০
৪১৭ বার পঠিত
প্রায় পঁচিশ বছর আগের ঘটনা। আমি তখন ক্লাস নাইনে। আমাদের পাশের গ্রামের জলিল ভাইয়ের দুই মেয়ে। কোনো ছেলে সন্তান নেই। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে ফুলমতিকে নিয়ে তিনি ভিক্ষা করেন। ফুলমতির বয়স বার কি তের। হঠাৎ একদিন ফুলমতিকেও বিয়ে দিয়ে দিলেন চল্লিশোর্ধ এক বরের সাথে। বর সাহেব দুটি কলা গাছের গেইটের ভেতর দিয়ে বউকে নিয়ে গেলেন।
পরদিন গ্রাম জুড়ে হৈচৈ পড়ে গেল। ফুলমতি খুব ভোরে তার স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। স্বামী মহাশয়ও দুপুর দিকে এসে হাজির। স্বামীর উপস্থিতি টের পেয়ে ফুলমতি গ্রামের কোন এক বাড়িতে গা ঢাকা দিয়েছে। এদিকে বর সাহেব থেকে গেলেন। বিকেলে খাওয়া দাওয়া করে বউকে নিয়ে যাবেন। বিকেলে শুরু হলো গ্রাম জুড়ে বউ খোঁজা। সারা গ্রামের ছেলে বুড়ো ও মহিলারা তন্ন করে খুঁজতে লাগলেন। হঠাৎ দেখা গেল ফুলমতি এক বাড়ির পাকঘর থেকে বের হয়ে প্রাণপণে দৌড়ে গিয়ে অন্য বাড়িতে ঢুকছে।
আর যায় কোথায়? শিশুরা মহানন্দে হাততালি দিল আর বড়রা পিছু নিল। যেন গ্রাম জুড়ে বউ ধরা উৎসব শুরু হয়েছে। যখন ফুলমতি বুঝতে পারে ধরা পড়ে যাবে অবস্থা তখন দৌড়ে আরেক বাড়িতে ঢুকে। এভাবে শেষ পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছে। কাঁপতে কাঁপতে আমার মাকে ‘চাচি আমারে বাঁচাও’ বলে খাটের নিচে ঢুকে পড়ে। আমি ভেবেছিলাম মা ওকে লুকিয়ে রাখবেন। কিন্তু ফুলমতির মা বাবা যখন এল আমার মা হাসতে হাসতে ফুলমতিকে খাটের নিচ থেকে টেনে বের করে তাদের হাতে দিলেন।
এদিকে ফুলমতির স্বামী মহোদয় উঠোনে পানের বাটা হাতে নিয়ে চেয়ারে বসে আছেন। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বউয়ের অপেক্ষা করছেন। অতি আয়েসে কিছুক্ষণ পর পর ফুচুৎ করে পানের পিক ফেলে বলছেন- এত পাজি মেয়েরে বাবা, আগে জানলে বিয়েই করতামনা। ফুলমতিকে টেনে হিঁচড়ে বরের সামনে হাজির করা হলো। বর সাহেব শক্ত হাতে বউকে ধরে উঠানের সবাইকে সালাম করে রওনা দিলেন।
ফুলমতি দুচার কদম গিয়ে পড়ে গেল। বর সাহেব ধমক দিয়ে টেনে তললেন। আবার কয়েক কদম গিয়ে পড়ে গেলে কিছু দূর টেনে নিয়ে ধমক দিয়ে দাঁড় করালেন। ফুলমতির বুক ফাটা কান্না এবং ‘ও মাগো আমি যাব না গো’ গগন বিদারি চিৎকার কেউ যেন শুনতেই পাচ্ছেনা। সবাই মহানন্দে ফুলমতির শ্বশুর বাড়ি যাওয়া দেখছে। এভাবেই এক সময় ফুলমতি আর তার স্বামী পথের বাঁকে হারিয়ে গেল। আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। ফুলমতির চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আমার হৃদয়টা ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠলো। প্রচন্ড জ্বালা করে চোখ দুটি ঝাঁপসা হয়ে গেল। সবার অলক্ষ্যে খুব গোপনে চোখ দুটি মুছে মাথা নিচু করে বাড়ির দিকে হাটা দিলাম। কেউ দেখে ফেললে আবার আমাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করবে। সারারাত ঘুমাতে পরিনি। কেবল ফুলমতির ভয়ার্ত চোখ মুখ মনের পর্দায় ভেসে উঠেছে। শুধুই ভেবেছি এখন এই মুহূর্তে ফুলমতি কি করছে? চিৎকার করে কাঁদছেনা তো? ওর স্বামী ওকে মারছেনা তো? ফুলমতি আমার কেউ না। অথচ আজো সেদিনের সেই ঘটনা আমাকে তাড়া করে ফেরে।
এর অনেক বছর পর ফুলমতির সাথে আমার আবার দেখা হয়েছে। ফুলমতির কোলে একটি এবং পেছনে তিনটি শিশু। সবকটি শীর্ণকায়, রুগ্ন, হাড্ডিসার। ফুলমতি এখন ভালো হয়ে গেছে। স্বামীর বাড়ি যাবেনা বলে সারা গ্রাম দৌড়ায়না। ফুলমতির বয়স তখনো আঠারো হয়নি। অথচ জীর্ণ শাড়ি পরে পেছনে সন্তানের সারি নিয়ে কি সুন্দর লক্ষি মেয়ের মতো স্বামীর বাড়ি যায়। জিজ্ঞেস করেছিলাম ফুলমতি তুমি কেমন আছো? উজ্জ্বল একটা সরল হাসি দিয়ে বলেছিল- ভালো আছি।
দেশে থাকতে আমার তেমন সামর্থ্য ছিলনা। বিদেশ আসার পর ফুলমতির জন্য এক হাজার টাকা পাঠিয়ে ছিলাম। বউকে বলেছিলাম ফুলমতি আবার বাপের বাড়ি আসলে যেন তাকে এই টাকাটা দেয়। গ্রামের পুত্রবধূরা শ্বাশুড়িকে না জানিয়ে কিছু করতে সাহস পায়না। তাই আমার স্ত্রীও আমার মাকে বলল যে ফুলমতিকে দেওয়ার জন্য উনি এই এক হাজার টাকা দিয়েছেন। মা ছোঁ মেরে টাকা গুলো নিয়ে বললেন, ‘আমার ছেলে গুলো এত বেকুব যে কেমনে হল? নিজের ক্বরিব (নিকট) গরীব রেখে তারা কোন মুলুকের কোন ফুলমতিকে টাকা দিবে। নিজের গরীবকে দেওয়া বেশি ছোয়াব এটা বুঝেনা’।
কি আর করা। পরের কিস্তিতে ফুলমতির জন্য আবার টাকা পাঠিয়ে, বউকে বললাম মাকে জানানোর দরকার নাই। গোপনে যেন ফুলমতিকে দেয়। পরে বেগম সাহেবা টেলিফোনে বললেন, ‘ফুলমতি এই সামান্য কটি টাকা পেয়ে কত যে খুশি হয়েছে তা তুমি যদি দেখতে। হয়তো তার চেয়ে বেশি আনন্দিত হতে। হয়তোবা আনন্দের আতিশয্যে কেঁদেই ফেলতে। তুমি যে সাইজের মানুষ’।
ফুলমতির খোঁজ নেইনা কতদিন। কেমন আছে জানিনা। তবে ফুলমতিকে আজো ভুলিনি। আজীবন হয়তো ভুলতে পারবনা। ফুলমতির জন্য যখন কেঁদেছি তখন আমার বয়স বড়জোর চৌদ্দ পনেরো। নারীবাদ কি জিনিস শুনিনি। অথচ আমি কি নারীবাদী ছিলামনা? নারীবাদী হতে হলে কি কোথায় পড়ালেখা করে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে হয়? আমার তো মনে হয় নারীর ব্যথায় ব্যতীত হলে, নারীর সমান অধিকারে বিশ্বাসী হলে, সর্বোপরি নারীকে একজন সম্পূর্ণ স্বাধীন মানুষ মনে করতে পারলে, আপনি একজন নারীবাদী। আপনি যদি ভেতরে মানবিক গুণাবলি নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। আপনি যদি নারী থেকে পুরুষ বা পুরুষ থেকে নারী শ্রেষ্ঠ এই জাতীয় কু ধারণা অন্তরে পোষণ না করেন তাহলে নিশ্চয়ই আপনি একজন নারীবাদী। আপনি যদি মানবতাবাদী হন তাহলে সাথে সাথে আপনি একজন নারীবাদীও। আমি মানবতায় বিশ্বাসী তাই আমাকে আলাদা ভাবে নারীবাদী সাজার দরকার নেই।
পুনশ্চঃ- এই গল্পের প্রতিটি চরিত্র (আমি নিজেসহ) সম্পূর্ণ কাল্পনিক। তবে যদি কেউ ভুলক্রমে বাস্তব মনে করে ফেলেন। তাহলে অবশ্য দোষের কিছুনা। কেননা আমাদের গ্রামে গঞ্জে এখনো অনেক ফুলমতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।।
আব্দুর রব
ফ্রান্স
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন