০
৬২০ বার পঠিত
আমি ছিলাম পিতামাতার অবাধ্য সন্তান। আমাকে নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। ছেলেটো মানুষ হলো না। কি করে খাবে? মাকে ধমক দিয়ে বাবা বলতেন, ‘তুমি ওকে একটু বোঝাও না।’
জবাবে মা বলতেন, ‘আমিতো প্রতিদিনই বলি। কিন্তু আমার কথা কানে তোলে না।’ বাবা রেগে বলতেন, ‘একদিন ধরে আচ্ছামতো পিটুনি দিতে হবে।’
এমন ধরনের কথাবার্তা তারা প্রায় বলেন। কখনো কখনো সেগুলো আমার কানেও আসে। আমার খারাপ লাগে মার জন্য। আমার মা বড় দুখি। কিন্তু নিজের ইচ্ছের কাছে বাকি সব আমি কেয়ার করতাম না। তুড়ি মেরে সব উড়িয়ে দিয়ে আমার মতো আমি চলতাম। তাঁদের বেশি ভাবনা ছিল, আমি কি করে খাব?
মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর বাবার সঙ্গে আমার দূরত্ব কমতে থাকে। তারপরতো তিনি আমার বন্ধু হয়ে যান। সে কাহিনী আরেক পর্বে। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, পিতার সঙ্গে যে সন্তানের বন্ধত্ব হয় সেই সন্তানই প্রকৃত ভাগ্যবান।
আমাকে নিয়ে পিতার যে আশঙ্কা এবং হতাশা ছিল সময়ের পরিবর্তনে আমার মতো উড়নচন্ডির বাসায় বাবাকে শেষ জীবনে ঠাঁই নিতে হয়। সেটাও ছিল আমার পরম সৌভাগ্য।
আমরা ছিলাম চারভাই তিনবোন। আমার বড় দু’ভাই বাবার খুব প্রিয় সন্তান ছিল। কিন্তু নিয়তির অমোঘ নিয়মে সেই প্রিয়তা দূর হয়ে যায়। বাবাকে রেখে তারা আলাদা সংসার করতে থাকলে বাবা আমার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ততোদিনে মা আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন।
বাড়িতে তিনি একা থাকেন। একজন কাজের মহিলা তাকে রান্না করে দেয়। আমরা তাকে অনেকবার ঢাকায় আনতে চেয়েছি বাবা রাজী হননি। তিনি অদ্ভূত অদ্ভূত কথা বলতেন। ঢাকায় আসার ব্যাপারে তিনি বলতেন, ‘ঢাকায় গিয়ে তোমাদের ঘরে বন্দি থাকতে হবে। এখানে আমি বাড়ির সামনে বসে থাকলে কত চেনা মানুষের দেখা পাই। দেশের একটা কুকুর দেখলেও ভাল লাগে।’
যখন তাঁর চলাফেরা সীমিত হয়ে পড়লো তখন তিনি স্বেচ্ছায় রাজী হলেন ঢাকায় আসতে। আমরা ছোট দুভাইয়ের ব্যস্ততা বেড়ে গেল বাবাকে ঢাকায় আনার জন্য। সকালে বাবা আমাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার চাচাদের ডেকে নিয়ে এসো। তাদের আমি কিছু কথা বলবো।’
আমি চাচাদের ডেকে আনলাম। তারা আমার আপন চাচা নয়। কিন্তু একই বংশের। তারা বাবাকে ভীষণ সম্মান করতেন। আমার বাবা ছিলেন পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি, সবার মুরুব্বি। সবাই তাঁর কাছে পরামর্শের জন্য আসতেন। একে একে সব চাচারা এলেন। তার পাশে সবাইকে বসতে ইঙ্গিত করলেন বাবা। সবাই বসলেন। আমি একপাশে আড়ালে দাঁড়িয়ে আছি। বাবা অনেকক্ষণ চুপ থেকে তারপর বললেন, ‘আমি ঢাকা চলে যাচ্ছি ইসহাকের বাসায়।’ এই কথা শোনার জন্য চাচারা প্রস্তত ছিলেন না। একসঙ্গে আৎঁকে উঠলেন তাঁরা। বাবা বললেন, ‘তোমারা মিলেমিশে থাকবে। নিজেদের মধ্যে কখনো কলহ করবে না। একজনের বিপদে আরেকজন ছুটে যাবে।’
আবেগে নজির চাচা প্রথম হু হু করে কেঁদে উঠলেন। বাকিরা সেই কান্নায় যোগ দিয়ে শিশুর মতো চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। একজন কাঁদতে কাঁদতে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। মমতাজ আলী খান নামে আমার সেই চাচা, পেশায় দলিল লেখক, রাগী স্বভাবের মানুষটি একটুতে রেগে-মেগে অস্থির হয়ে যান। রেগে গেলে তিনি কথা বলেন চেঁচিয়ে, গলা ফাটিয়ে। তিনি আমার বড় দু’ভাইকে ডেকে এনে বকাবকি করতে লাগলেন। ‘তোমরা কেমন সন্তান? তোমাদের বাপ আমাদের সাইকে ছেড়ে ঢাকায় চলে যাচ্ছেন। তোমরার তাকে এক মুঠো ভাত দেওয়ার ক্ষমতা রাখো না। কেমন ছেলে তোমরা? তোমরা কি নিজের ছেলেকে খেতে দাওনা? ছেলেমেয়েকে খেতে দিতে পারো শুধু বাপের জন্য ভাতের সংকট হয়? আমার সাফ কথা, ভাই যেন ঢাকায় যেতে না পারে।’
মমতাজ চাচার রাগারাগি আর অন্য চাচাদের কান্নাকাটিতে পাড়া প্রতিবেশিরা ছুটে এলো আমাদের বাড়িতে। তারপর এ কান সে কান হয়ে আমাদের উঠোনে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল।
বাবা কথা বলেন খুব ধীর স্থির ঠান্ডা মাথায়। এই মুহূর্তে তিনি মমতাজ চাচাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘ওদের কিছু বলো না। আমি আর এখানে থাকবো না। আমি নিয়ত করেছি আমি ইসহাকের বাসায় যাব। তোমরা এই নিয়ে আর কিছু বলো না।’
আড়ালে দাঁড়িয়ে বাবার এই কথা শুনে আমার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। যে আমি বাবার সবচেয়ে অপ্রিয় সন্তান, এসএসসি পরীক্ষার আগে যাকে বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন, সেই অবাধ্য সন্তানের কাছে যেতে তিনি অনড়। নিয়তির কি অদ্ভূত খেলা। আবেগে আমার চোখ ভিজে এলো।
ছোটবড় সবাই বাবার কাছে গিয়ে হাত ধরে দোয়া নিচ্ছেন। কেউ কেউ দোয়া নিতে গিয়ে কেঁদে ফেলছেন। আমাদের চাচাদের কান্না কিছুতেই থামছে না। তারা বুক চাপড়ে কাঁদছেন। কান্না গলায় বলছেন, ‘আমাদের মাথার উপর থেকে ছাদ সরে যাচ্ছে। কে আমাদের ভরসা দেবে? কে আমাদের সাহস দেবে? বিপদের সময় কে আমাদের পাশে দাঁড়াবে?
এইসময় বড়ভাই এসে বাবার পা ধরে কাঁদতে লাগলেন। বাবা অনড়। আমি বাবাকে দেখলাম নিরাবেগ। উদাস দৃষ্টিতে দূরে তাকিয়ে আছেন। আমি তার কাছে যেতেই বললেন, ‘টিকিটের ব্যবস্থা করেছ?’
আমি বললাম, ‘সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক বাবা।’
বিদায়ের সময় বড়ভাই বাবার পা ধরে ছিলেন। বাবা তাকে ধরে তুলে বললেন, ‘শেষ জীবনে একটু সহানুভূতি একটু ভালবাসা সব মানুষই চায়। তোদেরও যেন সে ভাগ্য হয়। একটু নিশ্চিত আয়েশের জন্য এই ঘর, এই বাড়ি, পুকুর, বাগান সব রেখে আমি চলে যাচ্ছি। যদি কখনো অজান্তে কারো মনে কষ্ট দিয়ে থাকি। কাউকে আঘাত করে থাকি তোমরা আমাকে মাফ করে দিও। আর তোমরা আমার শেষ বয়সের একমাত্র ভরসা এই সন্তান ইসহাকের জন্য সবাই দোয়া করো।’
সবার চোখের জলে বিদায় নিয়ে বাবা শিশু হয়ে গেলেন। আর আমি অবাধ্য সন্তান মুহুর্তে বাবা হয়ে গেলাম। আমি যা বলি বাবা তখন তাই করে। শুরু হলো বাবার ঢাকার জীবন।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন