পরিচ্ছেদসমূহ:
(১) মুদ্রণযন্ত্র উদ্ভাবনের ফলাফল
(২) ইসলামী সমাজে পরিবর্তনের সমস্যা
(৩) ইন্টারনেট এবং ইসলামী বিশ্বে বিপ্লবের আসন্নতা
(১) মুদ্রণ যন্ত্র উদ্ভাবনের ফলাফল
আধুনিক সভ্যতার উত্থান পশ্চিম ইউরোপ থেকে। এর পিছনে অনেক ফ্যাক্টর বা প্রভাবক কাজ করেছিল। তবে এর সূচনা যে মূলত রেনেসাঁ অর্থাৎ পুনরুজ্জীবন বা নবজাগরণের মাধ্যমে সেটা আমরা জানি। এই রেনেসাঁ বা নবজাগরণের জন্য সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী ঘটনা ছিল মূলত গ্রীক এবং রোমান বা লাতিন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলা চর্চার পুনরুজ্জীবন। এভাবে পশ্চিম ইউরোপে খ্রীষ্টান ধর্মের কঠোর বিধিনিষেধের চাপে আবদ্ধ ও পঙ্গু হয়ে থাকা জ্ঞানচর্চার মুক্তির পথ খুলে গেল। নবজাগরণের সূচনা কাল প্রকৃতপক্ষে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে, যা চতুর্দশ শতাব্দীতে বেগবান হয়ে উঠে।
তবে মনে রাখতে হবে জ্ঞানচর্চা শুরু হলেও তা যেমন বাধামুক্ত ছিল না তেমন ছিল না বিপদমুক্তও। খ্রীষ্টীয় ধারণার পরিবর্তে বিশ্ব ও প্রকৃতির যুক্তিসম্মত নিয়মের কথা বলার জন্য গীর্জা বা চার্চের বিচারে ধর্মদ্রোহিতার অপরাধে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ব্রুনোকে (১৫৪৮-১৬০০) অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করা হল। আরেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে (১৫৬৪-১৬৪২) আমৃত্যু বন্দী করে রাখা হল। এ ছাড়া ছিল ‘ইনকুইজিশন’ বা ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক পরিচালিত ধর্মীয় অপরাধ তদন্ত ও বিচারের তাণ্ডব।
কিন্তু পশ্চিম ইউরোপের অগ্রযাত্রাকে ঠেকিয়ে রাখা যায় নাই। তবে নবজাগরণ ছিল খুব অল্পসংখ্যক পণ্ডিত ও উচ্চশিক্ষিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেটা ছিল হাতে লিখা পুঁথির যুগ। অত্যন্ত কষ্ট এবং সময় সাধ্য ছিল সে কাজ। স্বাভাবিকভাবে হাতে নকল করা এইসব বই হত অনেক ব্যয়বহুল। ফলে সাধারণ পাঠকদের আয়ত্তের বাইরেই সচরাচর বই-পত্র রয়ে যেত। কাজেই জ্ঞানচর্চার জগৎটা ছিল খুব ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই রকম অবস্থায় খ্রীষ্টীয় ধারণার বাইরে মানুষের চিন্তা-চেতনাকে যেতে হয়েছিল খুব অনিশ্চিত ও ধীর পায়ে।
কিন্তু নবজাগরণ শুরুর প্রায় দেড়শত বৎসর পর একটা ঘটনা মানুষের সমস্ত জগৎটাকেই উল্টেপাল্টে ফেলল। সেটা হল আধুনিক মুদ্রণ যন্ত্রের উদ্ভাবন। জার্মানীতে গুটেনবার্গ তার মুদ্রণ যন্ত্রে ১৪৫২ থেকে ১৪৫৫ কিংবা ১৪৫৬ সালের মধ্যে কোনও এক সময়ে প্রথম যে গ্রন্থ মুদ্রণ করেন সেটা ছিল লাতিন ভাষায় লিখা খ্রীষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল। এর পর ছাপা বই আর বাইবেলের মধ্যে সীমিত থাকল না। মুদ্রিত গ্রন্থের উন্নত মান এবং সুলভতার ফলে মুদ্রণ শিল্পে জোয়ার দেখা দিল। একদিকে যেমন ছাপা বইপত্র সাধারণ পাঠকদের পক্ষে সংগ্রহ বা ক্রয় করা সম্ভব হল তেমন জ্ঞানচর্চাও আর ক্ষুদ্র গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ রইল না। সমগ্র ইউরোপ ব্যাপী মুদ্রণ শিল্পের প্রসারের সঙ্গে প্রবাহিত হল জ্ঞানচর্চার জোয়ার। মুদ্রণ শিল্পের প্রসার এবং মুদ্রিত গ্রন্থের বাজার সৃষ্টির ফলে স্বাধীন লেখক সৃষ্টির পথও খুলে গেল। এতকাল লেখকরা সাধারণত রাজা-রাণী বা ধনী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা বা অর্থ সাহায্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু এখন সামাজিক চাহিদা পূরণ করতে পারলে তথা পাঠক প্রিয়তা পেলে বই বিক্রীর অর্থ দিয়ে লেখকের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব হল। ফলে ব্যক্তি বিশেষের সদিচ্ছার উপর লেখকের নির্ভরতার কাল ফুরালো। এর তাৎপর্য ছিল বিপুল।
আধুনিক মুদ্রণ বা ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার অল্পদিন পরেই পশ্চিম ইউরোপে এমন একটা ঘটনা ঘটল যা শুধু পশ্চিম ইউরোপ নয় অধিকন্তু মানব জাতির ইতিহাসেও এক যুগান্তকারী প্রভাব ফেলল। সেটা হল রিফর্মেশন বা ধর্ম সংস্কার আন্দোলন। এতকাল খ্রীষ্টীয় ক্যাথলিক চার্চ ছিল পশ্চিম ইউরোপে একচেটিয়া আধিপত্যকারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। ক্যাথলিক চার্চের প্রধান পোপ ধর্মের যে ব্যাখ্যা দিত সবাইকে সেটা মেনে নিতে হত। পোপ সরাসরি রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী না হলেও পশ্চিম ইউরোপের রাজা বা সম্রাটদের পক্ষেও তার বিরোধিতায় দাঁড়াবার ক্ষমতা ছিল না। বিপুল ক্ষমতার অধিকারী ক্যাথলিক চার্চ বা পোপ বিশেষ সুবিধাভোগী, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং নিপীড়ক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। নিজ সুবিধা ও স্বার্থে ক্যাথলিক চার্চ এমন অনেক প্রথা ও নিয়ম প্রতিষ্ঠা করেছিল যা বাইবেল তথা মূল খ্রীষ্টান ধর্মে ছিল না কিংবা তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণও ছিল না। এই রকম একটা ছিল পোপ কর্তৃক অর্থের বিনিময়ে স্বর্গে যাবার সার্টিফিকেট প্রদান।
ছাপাখানায় ছাপা বাইবেল সুলভ মূল্যে বাজারে কিনতে পারার ফলে সাধারণ পাঠকরাও বাইবেল পড়ার সুযোগ পেল। এটা ক্যাথলিক চার্চের ধর্ম ব্যাখ্যার একচেটিয়া সুবিধার অবসান ঘটালো। এখন সাধারণ শিক্ষিত পাঠকরা বাইবেল পড়তে গিয়ে সহজেই চার্চের ফাঁকি ধরতে পারল। ফলে দেখা দিল পোপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং দাবী উঠল যীশুখ্রীষ্টের শিক্ষায় খ্রীষ্টান ধর্মের পুনর্গঠনের। এটাই ছিল প্রটেস্ট্যান্ট বা প্রতিবাদীদের ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের মূল বার্তা। ১৫১৭ খ্রীষ্টাব্দে মার্টিন লুথার তার লিখিত বক্তব্য দ্বারা প্রটেস্ট্যান্ট ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। পরবর্তী সময়ে এতে আরও অনেকে যোগ দেন। এই আন্দোলন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানীসহ পশ্চিম ইউরোপের উত্তরের দেশগুলিতে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়। পোপের নেতৃত্বে ক্যাথলিক চার্চ এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য মরীয়া চেষ্টা চালায়। পরিণামে ফ্রান্স এবং বিশেষত জার্মানীতে দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। কিন্তু প্রটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের জয়যাত্রাকে ঠেকানো গেল না। ইতালি, স্পেনের মত পশ্চিম ইউরোপের দক্ষিণের দেশগুলিতে ক্যাথলিক মতবাদ টিকে থাকলেও রাষ্ট্রের উপর পোপের আধিপত্য নিদারুণভাবে খর্ব হল। প্রকৃতপক্ষে পোপের আধিপত্য অতীতের বিষয়ে পরিণত হল। বিশেষত প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা কিংবা প্রভাবের ফলে পশ্চিম ইউরোপের সর্বত্র রাষ্ট্র শাসনে ধর্মের আধিপত্য ফুরাল। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পথে বাধা অর্পণের ক্ষমতাও ধর্ম হারাল। ধর্মবিশ্বাস তথা ধর্মের সমালোচনা কিংবা বিরোধিতার করার সুযোগও ক্রমপ্রসারিত হল। ক্রমে ধর্ম সীমিত হল ব্যক্তিগত জীবনাচরণের বিষয়ে।
মুদ্রণ যন্ত্রের ফলাফল শুধু এইটুকুতে সীমাবদ্ধ রইল না। এটা গোটা ইউরোপকে ঝড়ের গতিতে বদলাতে থাকল। মুদিত গ্রন্থ এবং সংবাদপত্র-পত্রিকার মাধ্যমে (ইউরোপের প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র জার্মানীর সীমান্তবর্তী বর্তমান ফ্রান্সে অবস্থিত শহর স্ট্রাসবুর্গ্ থেকে জার্মান ভাষায় মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয় ১৬০৫ খ্রীষ্টাব্দে) নূতন নূতন তথ্য এবং ধারণা দ্রুত গতিতে মানুষের কাছে পৌঁছাল। পুরাতন কালের অবসান ঘনিয়ে এল। একটার পর একটা দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব আছড়ে পড়ল। যা কখনও ঘটে নাই তাও এবার ঘটল। এতকাল রাজার হাতেই সচরাচর রাজার মৃত্যু হত অথবা রাজার মৃত্যু হতে পারত সিংহাসনের অভিলাষী সেনাপতি বা এই ধরনের রাজপদাকাঙ্ক্ষী কারও হাতে। কিন্তু এবার ঘটল ভিন্ন ঘটনা। ইংল্যান্ডে রাজা এবং প্রজাবৃন্দের প্রতিনিধি পার্লামেন্টের মধ্যে যুদ্ধে ১৬৪৬ খ্রীষ্টাব্দে রাজা ১ম চার্লস পরাজিত হলেন। ১৬৪৮ খ্রীষ্টাব্দে তাকে বিচারের সম্মুখীন করা হল এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল। ১৬৪৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রজাদের দ্বারা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত রাজার শিরশ্ছেদ করা হল। বিপ্লবের নায়ক ক্রমওয়েলের (১৫৯৯-১৬৫৮) মৃত্যুর পর ১৬৬০ খ্রীষ্টাব্দে প্রজাতন্ত্রের অবসান ঘ’টে রাজতন্ত্র ফিরে এলেও সেটা শেষ পর্যন্ত হল নামকা ওয়াস্তে। ১৬৮৮ সালে আরেক বিপ্লবের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে রাজার নির্বাহী ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তাকে নিয়মতান্ত্রিক রাজায় পরিণত করা হল এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতার অধিকারী হল সংসদ বা পার্লামেন্ট কর্তৃক নির্বাচিত মন্ত্রীসভা।
এরপর আরও বিরাট যুগান্তকারী ঘটনা ঘটল ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার ঘোষণায় উদ্দীপিত ফরাসী বিপ্লব গোটা পশ্চিম ইউরোপের সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনকে উলটপালট করে দিল। এইসব বিপ্লবের ধারায় সবশেষে যে বিশাল ঘটনা সারা পৃথিবীর মানুষের জীবনে বিপুল প্রভাব ফেলল তা হল ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দের ৭ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত রাশিয়ার অক্টোবর (রাশিয়ার তৎকালীন পুরাতন পঞ্জিকা অনুযায়ী এটা ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দের ২৫ অক্টোবর) বিপ্লব। এই বিপ্লবগুলির প্রভাব এবং ফল সম্পর্কে অনেকে অনেক আলোচনা করেছেন। অল্প কথায় সে সম্পর্কে বলা যাবে না। সেই আলোচনায় যাবার জায়গাও এটা নয়। এখানে শুধু এ কথা বলতে চাই যে, এই সবই কিন্তু এক অর্থে মুদ্রণ শিল্পের ফল। কারণ মুদ্রণ যন্ত্রের উদ্ভাবন ও ব্যবহার ছাড়া মানুষের অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, চিন্তা এবং বিভিন্ন তথ্যকে মানুষ এভাবে এত সহজে সর্বত্র মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারত না। ফলে এমন বিপুল আয়তনে পৃথিবীকে বদলে দিবার কর্মযজ্ঞে নামবার মত মানুষ পাওয়াও সম্ভব হত না। বই এবং পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে মানুষ যেমন নূতন নূতন ধারণা ও চিন্তার সন্ধান পেয়েছে তেমন মত বিনিময়ের মাধ্যমে পরস্পরকে সমৃদ্ধ করারও সুযোগ পেয়েছে। এভাবে জ্ঞানচর্চার বাহন হয়েছে মুদ্রণ যন্ত্র বা ছাপাখানা।
সুতরাং এভাবেও বলা যায় যে, ছাপাখানা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। এর হাত ধরে ইউরোপের সবটা এবং জাপান-চীন-ইন্দোচীনসহ এশিয়ার এক বিশাল ভূভাগ বেরিয়ে এসেছে মধ্যযুগের অন্ধকার থেকে আলোকিত কালে। পশ্চিম ইউরোপের পথ ধরে উত্তর আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া উন্নত আধুনিক সভ্যতা নির্মাণ করেছে। লাতিন আমেরিকা সাধারণভাবে এখনও অনেক পিছনে পড়ে আছে। এর জন্য শুধু সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থাকে দায়ী করে লাভ নাই। লাতিন আমেরিকার দেশগুলির নিজস্ব কিছু সমস্যাও নিশ্চয় আছে যার কারণে তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদেরকে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার অধীনস্থ করে রাখা সম্ভব হচ্ছে। সেই সমস্যা কি ধর্ম? নাকি, স্পেনীয় এবং পর্তুগীজ উপনিবেশবাদের উত্তরাধিকার? এতদূর থেকে এবং ভালভাবে না জেনে এ সম্পর্কে আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়, বলার চেষ্টা করা সমীচীনও নয়। যাদের সেই সমস্যা তাদেরকে তার কারণ এবং প্রতিকারও বের করতে হবে।
(২) ইসলামী সমাজে পরিবর্তনের সমস্যা
আমাদের বরং ভাবতে হবে আমাদের সমস্যা নিয়ে। আমরা বাস করছি আধুনিক কালে। সুতরাং আমরা চাই বা না চাই যুগের ধারায় কিছুটা হলেও তাল মিলিয়ে অগ্রসর হতে বাধ্য হচ্ছি। শুধু বাংলাদেশ বলে কথা নয়, এ কথা সমগ্র মুসলিম পৃথিবী সম্পর্কেই প্রযোজ্য। বিদেশ থেকে আসা প্রযুক্তিগত উপকরণ দিয়ে যে অগ্রগতি মুসলিম পৃথিবীতে হচ্ছে তাকে কি যথার্থ অর্থে উন্নয়ন বলা চলে? পাশ্চাত্যের চাপে, আধুনিক, সভ্য ও উন্নত পৃথিবীর চাপে আমরা হোঁচট খেয়ে অগ্রসর হচ্ছি। বলা উচিত, যে বিশ্বব্যবস্থায় আমরা আবদ্ধ আছি তা আমাদেরকে তাদের পিছন পিছন কিছু করে অগ্রসর হতে বাধ্য করছে। তবে সহজ ও স্বচ্ছন্দ গতিতে নয়, বরং অনবরত হোঁচট খেয়ে পথ চলছি। কারণ আমাদের চলার স্বাভাবিক শক্তি নাই, চলার জন্য অন্তরের তাড়নাও নাই। আসলে ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ব্রিটেন তার আধিপত্যমূলক যে ব্যবস্থার জালে আমাদেরকে বন্দী করে রেখে ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে বিদায় নিয়েছিল সেই জালে আবদ্ধ থেকেই আজ অবধি আমাদেরকে এভাবে নিরুপায় হয়ে পথ চলতে হচ্ছে। এই জাল ছিঁড়ে মধ্যযুগে ফিরবার ক্ষমতা যেমন আমাদের নাই তেমন এই জাল ছিঁড়ে স্বচ্ছন্দ গতিতে সামনের দিকে অগ্রসর হবার ক্ষমতাও আমাদের নাই। কেন আমাদের এই অক্ষমতা?
বুঝতে হবে, যে অক্ষমতার কারণে আমাদের সমাজ অতীতে সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদকে প্রতিহত করতে না পেরে অধীনস্থ হয়েছিল সেই একই কারণ আজ অবধি আমাদের সমাজকে পাশ্চাত্য কিংবা আধিপত্যকারী বিশ্বশক্তিসমূহের অধীনস্থ কিংবা কৃপার ভিখারী হয়ে থাকতে বাধ্য করছে। সেই কারণকে না বুঝলে আমরা মুক্তির পথে এক পাও অগ্রসর হতে পারব না। সেই কারণ হচ্ছে এ দেশে সমাজ নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান হিসাবে ক্রিয়াশীল ধর্ম। আমাদের দেশের বাস্তবতায় সেটা প্রধানত ইসলাম ধর্ম।
ইউরোপ ধর্মের আধিপত্য এবং খবরদারি থেকে বেরিয়ে এসেছে কয়েকশত বৎসর আগে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, আমরা আজও ধর্মের খবরদারি এবং নজরদারির বাইরে যেতে পারছি না। ইসলাম এমনই এক ধর্ম, মুসলিম সমাজে যার সম্পর্কে সামান্য বিরূপ মন্তব্য কিংবা সত্যনিষ্ঠ আলোচনা যে কোনও মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। সুতরাং অন্য যে কোনও সমাজে মুদ্রণ যন্ত্র বা ছাপাখানা যে ভূমিকাই পালন করুক ইসলামী বা মুসলিম সমাজে তা করতে পারে নাই।
এখানে ইসলামের নির্মোহ সমালোচনা করে লিখবে কে? আর লিখলেও তা মুদ্রণ এবং প্রকাশ করবে কে? আচ্ছা ধরে নেওয়া গেল লেখকের সঙ্গে মুদ্রক এবং প্রকাশকও পাওয়া গেল। কিন্তু বই তো দোকানে বিক্রী করতে হবে। তারপর চার জনেরই কী দশা হবে তা না বললেও চলে। ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে লেখক, মুদ্রক, প্রকাশক, বিক্রেতা চারজনই ইসলামের ‘বীর সিপাহীদের’ হাতে আক্রান্ত এবং নিহত হবে অথবা খুব ভাগ্যবান হলে ‘ধর্মানুভূতি’ রক্ষায় কাতর রাষ্ট্রের হামলা ও কারাদণ্ডের শিকার হবে। পাকিস্তানের মত ইসলামী রাষ্ট্রে অবশ্য ব্ল্যাসফেমীর জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধানও আছে। সুতরাং ইসলামী পৃথিবীতে নবজাগরণ, আলোকায়ন, মুক্তবুদ্ধির চর্চা এসব কিছুই প্রকৃত অর্থে হয় নাই। পাশ্চাত্যের আধিপত্যাধীনে অথবা প্রভাবে যা হয়েছে তা খুবই সতর্ক ও ভীরু হিসাবের ভিতরে থেকে দুরুদুরু বক্ষে। ওভাবে কি কোনও সমাজেরই জাগরণ হয়? সুতরাং আলোকিত পাশ্চাত্যের প্রভাবাধীনে থেকেও ইসলামী পৃথিবী এবং সকল মুসলিম সমাজ তাদের মানসলোকে অন্ধকারের মধ্যযুগেই পড়ে আছে।
এই বাস্তবতায় তুরস্ক, মিসর, সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়ার মত কোনও কোনও দেশে রাষ্ট্র বিপ্লব বা রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটলেও মুসলিম পৃথিবীর কোথায়ও সামাজিক বিপ্লব ঘটে নাই। এবং ফলত রাজনৈতিক বিপ্লবগুলিও হয় বিপর্যস্ত হয়েছে, নয় পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। হয়ত বলা হবে এর জন্য দায়ী প্রধানত পাশ্চাত্যের হস্তক্ষেপ। সব জায়গায় না হলেও কিছু জায়গায় তার জন্য পাশ্চাত্যকে দায়ী করা যেতে পারে। কিন্তু সিরিয়া-লিবিয়ায় কি শুধু বহিরাক্রমণ বা বাইরের হস্তক্ষেপ দায়ী ছিল? ভিতরের বিভক্তি, বিশৃঙ্খলা এবং আমন্ত্রণও কি বাইরের হস্তক্ষেপকে সুযোগ করে দেয় নাই?
কতকাল ধরে সাগর পারের জাপান এবং ভূমিসংলগ্ন দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থিত যুদ্ধঘাঁটিগুলি থেকে মার্কিন সেনা যে কোনও সময় উত্তর কোরিয়ার উপর হামলা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। কিন্তু বিপুল তেল সমৃদ্ধ ইরাক-লিবিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিম ইউরোপ যা করতে পেরেছে তার কিছুই ক্ষুদ্র উত্তর কোরিয়ায় করতে পারছে না। পাশ্চাত্যের চাপে প্রায় সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এবং একঘরে হয়ে থাকা উত্তর কোরিয়ার জনগণের অকল্পনীয় ঐক্য, সংহতি, দৃঢ়তা, সাহস এবং আত্মরক্ষার সক্ষমতা থেকে আমাদের অনেক কিছুই শিখবার আছে। একইভাবে উল্লেখ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় থাকা ক্ষুদ্র কিউবার দৃষ্টান্ত। লাতিন আমেরিকার ক্ষুদ্র এক দ্বীপরাষ্ট্র কিউবা পৃথিবীর সর্বাধিক শক্তিশালী পরাশক্তিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এতকাল ধরে। পুনরায় মধ্যপ্রাচ্যের দিকে দৃষ্টি ফিরাই। সেখানে মুসলিম দেশগুলি রাষ্ট্র বিপ্লবের মাধ্যমে যেটুকু আলো পেয়েছিল সেটুকুকেও ত্যাগ করে প্রায় সবাই এখন ধর্মের হাত ধরে পুনরায় অন্ধকার কালের যাত্রী।
ইসলামী পৃথিবীতে কোথায়ও নিজস্ব উদ্যোগে সামাজিক বিপ্লব করা যায় নাই। এ নিয়ে মুসলমানদের মনে তেমন কোনও আত্মজিজ্ঞাসাও এতকাল ছিল না। অবশ্য আত্মজিজ্ঞাসা একেবারে ছিল না এ কথা ঠিক নয়। মুষ্টিমেয় সংখ্যক মানুষ সমস্যাগুলি নিয়ে যে কোথায়ও কখনও ভাবে নাই তা নয়। সব সমাজেই নূতন ও অগ্রগামী ভাবনা তো মুষ্টিমেয়ই শুরু করে। তারপর সেটা সমাজে ছড়িয়ে পড়তে পারে। মধ্যযুগের শেষে ইউরোপে ধর্মের দিক থেকে অনেক বাধা দিয়েও মুষ্টিমেয় সংখ্যক নূতন কালের অগ্রদূতকে ঠেকিয়ে রাখা যায় নাই। কারণ সেখানে খ্রীষ্টধর্মের মধ্যে সহনশীলতার কিছু উপাদান ছিল, যা দীর্ঘকাল চার্চের কঠোরতার কারণে চাপা পড়ে থাকলেও রেনেসাঁ পরবর্তী কালে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা এবং বিশেষত মুদ্রণ শিল্পের প্রসারের পরিণামে প্রাধান্যে চলে আসে।
কিন্তু ইসলাম খ্রীষ্টধর্ম থেকে প্রকৃতপক্ষে বিপরীত ধর্মী একটা ধর্ম। এখানে সমাজের ভিতর থেকে ইসলামের ভূমিকা এবং সমস্যা নিয়ে কোনও নির্মোহ আলোচনার সুযোগ নাই। এখানে ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনা মানে ইসলাম এবং তার প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদের গুণগান করে যাওয়া। তা না হলে হত্যা অথবা রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হতে হবে। এবং সেটা একবিংশ শতাব্দীর এ কালে এসেও। প্রকাশ অথবা প্রচারের সুযোগের অভাবে মুষ্টিমেয়ের মনের জিজ্ঞাসা চাপা পড়ে থেকেছে এতকাল এবং চর্চার অভাবে, সামাজিক সংলাপের অভাবে সেসব হারিয়েও গেছে। সুতরাং প্রায় একশত ষাট কোটি মুসলমানের মনের পৃথিবীতে এখনও মধ্যযুগের ঘন অন্ধকার চাপ বেঁধে আছে।
(৩) ইন্টারনেট এবং ইসলামী বিশ্বে বিপ্লবের আসন্নতা
তবে সেই চাপ বাঁধা অন্ধকার এতকালে এসে ভাঙ্গতে শুরু করেছে ইন্টারনেটের আঘাতে। ইন্টারনেট সমস্ত পৃথিবীকে তো বটেই আরও বিশেষ করে মুসলিম পৃথিবীকে এক প্রচণ্ড ভাব-বিপ্লবের আঘাতে লণ্ডভণ্ড করতে শুরু করেছে। যা এতকাল কেউ পারে নাই তা এখন পাশ্চাত্যের নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে সেখানকার মতপ্রকাশের অধিকারকে ব্যবহার করে যে কেউ করতে পারছে। ইসলাম সম্পর্কে যে নির্মোহ আলোচনা-সমালোচনা এতকাল নিষিদ্ধ এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে ছিল তা ইন্টারনেটের কল্যাণে কম্পিউটার এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মানুষের ঘরে ঘরে শুধু নয় অধিকন্তু হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে।
বস্তুত মুদ্রণ যন্ত্রের উদ্ভাবনের ফলে পৃথিবীতে যে বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে তেমন বা তার চেয়েও বিশালতর পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে ইন্টারনেট উদ্ভাবনের ফলে; এবং সেটা অনেক বেশী দ্রুততার সাথে। মুদ্রণ যন্ত্রের পর প্রচার ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে রেডিও, টেলিভিশন যে অগ্রগতি ঘটিয়েছিল ইন্টারনেটের প্রবর্তন তার তুলনায়ও অনেক বিপুল অগ্রগতি ঘটিয়েছে। ওয়েবসাইট কিংবা অনলাইন পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে মানুষের চিন্তা, জ্ঞান এবং তথ্য পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে অবস্থিত মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। যে কোনও দূরত্বে অবস্থিত মানুষদের মধ্যে মুহূর্তের মধ্যে সহজে মতবিনিময়ও হচ্ছে ফেইসবুক, টুইটারের মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে।
ইসলাম সম্পর্কে জেনেও যারা এতকাল চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন তাদের অনেকে এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন। বলার জন্য আছে ইউটিউবের মত মাধ্যমও। স্বনামে হোক ছদ্মনামে হোক তারা এখন লিখছেন, বলছেন। পাশ্চাত্যে থেকে যেমন তেমন সেটা কিছু করে হলেও ইসলামী পৃথিবীর ভিতর থেকেও। তারা পরস্পরের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। এবং তাদের বক্তব্য ইন্টারনেটের সাহায্যে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে ইসলাম সম্পর্কে প্রশ্ন এতকাল যতই নিষিদ্ধ থাক এখন সেটা ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত ইসলামী সমাজেই। প্রশ্ন জাগছে সর্বত্র এবং এটা ক্রমবর্ধমান ঝড়ের গতিতে। এটা স্পষ্ট যে, সুনামির মত বিশালতা এবং প্রচণ্ডতা নিয়ে ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আছড়ে পড়তে যাচ্ছে মুসলিম পৃথিবীর দেশে দেশে। ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামকে রক্ষার দিন ফুরিয়েছে। কারণ ইন্টারনেটকে কোনও আঘাত দিয়েই ঈমানদার মুসলমানদের পক্ষে হত্যা কিংবা স্তব্ধ করা সম্ভব নয়।
ভাবজগতে শুরু হয়েছে নূতন বিপ্লবের কাল। ভাবগত বিপ্লবের হাত ধরাধরি করেই তো ঘটে বস্তুগত বিপ্লব। সুতরাং এখন বিশালায়তনে সমাসন্ন সামাজিক এবং সেই সঙ্গে রাষ্ট্রিক বিপ্লব। এটা স্পষ্ট যে এই বিপ্লবে বিস্ফোরিত হতে যাচ্ছে ইসলামী পৃথিবী। আমি ধারণা করি মানুষের মনোজগতে কৃষ্ণগহ্বর বা ‘ব্ল্যাকহোলের’ মত এক ভয়ঙ্কর ধ্বংসের শক্তি নিয়ে চেপে থাকা ইসলাম এক বিরাট বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ধ্বংস হবে। আমি এই বিস্ফোরণের একটা তুলনা খুঁজে পাই বিশ্বসৃষ্টির আদিতে সংঘটিত মহাবিশ্বের ‘বিগ ব্যাং’ বা মহাবিস্ফোরণের সঙ্গে। প্রায় চৌদ্দশত বৎসর অগণন মানুষের বুকের উপর ভয়ঙ্কর জগদ্দল পাথরের মত চেপে থাকা ইসলামের ধ্বংস বা বিস্ফোরণ মানুষের এতকালের অবরুদ্ধ বিপুল শক্তিকে মুক্ত করায় তা যে ‘বিগ ব্যাং’-এর মত প্রচণ্ড রূপ নিয়ে আবির্ভূত হবে সেই রকমটাই মনে হয়। এই মহাবিস্ফোরণ ধ্বংসের অনিয়ন্ত্রণযোগ্য মহাশক্তিকে যেমন মুক্ত করতে পারে তেমন নবসৃষ্টি ও নবনির্মাণের মহাশক্তিকেও মুক্ত করতে পারে। এটা নির্ভর করছে এই অনিবার্য বিস্ফোরণকে কে কীভাবে চালিত বা ব্যবহার করছেন তার উপর। তবে আমি আশাবাদী। আমি মনে করি খ্রীষ্টান এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রভাবিত সমাজগুলির পর এবার ইসলামী পৃথিবী নবতর বিপ্লবের অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, যা হবে মানুষের কল্যাণ এবং অগ্রযাত্রায় বিপুলভাবে সহায়ক। ইন্টারনেটের আবির্ভাবের পর আমরা নবতর বিশ্ববিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, যে বিপ্লবের মূল ভূমি হবে ইসলামী পৃথিবী এবং সমাজগুলি। হয়ত এর সঙ্গে যুক্ত হবে ভারত এবং হিন্দু সমাজেরও বিপ্লব। তবে সেটা আরেক আলোচনার বিষয়।