১৬০৫ বার পঠিত
ব্লগপোস্টটি শুরু করা যেতে পারে লিবিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি মুয়ামার গদ্দাফি ও আল-কায়দার প্রাক্তন সুপ্রিমো ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর ঘটনা দিয়ে। গদ্দাফি ছিলেন একজন সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক এবং ওসামা ছিলেন একজন ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী ব্যক্তিত্ব। লিবিয়ার মানুষ গদ্দাফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলো গণতন্ত্রের দাবীতে। সেই বিদ্রোহ ঠেকাতে পারেনি গদ্দাফির সামরিক বাহিনী। ফলে গাদ্দাফি বিদ্রোহীদের হাত থেকে বাঁচার আশায় প্রাণভয়ে পালাচ্ছিলেন কোনো নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। পলায়নরত গদ্দাফিকে পিছন থেকে গুলি করা হয়েছিলো। তারপর আহত গদ্দাফির উপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো। ঘটনাটি ঘটেছিলো ২০১১ সালের ২০ শে অক্টোবর। বিশ্বের মানুষ লিবিয় জনগণের বিদ্রোহকে সমর্থন জানালেও গদ্দাফিকে হত্যা করার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছিলো। কারণ, গদ্দাফির হত্যা করার ঘটনায়, তাও আবার বিচার না করেই, মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি খুব খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিলো। আর ওসামা বিন লাদেনকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ মধ্যরাত্রিতে তাঁর গোপন ডেরায় হানা দিয়ে গুলি করে হত্যা করে তাঁর লাশ সমুদ্রের জলে ডুবিয়ে দিয়েছিলো। লাদেন একজন কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী ছিলেন, তাঁর বিচার করে তাঁকে মৃত্যুদন্ড দিলে হয়তো অধিকাংশ বিশ্ববাসীই খুশী হতো, কিন্তু এভাবে তাঁকে হত্যা করার ঘটনায় আমেরিকাকেও প্রবল সমালোচিত হয়েছিল।
গদ্দাফি ও ওসামার হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে নিন্দায় ও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলো বলতে গেলে গোটা বিশ্বই। প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বহু ব্যক্তিত্বও। তবে সর্বাধি প্রতিবাদ ও নিন্দা ধ্বনিত হয়েছিলো মানবাধিকার সংগঠনগুলি ও মানবাধিকার কর্মীদের কন্ঠে। তাঁরা কিন্তু আবার সর্বাধিক সোচ্চার ছিলেন গদ্দাফির দীর্ঘ চার দশকের শাসনকালে ঘটা রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধেও। এটাই স্বাভাবিক যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় তাঁরাই সব আগে ও সব থেকে বেশী প্রতিবাদ ধ্বনিত করবেন। কারণ মানবাধিকারের প্রথম এবং প্রধান কথাই হলো প্রত্যেকেরই বাঁচার অধিকার আছে, এমনকি হত্যাকারীরও। আইনসিদ্ধ পথে বিচারের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র কারো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করলে সেটাও হত্যা এবং তাতেও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। সুতরাং ঠাণ্ডা মাথায় এবং নির্যাতন করে গদ্দাফিকে হত্যা করার ঘটনাটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল থেকে যে নিন্দা ও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিলো তা ন্যায়সঙ্গত ও স্বাভাবিকই ছিলো। একইকারণে ওসামা হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাও ছিলো সম্পূর্ণ সঠিক। ওসামা ও গদ্দাফির হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরব হওয়া খুব কিন্তু খুব সহজ কাজ মোটেই ছিল না। কারণ তাঁদের হুকুমে একদা অজস্র মানুষকে হত্যা করা হয়েছিলো, যার ফলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণঅসন্তোষ ও ঘৃণা তৈরী হয়েছিল। তাঁরা তো ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই গণতন্ত্র, মানবতন্ত্র ও মানবসভ্যতার শত্রু।
গদ্দাফি ও ওসামার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে মাঠে নেমেছিলেন উলামা [মাওলানা, মুফতি ও ইমামগণ], মুসলিম সংগঠনগুলি এবং মুসলিম বুদ্ধিজীবীরাও। তাঁরাও সরব হয়েছিলেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন তুলে। তাঁদের সমালোচনা, নিন্দা ও প্রতিবাদের প্রধান অভিমুখ ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ জোট ন্যাটো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। আমেরিকা ও ন্যাটোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যুক্তিসঙ্গতই। তিউনিসিয়া ও মিশরের জনগণ যখন একইকারণে তাদের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তখন ন্যাটো ও আমেরিকা নিরব ছিলো। সেই আমেরিকাই গদ্দাফির বিরুদ্ধে লিবিয়ার মানুষের বিদ্রোহকে অর্থ, অস্ত্র ও পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছিল মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে। এই সাহায্য দিয়েছিল লিবিয়ার মানুষের মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে। ওসামাকে হত্যা করেও ওই মানবাধিকারের দোহাই পেড়েছিল। তিউনিসিয়া ও মিশরের ক্ষেত্রে আমেরিকা নিরব ছিল, কারণ ওই দুটি দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধানগণ ছিলেন আমেরিকার অনুগত। সুতরাং মানবাধিকারের প্রশ্নে আমেরিকা যে সর্বদা সুবিধাবাদী নীতি ও অবস্থান নেয় তা বলা বাহুল্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মুসলিম সমাজের বুদ্ধিজীবী ও উলামার ভূমিকা কী স্বচ্ছ ও নীতিনিষ্ঠ? তাঁরা তো চোখ বুঁজে ছিলেন আমেরিকা যখন ভিয়েতনামের মাটিতে হাজার হাজার টন বোমা বর্ষণ করে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল। তাঁরাই তো সমর্থন করেছিলেন পাক-হানাদার বাহিনীকে যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা, ৩ লক্ষ নারীকে ধর্ষণ এবং অসংখ্য জনপদ ধ্বংস করেছিল। এরূপ আরো বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। সুতরাং মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নে তাদের ভূমিকাও স্বচ্ছ ও নীতিনিষ্ঠ নয়।
উলামা ও মুসলিম বুদ্ধিজীবিগণ কিন্তু তা অস্বীকার করেন। তাদের দাবি হলো তারা মানবাধিকারের প্রশ্নে সর্বদা সদর্থক ভূমিকা পালন করেন, কারণ ইসলাম নাকী সেই শিক্ষাই দেয়। তারা দাবি করেন যে ইসলাম ধর্মই পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও সকল প্রকার মানবাধিকারের প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছে। এ প্রসঙ্গে তারা ঠিক কী দাবি করেন তা শোনা যাক তাদের মুখেই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ও এপার বাংলার স্বনামধন্য মুসলিম বুদ্ধিজীবী ড.ওসমান গণি লিখেছেন –
“ইসলাম যেমন বিশ্বধর্মের শেষ সংস্করণ, আর মহানবী হযরত মহম্মদও [দঃ] তেমনি মানবতার শ্রেষ্ঠ উত্তরণ। … ইসলাম ‘ইন্সানিয়াৎ’ বা মানবতার যে সংজ্ঞা নিরূপণ করেছে তা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যেমন নেই, তেমনি কোন কাজের মধ্যেও নেই।”
[দ্রঃ মহানবী, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, পৃ: ৪২৪]
তিনি আরো দাবি করেছেন,
“মুহাম্মদ মানুষ তবে আল্লাহর রসুল/মানুষের মনুষ্যত্বের মানবতার ফুল।”
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ গৃহীত হয় ১৯৪৮ সালের ১০ই ডিসেম্বর। তার পূর্বে মানবাধিকারের স্পষ্ট ধারণা ছিল না, এবং ছিল না বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের পক্ষে সংগঠিত আন্দোলন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি ও কয়েক কোটি মানুষের প্রাণহানির বিভীষিকাময় পটভূমির ওপর ১৯৪৫ সালে তৈরি হয় রাষ্ট্রসঙ্ঘ। সদ্য গঠিত রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রথম অধিবেশনে মানবাধিকারের প্রশ্নে বিশদ আলোচনা হয় এবং একটি আন্তর্জাতিক পৃথক সনদ তৈরি করার নিমিত্তে গঠন করা হয় একটি পৃথক উপসমিতি। তারই ফলশ্রুতি হলো ওই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে মানবাধিকারের সুস্পষ্ট ধারণা, মানবাধিকার রক্ষার নিমিত্ত গঠিত মানবাধিকার সংগঠন ও মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনের বয়স মোটেই বেশি নয়।
বস্তুতঃ এটা আধুনিক সমাজ ও আধুনিক যুগের সৃষ্টি। এদিকে পৃথিবীতে সমস্ত ধর্মের [Religion] আবির্ভাব হয়েছে হয় প্রাচীনযুগে, না হয় মধ্যযুগে। ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে সবার শেষে এবং মধ্য যুগে, আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর আগে। সেই যুগটি ইতিহাসে অন্ধকার যুগ রূপে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। সেই যুগে ধর্মান্ধতা এতো তীব্র ছিল যে সেই ভয়ঙ্কর ধর্মান্ধতা প্রাচীনযুগের মানবসভ্যতার সব আলোটুকুই প্রায় শুষে নিয়েছিল, এবং দর্শন ও বিজ্ঞানের আলোক শিখাটি প্রায় নিভিয়েই দিয়েছিল। তেমনই এক গভীর অন্ধকার মধ্যযুগে ইসলামের আগমন ঘটেছিল। ফলে সেযুগের সমস্ত পশ্চাদপদ চিন্তা-ভাবনা নিয়েই তার আবির্ভাব ঘটবে- এটাই তো স্বাভাবিক। সেই ইসলামের পক্ষে কী মানবতা ও মানবাধিকারের পতাকা ওড়ানো সম্ভব? মানবতা ও মানবাধিকার নিয়ে উলামা ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ যা দাবি করেন তা কী বাস্তবে ঘটা সম্ভব? এসব প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করার জন্যেই এই নিবন্ধ।
এই প্রশ্নগুলির উত্তর সন্ধানের জন্যে আমাদের চোখ রাখতে হবে ইসলামি রাষ্ট্র, মুসলিম রাষ্ট্র [মুসলিমরাষ্ট্র মানে আমি বুঝি আধা গণতান্ত্রিক ও আধা ইসলামি রাষ্ট্র], অমুসলিম বিশ্বের সমাজ এবং শরিয়তি আইনের উপর। এ কাজে অনেক দীর্ঘ পরিসর প্রয়োজন যা একটা নিবন্ধে থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং এই নিবন্ধে যথাসম্ভব স্বল্প পরিসরে আলোচনা সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করা হবে। আলোচনা শুরু করার আগে বাংলাদেশের সাহিত্যিক আবুল ফজল মানবতা প্রসঙ্গে কী বলেছেন তা একটু দেখে নেওয়া যাক। ‘মানবতন্ত্র’ প্রবন্ধে মানবতার পক্ষে জোরালো সওয়াল করতে গিয়ে তিনি ধর্মের প্রসঙ্গ টেনেছেন। তিনি লিখেছেন-
“সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটা খুব ভালো করেই দেখা গেছে যে, ধর্ম বা সেক্যুলারিজম কোনোটাই মানুষকে বাঁচাতে পারে নি। … এখন ধর্ম আর সেক্যুলারিজমের উপর জোর দিতে গিয়ে আমরা সাধারণ মানবতাকে শুধু খাটো নয়, প্রায় মুছে ফেলেছি আমাদের জীবন থেকে। আমরা নির্ভেজাল মুসলমান বা নির্ভেজাল হিন্দু কীনা এ দাবীই আজ সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ। … নির্ভেজাল মানুষ হোক … এ দাবী কোথাও শোনা যায় না … পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে এ দাবী অনুপস্থিতিতেই বিশিষ্ট।”
এই যে নির্ভেজাল মানুষ হওয়া, যা খুবই জরুরী, এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা যে ধর্মই [Religion] তা বলা বাহুল্য। মানবতার গুণ অন্তরে ধারণ করতে হলে সকলকে আগে মানুষ ভাবা জরুরী। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ সকল মানুষকে নির্ভেজাল মানুষ না ভাবলে, আপন করে নিতে না পারলে মানবতা ও মানবাধিকারের পতাকা ধারণ ও বহন করা যায় না, সে পতাকা সমুন্নত রাখা তো দূরের কথা। আবুল ফজলের লেখায় ঠিক এই কথাটাই ফুটে উঠেছে। এ কথাটি যদি যথার্থ হয়, তবে উলামা ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের দাবিটি যথার্থ হওয়া সম্ভব নয়। শেষোক্ত দল যা দাবি করেন তা আদৌ যথার্থ কীনা তা জানার জন্যে ইসলামের ইতিহাস, মুসলিম সমাজের হাল-হকিকত এবং তাদের ধর্মগ্রন্থগুলি উপর চোখ রাখতে হবে।
ইসলামি রাষ্ট্রগুলির প্রতি চোখ রাখলে আমরা যা স্পষ্ট দেখতে পাই তা হলো এই যে, এই রাষ্ট্রগুলিতে অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অনেক বেশী। এটা সর্বজন সুবিদিত যে রাষ্ট্র ও মানবাধিকারের মধ্যে পারষ্পরিক সম্পর্ক বৈরিমূলক এবং রাষ্ট্রমাত্রই সাধারণ মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে সর্বাধিক। তবে একথা অনস্বীকার্য যে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে মানবতা ও মানবাধিকারের প্রধানশত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। এতদ্বসত্বেও এ কথা আমরা অস্বীকার করতে পারি না যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ যতটা মানবাধিকার ভোগ করেন তার এক শতাংশও ভোগ করার সুযোগ পায় না ইসলামি রাষ্ট্র ও মুসলিম রাষ্ট্রের। বিষয়টা বুঝে নিতে চোখ রাখা যাক সৌদি আরবের দিকে। বলা বাহুল্য যে সৌদি আরব একটি আদর্শ ইসলামি রাষ্ট্র এবং সমগ্র বিশ্বের সুন্নি মুসলমানদের কাছে সর্বোচ্চ আস্থা, বিশ্বাস ও সর্বাধিক শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত। এই দেশে নারীর ভোটাধিকার নেই [সম্প্রতি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে], নারীর গাড়ি চালানোর অধিকার নেই, বোরখা না পরে পথে বেরোনোর অধিকার নেই, পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ও সঙ্গ ছাড়া বাড়ির বাইরে পা ফেলার অধিকার নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। অমুসলিমদের ধর্মাচারণের অধিকার নেই, ধর্মীয় উপাসনালয় স্থাপন করার অধিকার নেই, ধর্মীয় শোভাযাত্রা বের করার অধিকার নেই, আরবের নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার নেই ইত্যাদি। চোরের হাত কেটে নিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়, ব্যভিচারীকে মাটিতে বুক পর্যন্ত পুঁতে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়। সৌদি আরবের বাদশার, সৌদি সরকারের ও ইসলামের সমালোচনা করার অধিকার নেই। এরূপ কোনো কাজের শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড। সৌদি আরবের এই আইনগুলি শুধু অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিকই নয়, চরম অসভ্য আইনও বটে।
বিশ্বব্যাপী মুসলিম সমাজে- সে ইসলামি রাষ্ট্র হোক, কিংবা মুসলিম রাষ্ট্র হোক, কিংবা অমুসলিম রাষ্ট্রই হোক-সর্বত্রই একটা সাধারণ ছবি আমরা দেখতে পাই। সে ছবি হলো- প্রতিনিয়ত নানা ইস্যুতে শ্রাবণের বর্ষার ধারার মতো ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের ফতোয়াবর্ষণ চলছে। সমগ্রবিশ্বে প্রতিদিন কতো যে ফতোয়া জারি হয় আক্ষরিক অর্থেই তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ফতোয়াগুলি অধিকাংশই এতোই অমানবিক, বর্বরোচিত ও পৈশাচিক হয় যে শোনামাত্রই রক্ত হিম হয়ে যায়। ফতোয়া জারি করা হয় মূলতঃ ইসলামি অনুশাসন লঙ্ঘন করার জন্যে। বর্বর এসব ফতোয়ায় চরম শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া ও তা কার্যকর ঘটনা কীভাবে ঘটে তার উদাহরণ দেওয়া যাক।
বাংলাদেশে রাজশাহী ও নওগাঁ জেলায় ২০০৪ সালে ২২ জনকে শরিয়া আদালত গঠন করে বিচারকার্য সম্পন্নের পর মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হয়। জামাত-উল-মুজাহিদিনের (জেএমবি) শীর্ষ নেতা সেকেন্ড ইন কমান্ডার মাওলানা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই পুলিশের কাছে ধরা পড়ে বলে যে,
“শরিয়া আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই ২২ জনের মৃত্যুদণ্ডের জন্য বিচারকরা [শরিয়া আদালতের কাজী] দায়ী নয়। তিনি আরো বলেন যে, এগুলো হত্যাকাণ্ড নয়, ‘কতল’। ”
[সংবাদ সূত্রঃ দৈনিক স্টেটসম্যান, ২৫.০৩.২০০৬]
বাংলাদেশ সরকার এই ফতোয়াগুলির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে নি। শুধু বাংলাদেশ সরকারই নয়, কোনো মুসলিম দেশর সরকারই কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। ২০০৫ সালে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার আক্রায় হাই মাদ্রাসার শিক্ষক মোরসেলিন মোল্লার বিরুদ্ধে স্থানীয় একটি পত্রিকায় একটি প্রগতিশীল নিবন্ধ লেখার জন্যে মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া জারি করা হয়। সেই ফতোয়া কার্যকর করার উদ্দেশ্যে তাঁর বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করে তাঁকে হত্যা করার চেষ্টাও করা হয়। পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধেও ওই একই ফতোয়া জারি করে তাঁকেও একইভাবে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। পুলিশ ওঁদের দুজনকে নিরাপত্তা তো দেয়ই নি, ঘুরিয়ে তাঁদেরকেই ওই প্রবন্ধ লেখা ও প্রকাশ করার জন্যে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। আমার বিরুদ্ধেও ওই একই বছর ওই একই ফতোয়া জারি করা হয়েছিল। আমাকেও পুলিশ নিরাপত্তা দেয় নি। আমার বিরুদ্ধে জারি করা মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়ার উল্লেখ করে ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া এবং আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্যে আবেদন জানিয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ জানিয়েছিলাম। পুলিশ আমার অভিযোগও নেয়নি। মুসলিম সমাজে সারাবিশ্বে এভাবেই অবাধে চলছে শরিয়া রাজ। মুসলিম যাজকদের ফতোয়ার শিকার অবশ্য অধিকাংশক্ষেত্রেই নারী।
মুসলিম জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ এখন দৈন্দিন ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও মুসলিম জঙ্গিদের কোনো না কোনো গ্রুপ হয় নাশকতামূলক কাজ করছে, না হয় সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ সংগঠিত করছে। আইএস [প্রথমে নাম ছিলো আইএসএল, তারপর নাম হয় আইসিস, এখন আইএস বা Islamic State] এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভয়ংকর সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। ইরাক ও সিরিয়ার বহু অঞ্চলই এখন আইএস -এর দখলে। তারা ইসলামি খেলাফত গঠন করেছে তাদের অধিকৃত অঞ্চলে। আইএস জঙ্গিরা ইহুদি, খ্রিস্টান, ইয়াজিদি ও শিয়া মুসলমানসহ কয়েকলক্ষ মানুষকে ইতোমধ্যেই হত্যা করেছে এবং সে হত্যালীলা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তাদের আক্রমণে ও ভয়ে প্রায় দেড় কোটি মানুষ স্বদেশ ত্যাগ করে পার্শবর্তী বিভিন্ন রাষ্ট্রে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। নাইজিরিয়ার অবস্থাও প্রায় অনুরূপ। দেশটি কার্যতঃ মুসলিম জঙ্গি সংগঠন ‘বোকো হারাম’- এর দখলে চলে গেছে। সেখানে ‘বোকো হারাম’ও গঠন করেছে ইসলামি খেলাফত। এছাড়া আল-কায়দা, মুসলিম ব্রাদারহুড, লস্কর-ই-তৈবা, জৈস-এ-মহম্মদ, হুজি, জেএমবি [জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ] প্রভৃতি আরো কতো যে মুসলিম জঙ্গি সংগঠন আছে তার ইয়ত্তা নেই। মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলির হিংস্রতা, বর্বরতা ও পৈশাচিকতা গোটাবিশ্বে আজ রীতিমতো ত্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসের সাথে একযোগে উচ্চারিত হচ্ছে ইসলামি সন্ত্রাসও।
মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ এসব ফতোয়া এবং জঙ্গি ও সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ডকে এককথায় অনৈসলামিক বলে উড়িয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলছেন। এদেশের মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দও ইসলামে সন্ত্রাসের স্থান নেই বলে বিবৃতি দিয়ে দায় সারছেন। সত্যিই কী তাই? সৌদি আরব ও অন্যান্য ইসলামি রাষ্ট্রগুলিতে যে ইসলামি আইনগুলি সেগুলিও কী অনৈসলামিক? তাহলে কারা সঠিক- যে সব ধর্মীয় নেতারা জিহাদে লিপ্ত এবং হত্যা ও রাহাজানিতে মত্ত তারা, নাকি এদেশের ধর্মীয় নেতারা ও বুদ্ধিজীবীগণ? সৌদি আরবসহ অন্যান্য ইসলামি রাষ্ট্রের ইমাম ও মুফতিগণ নাকী এদেশের মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ- কারা সত্যি কথা বলছেন? কে দিবে এসব প্রশ্নের সদুত্তর? সদুত্তর দিতে পারে কেবল শরিয়তি আইন ও ইতিহাস। শরিয়তি আইনের প্রধান দুটি উৎস হলো কোরান ও হাদিস। সুতরাং চোখ রাখা যাক কোরান-হাদিস ও ইতিহাসের পাতায়।
মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের দাবি- ইসলাম একটি উদারনৈতিক, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ধর্ম। ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে-মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণভাবে সহবস্থান করবে। তারা এর সপক্ষে কোরান থেকে কিছু আয়াত উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। সে রকম কয়েকটি আয়াত হলো-
“ধর্মের জন্য কোন জোর-জবরদস্তি নেই।”
[কোরান, ২:২৫৬]
“তোমার ধর্ম তোমার কাছে আমার ধর্ম আমার কাছে।”
[কোরান, ১০৯:৬]
“তোমাকে ওদের উপর জবরদস্তি করার জন্যে প্রেরণ করা হয় নি।”
[কোরান, ৫০:৪৫]
এরকম আয়াত কোরানে আর কয়েকটি মাত্র আছে, খুব বেশী নেই। এই আয়াতগুলি বলা বাহুল্য যে মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের দাবিকে অনেকটাই সঠিক বলে প্রমাণ করে। তৎসত্ত্বেও সত্যি কথাটি হলো এই যে ইসলামের আসল চিত্র কিন্তু এটা নয়। মক্কায় মুহাম্মদ যতোদিন ধর্মপ্রচার করেছেন ততোদিন তাঁর নীতি ছিল শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের পক্ষে। মদিনায় গিয়ে মুহাম্মদের আমূল পরিবর্তন ঘটে। তিনি নিজে সম্পূর্ণ পাল্টে যান এবং পাল্টে ফেলেন তাঁর ধর্মের নীতিও। সেখানে গিয়ে কিছূদিন পরেই বিধর্মীদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠেন। মুহাম্মদের এই অপ্রত্যাশিত আমূল পাল্টে যাওয়ার প্রমাণ আছে কোরান ও হাদিসের পাতায় পাতায়। বিধর্মীদের যে তিনি শত্রু বলে গণ্য করতে শুরু করেন তার সুস্পষ্ট সাক্ষ্য দেয় কোরান। একটি আয়াতের ভাষ্য হলো-
“অবিশ্বাসীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করো না, ওরা মুসলমানদের অমঙ্গল কামনা করে।”
[কোরান, ৩:১১৮]
এ ধরনের একই কথা বলা হয়েছে এই আয়াতগুলিতেও- ৪:১৪৪, ৫:৫১-৫৭, ৬০:১। অবিশ্বাসীদের সরাসরি শত্রুও বল হয়েছে এমন আয়াতও আছে। সে রকম একটি আয়াত হলো-
“… নিশ্চয় কাফেরগণ তোমাদের শত্রু।”
[কোরান, ৪:১০১]
এ রকম আর একটি আয়াতে বলা হয়েছে-
“যে আল্লাহর, ফিরিস্তাদের, রাসূলদের, জিব্রাইলের ও মিকাঈলের শত্রু হয়, [সে জানিয়া রাখুক] আল্লাহ কাফিরদের শত্রু।”
[কোরান, ২:৯৮]
কোরানে এরকম আরো অনেক আয়াত আছে। বিধর্মী মানেই শত্রু, আর শত্রুদের জন্যে যেসব ভয়ানক শাস্তির কথা বলা হয়েছে তা শুনলেই লোমকূপ খাড়া হয়ে ওঠে। কোরানে এ প্রসঙ্গে ঘোষণা করা হয়েছে-
“আমি অবশ্য তাহাদিগকে আগুনে প্রবেশ করাইব। যখন তাহাদের চর্ম দগ্ধ হইবে তখন তাহার বিনিময়ে তাহাদিগকে অন্য চর্ম দিব, যেন তাহারা শাস্তির আস্বাদপ্রাপ্ত হয়, নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রান্ত ও নিপুণ হন।”
[কোরান, ৪:৫৬]
অবিশ্বাসী তথা কাফেরদের প্রতি মুহাম্মদের এই কঠোর ও শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় ফুটে উঠেছে কোরানের আরো অনেক আয়াতে। শুধু পরকালে কঠোর শাস্তি প্রদানের ঘোষণা বা হুঁশিয়ারি দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি। যখন তিনি বিধর্মীদের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন তখন তিনি পার্থিব জগতেই ইহুদি ও কোরেশ সম্প্রদায়কে নৃশংস শাস্তি দিতে শুরু করেন। মক্কা বিজয়ের পর নীতি হিসেবে ঘোষণা করেন-
“নিশ্চয় আমি ইহুদি ও নাছারা সম্প্রদায়কে আরব উপদ্বীপ হতে বের করে দিব। শেষ পর্যন্ত মুসলমান ব্যতীত অন্য কাউকেও এ স্থানে থাকতে দিব না।”
[মুসলিম শরীফ, ১৯/৪৩৬৬]
অবশ্য বিধর্মীদের বিতাড়নের মতো ভয়ঙ্কর নৃশংস ও অমানবিক কাজ মুহাম্মদ শুরু করেছিলেন মক্কা বিজয়ের পূর্বেই। মদিনায় ইহুদিদের তিনটি গোষ্ঠী বাস করতো মুহাম্মদের জন্মেরও বহুকাল আগে থেকে। তাদের মধ্যে বানু কাইনুকা এবং বানু নাজির গোষ্ঠীকে মুহাম্মদ নির্বাসিত করেছিলেন যথাক্রমে ৬২৪ ও ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে। বানু কাইনুকা গোষ্ঠীকে বিতাড়নের পূর্বে তাদের মহল্লায় গিয়ে মুহাম্মদ কী বলেছিলেন সে কথা শোনা যাক হাদিসের ভাষ্য থেকেই। তিনি যা বলেছিলেন-
“তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর। তাহলে সুখে থাকবে। তোমরা জেনে রাখ নিশ্চয় দুনিয়া আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের। আর আমার ইচ্ছা এটাই যে, তোমাদেরকে আমি এ ভূখণ্ড থেকে বের করে দিব।”
[মুসলিম হাদিস, ১-৮ খণ্ড একত্রে, সোলেমানিয়া বুক হাউস, ঢাকা, হাঃ নং-১০৮৯]
এই হাদিস অন্যান্য সমস্ত সহিহ হাদিসেও আছে। তৃতীয় গোষ্ঠী বানু কুরাইজাদের সকল প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের হত্যা এবং নারী ও শিশুদের ক্রীতদাস বানিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছিল। ঘটনাটি সংক্ষেপে এরকম- ৬২৭ খ্রিস্টাব্দ খন্দক যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই মুহাম্মদ তাঁর শিষ্যদের বানু কুরাইজাদের ওপর আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। মুসলমানরা গিয়ে ওদের মহল্লা অবরোধ করে। বানু কুরাইজা গোষ্ঠীর লোকজন পনেরো দিন পর আত্মসমর্পণ করে তারাও বানু কাইনুকা এবং বানু নাজির গোষ্ঠীর মতো মদিনা ছেড়ে চলে যেতে সম্মতি প্রকাশ করে দূত মারফত মুহাম্মদের কাছে খবর পাঠিয়েছিল। সেই সঙ্গে তারা সকাতরে একটাই প্রার্থনা করেছিলো মুহাম্মদের কাছে, তিনি যেন দয়া করে তাদের হত্যা বা বন্দি না করে খালি হাতে মদিনা ত্যাগ করে চলে যাওয়ার অনুমতিটুকু দেন। কিন্তু মুহাম্মদ তাদের সেই প্রার্থনা শোনামাত্রই বাতিল করে দেন এবং বলেন যে, তাদের বিচার করা হবে। ‘কোরেশদের সঙ্গে খন্দক যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল’ এই মিথ্যা অভিযোগে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন মুহাম্মদ। সেই বিচারের রায় যেরকম ছিল-
“তাদের মধ্যেকার যুদ্ধের যোগ্য লোকদেরকে কতল করা হোক। আর তাদের নারী ও শিশুদের বন্দী করা হোক। তখন রাসূলে পাক [সাঃ] বললেন, তুমি আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ফায়ছালা করেছ।”
[সূত্রঃ মুসলিম শরীফ, ১-৮ খণ্ডে একত্রে, সোলেমানিয়া বুক হাউস, ঢাকা, হাঃ নং- ৪৪৪৬]
নৃশংস এই ঘটনাটি সম্পর্কে জেমস এম. আর্লন্ডসন লিখেছেন-
“In AD 627, Muhammad committed an atrocity against the last remaining major tribe of Jews in Medina: the Qurayza. He beheaded the men and the pubescent boys and enslaved the women and children. In doing this, he wiped an entire tribe “off the map” to use the language of the President of Iran, recently. The purpose of this article is full disclosure and straightforward analysis about early Islam. How and why did this atrocity unfold?”
সুত্র: Answering Islam
এই বর্বর নিধনকাণ্ড ও নির্বাসনকাণ্ডের উল্লেখ শুধু ইতিহাসেই নয়, উল্লেখ রয়েছে কোরান ও হাদিসেও। মুহাম্মদ মদিনা থেকে সমস্ত ইহুদিদের তাড়িয়ে দিতে পারলেও আরব ভূখণ্ডকে সম্পূর্ণ কাফেরমুক্ত করে যেতে পারেন নি। কারণ, মক্কা বিজয়ের [৬৩০ খ্রি:] মাত্র দু’বছর পরেই তিনি মারা যান। তিনি তাই মৃত্যুশয্যায় তাঁর অনুগামীদের আরব ভূখণ্ডকে সমস্ত মুশরিকদের [অমুসলমান] তাড়িয়ে আরবকে পবিত্র করার নির্দেশ দিয়ে যান। নির্দেশটি ছিলো এ রকম-
“কোন মোশরেক যেন আরবে থাকিতে না পায়।”
[দ্রঃ মৃত্যুর দুয়ারে মানবতা, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, পৃ-১৬]
আরবকে পবিত্র করার জন্যে সমস্ত বিধর্মীদের তাড়ানোর নির্দেশ কেন? কারণ, তারা অপবিত্র। কোরানের ৯:২৮ নং আয়াতে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় সমস্ত অমুসলিমদের অপবিত্র বলা হয়েছে-
“হে মুমিনগণ! মুশরিকরা নাপাক। এই বছরের পর তাহারা যেন মসজিদুল হারামে না আসে।”
মক্কা জয় করার পরের বছর [৬৩১ খ্রিস্টাব্দে] এই আদেশটি দেওয়া হয়েছিল।
উক্ত বাণী, নির্দেশ ও ঘটনাগুলি আমাদের অতি সহজেই নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয়-
এক) ইসলামি রাষ্ট্রগুলি শরিয়তি আইন মেনেই বিধর্মীদের সমস্ত প্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে।
দুই) মক্কায় যে নীতি নিয়ে মুহাম্মদ ধর্ম প্রচার করেন তা মদিনায় গিয়ে সম্পূর্ণ বর্জন করেন এবং বিধর্মীদের প্রতি কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেন ও তাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠেন।
তিন) মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ মুহাম্মদ মক্কার যে নীতিগুলি মদিনায় গিয়ে বর্জন করেন সেগুলিকেই ইসলামের নীতি বলে প্রচার করে মিথ্যাচার করছেন এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। এই মিথ্যাচার অজ্ঞতা হেতু নয়, তাঁরা সচেতনভাবেই তা করে আসছেন।
মুহাম্মদ কেবল মদিনার ইহুদিদের হত্যা ও নির্বাসিত করেই ক্ষান্ত হন নি। মদিনার বাইরেও ইহুদিদের ওপর তিনি অকথ্য অত্যাচার, লুঠতরাজ ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিলেন। সেই অত্যাচারগুলি মোটেই কম নৃশংস ছিল না। কী তার বীভৎস চেহারা ছিলো তা উপলব্ধিতে নেওয়ার জন্যে একটি ঘটনার উপর একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। ঘটনাটি ঘটে খায়বার নামক একটি ইহুদিদের ভূখণ্ডে। এটা ছিল একটি ভীষণ সমৃদ্ধ শ্যামল মরুদ্যান। মদিনা থেক ১০০ মাইল দূরে উত্তর-পশ্চিম দিকে এই মরুদ্যানে কুড়ি হাজার ইহুদি ধর্মানুসারী মানুষ বসবাস করতেন। স্বভাবতই তারা আর্থিক দিক থেকে বেশ স্বচ্ছল ছিলেন এবং কয়েকজন তো ছিলেন সেসময়ে আরবের সেরা ধনী। ধনসম্পত্তি লুঠ ও ইহদিদের নির্বংশ করার উদ্দেশ্যে মুহাম্মদ ১৬০০ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে ৬২৮ সালের মে মাসে একদিন খায়বারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এই বর্বরোচিত আক্রমণেরও একটা সাফাই দিয়েছিলেন মুহাম্মদ। সে সাফাই-এর বর্ণনা দিয়েছেন অধুনা বাংলাদেশের খ্যাতনামা কবি গোলাম মোস্তফা এই ভাষায়-
“ইহুদিদের চক্রান্তের কথা হযরতের নিকট পৌঁছাইতে বিলম্ব হইল না। গুপ্তচর পাঠাইয়া সন্ধান লইয়া তিনি জানিলেন, ইহুদিরা মদীনা আক্রমণের জন্যই আয়োজন করিতেছে। হযরত তখন আর নিশ্চেষ্টভাবে বসিয়া থাকা সমীচীন মনে করিলেন না। অনতিবিলম্বে তিনি চৌদ্দশত পদাতিক ও দুইশত অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া খায়বার অভিমুখে যাত্রা করিলেন।”
[বিশ্বনবী, পৃ: ২২৬]
খায়বারের ইহুদিরা মদিনা আক্রমণ করে মুসলমানদের ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছিল বলে মুহাম্মদ তাদের বিরুদ্ধে অভিযান করতে বাধ্য হয়েছিলেন- এটা নেহাতই একটা অজুহাত ছিলোমাত্র। সে কথা এখন থাক।
এদিকে খায়বারের ইহুদিরা ভাবতেই পারেন নি যে ১০০ মাইল দূর থেকে এসে মুহাম্মদ দস্যুদলের মতো ভোরের আলো ফোটার আগেই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। স্বভাবতঃই মুহাম্মদের বাহিনীর সঙ্গে তারা পেরে ওঠে নি। তবুও প্রতিরোধ করার চেষ্টা তারা করেছিলো, কিন্তু সেই অসমযুদ্ধে তারা পরাজিত হয়েছিল। ইহুদিদের বহু লোক নির্মমভাবে মুহাম্মদ ও তাঁর দলবলের হাতে নিহত এবং বহু লোক বন্দি হয়েছিল। বন্দিদের মধ্যে ছিলেন একটি দূর্গের [খায়বার মোট সাতটি দুর্গ ছিলো] সেনাপতি যার নাম ছিলো কিনানা। কিনানার কাছে বানু নাজির গোষ্ঠীর [মদিনা থেকে নির্বাসিত] কোষাগারের চাবি ছিলো। তিনি চাবি দেন নি বলে মুহাম্মদের নির্দেশে মুসলমানরা তাঁর ওপর নারিকীয় অত্যাচার চালিয়ে তাঁকে হত্যা করে। খায়বারের ইহুদিদের ওপর দস্যুদের ন্যায় আচমকা হানা এবং কিনানার উপর সেই বীভৎস অত্যাচারের ঘটনার কিঞ্চিত ছবি ফুটে উঠেছে এই লেখায়-
“Ibn Ishaq in his narration of the conquest of Jewish town Khaibar reports that Muhammad, without warning, attacked this fortress town and killed its unarmed people as they were fleeing. Among the captured was Kinana, Kinana al-Rabi, who had the custody of the treasure of Banu Nadir, was brought to the apostle who asked him about it. He denied that he knew where it was. A Jew came, [Tabari says ‘was brought’] to the apostle and said he had seen kinana going to a certain ruin every morning early. When the apostle said to Kinana, ‘Do you know that if we find you have it [the treasure] I shall kill you. He said, ‘yes’.
The apostle gave orders that the ruin was to be excavated and some of the treasure was found. When he asked him about the rest [of the treasure?] he refused to produce it, so the apostle gave orders to al-Zubayr Al-Awwam, ‘Torture him until you extract what he has.’ So he kindled a fire with flint and steel on his chest until he was nearly dead. Then the apostle delivered him to Muhammad b. Maslama and he struck off his head, for revenge of his brother Mahmood.”
[Vide– Understanding Muhammad, Ali Sina, p – 33]
প্রসঙ্গতঃ এটা উল্লেখ্য যে উক্ত বর্ণনা আলি সিনার নিজস্ব নয়। তিনি ‘Sirat Rasul Allah, p- 515′ থেকে এই কথাগুলি উদ্ধৃত করেছেন। মুহাম্মদ খায়বার থেকে অঢেল ধনরাশি ও মূল্যবান সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে এসেছিলেন এবং নিয়ে এসেছিলেন বহু ইহুদি নর-নারীদের বন্দি করে ক্রীতদাসরূপে। কিছু লোককে রেখে এসেছিলেন খায়বারের চাষবাস ও উৎপাদন ব্যবস্থা বহাল রাখার জন্যে। তারা যেহেতু স্বধর্ম ত্যাগ করে নি তাই তাদের ওপর বাৎসরিক কর ধার্য করা হয়েছিল। ইসলামের ইতিহাসে সেই প্রথম অমুসলিমদের উপর ‘জিজিয়া কর’ আরোপ করা হয়েছিল তাদের জীবনের নিরাপত্তার বিনিময়ে।
ইসলাম মুরতাদদের হত্যা করার বিধান দিয়েছে। যারা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে তাদের ইসলামের পরিভাষায় মুরতাদ বলা হয়। মুরতাদদের শাস্তি প্রসঙ্গে একটি হাদিসে বলা হয়েছে-
“নবী করিম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম এর হুকুম রয়েছে, কেউ দ্বীন বদলে ফেললে তাকে হত্যা কর।”
[বোখারী শরীফ, ১-৭ খণ্ডে একত্রে, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, হাঃ নং ৩২৫৫]
মুহাম্মদ স্বয়ং কতো নৃশংসভাবে মুরতাদদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিলেন তা আমরা জানতে পারি হাদিস থেকে। হাদিসটি এ রকম-
“‘উকল’ গোত্রভুক্ত আটজন ব্যক্তি মহম্মদের নিকট এসে ইসলাম গ্রহণ করে। তাঁরা একটি অসুখে ভুগছিল। মুহাম্মদ ওদেরকে বলেন যে উটের দুধ ও মূত্র পান করলে অসুখটা ভালো হয়ে যাবে, তোমরা এখানে উটের রাখালদের কাছে থেকে যাও। কিছুদিন পর ওরা সুস্থ হয়ে উঠল এবং কয়েকটি উট চুরি করে পালিয়ে গেল। মুহাম্মদ ওদের ধরে আনতে লোক পাঠালেন। তারা ওদেরকে ধরে নিয়ে এসে মুহাম্মদের কাছে সমর্পণ করলো। মুহাম্মদ ওদের বলেন যে, তোমরা দু’টি অপরাধ করেছো- প্রথমতঃ তোমরা ইসলাম ত্যাগ করেছো এবং দ্বিতীয়তঃ উট চুরি করেছো। তারপর তিনি ওদের হাত ও পায়ের রগ কেটে নিলেন এবং গরম রড ঢুকিয়ে চোখ দুটি উপরে ফেললেন। তারপর গণগণে আগুনে রোদে তপ্ত বালির উপর ফেলে দিলেন। ফলে ওরা অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মারা গেলো।
[দ্রঃ বোখারী শরীফ, ১-৭ খণ্ডে একত্রে, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, হাঃ নং ৩১৬৭ – ৩১৬৯; এবং মুসলিম হাদিস, ১-৮ খণ্ড একত্রে, সোলেমানিয়া বুক হাউস, ঢাকা, হাঃ নং- ৪২০৮ – ৪২১১]
বিধর্মীদের লুঠ করা জিনিশপত্র নিতে মুসলিমদের মধ্যে আপত্তি ছিল। মুহাম্মদ তাদের এই নৈতিক মূল্যবোধকে নষ্ট করেন আল্লাহর দোহাই দিয়ে। তিনি একটি আয়াত আবৃতি করে বলেন যে শত্রুদের লুণ্ঠন করা ধন-সম্পদ [গণিমতের মাল] তোমাদের জন্যে বৈধ। তিনি আর একটি আয়াত আবৃতি করে মুসলমানদের জানিয়ে দেন তারা গণিমতের মালে কে কতো ভাগ পাবে। আয়াত দুটো হলো-
“যুদ্ধে যা তোমরা লাভ করেছো তা উত্তম ও বৈধ বলে ভোগ করো। আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।”
[কোরান, ৮:৬৯]
“যুদ্ধে যা তোমরা লাভ করো, তার এক-পঞ্চামাংশ আল্লাহর ও রসুলের, এবং রসুলের আত্মীয়-স্বজন ও পিতৃহীন ইয়াতীম ও দরিদ্র এবং পথিকদের জন্য।”
[কোরান, ৪:৪১]
বাকি চার-পঞ্চমাংশ যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে তাদের। যুদ্ধলব্ধ ধন-সম্পদের মধ্যে যুদ্ধবন্দী পুরুষ, নারী ও শিশুরাও অন্তর্ভুক্ত। তাদেরও ওই একই অনুপাতে ভাগ-বণ্টন করার নির্দেশ দিয়েছে আল্লাহ এবং সেভাবেই তাদের বণ্টন করা হতো।
‘গণিমতের মাল‘- এর ঘৃণ্য তত্ত্বটির ইসলামের বিজয়ের পশ্চাতে বিরাট অবদান রেখেছিল। এরই আকর্ষণে মুসলিমদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং তারা দরিদ্র থেকে দ্রুত সম্পদশালী হয়ে ওঠে। মুহাম্মদের জীবনী পর্যালোচনা করলে এ ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যাবে। তিনি যে ভীষণ দরিদ্র ছিলেন তা সর্বজনবিদিত। দারিদ্রতার কারণে তিনি খাদিজার [মুহাম্মদের প্রথম স্ত্রী] অধীনে কর্মচারীর কাজ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই মুহাম্মদ মক্কা বিজয়ের বছর [৬৩০ খ্রিস্টাব্দে] একাই ১০০টি উট কোরবানি দিয়েছিলেন।
‘গণিমতের মাল বৈধ’- এই তত্ত্ব উদ্ভাবন করে ও নির্মমভাবে তার প্রয়োগ করে মুহাম্মদ মানবসমাজের ইতিহাসে একটি কুৎসিত অধ্যায় যুক্ত করে গেছেন। একদল স্বাধীন পুরুষ মানুষকে কেবল ইসলাম গ্রহণ না করার কারণে ক্রীতদাস বানিয়ে তাদের উপর শাসন-শোষণ, ধর্ষণ ও নির্যাতন চালানো এবং নারীদের ক্রীতদাসী বানিয়ে স্ত্রীরূপে যথেচ্ছ ভোগ করাকে আল্লাহর নামে বৈধতা দেওয়া হয়েছে এই তত্ত্বে। মানবসমাজের ইতিহাসে ধর্মের নামে মানুষকে ক্রীতদাস বানানো এবং তাদের ওপর এমন দুঃসহ অত্যাচার-নির্যাতন চালানোর মতো বর্বর ও পৈশাচিক ঘটনা খুবই বিরল। ইসলামের এই জঘন্য ও কুৎসিত আইন ও অধ্যায়টিকে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা সচরাচর আড়াল করে থাকেন, নতুবা যুদ্ধের একটি অঙ্গ হিসেবে এটিকে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু এই বুদ্ধিজীবীরাই আবার ইসলামের ‘মানবতা’র মাহাত্ম প্রচারে সর্বদা অতিশয় উচ্চকণ্ঠ। তাঁরা দাবি করেন যে, ইসলামি মানবতাই আদর্শ মানবতা এবং মানবতার শ্রেষ্ঠ ও শেষ নিদর্শন।
বিধর্মী ও ধর্মত্যাগী মুসলমানদের প্রতি ইসলামের এই অসহিষ্ণু, কঠোর ও অমানবিক নীতি ও ভূমিকা কেবল তাদের ক্ষেত্রেই যে সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়। আসলে চরিত্রগতভাবে ইসলাম হলো একটি অসম্ভবরকমের সঙ্কীর্ণ, উগ্র, অসহিষ্ণু, উদ্ধত, সহিংস ও অমানবিক ধর্ম। শুধু বিধর্মী বা ধর্মত্যাগী মুরতাদদের প্রতিই নয়, প্রায় একইরূপ কঠোর, নির্মম, হিংস্র, অমানবিক ও স্বৈরাচারী নীতি আমরা দেখতে পাই মুসলমানদের প্রতিও। শরিয়তি ফৌজদারী আইনগুলিই তার প্রমাণ। চুরি, ব্যভিচার, কিসাস প্রভৃতি অপরাধের শাস্তিগুলি শরিয়তে আইনে ভীষণ কঠোর, মানবতাবিরোধী ও মানবাধিকারের পরিপন্থী। যেমন, চোরের শাস্তি-
“পুরুষ কিংবা নারী চুরি করিলে তাহার হস্তচ্ছেদন কর, ইহাই উহাদের কৃতকর্মের ফল, এবং আল্লাহর নির্ধারিত দণ্ড।”
[কোরান, ৫:৩৮]
ব্যভিচারের শাস্তি একশো বেত্রাঘাত থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত। বিবাহিতা নারী হলে তাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে হত্যা করার বিধান আছে। কয়েকবছর আগে আশতিয়ানি নাম্নী একজন নারীকে ব্যভিচারের অভিযোগে ইরানের সর্বোচ্চ আদালত মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছিল। আদালতের এই রায় কাজীর [বিচারকের] মনগড়া রায় মোটেই নয়। এই শাস্তির কথা স্বয়ং মুহাম্মদই বলে গিয়েছেন। মুহাম্মদ ঠিক কী বলেছেন এবার তা শোনা যাক-
“… রেওয়াতকারী বলেন, … তারপর ওহি নাজেল শেষ হলে তিনি বলেন, তোমরা আমার নিকট হতে গ্রহণ কর, নিশ্চয় আল্লাহপাক স্ত্রীলোকদের জন্য একটি পথ বের করে দিয়েছন। কোন বিবাহিত পুরুষ কোন বিবাহিত মহিলার সাথে এবং কোন অবিবাহিত পুরুষ কোন অবিবাহিত মহিলার সাথে ব্যভিচার করলে বিবাহিত পুরুষ ও মহিলাকে একশো চাবুক মারো, তারপর প্রস্তরাঘাতে হত্যা করে ফেল। আর অবিবাহিত পুরুষ ও মহিলাকে একশতো করে চাবুক মারো তারপর এক বছরের জন্য দেশত্যাগী কর।”
[মুসলিম হাদিস, ১-৮ খণ্ড একত্রে, সোলেমানিয়া বুক হাউস, ঢাকা, হাঃ নং- ৪২৭১]
সমকামিতা কোনো অপরাধ নয়। কিছু কিছু মানুষ পুরুষ ও নারী নির্বিশেষে সমকামি হতেই পারে, এতে কোনো দোষ নেই। ঈশ্বর বিশ্বাসীগণ যেমনটা ভাবেন যে এটা প্রকৃতির স্বভাব-বিরুদ্ধ বিকৃত কাম, বিজ্ঞান বলছে, না, মোটেই তা নয়। বিজ্ঞানের এই গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সমকামিতাকে পৃথিবীর বহু দেশই স্বীকার করে নিয়েছে। সেসব দেশে সমকামিতা এখন সম্পূর্ণ আইনসিদ্ধ। ফলে সমকামিরা এখন একসঙ্গে থাকতে পারে এবং সহমতের ভিত্তিতে পরষ্পরকে বিয়ে করতেও পারে। কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্রগুলি ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলি এখনও সমকামিতাকে স্বীকৃতি দেয় নি এবং সমকামিতাকে কঠিন দণ্ডযোগ্য অপরাধ বলে আইন বহাল রেখেছে। এসব দেশে শরিয়তি আইনের ভিত্তিতে সমকামিতার শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড। শরিয়তি আইনের ১৩৯ নং ও ১৪০ নং ধারা অনুসারে সমকামিতার শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড। ১৩৯ নং ধারায় যা আছে-
“[ক] পুরুষের সহিত পুরুষের সঙ্গমকে ‘লাওয়াতাত’ [সমকামিতা] বলে।
[খ] লাওয়াতাত-এ লিপ্ত অপরাধী তাযীরের আওতায় শাস্তিযোগ্য হইবে; কিন্তু বারবার উক্ত কার্য সংঘটনকারী মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি ভোগ করিবে, সে বিবাহিত বা অবিবাহিত যাই হোক।”
[সূত্র: বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন, প্রথম খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ]
শরিয়তি এই আইনটির ভিত্তি হলো কোরান। কোরান বলছে-
“তোমরা তো কাম-তৃপ্তির জন্য নারী ত্যাগ করে পুরুষের নিকট গমন করো, সুতরাং তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী।”
[ কোরান, ৭:৮১]
আল্লাহর কিসাস [সমান মাপের প্রতিশোধ] আইনটি আরো নিষ্ঠুর ও নৃশংস আইন। আল্লাহ এই আইনে বলছে-
“হে মুমিনগণ! নিহতের ব্যাপারে কিছাছ [কিসাস] ফরজ* করা হইল স্বাধীন ব্যক্তির পরিবর্তে স্বাধীন ব্যক্তি, গোলামের পরিবর্তে গোলাম এবং নারীর পরিবর্তে নারী। কিন্তু তাহার ভাইয়ের পক্ষ হইতে কিছুটা ক্ষমা করা হইলে যথাযথ বিধি পালন করা এবং সততার সঙ্গে তাহার দেয় আদায় বিধেয়। ইহা রবের পক্ষ হইতে লাঘব ও রহমত স্বরূপ। ইহার পরও যে সীমালঙ্ঘন করে তাহার জন্য যন্ত্রণাময় শাস্তি।”
[কোরান, ২:১৭৮]
অন্যায়ভাবে সুস্থ বিবেকে কেহ কাহাকে হত্যা করলে বিনিময়ে হত্যাকারীকে হত্যা করাই কিছাছ। [এই তফসিরটির সূত্রঃ শাহনুর বঙ্গানুবাদ কুরআন শরীফ, রহমানিয়া লাইব্রেরি, ঢাকা] এই আয়াতে অর্থের বিনিময়ে ক্ষমা করার যে বিধানটি রয়েছে সেটা কিন্তু খারিজ করে দেওয়া হয়েছে ঠিক তার পরের আয়াতেই। সেখানে আল্লাহ বলছে-
“তোমাদের জন্য বিনিময় হত্যাতেই জীবন, হে বুদ্ধিমান লোক সকল, তাহা হইলে তোমরা রক্ষা পাইবে।”
[কোরান, ২:১৭৯]
এই আয়াতটির ধোঁয়াশা স্পষ্ট করে প্রাঞ্জলভাবে বাখ্যা করা হয়েছে এর তফসীরে। সেখানে বলা হয়েছে-
“বিচারকদের উচিত হত্যার বদলে হত্যা করতে ত্রুটি না করেন।”
[দ্রঃ- ভাই মৌলবী গিরিশচন্দ্র সেন অনুবাদিত কুরআন শারীফ]
মানবতা বা মানবাধিকারের বালাই নেই আল্লাহর এই কিসাস আইনে, আল্লাহ আর একটি আয়াতে মুসলিমদের আরো স্পষ্ট করে প্রতিশোধ নিতে নির্দেশ দিচ্ছে-
“যে তোমাদের উপর আক্রমণ করে তোমরাও তাহার ওপর অনুরূপ আক্রমণ করিবে। আল্লাহকে ভয় কর এবং জানিও যে আল্লাহ মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন।”
[কোরান, ২:১৯৪]
মুসলিম ব্যক্তিগত আইনেও মানবতা, মনুষ্যত্ব, ও মায়া-মমতার স্থান নেই বনলে অত্যুক্তি হয় না। মুসলিম বিবাহ ও তালাক আইনটি যেমন অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক, তেমনি নারীর পক্ষে অবমাননাকরও। এই আইনে মুসলিম নারীর কোনো নিরাপত্তা নেই। এই আইনটি পুরুষকে যার পর নাই ক্ষমতাবান করেছে। পুরুষগণ যতো খুশি বিয়ে করতে ও যখন খুশি তালাক দিতে পারবে। ইসলামি তালাক আইনটি কতো কুৎসিত ও অমানবিক তা বোঝানোর জন্যে ভারতের তিনটি ঘটনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
প্রথম ঘটনা:
উত্তর প্রদেশে প্রৌঢ় বয়সে শাহবানু নাম্নী একজন মুসলিম মহিলা বিতাড়িত হয়েছিলেন পতিগৃহ থেকে। তিন বছর অপেক্ষা করলেও তাঁকে তাঁর পতি যখন ফিরিয়ে নেয় নি তখন তিনি ভরণ-পোষণের মামলা করেন। আল্লাহর আইনে তালাকপ্রাপ্তা মুসলিম নারীর খোরপোষ পাওয়ার অধিকার নেই। আইনের এই সুযোগ নিতে তাই তাঁর পতি তাঁকে পত্রযোগে তালাক দেন এবং আদালতে সে কথা জানিয়ে মামলাটি খারিজ করে দেবার আর্জি জানান। আদালত কিন্তু তাঁর আর্জি প্রত্যাখান করে ১২৫ নং ধারা প্রয়োগ করে শাহবানুর পক্ষে খোর-পোষের একটি ঐতিহাসিক রায় দেন। ভারতের মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতাগণ তখন এই রায়কে মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ বলে রায়টি বাতিলের দাবি জানান। তৎকালীন [১৯৮৫ সাল] প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধী ধর্মীয় নেতাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে সংসদে আইন তৈরি করে রায়টি নস্যাৎ করে দেন।
দ্বিতীয় ঘটনা:
উত্তর প্রদেশের ইমরানা নামক একটি মুসলিম নারী ধর্ষিত হয়েছিলেন তাঁর শ্বশুরের কাছে। মুফতিরা ফতোয়া দেন ইমরানার তালাক হয়ে গেছে, এবং যেহেতু সে ধর্ষিতা হয়েছে তাই তাকে তার শ্বশুরকেই বিয়ে করতে হবে। এই ফতোয়ায় তখন ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। জনমানসে এরূপ ধারণা হয়েছিল যে, ফতোয়াটি নিশ্চয় ইসলামসম্মত নয়। কিন্তু দেওবন্দ উলুম মাদ্রাসার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল ফতোয়াটি বৈধ।
তৃতীয় ঘটনা:
এটিও কুৎসিত ও হৃদয়বিদারক। উত্তর প্রদেশেরই গুঁড়িয়া নামের একটি মুসলিম মেয়ের বিয়ে হয়েছিল একজন ভারতীয় সৈনিকের সঙ্গে। ছেলেটিকে বিয়ের পরপরই কার্গিল যুদ্ধে গিয়ে পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে। পাক সরকার তাকে জেলে বন্দি করে রাখে। কিন্তু ভারতের সেনাবাহিনী এই খবরটি জানতে পারে নি। ফলে সকলের ধারণা হয়েছিলো যে সে মারা গেছে। এটা ধরে নিয়ে চার বছর অপেক্ষার পর গুঁড়িয়ার আবার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এই বিয়ের কয়েকমাস পরেই পাক জেল থেকে মুক্তি পেয়ে গুঁড়িয়ার সেই প্রথম পতি বাড়ি ফিরে আসে। এদিকে ইতোমধ্যেই গুঁড়িয়ার গর্ভে সন্তান এসে গেছে। এই পরিস্থিতিতেও মুফতিগণ ফতোয়া দেন যে, দ্বিতীয় বিয়েটা রহিত হয়ে গেছে এবং গুঁড়িয়াকে তাঁর প্রথম স্বামীর কাছেই ফিরে যেতে হবে। গুঁড়িয়ার তাতে প্রবল আপত্তি ছিল। তার আপত্তি অগ্রাহ্য করে ফতোয়া কার্যকর করা হয় এবং গুঁড়িয়াকে বলপ্রয়োগ করেই তাঁর প্রথম স্বামীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। নারীত্বের এই অবমাননা সহ্য হয়নি গুঁড়িয়ার। তিনি মানসিক যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে গুরুতর একটি পীড়ায় আক্রান্ত হন এবং কিছুদিনের মধ্যেই মারা যান।
ঘটনা তিনটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তালাক আইনটি এমনই যে মুসলিম নারীদের তালাক সামান্য কারণেই, কখনও বিনা কারণেও ঘটে থাকে। পুরুষরা কারণে ও অকারণেও স্ত্রীদের তালাক দিতে পারে। এর ফলশ্রুতিতে লক্ষ লক্ষ মুসলিম নারী তালাকের শিকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। এই কুৎসিত তালাক আইন ছাড়াও মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের অন্য বিধি-বিধানগুলিও এতো কুৎসিত, যা মুসলিম নারীর জীবনকে আক্ষরিক অর্থেই দূর্বিসহ করে তুলেছে। এই ব্যক্তিগত আইনে হরণ করা হয়েছে নারীর সমস্ত স্বাধীনতা, অধিকার ও মান-মর্যাদা। প্রাক-ইসলাম যুগে যেমন আরবে নারীর অনেক অধিকার ও স্বাধীনতা ছিল। ইসলাম নারীকে গৃহবন্দী ও বোরখাবন্দী করে তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে। মুহাম্মদ আল্লাহর নামে নারীদের বলেছেন-
“তোমরা গৃহকোণে থাকবে। পূর্বের ন্যায় বেশভূষা করে বাইরে বেরোবে না।”
[কোরান, ৩৩:৩৩]
এই আয়াতটি প্রমাণ করছে নারী আগে পছন্দমতো সাজসজ্জা করে স্বাধীনভাবে বাইরে চলাফেরা করতে পারতো। সেই নারীকে ইসলাম বললো বাইরে যেতে হলে বোরখায় সর্বাঙ্গ ঢেকে নিতে হবে। [কোরান,৩৩:৫৯]
নারীকে নির্দেশ দেওয়া হলো তারা যেন পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ও সঙ্গ ছাড়া নিজেরা একাকী বাইরে না যায়। এই আদেশে নারীর স্বাধীনতাই শুধু হরণ করা হয় নি, তার মান-মর্যাদাও হরণ করা হয়েছে। আরও নানাভাবে ইসলাম নারীকে হেয়, অপমান ও অপদস্ত করেছে। ইসলামের চোখে নারী বিশ্বাসের অযোগ্য এবং এমনকী ক্ষতিকর প্রাণীর সমগোত্রীয়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়ে মুহাম্মদ নারীদের সম্পর্কে যেসব উক্তি করেছেন তা থেকে। শ্রবণ-অযোগ্য সেই উক্তিগুলির কয়েকটি হলো-
“তিনটি জিনিশের মধ্যে কুলক্ষণ আছে- স্ত্রীলোক, ঘর ও ঘোড়া”
“নারী সামনে দিয়ে গেলে নামাজ ভঙ্গ হবে”
“স্ত্রীকে গোপন কথা বললে কার্যসিদ্ধি হয় না”
“নারী নেতৃত্ব করলে মানবজাতির সর্বনাশ হবে”
“পুরুষের জন্যে নারীদের চেয়ে ক্ষতিকর ফিতনা আর কিছু রইলো না” ইত্যাদি।
মুহাম্মদ বলেছেন নারীকে স্পর্শ করা ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর, তিনি তাই পুরুষদের এভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন-
“অন্য নারীর কনুইয়ের স্পর্শ অপেক্ষা শুকরের ছিটানো জল অনেক উত্তম”
“অন্য নারীর স্পর্শ অপেক্ষা মাথায় ছুঁচ ফোটানো উত্তম”
“অন্য নারীর করতল স্পর্শ করলে তার করতলে জ্বলন্ত অঙ্গার স্থাপন করা হবে” ইত্যাদি।
ইসলাম নারীকে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিরূপে গণ্য করে এবং গণ্য করে ভোগ্যবস্তুরূপেও। কোরানে এ কথারও প্রমাণ রয়েছে। কোরান বলছে-
“নারী, সন্তান, রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য আর সুশিক্ষিত অশ্বরাজী, গবাদিপশু ও ক্ষেত-খামারের প্রতি আসক্তি মানুষের নিকট সুন্দর ও লোভনীয় করা হয়েছে, এসব পার্থিব জীবনের ভোগ্যবস্তু।”
[কোরান, ৩:৪৩]
নারীরা কীরকম ভোগ্যবস্তু তা আরও স্পষ্ট করে কোরান বলছে-
“তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র, তোমরা শস্যক্ষেত্রে যেভাবে খুশী গমন করতে পারো।”
[কোরান, ২:২২৩]
কোরানের এই আয়াত প্রসঙ্গে অর্থাৎ ‘যেভাবে’ বলতে কীভাবে তার ব্যাখ্যায় মুহাম্মদ বলেছেন-
“ইহুদিরা বলতো স্ত্রীর সাথে পিছনদিক থেকে সঙ্গম করলে সন্তান বক্রদৃষ্টিসম্পন্ন হয়, তাই আল্লাহ তা’আলা এ ভ্রান্ত ধারণা অপনোদন করে এ আয়াত অবতীর্ণ করেন, তোমাদের স্ত্রীরা হল তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্র- তোমরা যেভাবে ইচ্ছা গমন করতে পার।”
[ বোখারী শরীফ, ১ম-৭ম খণ্ড একত্রে, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, হাদিস নং- ১৮৬৯]
শুধু যেভাবে খুশিই নয়, মুহাম্মদ বলেছেন পুরুষ যখন খুশি, যে কোনো অবস্থায়ই নারীকে ভোগ করবে এবং নারী কখনই তা আপত্তি করতে পারবে না। মুহাম্মদ এ প্রসঙ্গে যা বলেছেন তা হলো-
“পতি যখনই পত্নীকে সঙ্গম করার জন্যে ডাকবে সে যেন তৎক্ষণাৎ পতির ডাকে সাড়া দেয়, এমনকী রান্নার কাজে উনুনে ব্যস্ত থাকলেও।”
পত্নী সাড়া না দিলে মুহাম্মদ তাকে প্রহার করার নির্দেশ ও অধিকারও দিয়েছেন পতিকে। এই আদেশ রয়েছে কোরানের এই আয়াতে-
“পুরুষগণ নারীদের কর্তা, … সতী নারী অনুগত, … যখন অবাধ্যতার ভয় কর তখন উপদেশ দাও, শয্যা বর্জন কর, প্রহার কর।”
[কোরান, ৪:৩৪]
‘পুরুষ নারীর কর্তা‘ এই কথায় নারী পাছে আহত ও ক্ষুব্ধ হয় তাই নারীকে কোরান সাবধান করে দিচ্ছে এভাবে-
“যা দিয়ে আল্লাহ তোমাদের কাউকে কারুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন তোমরা তার লালসা করো না। পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য, আর নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য।”
[কোরান, ৪:৩২]
মুহাম্মদ হয়তো আশঙ্কা করেছিলেন যে নারী পুরুষের ওই ডাকে সাড়া নাও দিতে পারে, তাই তিনি নারীকে পরলোকের শাস্তির ভয়ও দেখিয়েছেন। ভয় দেখানোর জন্যে তিনি নারীকে বলেছেন-
“যে নারীর প্রতি তার পতি অসন্তুষ্ট থাকে, তাকে দোজখের শাস্তি ভোগ করতে হবে।”
পাছে নারী এই কথায় গুরুত্ব না দেয় তাই তিনি বলেছেন,
“দোজখের অধিকাংশ বাসিন্দাই হলো নারী, যারা পতিসেবায় ত্রুটি করার জন্যে দোজখের শাস্তি ভোগ করছে।”
[দ্রঃ বোখারী শরীফ, ১ম-৭ম খণ্ড একত্রে, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, হাদিস নং- ১৪৬, ২১২৫]
ইসলাম নারীর মর্যাদা খাটো করেছে সাক্ষীর নিরিখেও। কোরান বলছে বিচারে নারীর সাক্ষী চলবে না, কারণ নারী বিশ্বাসযোগ্যই নয়। যদি একান্তই পুরুষ সাক্ষী না থাকে তবে একজন পুরুষের পরিবর্তে দুজন নারীর সাক্ষ্য লাগবে। [দেখুন কোরান, ২:২৮২] নারীকে এভাবে এতো বড়ো অপমান আর কেউ করেছে কীনা সন্দেহ।
মুসলিমরা দাবি করে যে, প্রাক-ইসলাম যুগে পৃথিবীর কোথাও নারীকে সম্পত্তির অধিকার দেয়া হতো না, ইসলাম নারীকে সে অধিকার দিয়েছে। এই দাবি সর্বৈব ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। মুহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খাদিজা ছিলেন মক্কার সবচেয়ে ধনী বণিক। মুহাম্মদের সঙ্গে বিয়ের আগে তাঁর তিনবার বিয়ে হয়েছিল এবং তাঁর তিনজন স্বামীই মারা গিয়েছিল। খাদিজা উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁর সেই পতিদের বিপুল সম্পত্তিসহ তাঁর পিতার অঢেল সম্পত্তি পেয়েছিলেন বলেই তিনি সবচেয়ে ধনী বণিক হতে পেরেছিলেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে প্রাক-ইসলাম যুগে আরবে সম্পত্তির ওপর নারীর অধিকার ছিল। মুহাম্মদ নারীর সেই অধিকার খর্ব করে দেন। শরিয়তি উত্তরাধিকার আইনে দু’জন নারী পাবেন একজন পুরুষের সমান অংশ।
এরূপ দাবি করা হয় যে আরবে প্রাক-ইসলাম যুগে বহু বিবাহের ব্যাপক প্রচলন ছিল, পুরুষ যতো খুশি বিয়ে করতে পারতো এবং যতো খুশি পত্নী রাখতে পারতো। ইসলাম সেই সংখ্যাকে চার-এ সীমিত করে নারীকে ব্যাপক মর্যাদা প্রদান করেছে। কিন্তু সেই সময়ের আরবের ইতিহাসে এই দাবির সপক্ষে কোনো জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায় না। ধরা যাক মদিনার কথা। মুহাম্মদ তো অনেক বিয়ে করেছিলেন। এতো বেশিসংখ্যক বিয়ে করেছিলেন যে, তার হিসেব কেউ রাখতে পারে নি। কতগুলো বিয়ে করেছিলেন তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ দেখতে পাই। বিভিন্ন তথ্য থেকে এটা আন্দাজ করা যায় যে, তিনি সর্বনিম্ন তেরো অথবা সর্বোচ্চ বাইশটি বিয়ে করেছিলেন। এতোগুলো বিয়ের মধ্যে তিনি মাত্র চারটি [প্রথম তিনটি ও মাঝে একটি] বিয়ে করেছিলেন মক্কায়, বাকি সব কয়টি বিয়ে করেছিলেন মদিনায়।
এক্ষেত্রে একটি বিষয় ভীষণ অবাক করে আমাদের, তা হলো, মদিনার কোনো মুসলিম মেয়ের সাথে মুহাম্মদের বিয়ে হয় নি। অবিশ্বাস্য ঘটনাটি কেনো ঘটেছিল? এই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি মদিনার একটি বিশেষ ঐতিহ্যকে তুলে ধরে বলে মনে করা হয়।
কী সেই ঐতিহ্য?
এক্ষেত্রে যে কথাটি আমাদের স্মরণে রাখতে হবে তা হলো, মুহাম্মদ মদিনায় গিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই সবচেয়ে ক্ষমতাবান, বিত্তবান ও মর্যাদাবান ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। এরূপ ব্যক্তিত্বের প্রতি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অধিকাংশ মানুষই আকৃষ্ট হয়ে থাকে। তাছাড়া তার একটি তীব্র আকর্ষণ ক্ষমতা ছিল, সেটা হলো তাঁর নবীত্ব। মুসলমানরা বিশ্বাস করতো যে নবীর স্ত্রীরা নিশ্চিতভাবেই জান্নাতবাসী [স্বর্গবাসী] হবে। এসবের ফলে মুহাম্মদের প্রতি নারীর আকর্ষণ তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা ছিলো না। এবং এটা যে ঘটেছিল তার প্রমাণ কোরানেও আছে। অনুরূপভাবে পুরুষরাও তাদের একজন মেয়ের সাথে মুহাম্মদের বিয়ে দেওয়ার জন্যে অনেকেই লালায়িত ছিল। সেটা এজন্যে যে, তার মেয়ে জান্নাতবাসী হবে এবং সে আল্লাহর নবীর শ্বশুর হবে। কিন্তু মদিনায় এমন ঘটনা ঘটেনি। এমনটা না ঘটার একটাই কারণ হতে পারে। তা হলো, মদিনায় বহু বিবাহের প্রচলন না থাকা। মদিনার মানুষের এই মহান ঐতিহ্যকে ধ্বংস করেছে ইসলাম।
ইসলামের বহুবিবাহ সম্পর্কে আর একটি মিথ চালু আছে। তা হলো, আগে পুরুষরা যতো খুশি স্ত্রী রাখতে পারতো, ইসলাম সেই সংখ্যাটা ‘চার-এ’ সীমিত করে একটা বৈপ্লবিক কাজ করেছে। এটা কেবলই মিথ, ইসলাম কোথাও বলেনি যে চারটির বেশি স্ত্রী একত্রিত করা যাবে না। মুহাম্মদ তো নিজেই তার সাক্ষী। শিয়া মুসলিমদের অভিমত হলো মুহাম্মদ যা করেছেন তা প্রত্যেক মুসলিমের জন্যে সুন্নত। অর্থাৎ মুসলিমদের কর্তব্য হলো মুহাম্মদের প্রত্যেকটি কাজকে অনুসরণ করে তাঁকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। বহুবিবাহ প্রসঙ্গে শিয়াদের কী অভিমত সে কথা কোরানের তফসির থেকে জানা যায়-
“কোন কোন শি’আর মতে তা নয়টি পর্যন্ত একত্রিত করা বৈধ। বরং কোন কোন শি’আর মতে তা নয়টির বেশি একত্রিত করলেও দোষ নেই। তাদের মতে কোন সংখ্যাই নির্ধারিত নেই। তাদের দলিল হচ্ছে রসূলুল্লাহ (সঃ)- এর কাজ। যেমন সহিহ হাদিসে রয়েছে, তাঁর নয়জন পত্নী ছিলেন। সহীহ বুখারী শরীফের মুআল্লাক হাদীসের কোন কোন বর্ণনাকারী এগারোজন বলেছেন।
(সূত্রঃ ইবনে কাসিরের তফসির, ৪র্থ-৭ম খন্ড, পৃ- ২৮০)
ইসলাম কোরানের যে আয়াতে [৪:৩] চারটির বেশি বিয়ে করা যাবে না বলা হয়, সেখানে এমন কথা বলাই হয় নি। বলা হয়েছে-
“…বরং আরও বহু স্ত্রীলোক রয়েছে তাদের মধ্যে তোমাদের পছন্দমত দুটি, তিনটি এবং চারটিকে বিয়ে কর।”
এখান চারটির বেশি বিয়ে করা অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ এমন কথা তো বলা হয় নি। এ প্রসঙ্গে আর একটা কথা উল্লেখ যোগ্য যে, ইসলাম পুরুষদের যতো খুশি উপ-পত্নী রাখাকেও বৈধতা প্রদান করেছে এবং স্বয়ং মুহাম্মদও বহু উপ-পত্নী রেখেছিলেন যা নিয়ে তাঁর দাম্পত্য জীবনে ভীষণ কলহ ও অশান্তির শেষ ছিল না। বহুবিবাহ ও যতো খুশি উপ-পত্নী রাখাকে বৈধতা দিয়ে ইসলাম নারীর মর্যাদা ও মানবাধিকারকে যেভাবে লঙ্ঘন করেছে তা মানবসভ্যতার ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।
কোনো সংশয় নেই যে, আরবের নারীরা যেসব অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করতো ইসলাম তা নির্মমভাবে হরণ করেছে। ইসলাম নারীকে মুক্তি তো দেয়ই নি, বরং তাদের গৃহবন্দী ও বোরখাবন্দি করে নিঃস্ব করে ছেড়েছে। তাদের চরম অসম্মান, হেয়, অপমান, লাঞ্ছিত ও উৎপীড়ন করেছে। আর যেটা করেছে তা হলো নারীকে অবাধে ভোগ করার যা যা বাধা ছিলো তার সবগুলি নিপুণতা ও নিষ্ঠুরতার সাথে নির্মূল করে দিয়েছে। সুতরাং কোনো সংশয় নেই যে শরিয়তি আইনে নারীর মানবাধিকারে জন্যে বিন্দুমাত্র স্থান নেই।
শরিয়তে কীভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে তা আলোচনা করার আরো বহু ক্ষেত্র রয়েছে। একটা নিবন্ধে তা সম্পূর্ণ আলোচনা করা সম্ভব নয়। আলোচনা তাই অসম্পূর্ণ রেখেই উপসংহারে বলতে চাই, এই ব্লগপোস্টে যে ছবিগুলি ফুটে উঠেছে তাতে এটা প্রমাণ করে যে, শরিয়তি আইনে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার এবং মানবতা ও মানবাধিকারের স্থান একেবারেই নেই। যাঁরা এরূপ দাবি করেন ‘ইসলাম একটি প্রকৃতই গণতান্ত্রিক ও মানবিক ধর্ম এবং ইসলাম হচ্ছে মানবতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ও মূর্ত প্রতীক’, তাঁরা এক ভয়ংকর মিথ্যা দিয়ে একটা [নির্মম] সত্যকে চাপা দিতে চান যা চরম মিথ্যাচারের নিদর্শন। এরূপ মিথ্যাচার মানবসমাজের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকর। মানবসমাজ ও মানবসভ্যতার কল্যাণে এই মিথ্যাচারকে উন্মোচন করা আমাদের সকলের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত।
প্রসঙ্গতঃ সবশেষে যে কথাটা বলা একান্ত আবশ্যক তা হলো- এই যে ইসলামে মানবতা ও মানবাধিকারে স্থান নেই- এই কথার অর্থ এই নয় যে অন্য সকল ধর্মে তা সুরক্ষিত আছে। মোটেই তা নয়। মানবতা ও মানবাধিকারের প্রশ্নে সমস্ত [ঈশ্বরকেন্দ্রিক] ধর্মই এক।
[নোট: নবযুগ ব্লগে প্রকাশিত আমার কোন লেখা নবযুগ ব্লগ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে অন্য কোন মাধ্যমে আংশিক বা অংশবিশেষ প্রকাশ করা নিষেধ]
আগস্ট ৮, ২০১৭; ৯:৪৯ পূর্বাহ্ন
সর্বাধিক চারটি বিয়ে করা যাবে এমন আইন বাধ্যতামূলক নয়। কোরানের মতে যদি বিবিদের মধ্যে সমতা বজায় রাখা না যায় তবে একাধিক বিবাহ করতে নিষেধ করা হয়েছে। অথবা একাধিক বিবি থাকলে যদি কারও বেলায় যথেষ্ট সময় দিতে সমস্যা হয় তখন তালাক দিয়ে বিবির সংখ্যা কমিয়ে ফেলার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু মহম্মদ নিজেই আয়েষা বেবিকে বিয়ে করার পর ৩৫ বছরের সাওদাবিবিকে তালাক দিতে চেয়েছিল কারণ বেবি আয়েষা আর বুড়ি সাওদার মধ্যে সমতা রেখে সংসার করা সম্ভব ছিলনা। সাওদাবিবি কিন্তু তালাকের বিরোধিতা করে এবং অসম অধিকার নিয়েই সংসারে থেকে যেতে রাজী হয়ে যায়। মহম্মদও আল্লার দরবার থেকে আয়াত নামিয়ে এই সমঝোতাকে বৈধতা দিয়ে ফেলে। এই আয়াত অনুযায়ী বিবিরা যদি সমান অধিকারের দাবী ছেড়ে দিয়ে আপোষে কোনো পথ মেনে নেয় সেক্ষেত্রে যত ইচ্ছা বিয়ে করা যাবে। আল্লার তাতে আপত্তি নেই।