আরনেস্ট হেমিংওয়ের জীবনীর উপরে করা ৬ ঘন্টা লম্বা ডকুমেন্টারি দেখলাম। কেন বার্নসের করা অসাধারণ কাজ, গত সপ্তাহে পিবিএস প্রিমিয়ার করেছে। ডকুমেন্টারিতে হেমিংওয়ে সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানা গেল। লোকটা পাগলা ছিল, ফ্যামিলিতে সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি জানতাম কিন্তু এত খারাপ অবস্থা ছিল এটা জানা ছিল না।
হেমিংওয়ে ছোটবেলা থেকে খুবই দূরন্ত প্রকৃতির ছিলেন। বাবা ছিল ডাক্তার, মা সঙ্গীত শিল্পী হয়েও পরিবারের জন্য নিজের ক্যারিয়ারে ইস্তফা দেন। ছেলেমেয়েদের মধ্যে আর্ট কালচার ঢুকানোর চেষ্টা করেন। হেমিংওয়ে স্কুল শেষ হবার আগেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু বয়স আঠার না হওয়ায় যেতে পারেনি। যুদ্ধে যেতে না পারলেও সে তখন শিকাগোর ওক পার্কের বাড়ি ছাড়ে। প্রথমে ক্যানসাস স্টার পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজ নেয়। এই পত্রিকার স্টাইল গাইড থেকে সে তার লেখার স্টাইল বেছে নেয়। সহজ-সরল ভাষা, ছোট, পাওয়ারফুল, অনেস্ট বাক্য লেখার সাংবাদিকতার স্টাইল হয়ে যায় তার স্টাইল। তারপর ছয় মাসের মাথায় ১৯১৭ সালে যুদ্ধের বয়স (১৮) হলে রেডক্রসের সদস্য হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিতে ইওরোপ চলে যান।
যুদ্ধের পরে কিছুদিন ক্যানসাসে থেকে হেমিংওয়ে ১৯২০ সালে টরন্টো স্টারের সাংবাদিক হিসেবে ফ্রান্সের প্যারিসে চলে যান। তখন আমেরিকার সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সমাজে সেরকম একটা ট্রেন্ড ছিল, সাহিত্য করতে হলে প্যারিসে যেতে হবে। প্যারিসে গেরট্রুড স্টাইন ছিলেন তার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। এছাড়া জেমস জয়েস, এজরা পাউন্ড এদের সাথেও তার সম্পর্ক তৈরি হয়। এই সময় সফর সঙ্গী ছিল প্রথম প্রেমিকা, বউ হ্যাডলি। হ্যাডলিকে সাথে নিয়ে প্যারিসে ল্যাটিন কোয়াটার্সে লেখক, শিল্পীদের আড্ডাতে হেমিংওয়ে সময় কাটাতেন, সাথে বিস্তর পড়াশোনা, বিশেষ করে রাশান নভেল, ইওরোপিয়ান সাহিত্যের সাথে পরিচয় হয়।
১৯২৩ সালে আপার মিশিগানে তাদের পারিবারিক লজ এবং ইলিনয়, মিশিগান এলাকা নিয়ে লেখা প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তার লেখার অপ্রকট স্বীকারোক্তি, যৌনতা, মৃত্যুর থিম তখন সমালোচিত হয়। তবে অনেকে তার ডাইরেক্ট বলার ভঙ্গী পছন্দ করেন, আবার অনেকে ডিসেন্সির প্রশ্ন তুলে একে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান। ‘আপ ইন দ্য মিশিগান’ এই সময়ের উল্লেখযোগ্য গল্প। এছাড়া তার বাবার ডাক্তারি জীবন, শিকার, ফিশিং এসব তার গল্পের অন্যতম থিম। হেমিংওয়ে্র লেখার একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো তিনি জীবনে যেটা জানেন না সেটা নিয়ে লিখেননি। তার লেখা পড়ে মানুষ বুঝতে পারত যে এগুলো তার ন্যাচারাল অভিজ্ঞতার ফসল।
ছোট গল্পের পরে হেমিংওয়ে উপন্যাস লেখার প্রতি মনোযোগ দেন। বিশেষ করে এফ স্কট ফিটজেরাল্ডের ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’ প্রকাশিত হলে তার মধ্যে উপন্যাস লেখার প্রতি আগ্রহ জাগে। প্যারিস এবং ইওরোপে থাকার সময় নিয়ে তার লেখা প্রথম উপন্যাস ‘দ্য সান অলসো রাইজেস’ (১৯২৬)। এই বইতে বুল ফাইটিং নিয়ে প্রথম তার উচ্ছ্বাস প্রকাশ পায়। সমালোচক এডমান্ড উইলসন এবং আরো অনেকে তার লেখার ভূয়সী প্রশংসা করেন। বুলফাইটিং নিয়ে তার যত পারা যায় লেখার ইচ্ছা ছিল, পরবর্তী জীবনে ‘ডেথ ইন দ্য আফটারনুন’ নামের নন-ফিকশান সেটার প্রাথমিক কাজ ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেমিংওয়ে আহত হয়েছিলেন, আহত হয়ে তাকে হাসপাতালে সময় কাটাতে হয়। সেই কাহিনী নিয়ে পরে লিখেন ‘ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’(১৯২৯)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে লেখা এই বইটিও সমালোচকদের কাছে প্রশংসিত হয়।
প্যারিস থেকে ফিরে এসে হেমিংওয়ে আমেরিকাতে থাকা শুরু করেন। কিন্তু বেশিদিনের জন্য নয়। আবারো ইওরোপের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় পলিন নামের একজনের সাথে।
১৯২৭ সালে এক বাচ্চাসহ প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে পলিনকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। এ সময় তারা ফ্লোরিডা’র কী ওয়েস্টে থাকা শুরু করেন। খুব লাক্সারিয়াস লাইফ ছিল হেমিংওয়ের। বই লেখার সম্মানীর বাইরে বই লেখার অন্তর্বর্তীকালীন সময়টাতে পলিন তার খরচের টাকা যোগাত। প্রথম স্ত্রীর মত পলিনও তাকে খুব ভালবাসত, বাচ্চাদের বাদ দিয়ে তার দিকে খেয়াল রাখত। পলিনের সাথে হেমিংওয়ের বিবাহিত জীবনের সবচেয়ে লম্বা সময় কেটেছে। ফ্লোরিডাতে থাকতে হেমিংওয়ে ডিপ-সী ফিশিং করত। পিলার নামে হেমিংওয়ের একটা ফিশিং বোট ছিল। সেটাতে করে প্রায় সে ফ্লোরিডা থেকে কিউবা চলে যেত। এভাবে কিউবার সাথে তার একটা স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরবর্তীতে কিউবা ছিল তার ঠিকানা, ১৯৫৪ সালে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার সময় হেমিংওয়ে যাকে বলতেন, ‘দ্যাট সুইডিশ থিং’ তার কিউবার বাসাতেই ছিলেন। তার শারীরিক অবস্থা ওয়াশিংটনে গিয়ে পুরস্কার নেবার মত ছিল না সেইজন্য সুইডিশ প্রতিনিধি কিউবাতে গিয়ে পুরষ্কার পৌঁছে দেন।
ফ্লোরিডা থাকার সময় হেমিংওয়ে বক্সিং ম্যাচে রেফারি থাকতেন। বক্সিংয়ে কেউ তাকে হারাতে পারলে ২৫০ ডলার পুরষ্কার ছিল, কিন্তু সে টাকা তাকে কখনো দিতে হয়নি। সকালে উঠে নিয়ম করে কয়েক ঘন্টা লেখার পরে বাকি সময় বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ফিশিং, আর আনলিমিটেড ড্রিংকিং শুরু হতো, সেটা যতক্ষণ সজাগ থাকত ততোক্ষণ চলত, সকাল দশটা থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত।
সে সময় তার প্রকাশিত বইয়ের কারণে হেমিংওয়ে ইতোমধ্যে আমেরিকান সেরা লেখকের স্বীকৃতি পান। লোকজন তার বাড়িতে তাকে দেখতে আসত, জানালা দিয়ে বিরক্ত করত। এজন্য তাকে বাড়ির চারপাশে দেয়াল তুলতে হয়। তবে হেমিংওয়ে ছিল পাবলিক পারসন, তার মধ্যে একটা আমেরিকান ‘লুক এট মী’ ভাব ছিল। সবাইকে বিভিন্ন বিষয়ে তাজ্জব করে দেয়ার একটা প্যাশন ছিল।
হেমিংওয়ে এমনিতে জিনিয়াস, এর উপর ফিশিং, হান্টিং, এনিম্যাল লাইফ, বুল ফাইট, যুদ্ধ, সাংবাদিকতায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এর সাথে বিস্তর পড়াশোনা, ঘুরাঘুরি, বিভিন্ন দেশে বসবাস করার মাধ্যমে তার জ্ঞানের ভান্ডার ছিল অফুরন্ত। আড্ডাবাজ, ফূর্তিবাজ, এডভেঞ্চারাস মানুষ সব সময় তার আশেপাশে থাকত।
১৯৩৩ সালে পলিনকে সাথে নিয়ে কেনিয়াতে সাফারিতে যান। সেখানে তিনি নিজ হাতে শত শত প্রাণি হত্যা করেন। সমালোচকেরা হেমিংওয়ের রক্ত-লোলুপতায় তাজ্জব হয়ে যান। এই সময়ের ফসল ‘গ্রিণ হিলস অফ আফ্রিকা’, ‘দ্য স্নোস অফ কিলিমাঞ্জারো’ এসব গল্পের বই।
স্পেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে হেমিংওয়ে সেখানে যান। সেখান থেকে আমেরিকান পত্রিকার জন্য যুদ্ধের রিপোর্ট পাঠান। স্পেনের সিভিল ওয়ার নিয়ে হেমিংওয়ে নিজে লিখে, কণ্ঠ দিয়ে একটা ডকুমেন্টারিও বানান। স্পেনে বসবাসের সময় হেমিংওয়ে বুল ফাইট নিয়ে মেতে ওঠেন। খেলা হিসেবে, দর্শন হিসেবে বুল ফাইটিং তাকে আকৃষ্ট করে। ষাঁড়ের নিশ্চিত মৃত্যু, ম্যাটাডরের অমরত্ব এগুলো হেমিংওয়ের লেখার অন্যতম থিম। স্পেনের গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেন, ‘ফর হোম দ্য বেল টোলস’। অনেকের জন্য সেই বেল টোলিং ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগমন বার্তা।
স্পেনের সিভিল ওয়ার কভার করার সময় হেমিংওয়ে মার্থা গেলহর্ণ নামের এক সাংবাদিকের প্রেমে পড়েন, যার কারণে ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় স্ত্রী পলিনের সাথে তার ডিভোর্স হয়ে যায়। এসময় হেমিংওয়ে কিউবাতে থাকা শুরু করেন। প্রতিবছর সামারে আইডাহো’র কেচাম শহরে আর শীতের সময়টা কিউবা এই দুই জায়গাতে ছিল তার বাস। সে বছর অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয় ‘ফর হোম দ্য বেল টোলস’। ১৯৪১ সালে মার্থা এসাইনমেন্ট নিয়ে চিনে যান, হেমিংওয়ে তখন মার্থার সাথে চিন যান। চিনে তিনি সোভিয়েতদের হয়ে গোয়েন্দাগিরি করেন বলে জানা যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়টা হেমিংওয়ে সিরিয়াস বিষণ্ণতায় ভোগা শুরু করেন। প্রথম কয়েক বছর যুদ্ধে না গিয়ে ফ্লোরিডা আর কিউবাতে কাটিয়ে দেন। এসময় সরকারি সহায়তা তার ফিশিং বোট নিয়ে জার্মান ইউবোট, সাবমেরিন এসব খুঁজেন। মার্থার পীড়াপীড়িতে ১৯৪৪-৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যান, একটিভলি যুদ্ধে অংশ নেন, আবারো আহত হন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লণ্ডনে তার সাথে মেরি ওয়েলশ নামের টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিকের সাথে পরিচয় হয় যেটা ১৯৪৬ সালে বিয়েতে গড়ায়। কিউবাতে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। যুদ্ধের পরে তার লেখা বই Across the River and Into the Trees এর খুব বাজে সমালোচনা হয়। এতে করে হেমিংওয়ে খুবই ক্ষিপ্ত হয়ে মাত্র আট সপ্তাহে লিখেন ‘দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’ যার জন্য তাকে পুলিৎজার পুরষ্কার দেয়া হয়।
১৯৫৪ সালে হেমিংওয়ে তার চতুর্থ স্ত্রী মেরিকে সাথে নিয়ে কঙ্গোতে সাইটসিয়িং করার সময় তাদের বিমান ভূপাতিত হয়। এতে দুজনে আহত হন। প্রথম একসিডেন্টের পরে তাকে হাসপাতালের নেয়ার সময় দ্বিতীয় বিমানও বিস্ফোরিত হয় যার ফলে হেমিংওয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন, মুখ এবং মাথার কিছু অংশ পুড়ে যায়। হেমিংওয়ের খবর তখন আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। অনেকে ভেবেছিল পরপর দুটি দূর্ঘটনায় হেমিংওয়ে মারা পড়েছেন। সুস্থ হয়ে হেমিংওয়ে নিজের অবিচুয়ারি পড়ে জানতে পারলেন মানুষ তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করে। এই বছরেই হেমিংওয়ে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পান।
নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার সময় থেকে হেমিংওয়ের শারীরিক অবনতি হতে শুরু করে। লেখালেখিতে সমস্যা হয়, আগের মত লিখতে পারেন না। লিখলেও সেগুলো এডিট করতে আরেকজনের সাহায্য লাগে। এরমধ্যে কিউবার বিপ্লব চলে আসে। বিপ্লবের সময় হেমিংওয়ে ক্যাস্ট্রোকে সাপোর্ট করেন। নিরাপত্তার জন্য এসময় হেমিংওয়ে তার আইডাহো’র বাড়িতে চলে আসেন। বিপ্লবের কারণে হেমিংওয়ে কিউবাতে থাকা তার বাড়ি, বই-পুস্তকসহ সকল সম্পত্তি হারান। আমেরিকাতে ফেরত আসার পরে অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। তার ধারণা হয় এফবিআই তাকে সবসময় অনুসরণ করছে । লেখালেখি একদম বন্ধ হয়ে যায়। কেনেডি সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করলে তাদের অভিনন্দন জানিয়ে চার লাইন লিখতে তার এক সপ্তাহ সময় লেগে যায়।
জীবনের শেষ সময়টাতে হেমিংওয়ে তার যৌবনের দিনগুলো আবার যাপন করতে চান। ১৯৫৭ সালে স্পেনে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বুল ফাইটিং দেখতে যান। সমানে ড্রিংকিং এবং বুল ফাইটিং এর মাধ্যমে নিজেকে আবার জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টার ফলে মারাত্মক শারীরিক অবনতি হয়। স্মৃতিচারণ মূলক লেখায় হেমিংওয়ে তার প্রথম জীবনের মানুষ গেরট্রুড স্টেইন, এফ স্কট ফিটজেরাল্ড এদেরকে অযাচিত আক্রমণ করেন। তারা দুজনেই তখন প্রয়াত। হেমিংওয়ের অভিযোগের জবাব দেবার জন্য কেউ বেঁচে নেই। ফিটজেরাল্ড একসময় বলেছিলেন, প্রায় প্রতিটি উপন্যাসের জন্য হেমিংওয়ে একজন করে নতুন নারীকে ব্যবহার করেছেন। উপন্যাস লেখা শেষ হলে তাকে ছুঁড়ে ফেলে নতুন কাউকে নিয়ে মেতে উঠেছিলেন। এক সময় এমন ছিল হেমিংওয়ে যে নারীকে চাইতেন তাকে পেয়ে ছাড়তেন। শেষ বয়সে এসে ভেনিসে এক টিনএইজ মেয়েকে পটানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু তাতে সফল হতে পারেননি। ফলে তার আর নতুন কোন উপন্যাস লেখা হয়ে উঠেনি। শেষ বয়সের স্মৃতিলেখা নিয়ে তার শেষ বইয়ের নাম A Moveable Feast।
৬০ বছর বয়সে হেমিংওয়েকে দেখলে অনেক বৃদ্ধ মনে হতো। এক জীবনে শরীর এবং মনের উপর অনেক অত্যাচার করেছেন। অনেক আগে থেকেই পরিবারের আত্মহত্যাপ্রবণতা তাকে পেয়ে বসে। বাবা আত্মহত্যা করেন, পরিবারের ৬ সদস্যের মধ্যে ৪ জনের মৃত্যু অস্বাভাবিক। এছাড়া নিজে অনেকবার আহত হয়েছেন, মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরত এসেছেন। জীবনের শেষ সময়টাতে আইডাহোর কেচাম শহরে থাকার সময়ে তার চতুর্থ স্ত্রী মেরি তার সাথে ছিল। হেমিংওয়ের মেন্টালিটি মেরির জানা ছিল সেজন্য বন্দুক লুকিয়ে রাখতেন। কিন্তু একবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ফেরত আসার পরে মেরি আর সেটা করেননি। একদিন ভোরে হেমিংওয়ে নিজের বন্দুক দিয়ে আত্মহত্যা করেন। বন্দুকের বিকট শব্দে মেরির ঘুম ভাঙে কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। মাত্র ৬১ বছর বয়সে আমেরিকার কিংবদন্তী তুল্য সাহিত্যিক ইহধাম ত্যাগ করেন। মজার ব্যাপার হলো তখনকার টিভি নিউজে ব্যাপারটা সুকৌশলে চেপে যাওয়া হয়, তার মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলে প্রচার করা হয়।
হেমিংওয়ে ছিলেন অসম্ভব রকমের বুনো, গোঁয়ার ধরণের মানুষ। মারামারি, কাটাকাটি, ফিশিং, বক্সিং, হান্টিং, বুল ফাইটিং, যুদ্ধ, সংগ্রাম এসব রক্তারক্তি কান্ডে তার খুব আগ্রহ ছিল। এসব কিছু এবং সাথে সকাল-সন্ধ্যা হার্ড ড্রিংকস করতে পারলে তার কাছে নিজেকে জীবিত মনে হত। এর বাইরে তার জীবন ছিল বিষণ্ণ, অস্থির। নিজের থেকে পালিয়ে বাঁচতে তাকে এডভেঞ্চার নিয়ে থাকতে হয়েছিল। নারীদের প্রতি আচার-আচরণ ছিল জঘন্য, সব স্ত্রীই তাকে ছেড়ে গিয়েছেন, বারবার ছেড়ে চলে যাবার হুমকি দিয়েছেন। ছেলেমেয়েদের সাথেও তার সম্পর্ক খুব খারাপ ছিল। জীবনটাকে উন্মাদনা আর লেখালেখি দিয়ে পূর্ণ করেছিলেন। তবে হেমিংওয়ের লেখা আমেরিকার সাহিত্য তো বটে সমগ্র ইংরেজি সাহিত্যকে পরিবর্তিত করে দেয়। সহজ, সরল কথা দিয়ে লেখা তার উপন্যাসের বিষয়-বস্তু সহজ-সরল ছিল না। ব্যক্তি হিসেবে তাকে বিবেচনা করলে শেষ পর্যন্ত একধরণের সহমর্মিতাই জন্মে। যারা তার ঘনিষ্ঠ ছিল তারা অনেক সাফার করেছে, কিন্তু সাহিত্যের জন্য, গণ মানুষের জন্য তার অবদান অপরিসীম।