আমি কেন ইসলাম ছেড়েছি: প্রাসঙ্গিক বিবৃতি
খালেদ ওলিদ (সৌদি আরব)
ভুমিকা
[প্রায় তিন বছর আগে সৌদি আরবের এক পাঠক আমাকে একটি ই-মেইল করেন। এটা আমার জন্য ছিল নিতান্তই অপ্রত্যাশিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ।আমরা যারা ইসলামের সমালোচনা করি তারা চিন্তাই করতে পারিনা যে ‘ইসলামের জন্মভূমি’ সৌদি আরবেও কিছু লোকজন আছে যারা ইসলাম ত্যাগ করতে একপায়ে খাড়া, যদিও তাদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। একটা সময় খালেদের সাথে আমার প্রচুর ই-মেইল আদান প্রদান হয়েছে- যদিও আজ আমার সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। আমি খালেদের একটি ই-মেইল বাংলায় অনুবাদ করলাম। ভবিষ্যতে ইচ্ছা থাকল খালেদের আরো কিছু খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেখা বাংলায় অনুবাদ করে নবযুগ ব্লগে প্রকাশ করবো। এখানে উল্লেখযোগ্য যে খালেদের ওই লেখাগুলির কিছুটা একটা বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে। বইটার টাইটেল হলো: Why We Left Islam.
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ, এই লেখাটা বাংলা টাইপিং সফটঅয়্যার ‘অভ্র‘ ব্যবহার করে মুক্তমনা ব্লগের জন্য প্রথম লেখা লিখেছিলাম, এবং পরবর্তীতে নবযুগ ব্লগে যুক্ত হবার পরে পাঠকদের সুবিধার্থে এখানেও সংশোধিতরূপে উপস্থাপন করলাম। বলা যায় বাংলা টাইপে এই লেখাটাই আমার হাতেখড়ি। পাঠকেরা আশা করি ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করে দিবেন।
আবুল কাশেম
জানুয়ারি ০৩, ২০১৩]
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন প্রতিদিন মসজিদে যেতাম। সেখানে আমি ইসলামি প্রার্থনা শিক্ষা ছাড়াও কোরান তেলাওয়াৎ, হাদিস এবং তফসির শিখতাম।
আমাদের মসজিদের শিক্ষক (ইমাম) এবং অন্যান্য ইসলামী পণ্ডিতেরা আমাদের বলতেন যে, যেহেতু আমরা মুসলমান সেইহেতু আমরা হচ্ছি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। ওনারা আরো বলতেন যে সৌদি আরবের মুসলমানেরা হচ্ছে একমাত্র প্রকৃত মুসলিম। সেই জন্য বিশ্বের তাবৎ মুসলিমরা একমাত্র সৌদি মুসলিমদের অনুসরণ করবে, অন্য কাউকে নয়। বলাবাহুল্য আমরা একবাক্যে, কোন প্রশ্ন ছাড়াই, দৃঢ়ভাবে ওইসব মেনে নিতাম।
এইভাবে আমরা নিজেরা মুসলমান হিসেবে খুবই গর্ববোধ করতাম।
কিন্তু এখন আমি বুঝি যে, এসব ছিল একেবারেই মিথ্যা।
পাঠকবৃন্দ, আমি আমি সৌদি আরবের মসজিদ থেকে যা বুঝেছি এবং শিখেছি তার ভিত্তিতে আমি হলফ্সহ বলতে পারি যে, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাই (কোরানের প্রাসঙ্গিক আয়াত সমূহ যেমন – তোমাদের ওপর যুদ্ধ ফরজ করা হলো (২:২১৬), তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না (২:৮৯), তাদেরকে যেখানেই পাবে হত্যা করো (২:২৯১, ৯:৫ ) ইত্যাদি) ওসামা বিন লাদেনরা হুবহু পালন করার চেষ্টা করে। এতে কারো মনে কোন সন্দেহ থাকা উচিত নয়। আসলে ইসলামের চোখে বিন লাদেন একেবারে পাক্কা মুসলমান। বিশ্বাস করুন, সৌদি আরবের প্রায় সবাই বিন লাদেনের সমর্থক এবং তাকে দারুণভাবে ভালবাসে তার কার্য্যকলাপের জন্য (সামগ্রিকভাবে পুরো ইসলামী বিশ্বেই অবস্থা একইরকম, বিন লাদেন তাদের কাছে হিরো)।
বিন লাদেনের ক্রিয়া কলাপের জন্য আমরা কী তাকে দোষী করতে পারি? মোটেই নয়। তার পরিবর্তে আমাদের ইঙ্গিত করতে হবে ইসলামের প্রতি। বিন লাদেন তো অক্ষরে অক্ষরে ইসলাম পালন করছে। সে নিঃসন্দেহে ইসলামের নির্ভীক সেনানি, একেবারে খাঁটি মুসলমান।
এখন আমার কথায় আসা যাক। আমার ইসলাম ছাড়ার ঘটনা শুরু হয় আমি যখন পঞ্চম গ্রেডের ছাত্র। আমি কোরানের সুরা আল-কাহফ্ আয়াত ৮৬ (১৮:৮৬) পড়লাম। এখানে লেখা আছে যখন জুলকারনাইন সূর্যাস্তের প্রান্তে পৌঁছাল তখন সে দেখল অনেক লোক সূর্যের প্রচণ্ড তাপে অসহনীয়ভাবে পীড়িত। এর কারণ হল সূর্যটা তখন ওই লোকদের খুব কাছাকাছি ছিল। ওই একই ঘটনা ঘটল যখন সে সূর্যোদয়ের প্রান্তে পৌছাল।
আমি ভাবলাম, এটা কীভাবে সম্ভব! পৃথিবী তো একটা বলের মত গোলাকার। তাহলে জুলকারনাইন কীভাবে পৃথিবীর অপরপ্রান্তে পৌছাল? আমি আমার শিক্ষককে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। আমার শিক্ষক একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। তিনি কোন উত্তর দিতে পারলেননা, শুধু বললেন কোরানে যা লেখা আছে তাতেই বিশ্বাস করতে হবে- কোন প্রশ্ন করা চলবেনা।
এইভাবে কোরানের প্রতি আমার সংশয় শুরু হয়।
এরপর একটা বিশাল বিস্ময় আমার মনকে পীড়িত করলো। আমি জানলাম যে আমি যদি ভাল মুসলিম হতে চাই তবে আমাকে অবশ্যই অমুসলিমদের থেকে দূরে থাকতে হবে। আরো বিস্মিত হলাম এই জেনে যে, আমি যদি অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব করি তা হলে আমি কাফের হয়ে যাব (আল কোরান ৫:৫১,২:৮৯, ৩:২৮, ৪:১৪৪ ইত্যাদি দ্রঃ) ।
আমি অন্যান্য ক্রিয়াকলাপের মত চলচ্চিত্র দেখা, গান শোনা এবং খেলাধূলায় পারদর্শীদের সাথে বন্ধুত্ব করা খুবই পছন্দ করতাম। এদের বেশিরভাগই ছিল অমুসলিম। এখন ইসলামের নীতি আনুযায়ী আমি সত্যিই কাফের হয়ে গেছি। আমি শিখেছি যে বেহেস্তে যেতে হলে নবী মোহাম্মদকে শর্তহীনভাবে ভালোবাসতে হবে, যদিও আমি কোনদিনই তাঁকে দেখি নাই। এখন আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হলাম যে আমার স্থান দোজখে।
আমি ইমামদের কথাবার্তা শুনে আরো বিক্ষুব্ধ হলাম। তারা অত্যন্ত গালিগালাজপূর্ণ ভাষায় অমুসলিমদের বানর এবং শুকরের নাতি-নাতনি বলে আখ্যায়িত করলো। আমি চিন্তা করলাম যদি কেউ পাপ করে তার শাস্তি আল্লাহ্ দিবেন। আমাদের ইমামরা কেনইবা ওদের আপমানজনকভাবে নিন্দা এবং বিদ্রুপ করবে?
আমি আরো বিস্মিত হলাম যখন আমার মুসলিম বন্ধুরা এবং আমার নিজের ইমাম বললো যেহেতু অমুসলিমরা মুসলিমদের শত্রু সেহেতু আমাদের কর্ত্তব্য হবে সর্বভাবে অমুসলিমদের হেয় প্রতিপন্ন করা এবং তীব্র ভাষায় কটুক্তি করা। আমি তাদের কথায় রাজী না হওয়ায় তারা আমাকে দূর্বল মুসলিম আখ্যায়িত করলো। তারা আমাকে এটাও বললো যে একজন বিদেশি না জানা মুসলিম একজন অতি পুরাতন বিশ্বস্ত কাফের বন্ধুর চাইতে অনেক ভালো।
আমি কিন্তু আমার প্রশ্ন থেকে বিরত থাকলামনা। সবচাইতে উল্লেখযোগ্য যে প্রশ্ন আমার মনে সর্বদা বিরাজমান ছিল সেটা হলো- এ কেমন আল্লাহ্ যিনি নিজেকে সবসমই পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল হিসেবে দাবি করেন তিনি কেমন ভাবে তাঁর প্রিয় বান্দাদের একে অপরের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে বলেন? তাকে কিঞ্চিৎ অবিশ্বাস করলে আল্লাহ্ কেন আগুনে পোড়ানোর এবং অসীম নির্যাতনের ভীতি প্রদর্শন করেন তাঁরই সৃষ্ট মানবকুলের প্রতি? আল্লাহ্ কি আমাদের উপাসনার জন্য এতই কাঙ্গাল? আমরা সর্বদা তাঁর উপাসনা করি এটা কি তাঁর জন্য সত্যিই এত গুরুত্বপূর্ণ?
এইসব প্রশ্ন নিয়ে আমি গভীর চিন্তা করলাম। আমি কোরান ঘেঁটে ঘেঁটে দেখলাম যে আমাদের নিয়তি আল্লাহ্ আগেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কে স্বর্গে যাবে, কে নরকে যাবে সেতো আল্লাহ্ বহু পুর্বেই ঠিক করেছেন। যুক্তিযুক্ত কারণে তাই বলা যায় যে প্রার্থনা করে কী-ইবা হবে? আমি যখন এই প্রশ্ন ধর্মপ্রাণ মুসল্লীদের করলাম তখন ওরা আমার প্রতি ভীষণ রাগান্বিত হয়ে গেল। ওরা আমাকে জিজ্ঞাসা করল আমি পূর্বথেকে কেমন করে জানি আমার স্থান কোথায়- স্বর্গে না নরকে? আমি উত্তর দিলাম যেহেতু আল্লাহ্ আমাদের সবার পরিণতি আগেই ঠিক করে দিয়েছেন কাজেই নামাজ পড়া আর না পড়ায় কোন পার্থক্য আনবেনা। ওরা আমাকে বিকৃতমস্তিষ্ক হিসেবে আখ্যায়িত করল, কারণ আমি আল্লাহ্র ব্যাপারে সন্দেহ করেছি।
এইভাবেই আমার ইসলামের প্রতি ঘৃণার শুরু। কিন্তু সৌদি আরবে আমি হলাম অসহায়। আমি যে সমাজে বাস করি সেখানে খোলাখুলিভাবে অনৈসলামি কিছু করা যাবেনা।
১৯৯৯ সালে আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন, এবং কিছুদিন পরে মারা যান। এই ঘটনা আমার জীবনের মোড় পরিবর্তন করে দেয়। আমি চিন্তা করে বুঝলাম আমরা মুসলিমরা কোনক্রমেই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি নই। অন্যান্যদের মতো আমরাও পীড়িত হই এবং সময়ের সাথে আমরাও মারা যাই। আমি এটাও বুঝলাম যে পরিশ্রমী হলে আমরাও উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারি। আর তা যদি না করি তবে আমাদের পশ্চাদপদতা একেবার সুনিশ্চিত। ‘আল্লাহ্র ইচ্ছা’ বলতে কিছুই নাই। মুসলিমদের বিশেষ স্থানের দাবি নিতান্তই হাস্যকর।
আজ আমি যখন ইসলামি বিশ্বের প্রতি তাকাই শুধুই দেখি চরম অন্যায়, অবিচার এবং নারী ও কাফেরদের প্রতি অসীম বৈষম্যমূলক আচরণ আর নগ্নভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। ইসলামি জগতে সীমাহীন অরাজকাতা ও দূর্নীতির কথা নাই বা বললাম। আমরা পরিষ্কার দেখি যে ইসলামি বিশ্ব এক গভীর সমস্যায় নিমজ্জিত।
আমি নিজেকেই প্রশ্ন করি- ‘ইসলামি বিশ্বের এই অসীম দূর্গতির কারণ কী?‘ আমি আবার নিজেই বিশ্বাসযোগ্য উত্তর পাই- সেটা হল ইসলাম। আমি এখন সন্দেহাতীত যে ইসলাম হচ্ছে একটা অর্থহীন, মূঢ় এবং ভুল ধর্ম।
দুঃখের বিষয় হল- ইসলামের প্রতি আমার ঘৃণাবৃদ্ধি সত্বেও আমি ইসলামকে তখনো আমার জীবন হতে বিতাড়িত করতে পারি নি। মনের গভীরে আমি চিন্তা করতাম যে ইসলাম এত খারাপ হতে পারেনা- হয়তোবা সমস্যাটা মুসলিমদের- ইসলামের নয়।
কিন্তু ৯/১১-এ আমি যা দেখলাম সেতো ইসলামের প্রকৃত রূপ। কোথায় এর প্রতিবাদ হবে, না না- আমি বিস্মিত হয়ে আমাদের এখানকার লোকদের মুখে দেখলাম হাসি এবং সুখের ছায়া। এত সহজেই অগুণতি কাফের মেরে ফেলা যাবে সেটা তখন চিন্তাই করতে পারেনি। আমি অসীম বেদনার সাথে লক্ষ করলাম আমার লোকদের উল্লাস- যেহেতু এতো বেশি নিরীহ কাফের মারা গেছে। আমি দেখলাম প্রচুর মুসলিম আল্লাহ্কে শুকরিয়া জানাল এই নির্দয় হত্যাকাণ্ডের জন্য। এইসব ইসলামি জনগণ ভাবে যে আল্লাহ্ মুসলিমদের কামনা বাসনা পরিপূর্ণ করেছেন। এইভাবেই বুঝি শুরু হল জগৎজুড়ে কাফের ধ্বংসের খেলা।
কিন্তু আমার নিকট এসব ছিল নিতান্তই অমানবিক আচরণ।
এর কিছুদিন পর আমাদের ইমাম আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা শুরু করলেন তালিবানদের বিজয়ের জন্য- মার্কিন সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। আমি নিতান্তই ক্রুদ্ধ হয়ে নামাজ পড়া ছেড়ে দিলাম।
২০০৪ সালে এক পাকিস্তানি ম্যানেজারের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। আমার বিশ্বাস উনি ইসলামের উপর ক্ষিপ্ত এবং সন্দিহান ছিলেন। উনার সংস্পর্শে আশার ফলে আমার মানবচেতনা ফিরে আসে। উনি আমাকে আশ্বাস দেন যে, আমি বিকৃতমস্তিষ্ক নই। এরপর আমি মসজিদে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম, এবং রমজান মাসের রোজা রাখা হতে বিরত থাকলাম। গতবছর আমি একটি রোজাও রাখি নি।
আমার জীবন হতে ইসলাম মুছে দেয়ার পর আমি না এখন কতোই মুক্ত এবং সুখিবোধ করছি। নিজেকে আর আমি দোষী বা অপরাধী ভাবি না। আমি এখন কোন চিন্তা ছাড়া চলচ্চিত্র উপভোগ করতে পারি- গানও শুনতে পারি। আমার মনে হয় আমার যেন নতুন জন্ম হয়েছে- আমি এখন সর্বভাবে মুক্ত ও আমার যা ভাল লাগে তাই-ই করতে পারি।
আমি আশারাখি ভবিষ্যতে ভয়ংকর ইসলাম সম্বন্ধে অনেক কিছু লিখব।
আপানাদের ওয়েব সাইটকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি- এর কারণেই আমি আজ আর একাকীবোধ করিনা। এখন আমি পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত আমি ভুল করি নি।
ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছান্তে।
খালেদ
সৌদি আরব
জানুয়ারি ১৩, ২০০৬
(এটি খালেদ ওলিদের এর ২০০৬ সালের একটি ই-মেইলের অনুবাদ, যেখানে তিনি হাল্কাভাবে ব্যক্ত করতে শুরু করেছিলেন তার ইসলাম ত্যাগ করার কারণগুলো। উনি যা যা লিখেছিলেন, সেটাই পাঠকদের জন্য অনুবাদ করার চেষ্টা করা হয়েছে। মূল লেখকের সকল বক্তব্যের জন্য অনুবাদক দায়ী নয়)।