ নম্বর সেলে বন্দী ছিলেন। পরবর্তিতে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে এসে বিভিন্ন ধরনের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন।
ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সূচিত ও বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত বাংলা বর্ষপঞ্জির ব্যাপক সংস্কার করেছেন মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ। বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত এই বর্ষপঞ্জি বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত আছে। তকীয়ূল্লাহ প্রস্তাবিত পদ্ধতিতেই ১৪০২ বঙ্গাব্দ থেকে বাংলা সনের বর্ষপঞ্জির দিন তারিখ গণনা করা হচ্ছে। তিনি চার হাজার বছরের বাংলা, ইংরেজি ও হিজরি ক্যালেন্ডারও তৈরি করেছেন। তিনি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জীবনী লিখেছেন সেই সঙ্গে আমাদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বিকাশ সম্পর্কে লেখালেখি করেছেন। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত রচনার প্রথম তালিকাটি তাঁরই করা।
১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের যে চারটি মাত্র আলোকচিত্র পাওয়া যায় তা মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহর তোলা।
এতক্ষণ কমরেড তকীয়ূল্লাহর পরিচয় দিলাম। এবার তার মেয়ে হিসেবে কিছু কথা বলি। আমার জীবনে আমি বাবার মতো ধৈর্য্যশীল ও মানবিকগুণসম্পন্ন মানুষ দেখিনি।ছোটবেলায় দেখতাম আমাদের পুরান ঢাকার বাড়িতে মহল্লার রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে রাজমিস্ত্রী, তরকারিবিক্রেতাসহ সব পেশার মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল। যে কোনো প্রয়োজনে অথবা এমনিতেই বাবার সঙ্গে সুখদুঃখের আলাপ করতে এরা আসতেন। ড্রইংরুমের সোফায় বসে চা নাস্তা খেতেন। বাবা তখন জুটমিলে চাকরি করতেন। নদীর ওপারে ঢাকা জুটমিলে তার অফিস। সেখান থেকে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। সন্ধ্যার পর বাড়িতে তিনি বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম চালাতেন। বিনা বেতনে তো বটেই তিনি নিজের খরচে ছাত্রদের বই খাতা কিনে দিতেন। রিকশাওয়ালা, রাজমিস্ত্রী, মাংসবিক্রেতার সহকারী এরা ছিল তার ছাত্র। তিনি নিজের উদ্ভাবিত সহজ শিক্ষা পদ্ধতিতে এদের লেখাপড়া শিখাতেন। শীতের সময় অনেকদিন দেখেছি বাবা তার নিজের কোট, সোয়েটার কোনো গরীব ছাত্রকে দিয়ে দিয়েছেন।
বাবা আশি সাল পর্যন্ত জুটমিলে চাকরি করেন। তিনি মিলের পারচেজ ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন। বাবার অনেক নিচের গ্রেডের কর্মকর্তাও সে সময় পারচেজে চাকরি করে ঢাকায় দুতিনটে বাড়ি করে ফেলেছে। কিন্তু তিনি এক পয়সাও ঘুষ খাননি। সেটা নিয়ে কোনো অহংকারও করতেন না। মা যদি কখনও বলতেন যে তুমি তো কখনও ঘুষ নাওনি। বাবা মৃদু হেসে বলতেন ‘ঘুষ খাবো না এটাই তো স্বাভাবিক। যদি ঘুষ নিতাম সেটাই হতো অস্বাভাবিক। স্বাভাবিক বিষয় নিয়ে আবার বলে বেড়াতে হবে কেন।’
আমার প্রবাসী চাচা আবুল বায়ান নকীয়ূল্লাহর সঙ্গে তিনি কয়েক বছর ব্যবসা করেন। সেসময় তার একটি দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। রাস্তায় একটি পথশিশুকে গাড়িচাপা পড়া থেকে বাঁচাতে গিয়ে তার ডান হাত ভেঙে যায়। সেজন্য কয়েকমাস তাকে ঘরে বসে থাকতে হয়। ফলে ব্যবসা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে ব্যবসা ছেড়ে তিনি পুরোপুরি ক্যালেন্ডার তৈরির গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন।
একসময় তিনি আমেরিকান এনিম্যাল সাইন্টিস্ট সোসাইটির সদস্য হন। গবাদি পশুর উপর গবেষণা করেন বেশ কয়েক বছর। তার উদ্ভাবিত তত্ব অনুযায়ী ইচ্ছামতো গাই বাছুর ও ষাঁড় বাছুরের জন্ম হওয়া সম্ভব। তার তত্ব তিনি পশুহাসপাতালে গবাদি পশুর উপর প্রয়োগ করে শতভাগ সাফল্য পান। কিন্তু মানুষের বেলায় এ তত্ব প্রয়োগ করা হতে পারে এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে সেই আশংকা থেকে তিনি তার তত্ব প্রচার করেননি।
বাংলাদেশে যারা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ফটোগ্রাফির চর্চা করেছেন তিনি তাদেরও অন্যতম। তার তোলা আলোকচিত্র দেশে বিদেশের অনেক প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছে।তিনি মূলত শ্রমজীবী মানুষের ছবি তুলেছেন। গুনটানা, গরুর গাড়ির গাড়োয়ান, মাছ ধরা ইত্যাদি অনেক ছবি তুলেছেন তিনি।
তার নিজের চাহিদা ছিল খুব সামান্য। খাবার দাবার কোনো কিছু নিয়ে কিছুই কখনও বলতেন না। হয়তো আলু সিদ্ধ বা ডিমভাজা দিয়ে ভাত খেয়ে উঠতেন। তরকারির ভালো মন্দ নিয়ে কোনো অভিযোগই করেননি কখনও। নিজের থালাবাটি নিজেই ধুতেন। এমনকী নিজের পরনের কাপড়ও নিজে হাতে ধুয়ে রাখতেন। কারও সাথে কখনও রাগ করতেন না। আমি এবং আমার ভাই আজ পর্যন্ত বাবার কাছে কখনও বকা খাইনি, মারার তো প্রশ্নই ওঠে না। ছেলে-মেয়ের মধ্যে তিনি কোনরকম বৈষম্য করেননি। আমার মাকে খুব সম্মান করতেন। তার সঙ্গে সব সময় দেখেছি খুব ভদ্রভাবে কথা বলতে। মা কোনো বিষয় নিয়ে রাগ করলে বা অস্থির হলেও বাবা ধৈর্য হারাতেন না। এমনকী বৃদ্ধ বয়সে আমার মায়ের (যিনি মানসিকভাবে অসুস্থ) সেবায় তিনি রাতের পর রাত ঘুমাননি। তিনি মায়ের প্রতিটি অসংলগ্ন কথা ও আচরণ ধৈর্যের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। তার প্রতিটি অসংলগ্ন কথার জবাব শান্তভাবে দিয়েছেন, তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছেন।
কাজের লোক, পিওন দারোয়ান, অফিসের কর্মচারী কারও সাথেই কোনোদিন তিনি বিন্দুমাত্র দুর্ব্যবহার করেননি। তাদের প্রত্যেকের সাথেই বন্ধুর মতো ব্যবহার করতেন। এমনকী বাড়ির সুইপারের সঙ্গেও তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। এ নিয়ে মা ঠাট্টা করে বলতেন, ‘তুমি খানবাহাদুরের জামাই হওয়ার অনুপযুক্ত’। বাবা হাসতেন, বলতেন, ‘আমি তো কমিউনিস্ট’।
অজাতশত্রু শব্দটি তাঁর বেলায় ছিল দারুণ লাগসই। তাঁর চেনা পরিচিত, আত্মীয় স্বজন কোথাও তাঁর কোনো শত্রু নেই। সবাই তাঁকে ভালোবাসে। এমনকী তিনি যখন রাজনীতি করতেন তখন তাঁর বিরোধীমতের মানুষরাও ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে পছন্দ করতেন। তাঁর সহজ সরল ও সকলের প্রতি আন্তরিক ব্যবহারই ছিল এর প্রধান কারণ।
তাঁর দৈহিক শক্তি ছিল প্রচণ্ড। বাড়িতে দুটি ডাম্বেল ছিল। সে দুটি ছিল ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। বাবা ওই ডাম্বেল দিয়ে ব্যায়াম করতেন। তার বাইসেপ ট্রাইসেপ ছিল দারুণ সুগঠিত। মধ্যম উচ্চতার মানুষ। সুগঠিত দেহের অধিকারী। একমাথা ঢেউ খেলানো চুল। আমাকে ব্যায়ামের খেলা দেখাতেন। তিনি কারাটি চপে কাঠের তক্তা ভাঙতে পারতেন। নারিকেল ভাঙতেন কিল দিয়ে। প্রায়ই বাড়ির ফার্নিচারগুলো এ ঘর থেকে ও ঘরে নিতেন। যেটা ছিল শোবার ঘর সেটা হয়তো বসার ঘর হয়ে গেল। এটা ছিল তার শখ। ভারি ভারি আলমারি ও অন্যান্য ফার্নিচার নিজেই টেনে সরিয়ে দিতেন। ছোট কালো একটি অস্টিন গাড়ি ছিল আমাদের। বাবা নিজেই গাড়ি চালাতেন। মোটর সাইকেলও চালাতে পারতেন তিনি। ধূমপান করতেন না কখনও, মদ্যপানও নয়। বাবা চা খেতেন না। সকালে এক কাপ ওভালটিন মেশানো দুধ খেতেন।
তার কর্মস্থল ঢাকা জুটমিলে তিনি আমাকে প্রায়ই নিয়ে যেতেন। তখন আমার পাঁচ-ছয় বছর বয়স হবে। জুটমিলে শ্রমিকদের কাজ দেখতাম। তিনি বলতেন, শ্রমজীবী মানুষকে শ্রদ্ধা করতে হবে। পৃথিবীটা শ্রমজীবী মানুষের শক্তিতেই চলছে। বেশ ছোটবেলা হলেও কথাটি আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল তখন থেকেই।
আমি বারো তের বছর বয়স পর্যন্ত বাবার কোলে চড়ে ঘুরতাম। ১৯৭৯ সালে আমরা কলকাতায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেসময় রণেশ দাশগুপ্ত আমাদের অনেক সময় দিয়েছিলেন। তখন দেখেছি রণেশ দাশ গুপ্তর সঙ্গে তার খুব বন্ধুত্ব। তিনি রণেশদা বলে ডাকতেন। রণেশদা ছিলেন বাবার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম দীক্ষাগুরু। সেবার নেপাল নাগের স্ত্রী ও মেয়ে, ইলা মিত্র, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যিক লীলা মিত্র এবং আরও অনেকের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। জ্যোতি বসুর সঙ্গেও তখন দেখা হয়েছিল তার। সেসময় শওকত ওসমান কলকাতায় ছিলেন। তার সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। মনে আছে পুরো কলকাতা শহর তিনি আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরেছিলেন পাছে বেশি হাঁটতে গিয়ে আমার পা ব্যাথা হয়ে যায়। তখন আমার ৯ বছর বয়স। এ ব্যাপারটি তিনি আরও বেশ কয়েক বছর পর পর্যন্ত চিড়িয়াখানা বা অন্য কোথাও বেড়াতে গেলেও করতেন। বারো তের বছর বয়সের একটি বড় মেয়েকে এভাবে কোলে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা হেঁটে বেড়ানো মুখের কথা নয়। এমনি প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী ছিলেন বাবা।
ছোটবেলা থেকে আরেকটা জিনিস দেখতাম। তিনি প্রচুর পড়ালেখা করতেন। এবং ক্যালেন্ডারের হিসেব কষতেন। চার হাজার বছরের ক্যালেন্ডার তৈরি করতে তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। গল্প উপন্যাস তেমন পড়তে দেখিনি। তিনি ইতিহাস এবং সমাজতত্বের উৎসাহী পাঠক ছিলেন।দৃষ্টিশক্তি হারাবার আগ পর্যন্ত তাকে ইতিহাসের বই পড়তে দেখেছি।
আমাকে প্রায়ই নিয়ে যেতেন জাদুঘরে। সেসময় নীমতলীতে ছিল ঢাকার জাদুঘর। শাহবাগের জাদুঘরেও তার সঙ্গে বহুবার গিয়েছি।
আমাকে তিনি কার্ল মার্ক্স ও লেনিনের গল্প বলতেন। সমাজতন্ত্রের আদর্শ খুব সহজ ভাষায় গল্প বলে বুঝাতেন। তার জেলজীবনের কথা, আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনের কথা, মজার স্মৃতি সবকিছু বলতেন। কমরেড আবদুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, অনিল মুখার্জি, সন্তোষ গুপ্ত, মোহাইমেন, মোহাম্মদ সুলতান, সরদার ফজলুল করিমসহ অনেক পুরানো কমরেডচাচাদের বাড়িতে আসতে দেখতাম। প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শহীদুল্লাহ কায়সার এবং অন্য শহীদ বন্ধুদের স্মরণ করেন, তার জন্য কাঁদেন।
বাবার কাছে সমাজতন্ত্র হলো ধ্রুব সত্য। আমার মনে আছে একটা কথা তিনি প্রায়ই বলতেন। ‘মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যেমন সত্য তেমনি হলো সমাজতন্ত্র। আজ হোক, কাল হোক, পাঁচশো বছর পরে হোক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবেই। আমি হয়তো সেদিন বেঁচে থাকবো না কিন্তু তুমি যদি থাকো অথবা যদি আমার বংশধররা বেঁচে তাকে তারা দেখবে বিশ্বে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে’। নব্বই দশকে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায় তখন বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন এমন হলো। তিনি বলেছিলেন এমন যে হতে পারে সেটা কমরেড স্ট্যালিনের লেখায় রয়েছে। স্ট্যালিন আশংকা প্রকাশ করে লিখেছেন যে, যখন পার্টির পা আর মাটির সঙ্গে যুক্ত থাকবে না, অর্থাৎ যখন পার্টি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে না, যখন পার্টির নেতারা শুধু নিজের সুবিধা দেখবে তখন পার্টির একনায়কত্বের বিরুদ্ধে জনগণ বিক্ষোভ করবে। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি ভুল করতে পারে। কিন্তু তাই বলে সমাজতন্ত্র তো ভুল হয়ে যায়নি।’
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করতাম, এই যে উনি সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাসের জন্য নিজের ক্যারিয়ার ত্যাগ করলেন, বিনিময়ে কী পেলেন তিনি?’ তিনি বলতেন, ‘সবচেয়ে বড় যে জিনিসটি পেয়েছি সেটা হলো আমি নিজের দিকে পরিষ্কারভাবে তাকাতে পারি। নিজের মুখোমুখি হতে পারি। আমার মানবজন্ম তো আমি বৃথা ব্যয় করিনি। বিশ্বের মহত্তম আদর্শ হলো সাম্যবাদ। আমি আমার তারুণ্য উৎসর্গ করেছি এই আদর্শের জন্য।’
তিনি আরও বলতেন নিজের সুখসুবিধা নিয়ে কখনও ভাবতে হয় না। সংসারে চলতে গেলে এসব নিয়ে সমঝোতা করতে হয়। কিন্তু নীতির প্রশ্নে কোনোদিন আপস করবে না। অনেক প্রলোভন আসে। কিন্তু ভাবতে হবে নীতির বেলায় যদি একচুল ছাড় দাও তাহলে নিজের দিকে নিজে তাকাবার সাহস হারিয়ে ফেলবে।’
বাবা এখনও সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাস করেন। তিনি এবং তার বন্ধুরা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন যে, মহত্তম স্বপ্নে উনি আজও তাতে আস্থা রাখেন।
আমার বাবা জন্মেছিলেন দীপাবলীর রাতে। নিজের চারপাশের মানুষদের স্নিগ্ধ আলোয় আলোকিত করাই ছিল তার জীবনের ব্রত।
আমার বাবা এখন দৃষ্টিশক্তিহীন। তিনি শয্যাশায়ী। তিনি ম্যাসিভ হার্টঅ্যাটাক ও গুরুতর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গত বছর(২০১৬) জুলাই আগস্ট মাসে বারডেম হাসপাতালের আইসিইউতে ১৬ দিন ও দেড় মাস ক্যাবিনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি এখনও গুরুতর অসুস্থ। অসুস্থতা সত্তেও তিনি বরাবর বলে এসেছেন এমনকি এখনও বলছেন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাংলাদেশে এখন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলন জরুরি বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন,
“বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলাই এখন বাংলাদেশের সমাজের অন্যতম প্রধান কাজ। এর মাধ্যমেই জঙ্গীবাদসহ পুজিবাদের সব বিষাক্ত বাই প্রোডাক্টের মোকাবিলা করতে হবে।”
বাবার কথা এখন অস্পষ্ট হয়ে গেছে। তবু একমাত্র আমি তার সব কথা বুঝতে পারি। কারণ আমি তাকে ভালোবাসি নিজের চেয়েও বেশি।
বাবাদিবসে বাবার প্রতি জানাই শ্রদ্ধা।