০
৯৬৫ বার পঠিত
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একবার ইসলামবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছিল। এই বিক্ষোভের সমালোচনা করে একজন বলেছিলেন, আরব এবং মুসলমানদের কোনো ভাল জিনিষ এই বিক্ষোভকারীদের চোখে পড়ে না। অবশ্য তারা কথার মধ্যে একটা ব্যালান্স করতে চাইছিল, কিন্তু খুব বেশি প্রশংসা করছিল না। এদের কথার একটা যুতসই জবাব তৈরি করেছেন বিশিষ্ট লেখক লুই পাম। ‘দি গুড থিংস দি এরাব এন্ড মুসলিম হ্যাভ ডান’ শিরোনামে লুই পামের লেখাটি গুরুত্ব বিবেচনা করে ভাষান্তর করে দেওয়া হল। ২০১৫ সালের ০৭ আগস্ট লেখাটি ইসলাম ওয়াচ-এ প্রকাশিত হয়।
লুই পাম ওই নিবন্ধটি শুরু করেছেন এভাবে,
‘সাধারণভাবে গৃহিত আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী আমরা দেখানোর চেষ্টা করব যে, আরব এবং মুসলমানরা কোথায় কীভাবে কোন ভাল কাজটি করেছে কিংবা ভাল কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।’
প্রথমেই আসা যাক শান্তির কথা
মুসলমানরা হল বিশ্বের জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ। অথচ বিশ্বজুড়ে সশস্ত্র সংঘাতে ৮৪ শতাংশে তাদের অংশ গ্রহণ রয়েছে। তাহলে শান্তিতে নীচের দিক থেকে এরাই প্রথম। (তথ্যসুত্র)
সমাজে অবদান
১৮৯৫ সাল থেকে এযাবত সারাবিশ্বে আট হাজার বিশিষ্টজন নোবল পুরস্কার পেয়েছেন। এরমধ্যে আরব বংশদ্ভুত পেয়েছেন মাত্র ছয়জন। যেখানে বিশ্বের জনসংখ্যার ৫ শতাংশ আরব। সেই অনুযায়ী নোবেল পুরস্কারের শেয়ার হল মাত্র শুন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ মুসলমান হিসেবে তার ভাগে পড়েছে এক দশমিক চার শতাংশ।
মানবিক সহায়তা
২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় এক ভূমিকম্প আঘাত হানে, ফলশ্রুতিতে ভয়াবহ সুনামির সৃষ্টি হয়। সুনামির আঘাতে তছনছ হয়ে যায় ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রার উপকূলীয় অঞ্চল। ইন্দোনেশিয়া ছাড়াও সুনামির আঘাতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয় শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ড। প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার লোকের প্রাণহানী ঘটে। হাজার হাজার লোক আহত হন। একশত মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন কিংবা বাস্তুচ্যুত হন। এত ক্ষয়ক্ষতি কেন হয়েছিল? কারণ মুসলমানরা ভেবেছিল, এ দুর্যোগ এসেছে আল্লাহর ইচ্ছায়। রক্ষাও করবে আল্লাহ। কিন্তু আল্লাহ রক্ষা করতে পারেনি। এখন আসা যাক দুর্যোগ পরবর্তী পূনর্বাসনের বিষয়ে। দুর্গতদের জন্য নানা দেশ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। অথচ আরব মুসলমানরা ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের মুসলিম উম্মাহ ও ভাতৃত্বের প্রতি একটা টোকেন সহযোগিতা দিয়েই দায় শেষ করে। ৫৬টি মুসলিম দেশের জোট রয়েছে অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কনফারেন্স বা ওআইসি। অথচ ৫৬টির মধ্যে যৎসামান্য ত্রাণ সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল মাত্র তিনটি দেশ, এই দেশ তিনটি হল সৌদি আরব, আরব আমিরাত এবং কাতার। খুব যৎসামান্য সহযোগিতা দিয়েছিল তারা। ওআইসি বহির্ভূত নন-মুসলিম দেশসমূহ দিয়েছিল ৯ হাজার ৬৫৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার। অপরদিকে ওআইসিভুক্ত দেশসমূহ দিয়েছিল ১৪৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার। এখান থেকে মুসলিম এবং নন-মুসলিম দেশের মানুষের চরিত্র এবং তাদের মানবিক সহায়তার মনোভাব বোঝা যায়।
সভ্য সমাজ
স্বাস্থ্য, সম্পদ ও কর্মক্ষেত্র নিয়ে কাজ করা নিউইয়র্ক ভিক্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘মার্সার’ ২০১২ সালে একটি জরিপ চালিয়েছিল। জীবন যাপনের মান নিয়ে বিশ্বের ২২১টি প্রধান প্রধান শহরের ওপর ওই জরিপ চালায় প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের র্যাঙ্কিং ছিল ১৫৭ তম। তার নীচে রয়েছে মাত্র ৬৫টি শহর। যাদের অবস্থা আরো খারাপ। এদের মধ্যে আবার অর্ধেকের অনেক বেশি শহর মুসলিম দেশের। যার মধ্যে রয়েছে ইরাক, লেবানন, লিবিয়া, সুদান, সিরিয়া এবং ইয়েমেন প্রভৃতি।
সহনশীলতা এবং বহুত্ববাদ
সর্বশেষ আনুষ্ঠানিকভাবে দাস প্রথার বিলোপ সাধন করেছে আরব দেশগুলো। বিশ্বজুড়ে যখন সামন্তবাদের পতন ঘটে গেছে, তার অনেক আগেই পতন ঘটে গিয়েছিল দাসযুগের। সেখানে সর্বশেষ দাসপ্রথা অবসানের দেশ হিসেবে রয়েছে সৌদি আরব (১৯৬২), ইয়েমেন (১৯৬২), ওমান (১৯৭০), মৌরিতানিয়া (১৯৮০)। তারও একশত বছর আগে এই বর্বরোচিত প্রথার অবসান ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। রিপাবলিক অফ মৌরিতানিয়ায় এখনো দাস প্রথার প্রচলন রয়েছে। যেখানে ৫ লাখ কালো দাসদের বাধ্যতামূলক শ্রম দিতে হয়। এর আগে ১৮ থেকে ১৯ শতকে, এই মৌরিতানিয়া থেকে ৬ লাখ ৪৫ হাজার নিগ্রো দাসেদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কনফারেন্সের ৫৬টি মুসলিম দেশে মানবাধিকারকে শরিয়া আইন বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। যেখানে শরিয়া আইন অনুযায়ী অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের কোনো অধিকারই নাই। সেখানে নারী ও অমুসলিমদের অধিকার হরণ করা হয়। শরিয়া আইনে ভিন্ন জাতি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ে অনুমোদিত নয়। সমকামী বিয়ে সেখানে বৈধ নয়। ইরানে সমকামীদের ধরে এনে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হত, আইসিস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সুউচ্চ ভবনের ছাদ থেকে তাদের ফেলে দিয়ে হত্যা করা হত। শরীয়া আইনে কোনো মুসলিম নারী অমুসলিমকে বিয়ে করতে পারে না। একজন আরব কখনো নন-আরবকে বিয়ে করতে পারে না। কারণ মোহাম্মদ ঘোষণা করেছেন, “আল্লাহ আরবদের সকলের ওপরে স্থান করে দিয়েছেন।” এটাই হল শরীয়া আইনের বৈশিষ্ট। অথচ তাকেই মানবাধিকার বলে চালাতে চায় মুসলমানরা।
লৈঙ্গিক সমতা
অর্থনীতিতে, পেশায় এবং রাজনীতিতে নারীদের অঞ্চলগত অংশগ্রহণ নিয়ে ২০১২ সালে জাতিসংঘ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে আরব হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ওই রিপোর্টে অংশ নেয়। ওই রিপোর্টের র্যাঙ্কিংয়ে আরব বা মুসলমান দেশের অবস্থান কোথায় দেখুন।
উত্তর আমেরিকা -৬৩
ওসানিয়া -৫১
ইউরোপ -৪৯
ল্যাটিন আমেরিকা -৩৯
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া -৩৫
আরব দেশ সমূহ -২৬
সাব সাহারান আফ্রিকা -২৪
সম্ভবত মুসলমানদের এইসব বিষয় সবচেয়ে সুন্দরভাবে কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন লেবানের বংশদ্ভুত মার্কিন কবি কাহলিল জিবরান। তিনি কবিতাটি লেখেন ১৯৩৪ সালে। কবিতাটির ভাষান্তর দেওয়া হল :
যে জাতির প্রতি আফসোস
কাহলিল জিবরান
সেই জাতির প্রতি আফসোস, যাদের হৃদয় ধর্মশুন্য কিন্তু বিশ্বাসে টইটুম্বর।
আফসোস সেই জাতির প্রতি যারা বস্ত্র পরিধান করে কিন্তু বুনন করে না
যারা রুটি ভক্ষণ করে, কিন্তু শস্য চাষ করে না। আফসোস সেই জাতির প্রতি,
যারা ভিলেনদের নায়ক বানায়, তাদের পেছনে হাততালি দেয়
মনে হয় যেন বড় ধরনের বিজয় পেয়ে গেছে
ওই জাতির প্রতি আফসোস, যারা আবেগময় স্বপ্নকে মূল্যহীন
করে রাখে আর বাক্সবন্দি করে রাখে তাদের জাগরণকে
আফসোস ওই জাতির প্রতি যারা কণ্ঠ ছাড়ে না
শবযাত্রাকালের জন্য তা জমা রাখে
দম্ভকে তার ধ্বংসস্তুপের মধ্যে গ্রহণ করতে পারে না
তরবারি এবং ফাঁসিকাষ্টের মাঝেও যাদের দ্রোহের অনল জ্বলে না
আফসোস ওই জাতির জন্য যাদের মুখপাত্র হলেন একজন ধুর্ত শৃগাল
যাদের দার্শনিক হলেন একজন যাদুকর
অন্যের অনুকরণ করে এবং জোড়াতালি দিয়ে তৈরি যাদের শিল্প
আফসোস, যারা নতুন শাসকদের ডঙ্কা বাজিয়ে
স্বাগত জানায় আর বিদায় জানায় বিদ্রুপ করে
এভাবে পরের শাসককেও একইভাবে স্বাগত ও বিদায় জানায়
আফসোস যাদের জ্ঞানীরা নীরব থাকে আর
বলশালীরা দোলনায় দোল খায়
ওই জাতির জন্য আফসোস
যে জাতি অনেক টুকরায় ভাগ হয়ে আছে
যার প্রতিটি টুকরাই নিজেদের জাতি মনে করে
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন