ইসরায়েল প্যালেস্টাইন সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গেলেই সবার আগে মানুষ যে কথাটা বলে তা হলো ইসরায়েল প্যালেস্টাইন সমস্যাতো হাজার হাজার বছরের পুরানো সমস্যা। নিঃসন্দেহে কথাটা আংশিক সত্য যে ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন বলতে যে জায়গাটা আমরা বুঝি সেই জমি নিয়ে সমস্যা আসলেই তিন-সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে চলে আসছে তবে বর্তমানে সমস্যার সাথে তিন-সাড়ে তিন হাজার বছর আগের সমস্যার তফাৎ হলো তিন-সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ইসলাম ছিল না। যদিও ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সমস্যাটা ভালো করে বোঝার জন্য তিন-সাড়ে তিন হাজার বছরের ইতিহাসটা জানা খুবই দরকারী তারপরেও সে আলোচনা এখানে উহ্য রেখে গত দেড়শো বছরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবো।
ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন বলতে আমরা যে অঞ্চলটুকুকে বুঝি উনিশ শতকের শেষের দিকে সেই এলাকাটা ছিল অটোমান এম্পায়ারের অধীনে। ১৮৭৮ সালে অটোমানদের আদমশুমারী থেকে জানা যায় সেখানে জনসংখ্যার ৮৭% মুসলিম, ১০% খ্রিস্টান এবং ৩% ইহুদী। সাধারণ ভাষা হিসাবে সেখানে সবাই কথা বলতো আরবি ভাষাতেই, হিব্রু ভাষার অস্তিত্ব জনজীবনে ছিলই না। যতদূর জানা যায় অটোমানদের অধীনে মোটামুটি শান্তিতেই মিলে মিশে থাকতো কমবেশী সম্ভবত তৎকালীন অটোমানদের লিবারেল এপ্রোচের কারণেই।
গল্পের এই অংশটা ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন থেকে ঘুরে চলে যাবে ইউরোপের দিকে। ইউরোপে তখন জাতীয়তাবাদ তথা জাতীয়তাবাদের লেজ ধরে ফ্যাসিবাদের উত্থান হওয়া শুরু করেছে। সেই সময়েই ইহুদী অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান পলিটিকাল রিফর্মার থিওডোর হার্যেল ইউরোপিয়ানদের দেখাদেখি ইহুদীদের জন্য আলাদা একটি স্বদেশ তৈরীর স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। যদিও প্রাথমিকভাবে তার ইচ্ছে ছিল ইউরোপিয়ানদের সাথে মিশে যাওয়ার তবে ইউরোপিয়ান জেনোফোবিয়া এবং এন্টি সেমেটিজমের কারণে তার সেই ইচ্ছেটা বেশিদিন টেকেনি উল্টো ইউরোপ থেকে বেরিয়ে প্যালেস্টাইন অঞ্চলে ইহুদীদের জন্য একটা দেশ তৈরির স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। তার এই আইডিয়াতাই ছিল ইহুদি জাতীয়তাবাদ বা জায়োনিজম। সেসময়ের জায়োনিস্টদের দেশ তৈরীর ইচ্ছার অনেকাংশই সেকুলার ছিল, ধর্মীয় ইহুদী রাষ্ট্রের বদলে ইহুদীদের জন্য একটা সেইফ হেভেন তৈরী করাই ছিল যার মূল উদ্দেশ্য। অন্যদিনে অটোমানদের অধীনে আরব দেশগুলোর মধ্যেও একই সময়ে আরব জাতীয়তাবাদেরও উথান শুরু হয়। আর এই দুইদলই সাহায্যের জন্য হাত বাড়ায় পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে।
পরবর্তী ঘটনায় যাবার আগে ইউরোপে ইহুদীদের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে দুকথা বলে নেয়া ভালো। ইউরোপিয়ানরা ইহুদীদের কিভাবে দেখতো তা শেক্সপিয়ারের মার্চেন্ট অব ভেনিসের শাইলকের চিত্রায়ন দেখলেই কিছুটা হলেও তার আন্দাজ পাওয়া যায়। ইহুদীদের অর্থনৈতিক অবস্থা ইউরোপে খুব খারাপ না থাকলেও সামাজিক অবস্থান খুব একটা ভালো ছিল না যদিও ফ্রান্সে ১৭৯১ সাল থেকেই ইহুদীরা লিগ্যালি সমঅধিকার ভোগ করতো। অবস্থার পরিবর্তন হয় ১৮৮১ সালে রাশান এম্পায়ার তথা পূর্ব ইউরোপে যখন ইহুদী বিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়। সেই আইনের কারণে সামাজিক ভাবে ইহুদীদের অবস্থা তো খারাপ হয়ই তার সাথে যুক্ত হয় মব ভায়োলেন্স। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক অত্যাচার থেকে বাঁচতে পূর্ব ইউরোপের ইহুদীরা সবাই পশ্চিম ইউরোপে রিফিউজি হিসাবে পাড়ি দেয়।
সেসময়ে আরেকটি উল্ল্যেখ্যযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল ফ্রান্সেই যেখানে কিনা ইহুদীরা সমঅধিকার ভোগ করতো। ইতিহাসে যাকে বলা হয় ড্রাইফুস এফেয়ার। ইহুদি বংশোভূত আলফ্রেড ড্রায়ফুস নামের একজন ফ্রেঞ্চ আর্টিলারি অফিসারের বিরুদ্ধে জার্মানদের কাছে মিলিটারি সিক্রেট বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ তোলা হয়। শুধু ইহুদী বলেই সাজানো এই মামলায় আলফ্রেড ড্রায়ফুসকে বানানো হয় স্কেপগোট। সমসাময়িক এসব নানা ঘটনার কারণেই ইহুদী বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ ইহুদী জনগণ বুঝতে পারে ইউরোপে তাদের আসল অবস্থান কি যার কারণে ইউরোপিয়ানদের সাথে ইন্টিগ্রেশনের বদলে জায়োনিজমের প্রতি তারা আগ্রহী হয়ে উঠতে থাকে।
থিওডোর হার্যেলের মৃত্যুর পর জায়োনিস্ট মুভমেন্টের নেতা নির্বাচিত হয় খাইম ওয়াইজম্যান যে কিনা ব্রিটিশ সরকারের সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হয়। ১৯০৬ সালে খাইম ওয়াইজম্যানের সাথে পরিচয় হয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আর্থার ব্যালফারের সাথে। প্রায় বছর দশেকের আলাপ আলোচনার পরে ব্রিটিশেরা প্রতিশ্রুতি দেয় প্যালেস্টাইনে ইহুদী রাষ্ট্র গঠন করে দিতে, ইতিহাসে যাকে আমরা ব্যালফার ডিক্লারেশন নামে জানি। সমস্যা ছিল প্যালেস্টাইন তখনো ব্রিটিশ টেরিটরি না। টেকনিক্যালি সেটা তখনো অটোমান এম্পায়ারের অংশ। শুধু এই নয়, ব্যালফার ডিক্লারেশনের এক বছর আগে ফ্রান্সের সাথে এক গোপন চুক্তি হয় যেখানে তারা ঠিক করে ফ্রেঞ্চরা নেবে লেবানন-জর্ডান আর ব্রিটিশের নেবে প্যালেস্টাইন। তার ও একবছর আগে ব্রিটিশ অফিসিয়ালরা মক্কার শাসক শরীফ হুসেনের কাছে প্রতিশ্রুতি দেয় অটোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে পুরস্কার হিসাবে পুরো প্যালেস্টাইন সহ আরব এলাকাই সে শাসন করতে পারবে। সোজা কথা, যে জমি তখনো ব্রিটিশদের ছিল না সে সমস্ত জমিই ব্রিটিশেরা আরব এবং জায়োনিস্ট দুই দলের কাছেই দেবার প্রতিশ্রুতি করে রেখেছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরপরেই ব্রিটিশরা প্যালেস্টাইনে একটা কলোনি তৈরী করে এবং লোকাল মুসলিম, খ্রিস্টান এবং ইহুদীদের উপর তাদের ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি এপ্লাই করে। সাথে ব্যালফার ডিক্লারেশনের প্রতি সন্মান দেখিয়ে ইউরোপ থেকে ইহুদিদের আসতেও দেয়। সেই ইহুদী ইমিগ্রেশনের কারণে ১৯৩৮ সালের মধ্যে ৩% থেকে ৩০% হয়ে যায় ইহুদী জনসংখ্যা। আসার পরপরেই ইউরোপ ফেরত ইহুদীরা প্যালেস্টিনিয়ান-আরবদের থেকে জমি কেনায় মন দেয় এবং সেই জমি থেকে ধীরে ধীরে আগের মালিক থেকে শুরু করে প্যালেস্টিনিয়ান বর্গা চাষীদেরও উৎখাত করতে শুরু করে। ইহুদীদের জমি সংক্রান্ত এই পলিসির কারণে প্যালেস্টিনিয়ান-আরবদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে ইহুদীদের এবং এক পর্যায়ে তারা বিদ্রোহ করে বসে ব্রিটিশ এবং আরবদের বিরুদ্ধে ১৯৩৬ সালে যা কিনা ব্রিটিশরা শক্ত হাতে দমন করে।
ইহুদী প্যালেস্টিনিয়ান কনফ্লিক্ট কমানোর উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা নতুন নিয়ম করে যাতে ইহুদী ইমিগ্রেশন লিমিটেড করা হয় আর তা করা হয় এমন সময়ে যখন ইহুদীদের ইউরোপ ছাড়াটা বিশেষ জরুরি হয়ে পড়েছিল। এর সাথে তারা ঘোষণা দেয় আগামী দশবছরের মধ্যে ইহুদী প্যালেস্টিনিয়ানদের নিয়ে জয়েন্ট একটা দেশ তৈরীর। ফলাফলে ইহুদী বা প্যালেস্টিনিয়ান কেউই খুশী হয় না। এর মাঝে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর সেই যুদ্ধে ইউরোপে ইহুদীদের উপর কি অত্যাচার করা হয় তা তো সবাই জানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটিশ এম্পায়ারের অবস্থা খুবই নড়বড়ে হয়ে যায় ফলাফলে তারা তাদের অনেক কলোনীই ছেড়ে দিতে থাকে। যার মাধ্যমে জন্ম নেয় ভারত পাকিস্তানের মত দেশের। তবে প্যালেস্টাইন সমস্যার সমাধান তারা নিজেরা না করে তারা সেই দায়িত্ব তুলে দেয় সদ্য প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের হাতে। জাতিসংঘের সমাধানটা ছিল পার্টিশন করে মোটামুটি একই আকৃতির দুটো দেশ তৈরী করার।
ইসরায়েল সেটা মেনে নিয়েও প্যালেস্টিনিয়ানেরা সেটা মেনে নেয়নি। দৈত রাষ্ট্র ঘোষণার কিছুদিনের মধ্যেই আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ বেঁধে যায়। যে যুদ্ধের একদল ছিল ইসরায়েল এবং আরেকদল ছিল প্যালেস্টিনিয়ান এবং অন্যান্য আরব কিছু দেশ। যুদ্ধে ইসরায়েল জিতে যায় এবং জাতিসংঘের ভাগ করা অংশের থেকেও আরো বেশী অংশ তারা দখলে নিয়ে নেয়। এর মধ্যে জর্ডানের অধীনে চলে আসে ওয়েস্ট ব্যাংক আর জেরুজালেম এবং মিশরের দখলে চলে যায় গাজা স্ট্রিপ। যুদ্ধের কারণে সাত লাখের উপর প্যালেস্টিনিয়ান শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নেয় আসে পাশের আরব দেশগুলোতে। ইহুদীদের জন্য যুদ্ধটা ছিল তাদের নতুন দেশের শুরু আর প্যালেস্টিনিয়ানদের জন্য ছিল তাদের ঘর বাড়ি হারানো।
এর প্রায় ১৮ বছর পরে ইসরায়েলের সাথে আরব দেশগুলোর যুদ্ধ আবার বাধে এবং বরাবরের মতোই ইসরায়েল সে যুদ্ধে জিতে যায় এবং সিনাই পেনিনসুলা, গাজা স্ট্রিপ, ওয়েস্ট ব্যাংক সবকিছুই তাদের দখলে নিয়ে নেয়। জাতিসংঘের তখন একটা রেসুলেশন ২৪২ পাবলিশ করে যেখানে বলা হয় শান্তিরক্ষার জন্য ইসরায়েল সিনাই পেনিনসুলা, গাজা স্ট্রিপ আর ওয়েস্ট ব্যাংক থেকে দখল ছেড়ে দেবে এবং রাষ্ট্র হিসাবে ইসরায়েল এবং প্যালেস্টাইনের স্বীকৃতি দেবে সকল দেশ। বলাই বাহুল্য সেটা হয়ে ওঠেনি। সিনাই পেনিনসুলা থেকে দখল উঠিয়ে নিলেও গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাংকে উল্টো সেটেলমেন্ট তৈরী করা শুরু করে। জাতিসংঘের নিয়ম অনুসারে এসব সেটেলমেন্ট অবৈধ যদিও ইসরায়েলের যুক্তি প্যালেস্টাইন যেহেতু কোন দেশ না সেক্ষেত্রে এই সেটেলমেন্টগুলো অবৈধ না।
এর পর অনেক জল গড়ায়। ইয়াসির আরাফাতের প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশন থেকে হামাস অনেকেই প্যালেস্টাইনের ক্ষমতায় আসে। তাদের সবার সব চেষ্টাই বিফলে যায়। একসময় পিএলও যে চেষ্টা শান্তিপুর্ন ভাবে করার চেষ্টা করেছিল হামাস সে চেষ্টা করছে অস্ত্রের মাধ্যমে। আর হামাসের জবাব ইসরায়েল দিচ্ছে হামাসের থেকেও বেশী আগ্রাসী ভঙ্গিতে। যার কারণে সে এলাকায় শান্তি আর আসেনি। প্যালেস্টিনিয়ানরা কখনো চায়নি তাদের এলাকায় ইসরায়েল তৈরী হোক আর ইসরায়েল চেয়েছে দুহাজার বছর আগের ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতির দাবীতে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। যদিও ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি ঈশ্বর নিজেই রাখতে পারেনি বরং সারা পৃথিবীর ইহুদীদের একসাথে হয়েই সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে।