৫৫২ বার পঠিত
ছবিতে সব সময়ই আমার কুণ্ঠা ছিলো। যার ফলে নিজের ভালো কোনো ছবি তোলা হয়ে ওঠেনি। বড় কোনো মানুষের সাথেও ছবি নেই খুব একটা। ওই যে কুণ্ঠা। নিজেকে নিয়ে দ্বিধা। মানুষ হতে পারার আগে, মানুষ হিসাবে প্রচারের আকণ্ঠ সলাজতা। যার ফলেই আমি প্রায় ছবিহীন।
নানা ভঙ্গিমায় বড় বড় মানুষদের সাথে ছবি দেন কেউ সামাজিকমাধ্যমে। আমার বিবমিষা হয়। নিজেই সংকোচ বোধ করি আত্মপ্রচারের পাগলামীর। আচ্ছা একজন বড় মানুষের সাথে ছবি দিলেই কি আমি তার উচ্চতাকে ছুঁয়ে দিতে পারি! এ যে বামন হয়ে চাঁদ ছোঁবার মতন অবস্থা। এটা কি এক ধরনের ধৃষ্ঠতাও নয়?
‘বাটপার’ অভিধায় খ্যাত সাহেদ করিমের ছবি কী বলে যায়। বলে যায়, ছায়া কখনো মানুষ হয় না। সাহেদ করিমরা ছায়া, এরা মানুষ নয়। যারা এমন প্রচারপাগল তাদের জন্য সত্যিই করুণা হয়। হিমু’র কোন এক খালার এমন পাগলামী ছিলো। শখ ছিলো বিখ্যাত লোকদের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করা তাদের সাথে সেলফি তোলা। হুমায়ূন আহমেদ এই মনোবিকারটা বুঝেছিলেন, তাই বিকারগ্রস্তদের জায়গায় ওই খালাকে বসিয়ে দিয়েছিলেন হিমু বিষয়ক লেখায়।
এই যে ছবি তোলার প্রবণতা। এটা এক ধরণের মনোবিকার। ইনফিরিয়রিটি এর জন্য দায়ী। হীনম্মন্যতা থেকে এই প্রদর্শনবাদীতার উদ্ভব হয়। কোনো বড় মানুষের সাথে ছবি দিয়ে প্রমাণ করতে চায়, আমিও কম কিসে। এই প্রমাণ করতে গিয়ে আসলেই যে সে ‘কম’ তা প্রমাণ করে দেয়। সুপিরিয়র যারা তাদের এই বাতিক নেই। বরং তারা বড়দের সাথে চিন্তার বিনিময় করার চেষ্টা করে। একটা বৃদ্ধিবৃত্তিক যোগাযোগ সৃষ্টির প্রচেষ্টায় থাকে।
মাঝেমধ্যে নিজেও বিব্রত হই। আমার মতন ছোট মানুষের সাথেও কেউ কেউ ছবি তুলতে চায়। তারা যে কতটা ছোট তা প্রমাণ করার বোধহয় তাদের কাছে আর কোনো ভালো পন্থা নেই। একটা অনুষ্ঠানের কথা বলি। যে অনুষ্ঠানে একজন মন্ত্রীসহ হাফডজন সেলিব্রেটি ছিলেন। অনুষ্ঠানে আগতদের দেখলাম হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে কে কার আগে কার সাথে ছবি তুলবেন তা নিয়ে। আমি এক কোনায় চুপচাপ বসেছিলাম। একজন রীতিমত টানাটানি শুরু করলেন। বললেন, ওই দিকে ফটোসেশন হচ্ছে আর আপনি এখানে বসে আছেন। আপনার আর বুদ্ধিশুদ্ধি হলো না। বুদ্ধিহীন আমি চেয়ারে আরো শক্ত করে এঁটে রইলাম। কুণ্ঠায় এবং লজ্জায় চেয়ে রইলাম ধরণীর দিকে, যদি দয়া হয়।
আমাদের চারিপাশে আজ এমন মনোবিকারগ্রস্ত মানুষ ঘুরে বেড়ায়। যারা ছবি দেখিয়ে বড় হতে চায়, চিন্তায় নয়। এরা মূলত অ্যাটেনশনসিকার। এদের কাছে জগতটা হলো ঝালেঝোলে খেয়ে বেঁচে থাকার। আর সে রকম বেঁচে থাকার জন্যই তারা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। এ শ্রেণিটার চিন্তা নিজেদের নিয়েই। তারা নিজেকেই দৃশ্যমান করতে চায়, প্রয়োজনে অন্যকে অদৃশ্য করে হলেও। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় এই মনোবিকারগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বেশি। এদের জন্যই নানা ঝামেলার সৃষ্টি হয়। এমন প্রদর্শনবাদীতায় মুগ্ধ হয়ে তাদের বসিয়ে দেয়া হয় কখনো ‘কি পয়েন্টে’। যার মাশুল পরবর্তীতে দিতে হয় সবাইকে। যিনি দিয়েছেন তাকেও গ্যাড়াকলে পড়তে হয়। এমন উদাহরণ রয়েছে ভুরিভুরি।
সব মিলিয়ে ছবি তোলাতে আমার অনাগ্রহ গড়ে উঠেছিলো প্রথম থেকেই। মানে যখন জীবন বুঝতে শুরু করেছিলাম তখনই। এখন তো কিছুটা বুঝে ওঠায় কুণ্ঠা আর লজ্জা দুই-ই বেড়েছে। এখন ক্যামেরা দেখলেই সংকুচিত হয়ে উঠি। মনটা পালাই পালাই করে। মনে হয় আমি তো এখনো পদছাপ ধরে হাঁটছি। মানুষের পদছাপ। এখনো মানুষের মতো, মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন