এপ্রিলের মাঝামাঝি এক রাতে আমার মেজো দুলাভাই রফিকুল আলম রাইফেলসহ পালিয়ে এলেন আমাদের বাড়িতে। তিনি তখন রাজশাহীতে ইপিয়ার বাহিনীতে চাকরি করতেন। প্রতিরোধ যুদ্ধে টিকতে না পেরে সবাই যার যার মতো পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছেন। আমার মেজো বোন তখন আমাদের বাড়িতে। সে স্বামীর জন্য ব্যস্তভাবে রান্না চড়িয়ে দিয়েছেন। সবই হচ্ছে অতি গোপনে, নিঃশব্দে। তারপরও আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। এমনিতে আমার ঘুম খুব হাল্কা। টিনের চালে একটি পাতা পড়লে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
আমি জেগে দেখি বিমর্ষ মুখে দুলাভাই বসে আছেন। তাঁকে চেনা যাচ্ছিল না। সেই রাজশাহী থেকে বন বাদাড় ভেঙ্গে না খেয়ে পায়ে হেঁটে এতদুর পথ পারি দিয়ে রাজশাহী থেকে উল্লাপাড়া থানা কানসোনা গ্রামে এসেছেন। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। উসকো খুসকো চুল। চেনা যাচ্ছিল না। দেখেই মনে হচ্ছিল অনেকদিন তিনি কিছু খাননি। তাঁর পায়ের কাছে থ্রি নট থ্রি রাইফেল। আমি গিয়ে সেটা হাতে নিতেই আমার কোমর বাঁকা হয়ে গেল। ভীষণ ভারী। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, এত ভারী অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করে কিভাবে? আমিতো শূন্যই করতে পারছি না।
এই সময় সাত্তারকে দেখলাম খুন্তি [আমরা বলি খোন্তা] হাতে এসে দাঁড়ালো। সাত্তার আমার মামাতো ভাই। গ্রামের বাড়ি নান্দিনামধু। আমাদের বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় থাকতো। আমাদের বাড়িতে থাকতেই নাকি ওর বেশি ভাল লাগতো। বয়সে আমার চেয়ে বছর তিনেকের বড়। শ্যামলা রঙের পেটা শরীর। ভীষণ সাহসী। গায়ে অসুরের শক্তি। খোন্তা দিয়ে গর্ত খুঁড়ে রাইফেল লুকিয়ে রাখা হবে। সবাই নিঃশব্দে যার যার মতো কাজ করে যাচ্ছে। দুলাভাই আর সাত্তারের সঙ্গে আমিও সঙ্গি হলাম।
আমাদের বাড়ির পেছনে তখন ঘন জঙ্গল। দিনের বেলা কেউ সেই জঙ্গলে যেতে সাহস পায় না। হ্যারিকেনের মৃদু আলোতে আমরা সেই জঙ্গলে ঢুকলাম। সাত্তার খোন্তা দিয়ে মাটি খুঁড়ে পলেথিন পেপার দিয়ে রাইফেল এবং গুলি জড়িয়ে মাটি চাপা দিয়ে রাখলো।
ভীষণ রসিক স্বভাবের মানুষ আমার মেজো দুলাভাই। সাত্তারের সঙ্গে তাঁর রসালো আলোচনা ভাল জমে। কিন্তু আজ তাকে ভীষণ গম্ভীর দেখাচ্ছে। ভাল করে কথাই বলছেন না।
বাবাকে দেখলাম তাহাজ্জদের নামাজ পড়তে। ছোট বেলা থেকে তাঁকে আমি তাহাজ্জদের নামাজ পড়তে দেখি। আজ যেন একটু বেশি সময় জায়নামাজে থাকলেন। নামাজ শেষে লম্বা মোনাজাত করলেন।
খাওয়ার পর আমি দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, যুদ্ধের অবস্থা কি? আমরা কি পাকিস্তানীদের সঙ্গে পারবো?
দুলাভাই মৃদু স্বরে বললেন, কিছুই বলা যাচ্ছে না।
আমরা সেইসময় সলপ হাইস্কুল মাঠে একজন বাঙালি মিলিটারির নেতৃত্বে লাঠি ট্রেনিং করতাম। লাঠি নিয়ে নানা ধরনের পজিশন নেওয়ার ট্রেনিং করতাম। কি বিপুল উৎসাহ আমাদের। কেউ কেউ অতি উৎসাহী ব্যক্তি বাঁশের আগা চোখা করে বীর দর্পে তাই নিয়ে ট্রেনিং করতো। আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় ওই অস্ত্রের নাম হলঙ্গা। আমি এই কাহিনী দুলাভাইকে বললে তিনি কোন প্রতি উত্তর করলেন না। শুধু নিঃশব্দে হাসলেন।
তখনো সিরাজগঞ্জ মহকুমায় পাক আর্মি আসেনি। মহকুমার এসডিও শামসুদ্দিন সাহেব বেশ কয়েকজন বাঙালি আর্মি এবং ইপিয়ার নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। একজন সিএসপি অফিসার হয়ে তিনি দেশ প্রেমের যে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন তা অকল্পনীয়। প্রথমে তিনি নগরবাড়ি ঘাটে প্রতিরোধের জন্য পজিশন নেন। যুদ্ধে টিকতে না পেরে পেছনে এসে বাঘাবাড়ি ঘাটে পজিশন নেন। সেখানেও টিকতে না পেরে আমাদের পাশের গ্রামে করতোয়া নদীর উপর রেলের ব্রিজের কাছাকাছি শাহজাহানপুর গ্রামে পজিশন নেন। দুঃখের বিষয় যে, এই লড়াকু সৈনিক পরে পাক বাহিনীর হাতে নির্মম ভাবে শহীদ হন। যুদ্ধে হেরে শামসুদ্দিন সাহেব বাড়ি ফিরে যান। তিনি তারপর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু তার নিকট আত্মীয়রা তাঁকে কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। কাজে যোগ দেওয়ার পর পাক আর্মি তাঁকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। সেই শহীদের নামে সিরাজগঞ্জে স্টেডিয়ামের নাম করণ করা হয়েছে, শহীদ শামসুদ্দিন স্টেডিয়াম। আরও একটি স্থানে তার নাম স্মরণে রাখা হয়েছে, সেটা হলো জেলা প্রশাসকের অফিসের সামনে একটি সুদৃশ্য তোরণ করা হয়েছে, নাম দেওয়া হয়েছে শহীদ শামসুদ্দিন তোরণ।
বলছিলাম করতোয়া নদীর উপর ব্রিজে যুদ্ধের কথা। যুদ্ধের কথা শুনে আমরা কয়েকজন বন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান দেখতে শাজাহানপুর গ্রামে যাই। গিয়ে দেখলাম তাঁরা বাঁশঝাড়ের আড়ালে টেন্স খুঁড়ে পজিশন নিয়ে আছে। ব্রিজের পাশে রেলের স্লিপার তুলে রাখা হয়েছে।
এই সময় আমাদের ছাত্র নেতা লতিফ ভাইকে দেখলাম সেই দলে। [লতিফ মির্জা নামে উত্তরবঙ্গে ব্যাপক খ্যাত] আমাকে দেখে তিনি বললেন, শোন, বাড়িত যা। আমাদের জন্য রুটি বানিয়ে নিয়ে আয়। আমরা গ্রামে ফিরে এলাম। বাড়ি বাড়ি ঘুরে আটা সংগ্রহ করে আমাদের বাড়িতে এনে মা আর মেজো বোনকে রুটি বানাতে বললাম।
বেলা তখন তিন কি সাড়ে তিনটে বাজে। রুটি বানানো শেষ। আমরা রুটি নিয়ে রওনা হবো সেই সময় দুনিয়া গায়েব করার মতো ভয়ংকর শব্দে গোলা-গুলি শুরু হলো। এই প্রথম আমি এলএমজির গুলির শব্দ শুনলাম। মনে হলো গজব নেমে আসছে। বাড়ির বাইরের উঠোনে গিয়ে দেখি চরায় মানুষ আর মানুষ। পালাচ্ছে। আমার তখন মনে পড়ছিল যারা হলঙ্গা নিয়ে পাকিস্তানীদের সাথে যুদ্ধে করতে চেয়েছিল তাদের অজ্ঞতার কথা। গুলির শব্দে কানের তালা ফেটে যাওয়ার যোগাড়। আমার মা অস্থির হয়ে ছোটাছুটি করছেন আর কাঁদছেন। দুলাভাই বললেন, ভয় নেই। গুলির রেঞ্জ এতদুর আসবে না।
বাবা উঠোনে গর্ত করে ধানচাল মাটির নিচে লুকিয়ে রাখতে বললেন। কোদাল দিয়ে উঠোনে গর্ত করতে লেগে গেল সাত্তার। গভীর করে গর্ত করা হলো। সেখানে চাল ডাল সোনাদানা লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। এই সময় মায়ের একটি কাণ্ড দেখে বাবা ধমকে উঠলেন। মা কাঁথা লেপ এই সব নিয়ে আসছিলেন। বাবা বললেন, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এ গুলো আনছো কেন? যে গুলো বেশি দামি সেইসব জিনিস নিয়ে এসো। এত দুঃখের মধ্যেও সবাই হেসে উঠলো।
জীবনের অনেক প্রয়োজনের মধ্যে কাঁথা বালিশও অনেক প্রয়োজন। এই জিনিসগুলি মাকে তৈরি করতে হয়েছে। এর কষ্ট সে ছাড়া আর কে উপলব্ধি করতে পারবে?
সন্ধ্যা নাগাদ গুলি থামলে শোনা গেল পাক আর্মিরা পিছু হটেছে। পর মুহূর্তেই দাও দাও করে আগুন জ্বলে উঠলো শাজাহানপুর গ্রামে। তারমানে আমাদের মুক্তিবাহিনী টিকতে পারেনি। আমরা তখন ভয়ংকর চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আমি গ্রামের যে বন্ধুদের সঙ্গে ভারত যাওয়ার চিন্তা করছিলাম তাদের সঙ্গে শলা পরামর্শ করে যাওয়ার ডেট ফাইনাল করলাম। রাতে বাড়ি ফিরে শুনি দুলাভাই চলে গেছে। যাওয়ার সময় রাইফেল নিয়ে গেছে। মেজো বোনের ভীষণ মন খারাপ। তার দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
এই সময় বাবার কণ্ঠ আমার কানে এলো। তিনি মাকে বলছেন, সাত্তার আর ইসহাককে কোথাও পাঠিয়ে দাও। ইসহাককে নিয়ে আমার বেশি চিন্তা। মিটিং মিছিলে ওইতো আগে আগে শ্লোগান ধরেছে। ওকে পেলে মিলিটারিরা ছাড়বে না।
সকালে এই ব্যাপারটা মা আমাকে বললে, আমি বললাম, মা তুমি চিন্তা করো না। আমি এবং সাত্তার ঠিক করেছি আমরা গোপনে কোথাও লুকিয়ে থাকবো। মায়ের কাছে সত্যি কথাটা বলতে পারলাম না। আমার মা বড় দুখি একজন মা। তার কয়েকজন সন্তানের মৃত্যুর পর আমি। আমি যুদ্ধে যাচ্ছি শুনে তাৎক্ষনিক সে হার্ট ফেল করতে পারে। সেই কারণে মিথ্যে বলতে হলো তার কাছে। তাকে বললাম, তুমি আমাদের কিছু টাকা দাও। মা বললেন, কত? আমি বললাম, দুজনের জন্য আপাতত শ খানেক দাও। পরে আবার চিন্তা করা যাবে। মা বললেন, এত টাকা আমার কাছে নাই। আমি দেখলাম ঘরে বস্তায় সর্ষে ভরা। আমি সাত্তারকে বললাম, উঠাও মাথায়। আমি মা এবং সাত্তার ধরাধরি করে দুইমণের সর্ষের বস্তা সাত্তারের মাথায় তুলে দিলাম। হাটে নিয়ে ৬০ টাকা বিক্রি করে আমি ত্রিরিশ আর সাত্তার ত্রিরিশ টাকা দুজনে ভাগাভাগি করে নিলাম। সাত্তার রাতেই যুদ্ধে চলে গেল ওর চেনা একজনের সঙ্গে। আমি রয়ে গেলাম। আমরা গ্রামের কয়েকজন বন্ধু অন্য পথে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। সাত্তারের সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা। যুদ্ধে সে শহীদ হয়। সে এক মর্মান্তিক কাহিনী। যুদ্ধের শেষ দিকে খবর পেলাম, সাত্তার যুদ্ধে শহীদ হয়েছে।
সাত্তার তার ছোট একটি দল নিয়ে পাক আর্মির ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যায়। ফায়ার দিয়ে সাত্তার বেরিয়ে গেলেও ওর সঙ্গিরা আটকা পড়ে। তারা একটি মসজিদে আশ্রয় নেয়। পাক আর্মি মসজিদ ঘেরাও করলে সাত্তার সঙ্গিদের বাঁচাতে ফিরে এসে পাক আর্মিকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্য গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয় না। পাক আর্মি তখন গুলি করে সাত্তারকে আহত এবং বন্দি করে। সঙ্গিদের সবাইকে মেরে ফেলে কিন্তু সাত্তারকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তারপর তাকে জিপের পেছনে বেঁধে সারা ময়মনসিং শহর ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে ঘোরায়। সাত্তারের শরীরের চামড়া ঊঠে রক্তাক্ত হয়ে মাথার খুলি ফেটে তখনই মারা যায়। এই খবর শোনার পর দুদিন আমি কিছুই খেতে পারিনি। মন খুলে কাঁদতেও পারিনি। সারাক্ষণ চাপা কষ্ট বুকের মধ্যে গুমরে গুমরে আমাকে অস্থির করে রেখেছে।
সাত্তারের মর্মান্তিক মৃত্যু আমার মনে ভয়ংকর হিংস্রতা তৈরি করে। সারাক্ষণ আমার ভেতর প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে থাকে। কোন যুদ্ধে পাক আর্মি ধরা পড়লে আমি সাত্তারের কথা ভেবে অমানবিক ভাবে তাকে কষ্ট দিয়ে হত্যা করতাম।
যুদ্ধ শেষ হলো। আমি বাড়ি ফিরে এলাম। মেজো দুলাভাই ফিরে এলেন। শুধু সাত্তার ফিরে এলো না।
একদিন সাত্তারের বাবা আমার বড় মামা আমাদের বাড়ি এলেন আমার কাছে সাত্তারের খবর নিতে। কি নিদারুণ সেই মুহূর্ত। আমি নির্মম সত্যটা মামাকে বলতে পারছি না। মামা কাঁদছেন। আমার বাবা মাও কাঁদছেন। আমি মামাকে বললাম, আপনি ভেঙ্গে পড়বেন না। অনেকেই আহত হয়ে ভারতের হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। আমার বিশ্বাস ও ফিরে আসবে।
এই মিথ্যেটা বলতে আমার বুক কাপছিল। কান্নায় বুক ভেসে যাচ্ছিল। তবু সত্যটা বলার সাহস পাচ্ছিলাম না।
কান্না জড়িয়ে আমার বাবা বললেন, ভাইজান, সাত্তার যদি ফিরে না আসে তাহলে বুঝবেন ও দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। আসুন আমরা ওর জন্য দোয়া করি। বলেই বাবা এবং মামা মোনাজাত ধরলেন। আমিও হাত তুললাম। মনে মনে বললাম, আল্লাহ, আমার এই মিথ্যেকে তুমি ক্ষমা করে দিও।
মাকে মিথ্যে বলে যুদ্ধে চলে যাই। কিন্তু ঘটনা ঠিকই প্রকাশিত হয়ে পড়ে। মা-বাবা জানতে পারেন তাদের অবাধ্য অপ্রিয় সন্তান পালিয়ে থাকার অজুহাতে যুদ্ধে চলে গেছে। সেই থেকে আমার মা অসুস্থ। ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করেন না। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে আমাকে দেখে চিৎকার করে ওঠেন। বাড়ির লোকজন মাকে নিয়ে অস্থির। এ সব কথা আমি জেনেছি যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর।
যুদ্ধের মাঝামাঝিতে যখন আমরা ভারত থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ঢুকেছি সেই সময় আরও একটি ভয়ংকর খবরে আমাকে দিশেহারা করে তোলে। আমার গ্রামের মানুষ, পরিবারের সদস্যরা জেনেছে যুদ্ধে আমি মারা গেছি। তাই শুনে আমার মা মুহূর্তে মুহূর্তে জ্ঞান হারাচ্ছেন। আমারও মনটা বিষাদে ভরে থাকতো। কেবলি মনে হতো যদি এক দৌড়ে বাড়ি গিয়ে মাকে দেখে আসতে পারতাম। আর বলে আসতে পারতাম, মা, তোমার ছেলে যুদ্ধে শহীদ হয়নি। তোমার ছেলে গাজী হয়ে ফিরে আসবে।
বাড়িতে যাওয়ার হঠাৎ অমুল্য সুযোগ পেয়ে গেলাম। আমার তখন সিরাজগঞ্জ মহকুমার রায়গঞ্জ থানার একটি গ্রামে অবস্থান করছি। সেখান থেকে আমার গ্রাম কানসোনা প্রায় ২০/২৫ মাইল দূরত্ব। কমান্ডারের অনুমতি নিয়ে আমি এবং আমার বন্ধু আলী আজগার বাড়ির উদ্দ্যেশে রওনা হলাম। আমাদের বাড়ি একই গাঁয়ে। আমরা একই গ্রাম থেকে ১০ জন যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই। কাজিপুর থানার শুভগাছা গ্রাম থেকে আমরা ভারতে যাওয়ার জন্য বজরা নৌকায় চড়ি। তিনদিন তিন রাত নৌকায় কাটিয়ে আমরা ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মানিকেরচর গিয়ে নামলাম। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে আমরা তখনকার রংপুর জেলার রউমারি থানায় অবস্থিতি অস্থায়ী ক্যাম্পে উপস্থিত হই। তখন বিকেল। সন্ধ্যার আগেই আমরা ক্যাম্পে নাম এন্ট্রি করি। রাতে খাওয়া হিসেবে দুমুঠো চিড়া আর আধা মুঠো চিনি। এই খেয়ে রাত পার করতে হলো। খাওয়ার এত কষ্ট দেখে দুদিন পর আমাদের একজন সঙ্গি পালিয়ে দেশে চলে আসে। তাকে খুঁজে না পেয়ে আমরাতো দারুন অস্থিরতায় ভুগছি। সেইসময় খবর পেলাম আমাদের হারিয়ে যাওয়া বন্ধু বহাল তবিয়তে গ্রামে ফিরে গেছে। আমরা নিশ্চিন্ত হলাম। কারণ সময়টা ছিল বড় টালমাটাল। অনেকেই বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন।
আমরা বাকি নয়জনও একদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। এই বিচ্ছিন্নতায় আমাদের কোন হাত ছিল না। আমাদের যারা ট্রেনিং করাতেন তারাই ঠিক করতেন কাকে কোথায় নিয়ে যাবেন।
এক সকালে রউমারি ক্যাম্প আক্রমণ করে পাকআর্মি। আমরা আরও ভেতরে অবস্থান গ্রহণ করি। জায়গাটার নাম নয়াবাজার। ভারতের অন্তর্ভুক্ত। সেখানে একটি স্কুল মাঠে আমরা তাবু টানিয়ে অবস্থান করতে থাকি। এক সকালে হুইসেল বেজে উঠলে আমরা তাবু থেকে বেরিয়ে লাইন দিয়ে দাড়াই। এটাই নিয়ম। সেখান থেকে আমাদের মিন্টু নামের একজনকে উচ্চতর ট্রেনিঙয়ের জন্য অনেকের সঙ্গে তাকেও ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। মিন্টু আমাদের মধ্যে সবচেয়ে জুনিয়র। ও তখন ক্লাস এইটে পড়ে। যুদ্ধে যাবার প্রবল বাসনা ওর। আমরা ওকে যুদ্ধে নিতে চাইনি। ওকে বার বার ফিরে যেতে বলা হয়েছে। কিন্তু না, সে যাবেই। তাকে নিয়ে আরেক সমস্যা হলো, তার কাছে কোন টাকা নেই। নৌকায় প্রতিজনের ভাড়া দিতে হবে ৩০ টাকা। ৩০ টাকা তখন অনেক টাকা। এই টাকা কে দেবে। তার অনমনীয় মনোভাবের কারনে আমরা শেয়ার করে ওকে নৌকায় নিয়ে যাই। সেই মিন্টু প্রথম উচ্চতর ট্রেনিঙয়ের জন্য আমাদের ছেড়ে গেল।
শুরু হলো আমাদের মধ্যে ভাঙন। এর কদিন পর আমি, আজগার এবং রফিকুল আলমসহ শখানেক যোদ্ধাকে উচ্চতর ট্রেনিঙয়ের জন্য মেঘালয়ের তুরার পাহাড়ে নিয়ে গেল। বাকিদের খবর জেনেছি যুদ্ধের পর।
কোন অবস্থাতেই বন্ধু আজগারের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়নি।
যুদ্ধের মাঝে আমি এবং আজগার বাড়িতে রওনা হই।
আমি যখন বাড়িতে পৌছাই তখন রাত ৮ কি সাড়ে ৮। আমি উঠোনে এসে দাঁড়ালাম। বাড়ির সবগুলো ঘরে বাতি জ্বলছে। আমার পাশ দিয়ে কেউ কেউ হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু আমাকে খেয়াল করছে না। আমার মুখে দাড়ি। মাথায় লম্বা চুল। গায়ে একটি কালো চাদর। চাদরের নিচে স্টেনগান।
আমার মেজো বোন হাজেরা আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল তবু সে কিছু আন্দাজ করতে পারলো না। আমি দেখলাম মা বড় ঘরে পান বাঁটার কাছে বসে পান বানাচ্ছে। আমি খুবই মৃদু স্বরে ডেকে উঠলাম, মা। এই ডাক মায়ের কান পর্যন্ত পৌঁছানোর কথা নয়। তারপরও মা শুনেছেন আমার ডাক। মা চিৎকার দিয়ে উঠলেন, আমার বাজান আইছে। ছুটে এলেন না, আমার মা যেন উড়ে এলেন। এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। এমন ভাবে আঁকড়ে ধরলেন তাঁর বন্ধন ছিন্ন করে আমাকে কেড়ে নেয় এমন শক্তি পাকআর্মিরও ছিল না।
একে একে বাড়ির সবাই এসে আমাকে ঘিরে ধরলো। বাবাকে দেখছিলাম না। বাবা কোথায় প্রশ্ন করতে যাব গলা খাঁকারি দিয়ে বাবা বাড়িতে ঢুকলেন। আমাকে দেখে তিনি ভাষা হারিয়ে ফেললেন। মাতো তখন থেকে জড়িয়ে ধরে আছেন। বাবা এসে আমার কপালে চুমু খেয়ে কান্না জড়িয়ে বললেন, ‘আমার বাজানের জন্য মুরগী রান্না করো। আমি আজ বাজানের সঙ্গে খাবো।
আমার বাবাকে ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি, তিনি একা আলাদা ভাবে খান। আমরা অন্য ভাইবোনেরা রান্নাঘরে বসে একসঙ্গে খাই।
আমি বাবার সঙ্গে খাচ্ছি। মা ছুটতে ছুটতে এটা সেটা আনছেন। প্রায়ই তিনি ভুল করছেন। বাবা ধমকে উঠলে মা নির্বিকার তাকিয়ে আমাকে দেখেন। আমি বাবাকে বললাম, মা আমাদের সঙ্গে খাক। মার সে কি আনন্দ। প্লেট নিয়ে নিজেই আমার পাশে বসে গেলেন। তিনি যত না খাচ্ছেন তার চেয়ে বেশি কাঁদছেন আর আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছেন।
খাওয়া শেষে মাত্র একটি প্রশ্ন করলেন, কালই চলে যাইবা বাজান?
আমি মাথা নেড়ে স্বীকার করলে মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন।
রাতে আমি অন্য বাড়িতে শুতে গেলাম। আমার এক চাচার বাড়িতে। সে কথা শুধু বাবা জানলেন।
সকালে আমি রেডি হয়ে বাবার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাবা বলে ডাকতেই তিনি দরোজা খুলে বেরিয়ে এলেন। ফজরের নামাজ পড়ছিলেন তিনি। মাকে ডেকে নিয়ে এলেন। মা এসে কান্না জুড়লে বাবা ধমক দিলেন। কাঁদছ কেন? ওকে আমরা আল্লার হাওলায় দিয়েছি। দোয়া করো। মায়ের মন তাতে কি বাঁধা মানে। আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। আমি বললাম, মা, এবার বিদায় দাও। দোয়া করো, আমরা যেন মাতৃভূমির স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পারি।
বাবা ক্রমাগত দোয়া পড়ছেন। আর মা শুধু কাঁদছেন। এরই মাঝে আমি বাবা এবং মাকে সালাম করলাম। বাবা বললেন, ‘তোমাকে আল্লার হাতে সপে দিলাম। সেই তোমাকে রক্ষা করবেন।’
মাকে কাঁদিয়ে আমি আবার রণাঙ্গনের দিকে পা বাড়ালাম।
আমাদের বহনকারি ট্রাকটি যখন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরার শহর অতিক্রম করছিল তখন ক্ষুধা ক্লান্তি আর নানা আশংকায় মন বিষাদে ভরে ছিল। এই যে গন্তব্য এর শেষ কোথায়? যুদ্ধ যদি শেষ না হয়? আর কি আর মায়ের মুখ দেখতে পাব না? আমার বাবা? আমার ছোটভাই? আমার প্রিয় গ্রাম? এমনতর ভাবনায় আমার মন যখন অস্থির সেই সময়য় একটি অভাবনীয় দৃশ্য দেখে আমার মন প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। তুরার শহরটি পাহাড়ের গায়ে গায়ে। অনেক উঁচু পাহাড় থেকে কল কল করে ঝর্নার পানি গড়িয়ে পড়ছে। এমন দৃশ্য জীবনে আমার প্রথম দেখা। কি নয়নাভিরাম সে দৃশ্য। মুহূর্তে আমার মন ভাল হয়ে গেল। আমি মুগ্ধ চোখে অবিরাম ঝম ঝমিয়ে পড়া ঝর্নার জলের দৃশ্য দেখতে লাগলাম। আমি চোখ বুজলে এখনো সেই অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্যটি দেখতে পাই।
আরও ঘণ্টা খানেক যাওয়ার পর আমাদের ট্রাক একটি সুউচ্চ গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। আমরা ট্রাক থেকে পঞ্চাশ জনের একটি দল নামলাম। দেখি সেখানে আরও অনেক যুবক ইতস্তত বসে দাড়িয়ে সময় কাটাচ্ছে। দেখতে দেখতে আর কয়েকটি ট্রাক এসে দাঁড়ালো। সেখানেও বেশ কিছু যুবক। সংখ্যায় আমরা হাজার খানেক। এর পর ভারতীয় আর্মি এসে আমাদের একটি একতলা ভবনের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়াতে বলল। আমরা লাইন দিয়ে দাঁড়ালাম। একজন একজন করে ভবনের ভেতরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসছে। ব্যাপার কি, আমাদের সবারই প্রচণ্ড কৌতূহল। যে যুবক হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসছে সবাই তাকে জিজ্ঞেস করছে, ভাই, ব্যাপার কি? যুবকটি হাসতে হাসতে জবাব দিচ্ছে, ভেতরে যান। ভেতরে গেলেই দেখতে পাবেন। তাদের এমন কথায় আমাদের কৌতূহল আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে।
একসময় আমার পালা এলো। ভেতরে গিয়ে দেখি দুজন ব্যক্তি বসে আছেন। তাদের ভাব দেখে মনে হলো তারা ডাক্তার। আমি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন হিন্দিতে বললেন, কাপড় খোলেন। বলে কি। আমি চমকে হতভম্বের মতো তাকালাম। ডাক্তার আবার একই কথা বললেন। এবারের বলার মধ্যে খানিকটা উষ্মা ছিল। একজন নিজেই এগিয়ে এসে আমার গায়ের জামা এবং প্যান্টের চেন খুলে ফেললেন। বাকি কাজটা আমি করলাম। পুরো জন্মদিনের পোশাকে আমি লোক দুটোর সামনে দাড়িয়ে আছি। একজন টর্চ লাইট হাতে নেড়ে চেড়ে আমার গোপন অঙ্গ দেখছেন। পশ্চাৎ দেশও লাইট মেরে দেখলেন। দেখে টেখে আমাকে হিন্দিতে বললেন, চেলে যাও। আমি কাপড় পরে বাইরে আসামাত্র বাকিরা আমাকে ছেঁকে ধরলো। আগের জনদের মতো আমিও বললাম, ভেতরে যান, গেলেই দেখতে পাবেন।
এতক্ষণ নিঃশব্দে শুনছিলেন আমার বাবা। এবার তিনি শব্দ করে হেসে উঠলেন, বললেন, বড়ই শরমের কথা।
আমি বললাম, বাবা, এটাকে বলে মেডিক্যাল টেস্ট। এটা আর্মির নিয়ম। তারা পরীক্ষা করে দেখে কোন সংক্রামক রোগ আছে কিনা।
এই নিয়ে আমরা সে কি হাসাহাসি। আমাদের দলে একজন ছিলেন সে অতিশয় ভদ্রলোক। কখনো তার মুখে বেফাঁস কোথা শুনিনি। তাকে নিয়ে শুরু হলো মজা। সবাই তাকে একই প্রশ্নে জর্জরিত করতে থাকে, ভাই, তুমি কি সত্যি কাপড় খুলে ছিলে?
বার বার একই প্রশ্নে ভীষণ রেগে যায় আমাদের সেই বন্ধু। একজন সিনিয়র ধমক দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দেয়।
তারপর ক্যাম্পের বড় গেট খুলে দেয়। আমরা ভেতরে প্রবেশ করি। সে এক এলাহি কাণ্ড। বিশাল জায়গা জুড়ে ক্যাম্প। ক্যাম্পে নিয়ে দলে ভাগ করা হলো আমাদের। আমাদের দলে ১২৬ জন যোদ্ধা। আমাদের আগে আর একটি গ্রুপ ট্রেনিং নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। তাদের তৈরি করা রেডিমেট তাবু আমরা পেয়ে গেলাম। সেখানেই আমরা উঠে পড়লাম। বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে খাট। এক খাটে দুজন থাকতে পারবে। আমি এবং আমার গ্রামের বন্ধু আলী আজগার একটা বাঁশের তৈরি খাট দখল করলাম। তার আগে আমাদের প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ হলো দুটো কম্বল, দুটো ফুলপ্যান্ট, দুটো হাফপ্যান্ট, দুটোগেঞ্জি, দুজোড়া কেডস, প্লেট, পানি খাওয়ার মগ, সুই, সুতা। মজার ব্যাপার হলো আমাকে যে দুটো ফুলপ্যান্ট দেওয়া হলো তার মধ্যে আমার মত হাল্কা পাতলা ইসহাক তিনজন ঢুকে যাবে।
বাবা আবার হেসে উঠলেন। বললেন, সে গুলো তোমরা পরেছ কিভাবে?
আমি বললাম। বাবা, ক্যাম্পের ভেতরে দর্জি আছে। তারা আমাদের প্যান্ট কেটে আমাদের মাপ মতো ঠিক করে দিয়েছে।
সারাদিন পর রাতে খাওয়া-দাওয়ার ভাল আয়োজন হলো। খাসির মাংশ এবং ভাত। সবাই তৃপ্তি সহকারে খেলাম।
সকালে উঠেই ট্রেনিং। প্রথম দিনই হাতে একটি রাইফেল এবং ৫টি গুলি দিয়ে দূরে একটি পাহাড়ের কাছে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। সামনে মানুষের আঁকা ছবি হলো টার্গেট। রাইফেলের গুলি বেরিয়ে যাওয়ার সময় পেছন দিকে যে সজোরে ধাক্কা দেয় তাতো আমার জানা ছিল না। রাইফেলে গুলি ভরে লাইন পজিশন নিয়ে অর্থাৎ শুয়ে শুয়ে পজিশন নিয়েছি। রাইফেলে গুলি লোড করে নিশানা ঠিক করে যেই ট্রিগারে চাপ দিয়েছি অমনি দ্রাম শব্দে গুলি বেরিয়ে গেল। গুলি বেরিয়া যাওয়ার পর এমন জোরে পেছনে ধাক্কা দিল রাইফেলের বাট আমার ঘাড়ের হাড়ে লেগে আমি কাত হয়ে পড়ে গেলাম। আমার বাম হাত আর কোন কাজ করছে না। প্রচণ্ড ব্যথায় আমার হাত যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে।
গল্পের এই জায়গায় এসে বাবা আমাকে থামিয়ে দিলেন। তার অনুরোধেই আমি তাকে যুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছিলাম। বাইরে থেকে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে আমার একমাত্র কাজ হলো আমার নিঃসঙ্গ বাবাকে সঙ্গ দেওয়া। তাকে বলেছিলাম, বাবা আজ আমি আপনার কোলকাতার জীবনের গল্প শুনবো। উনি বললেন, না, আমি তোমার যুদ্ধের গল্প শুনবো।
হঠাৎ কি হলো বাবার। উনি উঠে বাথরুমে গেলেন। নাক ঝাড়ছেন। শ্যামলী এসে বলল, তুমি বাবাকে কি বলেছ, বাবা কাঁদছেন।
চোখে মুখে পানি দিয়ে বাবা এলেন। আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, এত কষ্ট করেছে আমার বাজান। তার বিনিময়ে দেশ তোমাদের কি দিয়েছে? আমি বাবাকে বললাম, কিছু পাওয়ার জন্যতো যুদ্ধ করিনি বাবা। দেশকে ভালবেসে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি।
বাবা আফসোসের সুরে বললেন, আহারে। আমার বাজান বলে কি। এই না হলে আমার আদরের বাজান।
এবার বলো তারপর কি হলো?
আমিতো মাটিতে কাত হয়ে পড়ে আছি। আমাদের ওস্তাদ চারদিক তদারকি করছেন। আমাদের কোম্পানির দায়িত্বে ছিলেন একজন বাঙালি ক্যাপ্টেন। তার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে। তিনি এসে আমার মাটিতে কাত হয়ে পড়ে থাকার কারন জিজ্ঞেস করলেন। আমি ঘটনা খুলে বললাম। উনি আমাকে রাইফেলের বাট ঠিক ঠাক পজিশন নেওয়া দেখিয়ে দিলেন। বললেন, এবার ফায়ার করো। আমি ভয়ে ভয়ে ফায়ার করলাম। কিন্তু আর কোন সমস্যা হলো না। পরের গুলি গুলো ঠিক মতো টার্গেটে ভেদ করে বেরিয়ে গেল।
সেইদিনই আমাদের ট্রেনিং দেওয়া হলো, কিভাবে রাইফেল খোলা এবং আবার জোড়া লাগানো হয়।
পরেরদিন সকালে বাঁশি। উঠে লাইনে দাঁড়ালাম। ৩০ জনকে আলাদা করা হলো। তার মধ্যে আমিও আছি। আমাদের দায়িত্ব পড়লো সকাল দুপুর রাতে খাওয়ার আয়োজন করার। ভয়ংকর কষ্টকর কাজ। বেশি কষ্টকর হলো ঝর্না থেকে পানি আনা। বাঁশের লাঠির মাঝে বালতি বেঁধে দুপাশে দুজন কাধে নিয়ে গড়ান বেয়ে পাড়ে ওঠা ভয়ংকর বিপদজনক কাজ। পা পিছলে পড়ে অনেকি আহত হয়েছে। আমি আমার এক সহযোদ্ধা কয়েক বালতি পানি এনে দম নিতে তাবুতে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। আমি দায়িত্ব প্রাপ্ত কুককে বললাম, আমি অন্যকাজ করবো পানি আনতে পারবো না। আমার পায়ে ফোসকা পড়ে গেছে।
উনি দয়া পরবশ হয়ে আমাকে অন্যকাজ দিলেন। এইভাবে দিনটি পার হলো। এইভাবে নিজেদের রান্না নিজেদেরই করতে হতো। সেখানেতো বউ কিংবা মা নেই। একমাস ট্রেনিঙয়ে একবারই এই ডিউটি পড়েছিল আমার। রাতে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে গেছি। হুইসেলের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। সবাই এসে লাইনে দাঁড়ালাম। বলা হলো যারা আজ রান্নার কাজ করেছে তারা ছাড়া বাকিরা চলে যাও। আমরা ৩০ জন ঘুম জড়ানো চোখে দাড়িয়ে আছি। আমাদের বলা হলো, বাংলাদেশ থেকে ৪০ জনের একটি দল এসেছে, তাদের খাওয়ার আয়োজন করতে হবে। মহা বিরক্তি নিয়ে আটা ছেনার কাজে লেগে গেলাম। তখনো জানি না দেশ থেকে কারা এসেছে। আমাদের কাজের তদারকি করছিলেন একজন ভারতীয় সৈনিক। তিনি জানালেন কাদের সিদ্ধিকী এসেছেন ক্যাম্পে। কাদের সিদ্দিকীর নাম শুনে আমাদের কাজের জোশ বেড়ে গেল। আমরা মহানন্দে রুটি ভাঁজতে লাগ্লাম। কাদের সিদ্দিকী তখন আমাদের কাছে মহানায়ক। ভারতীয় সৈনিকরাও তাঁকে স্যালুট করে। রুটি ভাঁজার পর আমরা সেই রুটি নিয়ে কাদের সিদ্দিকীর তাবুতে গেলাম। এই প্রথম তাঁকে আমি মুখোমুখি দেখলাম। মুখে দাড়ি। লম্বা দশাসই চেহারা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। তাকে দেখে প্রথম দর্শনে আমি প্রেমে পরে গেলাম। এই না হলে বীর। পরদিন আবার তার সঙ্গে আমাদের দেখা হলো। সারাদিন ট্রেনিং শেষে বিকেলে আমরা সমস্ত যোদ্ধারা একটি বড় ময়দানে হাজির হতাম। এটা ছিল আমাদের নিত্যকার ডিউটি। প্রতিদিনই কোন না কোন রাজনৈতিক নেতা এসে উদ্দীপনামূলক ভাষণ দিতেন আমাদের উদ্দেশ্যে। সেদিনও আমরা ময়দানে হাজির হলাম। কাদের সিদ্দিকী ভাষণ দেবেন। তিনি কালো প্যান্ট কালো সার্ট কোমরে পিস্তল নিয়ে বীরের মতো যখন হেঁটে আমাদের সামনে এলেন আমরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। তাকে দেখে আমাদের সাহস বেড়ে যাচ্ছিল। উনি জোরালো কণ্ঠে ভাষণ দিলেন। আমরা আরও শাণিত হয়ে উঠলাম।
স্বাধীনতার পর তাকে নানা খেতাবে ভূষিত করা হলো। তাকে বাঘা সিদ্দিকী, বাঘা বাঙালি নামে ডাকা হতো। বাঘা বাঙালি নামে তাকে নিয়ে একটি সিনেমাও তৈরি করা হলো।
অথচ সেই মানুষটির এমন পতন এবং পচন হলো সে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ফাঁসি হওয়া মীর কাশেমের দিগন্ত টিভিতে রাজাকেরদের নিয়ে অনুষ্ঠান করতেন নিয়মিত। দুঃখে বুক ফেটে যায়। এইভাবে একজন হিরোর পতন হয়?
বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, এইটা কি শোনাইলা বাজান? কাদের সিদ্দিকীর এই অবস্থা?
বললাম, বাবা, এই মানুষটির পতন এবং পচন আমি মেনে নিতে পারিনি। এই হাতে রুটি ভেঁজে তাঁকে খাইয়েছি। তার প্রতিফল তিনি এখন রাজাকারের বন্ধু।