রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণ জাতীয় ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে অসুর নরগোষ্ঠী সম্পর্কে যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা আমাদের বেশ ধোঁয়াশার মধ্যে ফেলে দেয়। স্বর্গ-মর্ত তছনছ করে দেয় ভয়ংকর অসুররা। মহিষাসুরের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু সব দেবতাকে নিজের শক্তি দিয়ে ডাকতে হল মহামায়াকে? নাকি প্রজাপালক এক নৃপতি মহিষাসুর, যাঁকে নারীর মোহিনীমায়ায় বশ হয়ে শেষ অবধি মৃত্যুবরণ করতে হল? এই অসুররা আসলে কারা? দেবতাদের স্বর্গরাজ্য বা মুনিঋষিদের তপোবনে সন্ত্রাসের হানাদেয় যারা? কিন্তু ঋগ্বেদ তো উলটো কথাই বলছে। মিত্র, বরুণ, অগ্নি, রুদ্রবৈদিক দেবতাই নাকি অসুর। মায় সবিতৃ বা সূর্যদেবও ‘সোনালি হাতের দয়ালু অসুর।’ ঋগ্বেদই জানিয়ে দেয়, অসুর কোনও ঈশ্বরবিরোধী শয়তান নয়, শক্তিমান এক পুরুষ। ধোঁয়াশা বাড়তেই থাকে।
অপরদিকে রামায়ণ থেকেই জানতে পারছি, অসুরদের রাজা রাবণের কাছ থেকেই ‘রাজধর্ম’ শিক্ষা নিয়েছিলেন ‘ভগবানের অবতার’ রামচন্দ্র। আবার সেই রামায়ণেই পাই, অসুর গোষ্ঠীর শম্বুক জ্ঞানার্জনের (বেদপাঠের) চেষ্টা করলে করুণার অবতার(?) রামচন্দ্র নির্বিচারে তাঁর শিরোচ্ছেদ করেন। তাঁর অপরাধ, তিনি অব্রাহ্মণ হয়ে বেদ পাঠের চেষ্টা করেছিলেন। মহাভারতের একলব্য শুধুমাত্র সুর গোষ্ঠীর বা তাদের সহযোগী গোষ্ঠীর মানুষ না হওয়ায় অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হন। অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য্যের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে একলব্য স্বশিক্ষায় শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হয়ে ওঠেন। একজন অক্ষত্রিয় দ্রোণাচার্য্যের শিক্ষার্থী অর্জুনের থেকে শ্রেষ্ঠ বীর হয়ে ওঠাকে মেনে নিতে পারলেন না গুরুদেব। তিনি একলব্যের গুরুদক্ষিনা হিসাবে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে নিলেন। এরকম হাজার হাজার শম্বুক, একলব্যদের নিপীড়নের কাহিনী চাপা পড়ে আছে এই দেশের চেপেরাখা ইতিহাসে। যেটুকু আমরা জানতে পারি, তাতে কেবল ‘অসুর’ সম্পর্কে বিদ্বেষ আর ঘৃণার জন্ম দেয়, ইতিহাস-বোধ ধাক্কা খায় বারবার। এদেশের চলতি সংস্কৃতিতে সুর’রা নায়ক আর অসুর’রা ভিলেন হয়েই বিরাজ করে।
আদিবাসী লোককথায় পাওয়া যাচ্ছে, প্রাচীন ভারতে বীর রাজা হুদুড় দুর্গা মহিষাসুরকে নিধন করতে আর্যরা এক ছলনাময়ী নারীকে নিয়োগ করে। অসুর রাজার মূলত চারটি নীতি ছিল। ১) কোন শিশুর উপর অস্ত্র প্রয়োগ করবে না। ২) কোন নারীর উপর অস্ত্র প্রয়োগ করবে না। ৩) কোন বৃদ্ধের উপর অস্ত্র প্রয়োগ করবে না। ৪) কোন অসুস্থ মানুষের উপর অস্ত্র প্রয়োগ করবে না। এই সুযোগে সেই নারী হুদুড় দুর্গা মহিষাসুরকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। এর পর সেই নারী দুর্গা নামে পরিচিতি পায়। এই হত্যার পর আর্যরা উত্তর ভারতে সর্বপ্রথম আর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে বিজয় উৎসবে মেতে উঠেছিলো। সেই সময় বিজিত অনার্য আদিবসীগণ ‘দিকু’ আর্যদের বশ্যতা স্বীকার করে না। তীর-ধনুককে সেরেঞ বা ভুয়াং বানিয়ে, নারীর ছদ্মবেশে নাচ-গানের অভিনয় করতে করতে সপ্তসিন্ধু অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসাম, কাছাড়, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, বঙ্গদেশ ও দক্ষিণ ভারতের বনে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে মান বাঁচিয়েছিল। সেই সাঁওতাল, মুন্ডা, কোল, কুড়মি, কোড়া, মাহালী প্রভৃতি আদিবাসী ভূমিপুত্র গোষ্ঠীর লোকেরা আজও দুর্গাপুজার ক’টাদিন শাড়ি পরে মাথায় পাগড়ি বেঁধে, তাদের দেশহারার বেদনা নিয়ে, তাদের মহান রাজা হুদুড় দুর্গা মহিষাসুরের স্মরণে অতীব করুণ সুরে গান গাইতে গাইতে দাঁশাই ও কাঠি নাচ করতে করতে গ্রাম-গঞ্জের পথে পথে কাঁদতে কাঁদতে ভিক্ষা করে( ওই ক’টা দিন প্রতীকী ভিক্ষা করা ছাড়া আদিবাসীরা কখনই ভিক্ষা করে না)।
এই ভারতেই আজও ‘অসুর’ পরিচয় নিয়ে টিকে আছে কিছু মানুষ। ২৪ এপ্রিল, ২০১৬ লেখক গৌতম চক্রবর্তী আনন্দবাজার পত্রিকায় তাঁর নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘ঝাড়খণ্ডের ঝোবিপাট, বরপাট, চারুয়াপাট। এই লালমাটির জঙ্গলে পাট মানে উঁচু জায়গা। এইসব পাটেই অনিল অসুর, ললিত অসুর, সুষমা অসুরদের বাস। দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে তাদের অনেকের ঘরেই আলো জ্বলে না। গায়ে নতুন কাপড় ওঠেনা। তাঁদের পূর্বপুরুষ মহিষরাজাকে দুর্গা নামে বহিরাগত এক সুন্দরী রমণী ছলাকলায় ভুলিয়ে হত্যা করেছিল। শারদীয়া উৎসবের দিনগুলি তাই তাঁদের কাছে অশৌচ পালনের দিন। মহিষরাজার বর্তমান উত্তরাধিকারীদের পাওয়া যায় এই বাংলাতেও। জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা ব্লকের ক্যারন চা-বাগানে। বাগানের শেষপ্রান্তে কারি লাইনে রয়েছে ৪৫টি অসুর পরিবার। এই অসুরেরা সকলেই ঝুপড়িতে থাকেন। মহিলারা বাগানে চা-পাতা তোলেন, পুরুষেরা বেশিরভাগ সময় দিনমজুরের কাজে ভুটান চলে যান। সেখানে দৈনিক আড়াইশো টাকা মজুরি। কেউ আবার ভুটান থেকে আসা বস্তায় বাঁধা কাঁচাসুপারি গাড়িতে তোলার কাজ করেন। মেটেলি আর মালবাজারের চা-বাগানে আরও কয়েকঘর অসুর আছেন। ১৮৭২ সালের জনগণনায় ১৮টি জনজাতির কথা বলা হয়। সবচেয়ে বেশিলোক ছিলেন অসুরদের মধ্যে। ১৭৪ বছর পর সেই অসুরেরা আজ ঝাড়খণ্ডের এক ‘আদিম জনজাতি’— প্রিমিটিভ ট্রাইব। তাঁদের বেশিরভাগ সময় মুণ্ডাদের মধ্যে গণনা করা হয়েছে, আসুরি ভাষাকে মুণ্ডারি উপভাষার মধ্যে গণ্য করা হয়েছে’।
‘সুর’ কথাটার আভিধানিক অর্থ— দেবতা, অমর। আর অসুর কথাটার অর্থ— দেবতাবিরোধী, দৈত্য, শত্রু ইত্যাদি। অর্থাৎ গুটিকয় বহিরাগত আর্যশ্রেণির দেবতা ও তাদের পারিষদ ছাড়া সকলেই অসুর। কোথাও কোথাও শব্দগত অর্থে ‘অ’ উপসর্গ যোগে ‘অসুর’ দের এখানে ‘সুর’ এর নেতিবাচক অর্থেই আমরা পাচ্ছি। এবিষয়ে বিতর্ক আছে। আমরা যদি এদেশের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আরোপিত সংস্কৃতির গল্পকথা সরিয়ে, সুস্থ স্বাভাবিক মন নিয়ে, এই ‘সুর’ ও ‘অসুর’ মানুষদের চরিত্র বিশ্লেষণের চেষ্টা চালাই, তাহলে সাধারণত দেখতে পাই, সুর বা দেবতারা সারাক্ষণ পরিপাটি সেজেগুজে থাকেন, শ্রমের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক পাইনা। তাদের আইকনগুলো দেখলে বোঝাযায়, তারা একালের মডেলদের মত এক বিশেষ পোজে দণ্ডায়মান। সম্পদ উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও উৎপাদিত সম্পদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কেবলই ভোক্তার। চরম বিলাসী ভোক্তা তারা। শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদনের সারাংশ তাদের ভোগে উৎসর্গ করা হয়েছে। তারা বিশাল বিশাল রাজপ্রাসাদে থাকেন। কেবলই যুদ্ধকরেন, যার বেশীরভাগই অন্যায় যুদ্ধ। তারা বিশাল শক্তিধর এবং কিভাবে যেন আশীর্বাদ ও অভিশাপ দেওয়ারও অধিকারী। ওটাই ওদের আসল শক্তি, মোক্ষম অস্ত্র। ধর্মশাস্ত্র গুলো পড়লে জানা যায়, আরও কিছু কাজ আছে তাদের বেশীরভাগের। আকন্ঠ সোমরস পানকরা বা নেশাভাঙ করা ও চরম যৌন-নষ্টামি। বেলেল্লাপনায় তাদের জুড়ি নেই। নারীমাংসের লোভে তারা কোন সম্পর্ক-অসম্পর্ক (মাতা-কন্যা-ভগ্নি) মানতে নারাজ (শাস্ত্র পুরাণে অজস্র উদাহরণ আছে)।
অন্যদিকে, অসুর বা দেববিরোধীরা পরিশ্রমী জাতি, সভ্যতার কারিগর। এরাই ভারতবর্ষের আদিঅধিবাসী; আর্যপূর্ব সভ্যতার অপ্রতিরোধ্য অসীমশক্তিধর মানুষ, যারা সমাজে সম্পদের উৎপাদক। সাধারণত কুটিরে তাদের বসবাস। পরবর্তীতে কোথাও কোথাও নগরপত্তন করে বসবাস। জল, জমি, জঙ্গল থেকে ঘাম ঝরিয়ে তারা তুলে এনেছে বেঁচে থাকার রসদ। লেখক গৌতম চক্রবর্তী আনন্দবাজার পত্রিকায় তাঁর নিবন্ধে লিখছেন, ‘সুষমা অসুরই আসুরি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত কবি। দিল্লিতে ইন্ডিয়ান ল্যাংগোয়েজ ফেস্টিভ্যালে তাঁর কবিতার বই ‘অসুর সিরিং’ নিয়ে গিয়েছিলেন: ‘খেতো মে যব হুল চলাওগে/ তব ধান বোয়েগে/ নহি তো ঘাস আ জায়েগা।’সেখানে সুষমার কবিতাতেই ধরা পড়েছে অসুরদের জীবনসংগ্রামে শ্রমের ভূমিকা। জৈবিক বাধ্যবাধকতার বাইরে তারা সামান্য মিথ্যা, কপটতার আশ্রয় নেয়নি কখনও। যৌন-নষ্টামি যাদের কাছে সংস্কৃতির(?) ধারা হয়ে ওঠেনি।
এই আখ্যান বা ইতিবৃত্ত যদি আজ শুধুমাত্র ‘ইতিহাস বই’ বা ‘যাদুঘর’ এর বিষয় হয়ে থাকত, তাহলে সমস্যার কিছুই ছিলনা। কিন্তু হায়! আজও এদেশে শম্বুক, একলব্য, গুহক চণ্ডালরা ফিরে ফিরে জন্ম নেয় ব্রাহ্মণ্যবাদের জাঁতাকলে পেষাই হতে। তারা জন্ম নেয় বি, আর আম্বেদকর, রোহিত ভেমুলা বা কানাইহা কুমার নামে।
শুধুমাত্র এটুকু জেনেই একজন স্বাভাবিক যুক্তিবোধ সম্পন্ন নাগরিকের কাছে স্পষ্ট ভাবেই ধরা দেয়— ‘সুর’ না ‘অসুর’, কোন জাতীয় মানুষের আধিক্য সমাজের পক্ষে মঙ্গলের। নিঃসন্দেহে বলা যায়, সুর নয়, অসুররাই সমাজের পক্ষে হিতকর। তারাই সমাজ-সভ্যতার মূল কারিগর। অথচ আমাদের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কৃত্রিম সংস্কৃতির সুবিধাভোগী পণ্ডিত(?)রা দুর্গাপুজোর সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলে বা লিখে থাকেন, ‘দুর্গাপুজো আমাদের শিক্ষা দেয়— ভেতরের ও বাইরের অসুরকে দমন করতে না পারলে আমরা ঘোর অন্ধকারে পতিত হব’। এই কথাকেই আপ্তবাক্য মনে করে আমরা বহুজন(অসুরের বংশধর) মহালয়ার ভোরে বেতারে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শ্রবন করে ধন্য হয়ে যাই। মেতে উঠি দুর্গাপুজোয়। গৌতম চক্রবর্তী আনন্দবাজার পত্রিকায় যথার্থই লিখেছেন, ‘কিন্তু জনজাতি ইতিহাস, পুরাণ রচনা করে না। তারা পরাজিত। যারা বিজয়ী, তারাই ইতিহাস লেখে। রামায়ণ, মহাভারত, চণ্ডী, সবই বিজয়ীদের ব্যাখ্যা’। সেই ব্যাখ্যাই দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বলে চালু রাখার অতিসক্রিয় প্রকল্প জারি আছে লাগাতার ভাবে।
অবাক করা কাণ্ড এটাই, ব্রাহ্মণ্যবাদের ধাপ্পাবাজি এমনই শক্তিশালী চাতুর্যে ভরপুর, যার জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েও ভারতের প্রায় ৯০% অসুর জনজাতির মানুষ অসুরনিধনকেই সোল্লাসে পালন করে। বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিসগড়, উড়িষ্যা বা মধ্যপ্রদেশে আদিঅধিবাসী মানুষদেরও দেখেছি ঘটা করে মহিষাসুরমর্দিনী বা দুর্গাপুজো করতে, দশেরার দিন রাবণ পোড়ানোর উৎসবে মাতোয়ারা হতে। এটাই এই ভারতের চিরকালীন সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। এই ট্র্যাজেডির আসল ইতিহাস খুঁড়ে দেবতার নামে ঐব্ রাহ্মণ্যতন্ত্রীদের ভোগবিলাসী মৌরসিপাট্টা না ভাঙলে এই ভারতের মুক্তিনেই।
এবার আসুন, আমরাই ঠিক করে নিই, মনের ‘আসুরিক’ প্রবৃত্তিটাকে দমন করবো, নাকি আরও নিখাদ আসুরিক পর্যায়ে উন্নীত হতে মনের ‘সুরিক’ প্রবৃত্তি গুলোকে চিরতরে নির্বাসন দেব।
মে ১, ২০১৬; ২:৪৭ অপরাহ্ন
অসাধারণ
অক্টোবর ১৪, ২০২১; ১২:২৬ অপরাহ্ন
ভারতের ইতিহাসে অর্য অনার্য এই কথাটা লিপি বদ্ধ করেছে ঐ ব্রাহ্মন (মনুবাদিরা)তাই আমরা বলে আসছি?
এখন থেকে আর্য কথাটা ব্যাবহৃত হোক,অর অনার্য কথাটি স্থানে ভারতিয় বা মুলনীবাসি এভাবে লেখা হোক।
বাবা সাহেব উল্লেখ করছেন।
We are lndian.
আমরা ভারত বাসি।
জুলাই ২৯, ২০২২; ৮:১৪ অপরাহ্ন
ঠিক বলেছেন। ধন্যবাদ
অক্টোবর ৩, ২০২২; ৮:০৯ অপরাহ্ন
স্যার, যদি অনুমতি দেন তবে এই লেখাটা নিয়ে একটা ভিডিও করতে চাই।