৩
১৩২২ বার পঠিত
মধ্যযুগীয় মুসলিম বিশ্বে ‘হাশাশিন’ নামক এক ঘাতক গোত্রের উদ্ভব হয়, যারা ভাড়াটে গুপ্তহত্যাকারী হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। ধারনা করা হয় ‘হাশাশিন’ গোত্রের নাম থেকে ইংরেজি শব্দ ‘Assassin’ যার অর্থ গুপ্তঘাতক -এর উদ্ভব। নবি মুহাম্মদ কর্তৃক প্রতিপক্ষ ব্যক্তি, বিরোধীতাকারী ও সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে গুপ্তহত্যা পদ্ধতি এতটাই সফল ছিল যে, তা তার মৃত্যুর পরও ইসলামী রাজত্বের পরবর্তী সময়ে কার্যকর অস্ত্র হিসেবে ব্যাপক ব্যবহৃত হতে থাকে এবং আজও তা অব্যাহত রয়েছে।
বিরুদ্ধমতকে দমন ও বিনাশ করার জন্য মোক্ষম অস্ত্র হলো গুপ্তহত্যা। ইসলামের সূচনাকালে নবি মুহাম্মদ গুপ্তহত্যাকে প্রচণ্ডভাবে উৎসাহিত ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। আর এই গুপ্ত হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করার জন্য মুহাম্মদ কোরানের আয়াতও নাযিল করেছিলেন। অনেক ইসলামিক স্কলার এই বলে গুপ্তহত্যাকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেন যে,
“গুপ্তহত্যা ইসলামের স্বার্থে অবশ্যই করা যাবে, যদি না ইসলামিক সরকার শাসিত কোন দেশ না হয়।”
কী খোড়া যুক্তি!
নবি মুহাম্মদ কোরানের মাধ্যমে আয়াত নাযিল করেন এভাবে-
“সুতরাং যারা আখিরাতের বিনিময়ে পার্থিব জীবন বিক্রয় করে তারা আল্লাহ্র পথে জ্বিহাদ করুক এবং কেউ আল্লাহ্র পথে জ্বিহাদ করলে সে নিহত হউক অথবা বিজয়ী হউক আমি তাকে মহাপুরুষকার দান করবই“।
“কাফেররা চায় যে, তোমরা তোমাদের অস্ত্রে ও সরঞ্জামের ব্যাপারে অসতর্ক থাকো, যাতে তারা একযোগে তোমাদেরকে আক্রমণ করতে পারে“।
“হে ঈমানদারগণ! নিজেদের অস্ত্র তুলে নাও এবং পৃথক পৃথক সৈন্যদলে কিংবা সমবেতভাবে বেরিয়ে পড়“।
“কাজেই আল্লাহর কাছে যারা পার্থিব জীবনকে আখেরাতের পরিবর্তে বিক্রি করে দেয় তাদের জেহাদ করাই কর্তব্য। বস্তুতঃ যারা আল্লাহর রাহে লড়াই করে এবং অতঃপর মৃত্যুবরণ করে কিংবা বিজয় অর্জন করে, আমি তাদেরকে মহাপুণ্য দান করব“।
ইসলাম শুরুর সময় থেকে এ পর্যন্ত মুসলিম গুপ্তঘাতকদের হাতে কোটি কোটি মানুষের প্রাণসংহার হয়েছে। নবি মুহাম্মদের সময় থেকে এ পর্যন্ত যতো মানুষকে গুপ্ত হত্যা করা হয়েছে তাদের সকলেই ইসলাম ও নবি মুহাম্মদের মতের বিরোধী ছিলেন। অর্থাৎ নবি মুহাম্মদ তার জীবদ্দশা থেকেই তার বিরুদ্ধমতানুসারীদের গুপ্তহত্যার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। বর্তমান বিশ্বে উগ্রপন্থী মুসলিমদের কারণে গুপ্তহত্যা এক বহুমাত্রিক ধারনা লাভ করেছে। উগ্রপন্থী মুসলিমরা গুপ্তহত্যার মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল প্রতিপক্ষকে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে তাদের মতপ্রকাশকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে, যা ইসলামের অস্তিত্ব থাকা পর্যন্ত চলমান থাকবে বলে নিশ্চিত বোঝা যায়।
ইসলাম শুরুর প্রাক্কালে নবি মুহাম্মদ ইসলাম কায়েমের নামে যেসব সহিংস পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন তার মধ্যে গুপ্তহত্যা সবচেয়ে ভয়ংকর ও আগ্রাসী। মুহাম্মদের সময় যাদেরকে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল তারা সেসময় আরব ভূখণ্ডের অত্যন্ত মেধাবী মানুষ ছিলেন। যেমন-
আসমা বিন্তে মারওয়ান:
আসমা বিন্তে মারওয়ান ছিলেন আরব ভূখণ্ডের নামকরা কবি। তিনি ৫ সন্তানের জননী ছিলেন। মুহাম্মদের নির্দেশে ১২০ বছর বয়সী বৃদ্ধ আরব ভূখণ্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি আবু আফাককে গুপ্তহত্যার প্রতিবাদে মদিনার মতো শান্ত জনবসতিতে মুহাম্মদের মতো সহিংস ব্যক্তি ও তার হত্যাকারীদের যারা আশ্রয় দিয়েছিলেন, তাদের উদ্দেশে নিন্দা জানিয়ে আসমা বিন্তে মারওয়ান একটি কবিতা লিখেছিলেন। নবির অনুগতরা মুহাম্মদকে যখন জানায় যে আসমা এমন একটি কবিতা লিখেছেন।
প্রতিক্রিয়ায় নবি মুহাম্মদ বলেন-
“কে আছিস যে আমাকে মারওয়ানের কন্যার আপদ থেকে পরিত্রাণ দেবে?”
সে রাতেই মুহাম্মদের এক শিষ্য যার নাম উমায়ের, তিনি আসমা বিন্তে মারওয়ানের বাসায় অতি সন্তর্পনে প্রবেশ করে ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে তরবারি দিয়ে হত্যা করেন। আসমা বিন্তে মারওয়ানকে হত্যা করার সময় তার দুগ্ধ পানকারী শিশুটি আসমার বুকের উপর দুগ্ধ পান করছিলেন। উমায়ের অতি সতর্কতার সাথে শিশুটিকে মায়ের বুক থেকে সরিয়ে দিয়ে আসমার বুক বরাবর তরবারি চালিয়ে হত্যা করেছিল। এই ঘটনার পরদিন উমায়ের মুহাম্মদের সামনে গিয়ে আসমাকে হত্যা করার খবরটি জানায়।
প্রতিক্রিয়ায় মুহাম্মদ বলেছিলেন-
“তুমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে সাহায্য করেছো, হে উমায়ের”।
আবু আফাক:
১২০ বছর বয়সী বৃদ্ধ আবু আফাক ছিলেন আরব ভূখণ্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি। মুহাম্মদ কর্তৃক আল-হারিথ নামক এক প্রতিপক্ষ ব্যক্তিকে হত্যার নিন্দা করে তিনি একটি কবিতা লিখেছিলেন।
এর প্রতিক্রিয়ায় মুহাম্মদ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন,
“কে আছিস যে ওই দুবৃত্তকে শায়েস্তা করবে?”।
মুহাম্মদের কাছ থেকে আবু আফাককে হত্যা করার নির্দেশ পেয়ে গুপ্তহত্যার জন্য দক্ষ নবির শিষ্য সেলিম বিন উমায়ের গভীর রাতে কবির বাড়ি গিয়ে ঘুমন্ত আফাককে হত্যা করে।
কাব ইবনে আশরাফঃ
বদরের যুদ্ধে মুহাম্মদের হাতে মক্কার সম্ভ্রান্ত পরিবারের অসংখ্য সদস্য নিহত হবার শোকে ইহুদী কবি কাব ইবনে আশরাফ প্রচণ্ডভাবে মানসিক পীড়া অনুভব করছিলেন। তিনি আফসোস করে বলেছিলেন,
“মুহাম্মদ যদি তাদেরকে হত্যা করেই থাকে, ঈশ্বরের কসম, তাহলে বাঁচার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল”।
এর প্রতিবাদে তিনি একটি কবিতাও লিখেছিলেন। কাব ইবনে আশরাফকে গুপ্তহত্যা করার বিষয়ে বুখারী শরীফের হাদিসেও বর্ণনা করা আছে।
বুখারীর বর্ণনায়-
“আল্লাহর রাসুল বললেন, ‘কে আছিস যে কাব বিন আশরাফকে হত্যা করবে, যে আল্লাহ ও তার নবীকে পীড়া দিচ্ছে?’ সে কথা শুনেই মাসলামা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সে আল্লাহর রাসুল! আমি তাকে হত্যা করলে চলবে?’ মাসলামা আরও বলল, কাবকে হত্যা করার জন্য তাকে মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিতে হবে। এবং নবী তাতে অনুমতি দিলেন।”
এরপর এক রাতে কাব ইবনে আশরাফকে গুপ্ত হত্যা করা হয়।
আইহালা ইবনে কাব:
ইয়েমেন এলাকার আইহালা ইবনে কাব মুহাম্মদের সমালোচক ছিলেন। যিনি মুহাম্মদের অনুসারীদের কাছে আল-আসওয়াদ বা কালো ব্যক্তি নামে পরিচিত ছিলেন। মুহাম্মদের মৃত্যুর ঠিক একদিন আগে এক রাতের অন্ধকারে তাকে গুপ্তহত্যা করা হয়।
আবু সুফিয়ানঃ
ওহুদ যুদ্ধে চরম পরাজয়ের পর নবি মুহাম্মদ আমর বিন উমাইয়া আল-দামরী নামক এক শিষ্যকে নির্দেশ দেন আবু সুফিয়ানকে গুপ্ত হত্যা করতে। আবু সুফিয়ান ছিলেন মুহাম্মদের প্রতিপক্ষ, ওহুদ এবং বদর যুদ্ধে মক্কা বাহিনীর নেতা। তিনি মুহাম্মদের অনেকগুলো শশুরের মধ্যেও একজন। কিন্তু আবু সুফিয়ান অনেক সতর্ক থাকায় তাকে সেসময় হত্যা করতে ব্যর্থ হয়েছিল মুহাম্মদের গুপ্তহত্যাবাহিনী। আবু সুফিয়ানকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে হত্যাকারীরা ৩ জন কুরাইশকে হত্যা করে মুহাম্মদের কাছে ফিরে আসে।
নবি মুহাম্মদ তার জীবদ্দশায় অসংখ্য গুপ্তহত্যার আদেশ দিয়েছিলেন। যেগুলোর মধ্যে অনেকগুলিই সফল হয়েছে আবার কিছু গুপ্তহত্যার মিশন ব্যর্থও হয়েছে।
ইসলামের প্রবক্তা নবি মুহাম্মদ কর্তৃক গুপ্তহত্যার এই কৌশলটি আজও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপকভাবে চালু রয়েছে। যা আজও উগ্রপন্থী মুসলিমরা ইসলামের তথা মুহাম্মদের সমালোচনাকারীদের গুপ্তহত্যার মাধ্যমে নবির নির্দেশ পালনের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
সহায়ক গ্রন্থ:
1. ইবনে ইশহাক, The Life of Muhammad
2. Syed Amir Ali, The Spirit of Islam
3. হাদিস, সহিহ বুখারী
4. Benjamin Walker, Foundations of Islam
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
মার্চ ৯, ২০১৩; ৬:২১ অপরাহ্ন
তোকে জবাই করা সকল মুসলিমদের জন্য ফরজ হয়ে গেছে। তোর আর কোন ক্ষমা নাই। তুই যেখানেই থাকিস না কেন, তুই মারা পড়বিই ইনশাল্লাহ। আমিন।
মার্চ ১০, ২০১৩; ৫:৪৪ অপরাহ্ন
সত্য বললেই মুমিনরা জবাই করতে তেড়ে আসে।
নভেম্বর ১১, ২০২২; ১২:২৭ পূর্বাহ্ন
মূর্খ হলে যা হয় আরকি শুধুমাত্র কিছু অনুবাদ করে আসছে নিজেকে পন্ডিত ভাবতে!হাশাশিন বা হাশিশিন কোন ইসলামী সাম্রাজ্যের সামরিক বাহিনী ছিলনা বরং সেলজুক সালতানাতের সময় এদের উত্থান হয়েছিল মুসলিম সেলজুক প্রভাবশালী ব্যাক্তিবর্গকে হত্যা করেই! এমনকি সুলতান আল্প আরসলান ও ওদের হাতেই খুন হন।মালিক শাহ ওদের বিরুদ্ধে অভিযান ও পরিচালনা করেছিলেন।আর সবচেয়ে বড় কথা হাশাশিনরা ভাড়াটিয়া ছিল না বরং ওদের একজন নেতা ছিলেন এবং ওরা নিজেদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যই এসব গুপ্ত হত্যা করত।এর পরে যা বললেন আমাদের নবী সম্পর্কে সেটাও একটু বলি।ধরেন যদি কেউ আপনাকে মেরে ফেলতে চায় অথবা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তাহলে কি আপনি চুপ করে বসে থাকবেন নাকি? তৎকালীন মক্কা ও মদীনায় মুসলিমরা যে পরিমাণে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন সেটার প্রতিশোধ নিতে চাইলে মক্কা বিজয়ের দিনে একজন অমুসলিম ও জীবিত থাকত না।বিনা শর্তে ক্ষমা করার দৃষ্টান্ত ইতিহাসেই বিরল