ইসলামি দাস-ব্যবসা
ইসলামের আবির্ভাবে দাসপ্রথা এক নজিরবিহীন মাত্রায় উন্নীত হয়। সমগ্র ইসলামি বিশ্বে ক্রীতদাসরা একটা স্বাভাবিক পণ্যে পরিণত হয় এবং দাস-ব্যবসা পরিণত হয় সাধারণ ব্যবসায়িক উদ্যোগে। আগেই বলা হয়েছে, শরীয়া আইন ক্রীতদাসকে সাধারণ সম্পদ অথবা পণ্যের শ্রেণীতে স্থান দিয়ে তাদের শারীরিক যোগ্যতা অনুযায়ী দাম নির্ধারণের নিয়ম চালু করেছে। এছাড়া দাম নির্ধারনে যৌন আকর্ষণ ও অন্যান্য বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিওয়া হয়েছে। ‘ফতোয়া-ই-আলমগীরি’ নারী-ক্রীতদাস ক্রয়ের বিধান নির্দিষ্ট করেছে অতিবৃহৎ স্তন, অতি প্রশস্ত যোনি অথবা অক্ষত কুমারী কিনা সে ভিত্তিতে। উপরোক্ত আলোচনা অনুসারে, এসব বিধান নবির হাদিস ও তাঁর সম্মানিত অনুসারীদের দৃষ্টান্ত দ্বারা সমর্থিত।
ইসলামি দাস-ব্যবসার উৎপত্তি
ইসলামি ক্রীতদাস ব্যবসা শুরু হয় অস্ত্র ও ঘোড়া ক্রয়ের নিমিত্তে নবি-কর্তৃক ক্রীতদাস হিসেবে ধৃত বানু কোরাইজার কিছু নারীকে নাজদ-এ বিক্রি করে দেওয়ার মাধ্যমে। একান্তভাবে আল্লাহর পথে উৎসর্গীকৃত নবি মুহাম্মদ ও তার সদ্য গড়ে উঠা মদীনার মুসলিম সম্প্রদায় লিপ্ত হয়ে পড়ে বাণিজ্য-কাফেলা ও বিধর্মী সম্প্রদায়ের উপর হানা দিয়ে ডাকাতি ও লুটতরাজে, যা পরিণামে তাদের জীবনধারণের প্রধান উপায়ে পরিণত হয়। এসব অভিযানে তারা পুনঃপুনঃ ক্রীতদাস ধরতে থাকে, বিশেষত নারী ও শিশুদেরকে। সে সময় আরবে দাস-ব্যবসা তেমন বিস্তৃত ছিল না। সদ্য উদীয়মান মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য বন্দিকৃত ক্রীতদাসদেরকে খোলাবাজারে বিক্রি করাও নিরাপদ ছিল না। এ পরিস্থিতিতে নবি ক্রীতদাস বিক্রয়ের বিকল্পস্বরূপ রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যে বন্দিদের বিনিময়ে তাদের পরিবারের নিকট থেকে মুক্তিপণ দাবি করেন। নাখলার হামলা, বদরের যুদ্ধ ও অন্যান্য অভিযানের বন্দিদের ক্ষেত্রে এরূপে মুক্তিপণ আদায়ের মাধ্যমে নবি অর্থভাণ্ডার স্ফীত করেন। মুহাম্মদ হাওয়াজিন গোত্রের প্রতিজন বন্দি নারীর মুক্তিপণরূপে ছয়টি করে উট আদায় করেছিলেন, যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। পরে খলিফা ওমর ঘোষণা করেন যে, মুসলিম-মালিকানাধীন ক্রীতদাস অমুসলিমরা ক্রয় করতে পারবে না। এর অর্থ হলো: এরপর বন্দিকৃত কাউকে মুক্তিপণের মাধ্যমে ছাড়িয়ে নেওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়, পাছে তারা অমুসলিমদের হাতে পড়ে। এরপর থেকে তাদেরকে শুধু মুসলিমরাই কিনতে পারতো, যা নিশ্চিত করে যে, বন্দিরা কেবলমাত্র ইসলামের সীমার মধ্যেই থাকবে। এর ফলে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি দ্রুততর হয়।
বিক্রির জন্য ক্রীতদাস আটক
উত্তর আফ্রিকায় ধৃত ৩০০,০০০ ক্রীতদাসের মধ্য থেকে মুসা খলিফার অংশের ৬০,০০০-কে বিক্রি করে দেন। অবশিষ্টদের ৩০,০০০-কে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হয়; বাকিদেরকে তিনি তার যোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করে দেন, যারা তাদের অংশের কিছু সংখ্যককে বিক্রি করে দিতে পারে। ইবনে খালদুন (মৃত্যু ১৪০৬) তার নিজ চোখে দেখা মিশরীয় দাস-ব্যবসার বিবরণে লিখেন: ‘দাস-ব্যবসায়ীরা তাদেরকে দলবদ্ধভাবে মিশরে আনে এবং সরকারি ক্রেতারা তাদেরকে অনুসন্ধান করে দেখার জন্য সারিবদ্ধভাবে প্রদর্শণের পর দাম হাঁকায় প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি।’[১৮৫] সিন্ধুতে কাসিমের তিন বছরব্যাপী অভিযানে আনুমানিক ৩০০,০০০ ভারতীয়কে ক্রীতদাস করা হয়েছিল, যার এক-পঞ্চমাংশকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দামেস্কে খলিফার নিকট। খলিফা সম্ভ্রান্ত ও রাজকীয় পরিবারের সুন্দরী যুবতীদেরকে তার হেরেমের অন্তর্ভুক্ত করেন, কিছু সংখ্যককে দরবারের সম্ভ্রান্তদেরকে উপহার দেন; অনেককে তার রাজদরবারের নানা কাজে নিয়োগ করেন, এবং বাকি অংশকে অর্থভাণ্ডার বৃদ্ধিকরণের জন্য বিক্রি করে দেন।
খলিফা আল-মুতাসিম (মৃত্যু ৮৪২) ছিলেন ইসলামের ‘সুবর্ণ যুগ’ আনয়নের এক আলোকায়নকৃত অগ্র-পুরুষ। তিনি ৮৩৮ সালে আমোরিয়াম দখলের পর ৫ ও ১০ জনের দল করে ক্রীতদাস বিক্রি করেন। সুলতান মাহমুদ ভারতে লক্ষ লক্ষ ক্রীতদাস ধরে গজনীতে পাঠাতেন বিক্রির জন্য। ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি উয়াইহিন্দ থেকে ১০০২ সালে ৫০০,০০০; ১০১৫ সালে থানেসার থেকে ২০০,০০০; এবং ১০১৯ সালের অভিযান থেকে ৫৩,০০০ ক্রীতদাসকে ধরে নিয়ে যান। অধ্যাপক লালের হিসাব মতে, ভারতে তার অভিযানের মাধ্যমে হ্রাসকৃত ২০ লাখ লোকের একটা বড় অংশকে বন্দিরূপে নিয়ে যাওয়া হয়; অবশিষ্টদেরকে হত্যা করা হয়। এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, মোহাম্মদ গোরী ক্রীতদাসকরণের মাধ্যমে ৩০০,০০০ থেকে ৪০০,০০০ খোখারকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করেছিলেন। সুলতান মাহমুদ ও মোহাম্মদ গোরী উভয়েই বন্দিদেরকে গজনীতে নিয়ে যেতেন বিক্রি করার জন্য। আল-উতবি লিখেছেন: সুলতান মাহমুদের সময় গজনী দাস কেনা-বেচার এক বিশিষ্ট কেন্দ্রে পরিণত হয়, যেখানে ‘ক্রীতদাস ক্রয়ের জন্য বিভিন্ন নগরী থেকে ব্যবসায়ীরা আসে, যার ফলে মাওয়ারুন্নাহর, ইরাক ও খোরাসান ক্রীতদাসে ভরে উঠেছিল।’[১৮৬] ক্রীতদাস বিক্রির প্রথম ধাপের অর্থ চলে যেত রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। এরপর দাস-ব্যবসায়ীরা মুসলিম বিশ্বের দাসবাজারগুলোতে সেসব ক্রীতদাসের বেচাকেনা অব্যাহত রাখে।
১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লিতে সরাসরি মুসলিম শাসন শুরু হওয়ার পর ভারতের বিশাল পটভূমিতে অমুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানের সুযোগ ও ক্ষমতা বিশেষভাবে বেড়ে যায়। ফলে পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে ক্রীতদাসকরণের মাত্রা ও শিকারকৃত দাসের পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায় সম্রাট আকবর-কর্তৃক যুদ্ধে ক্রীতদাসকরণ নিষিদ্ধ হওয়া পর্যন্ত, যদিও আকবরের সে নিষেধাজ্ঞা কার্যকরকরণ তেমন সফল ছিল না। ১৬০৫ সালে আকবরের মৃত্যুর পর ক্রীতদাসকরণ ধীরে ধীরে পুনর্জাগরিত হয় এবং ধর্মান্ধ ও গোঁড়া সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে তা চরম পর্যায়ে পৌঁছে। ১৭৫৭ সালে থেকে ব্রিটিশ শাসনক্ষমতা সংহত হওয়ার সাথে সাথে ক্রীতদাসকরণ ও দাসপ্রথা দ্রুত ভারত থেকে অপসৃত হয়।
দিল্লিতে সুলতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে ক্রীতদাসদেরকে বিদেশের বাজারে প্রেরণের পরিবর্তে প্রধানত ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারেই সরবরাহ করা হতো। ফলে অবশ্যই মুসলিম-অধিকৃত ভারতীয় অংশের সর্বত্র ক্রীতদাস কেনা-বেচার বাজার ব্যাঙের ছাতার মতো ছড়িয়ে পড়ে। আমির খসরু সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সময়ে (১২৯৬-১৩১৬) লিখেছে: ‘তুর্কিরা যখন খুশি কোনো হিন্দুকে আটক, ক্রয় বা বিক্রি করতে পারতো।’ এ ক্রীতদাস কেনা-বেচা অবশ্যই দাস-বাজারে সম্পন্ন হতো। ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সুলতান আলাউদ্দিনের সময়ে দিল্লির ক্রীতদাস বাজারগুলোতে অবিরাম নতুন নতুন বন্দির দল এসে পৌঁছুতো। সুলতান মোহাম্মদ তুঘলকের সময়ে (মৃত্যু ১৩৫১) ইবনে বতুতা দিল্লির দাস-বাজারে ব্যাপক ক্রীতদাস সরবরাহের কারণে ক্রীতদাসদের মূল্য সস্তা হয়ে গিয়েছে দেখতে পান। শিহাবুদ্দিন আহমদ আব্বাস লিখেছেন: ‘মোহাম্মদ তুঘলকের শাসনকালে হাজার হাজার ক্রীতদাস নিম্নদরে বিক্রি হতো।’[১৮৭] মানরিকে ও বার্নিয়ার সম্রাট শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের শাসনকালে (১৬২৮-১৭০৭) প্রত্যক্ষ করেন যে, কর-আদায়কারীরা কর-পরিশোধে-ব্যর্থ দুস্থ কৃষকদেরকে তাদের নারী-সন্তানসহ ধরে নিয়ে যাচ্ছে ক্রীতদাসরূপে বিক্রি করার জন্য।
ক্রীতদাসের মূল্য
ক্রীতদাসদেরকে কত দামে বিক্রি করা হতো, তা অধিকাংশ দৃষ্টান্তে উল্লেখ করা হয়নি। ভারতীয় ক্রীতদাসদের দাম সম্পর্কে অধ্যাপক লাল কিছু তথ্য সংক্ষেপিত করেছেন।[১৮৮] তার তথ্যমতে: ‘সুলতান মাহমুদ রাজা জয়পালের মুক্তিপণ হিসেবে ২০০,০০০ সোনার দিনার এবং ২৫০টি হাতি আদায় করেন এবং সে সঙ্গে জয়পালের গলার হারটিও খুলে নেন, যার মূল্য ছিল ২০০,০০০ স্বর্ণ দিনার।’ আল-উতবি জানান: ১০১৯ সালে সুলতান মাহমুদ কর্তৃক ভারত থেকে আনা ৫৩,০০০ ক্রীতদাসের এক-একজনকে মাত্র দুই থেকে দশ দিরহামে বিক্রি করা হয়। হাসান নিজামী লিখেছেন: ‘হিন্দুদের উপর মোহাম্মদ গোরী ও কুতুবুদ্দিন আইবেকের সল্ট রেঞ্জ অঞ্চলে যৌথ আক্রমণে এত বিপুল সংখ্যক ক্রীতদাস ধৃত হয় যে, এক দিনার দামে পাঁচজন হিন্দু বন্দিকে ক্রয় করা হয়।’
ভারতে দাস-ব্যবসা এমন বিশিষ্ট একটি ব্যবসায়িক পেশায় পরিণত হয় যে, কোনো কোনো শাসক মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে দাস-বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির শাসনামলে ভারতীয় বাজার ক্রীতদাসে ভরপুর ছিল। তিনি উপপত্নী করার উপযুক্ত সুন্দরী বালিকার মূল্য নির্ধারণ করেন ২০ থেকে ৩০, এমনকি ৪০ তাঙ্খা (১০ তাঙ্খা = ১ স্বর্ণ মুদ্রা)। আর পুরুষ ক্রীতদাসদের মূল্য ধরা হয় ১০০ থেকে ২০০ তাঙ্খা। সুদর্শন বালকরা বিক্রি হতো ২০ থেকে ৪০ তাঙ্খায়। আর যাদের চাহিদা কম ছিলো, তারা বিক্রি হতো ৭ থেকে ৮ তাঙ্খায়। শিশু ক্রীতদাসদের মূল্য নির্দিষ্ট করা হয়েছিল ৭০ থেকে ৮০ তাঙ্খায়।[১৮৯] পাইকারি মূল্য নির্ধারণের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। তবে যখন বিপুল সংখ্যক ক্রীতদাস ধরা পড়তো, তখন চাহিদা ও সরবরাহের সর্বজনীন নিয়মই কাজ করতো এবং ইচ্ছা করলেও নির্দিষ্ট উচ্চমূল্য ধরে রাখা সম্ভব হতো না। যখন সরবরাহ কম হতো, তখন দাম স্বভাবতই বেড়ে যেতো। বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দাসদাসী, যেমন রাজকীয় বা সম্ভ্রান্ত বংশজাত, তরুণ বয়স, অসাধারণ সুন্দর কিংবা অতি উচ্চ সামরিক সামর্থ্যপূর্ণ বন্দিরা ১,০০০ থেকে ২,০০০ তাঙ্খা পর্যন্ত উচ্চমূল্যে বিক্রি হতো। জানা যায়: কবি বদর শাহ ‘গুল চেহরা’ (গোলাপমুখী) নামের এক ক্রীতদাসীকে ৯০০ তাঙ্খায় কিনেছিলেন। অপরদিকে বিখ্যাত সেনাপতি মালিক কাফুরকে বলা হতো ‘হাজার দিনারী’, কারণ তাকে ‘এক হাজার’ দিনার মূল্যে কেনা হয়েছিল।
সুলতান আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর পরবর্তী সুলতানগণও ক্রীতদাসদের বাজার-মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে চলেন। সুলতান মোহাম্মদ শাহ তুঘলকের শাসনকালে (১৩২৫-৫১) ক্রীতদাস ধরার পরিমাণ ছিল প্রচুর এবং তাদের দাম এতই সস্তা হয়ে যায় যে, ‘দিল্লির বাজারে গৃহকর্মের জন্য নিয়োজিত তরুণী ক্রীতদাসী বালিকার মূল্য ৮ তাঙ্খার বেশি হতো না। গৃহকর্ম ও উপপত্নী উভয় কাজের উপযুক্ত ক্রীতদাসীরা প্রায় ১৫ তাঙ্খায় বিক্রি হতো।’ ইবনে বতুতা বাংলায় এক স্বর্ণমুদ্রা (দশ তাঙ্খা) দামে এক সুন্দরী ক্রীতদাসী ক্রয় করেছিলেন; আর তার সহচর এক ক্রীতদাসীকে কিনেছিল দুই স্বর্ণমুদ্রায়।
মুসলিম সুলতানরা তাদের ভ্রষ্ট জীবনের যৌনলিপ্সা চরিতার্থ করতে হাজার হাজার উপপত্নীর সমাবেশ ঘটিয়ে বিশাল বিশাল হেরেম রাখা ছাড়াও বহু ‘গিলমান’ রাখতেন। বারানী লিখেছেন: ‘এর ফলে সুন্দরী বালিকা ও দাড়িহীন বালক দুর্লভ পণ্যে পরিণত হয় এবং তাদের মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ৫০০ তাঙ্কায়, কখনো কখনো এক হাজার থেকে দুই হাজার তাঙ্খায়।’ আল-ওমারী সাক্ষ্য দেন: ‘ক্রীতদাসদের কম মূল্য সত্ত্বেও, সুন্দরী ভারতীয় যুবতীরা ২,০০০ তাঙ্খা, এমনকি তারও বেশি দামে বিক্রি হতো।’ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাকে বলা হয়: ‘এসব তরুণী বালিকা সৌন্দর্যে ও ব্যবহারে ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য।’
মেধাবী ও বিলাসিতার বস্তুরূপে বিবেচিত বিদেশ থেকে আনা ক্রীতদাসদের উচ্চ চাহিদা ছিল ভারতে এবং তাদেরকে আনা হতে থাকে ভারতের বাজারে। তাদের দামও ছিল খুব বেশী। নারী-পুরুষ উভয় লিঙ্গের বিদেশী ক্রীতদাসদেরকে উচ্চ-দামে কেনা হতো বিশেষ দায়িত্বে নিয়োগের জন্য, যেমন সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে, উপপত্নী হিসেবে কিংবা হেরেমের নারীদের উপর নজর রাখার কাজে ইত্যাদি। আওরঙ্গজেব হেরেমের রক্ষী হিসেবে তাতার ও উজ্বেক ক্রীতদাসী কিনতেন তাদের যুদ্ধবাজ স্বভাব ও দক্ষতার কারণে, আর পূর্ব-ইউরোপীয় এক নারী ছিল তার যৌনদাসী। সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেক মার্জিত রুচিসম্পন্ন দুই সাহসী তুর্কি ক্রীতদাসকে ১০০,০০০ জিতল (২,০০০ তাঙ্খা) দামে, আর সুলতান ইলতুতমিস জনৈক কমরুদ্দিন তিমুর খানকে ৫০,০০০ জিতল দিয়ে কিনেছিলেন।[১৯০]
মরক্কোতে সুলতান মৌলে ইসমাইল ১৭১৫ সালে টমাস পেলো ও তার সঙ্গীদেরকে বন্দিকারী মুসলিম জলদস্যুদের কাছ থেকে মাথা-প্রতি ১৫ পাউন্ড দামে কিনেছিলেন। তবে খোলাবাজারে সাধারণ শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাসরা বিক্রি হতো ৩০ থেকে ৩৫ পাউন্ড দামে, আর কিশোর বালক জনপ্রতি ৪০ পাউন্ডে। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ও দুর্বল শরীরের দাসরা বিক্রি হতো কম দামে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইহুদি ব্যবসায়ীরা বন্দিদের মূল্য ১৫ থেকে ৭৫ পাউন্ডে উঠিয়ে দিতো।[১৯১] এর প্রায় ৭০ বছর আগে ব্রিটিশ সরকার যখন ইংরেজ বন্দিদেরকে ক্রয় করে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবসায়ী এডমুন্ড কেইসনকে আলজিয়ার্সে পাঠায়, সুলতানের প্রাসাদে আটককৃত প্রতি পুরুষ ক্রীতদাসের জন্য তাকে ৩৮ পাউন্ড দিতে হয়।[১৯২] কিন্তু নারীবন্দিদেরকে মুক্ত করতে খুবই চড়া মূল্য দিতে হয় তাকে: সারাহ রিপ্লির জন্য ৮০০ পাউন্ড, এ্যালিস হোইসের জন্য ১,১০০ পাউন্ড ও মেরী ব্রাস্টারের জন্য ১৩৯২ পাউন্ড।[১৯৩] সর্বদা প্রচুর পরিমাণে সরবরাহ থাকা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের মূল্য স্বাভাবিকভাবেই কম ছিল। ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে গাম্বিয়ার উপকূলে ইউরোপীয় দাস-ব্যবসায়ীরা তরুণ কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদেরকে কিনতো জনপ্রতি ৩.৪ পাউন্ড দামে; অন্যদিকে দেশের ভেতরের দাস-ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিজনকে এক থেকে তিন পাউন্ড দরে কিনে আনতো, যা নির্ভর করতো উপকূল থেকে দূরত্বের উপর।[১৯৪]
আন্তর্জাতিক ইসলামি দাস-ব্যবসা
সমগ্র ইসলামি বিশ্বে দাস-ব্যবসা ছিল একটা বিশিষ্ট ব্যবসা-উদ্যোগ। ভারত, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য (বাগদাদ ও দামাস্কাস) ছাড়াও মধ্য-এশিয়ার খোরাসান, গজনী ও সমরখন্দ ছিল দাস-ব্যবসার বিশিষ্ট কেন্দ্র। সম্রাট বাবর (মৃত্যু ১৫৩০) কাবুল ও কান্দাহারে দু’টি বিশিষ্ট দাস-বাণিজ্যকেন্দ্রের কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে ভারত থেকে বাণিজ্যবহর আসতো দাসসহ। একইভাবে খোরাসান, রুম (ইস্তাম্বুল), ইরাক ও চীন থেকে বাণিজ্য-কাফেলা আসতো কাবুলে।
ভারতের মুসলিম শাসকদের কাছে ইসলামি তুরস্ক, সিরিয়া, পারস্য ও ট্রানসক্সিয়ানা থেকে ব্যবসায়ীরা আসতো সেসব দেশ থেকে ক্রীতদাস সরবরাহ করার প্রস্তাব নিয়ে। ভারতীয় মুসলিম শাসকরাও দেশের বাইরে ব্যবসায়ীদেরকে পাঠাতেন বিদেশী ক্রীতদাস ক্রয়ের জন্য, যা ছিল অতি আকাক্সিক্ষত পণ্য। সুলতান ইলতুতমিস একবার বিদেশী ক্রীতদাস ক্রয়ের জন্য সমরখন্দ, বুখারা ও তিরমিযে ব্যবসায়ীদেরকে প্রেরণ করেছিলেন। তারা সুলতানের জন্য ১০০ জন ক্রীতদাস ক্রয় করে এনেছিল, যার মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত বলবন, যিনি ১২৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ক্ষমতা দখল করে সুলতান হন। ভারতে উজ্বেকিস্তান ও তাতারিস্তান থেকেও ক্রীতদাস আসতো। স্থানীয় বা স্বদেশী লোকদের দ্বারা বিদ্রোহমূলক উত্থান এড়াতে ভারতের মুসলিম শাসকরা সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত করার জন্য বহু সংখ্যায় বিদেশী ক্রীতদাস ক্রয় করতেন। এমনকি সম্রাট আকবর যদিও তার রাজসভায় সর্বপ্রথম হিন্দুদেরকে নিয়োগের পথ খুলে দেন, তথাপি তার দরবারেও বিদেশীরা ছিল প্রধান জনশক্তি। আকবর কর্তৃক রাজকার্যে নিয়োগকৃতদের ৭০ শতাংশই বিদেশী বংশোদ্ভূত ছিল বলে জানান তার মন্ত্রী আবুল ফজল। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশের অর্ধেকেরও বেশি ছিল মুসলিম, বাকিরা হিন্দু।[১৯৫]
মুসলিম বিশ্বে দাস-ব্যবসার বিস্তৃতি ও বৈচিত্র্য সম্বন্ধে বার্নার্ড লুইস লিখেছেন:[১৯৬]
ইসলামি বিশ্বের ক্রীতদাসদেরকে বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা হতো। প্রাথমিক যুগে ক্রীতদাসরা এসেছে প্রধানত নতুন নতুন বিজিত দেশ থেকে − যেমন ফারটাইল ক্রিসেন্ট (পশ্চিম-এশীয় মেসোপোটেমিয়া ও লেভান্ট অঞ্চল) ও মিশর থেকে, ইরান ও উত্তর আফ্রিকা থেকে, মধ্য এশিয়া, ভারত ও স্পেন থেকে… দেশজয় ও সে সাথে বন্দিকৃত ক্রীতদাস সরবরাহ যখন হ্রাস পায়, তখন ক্রীতদাস বাজারের চাহিদা মেটাতে বেশি বেশি করে তাদেরকে আমদানি করা হয় সীমান্তের বাইরে থেকে। ভারত, চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য থেকেও কিছু সংখ্যক ক্রীতদাস আনা হতো, যারা ছিল প্রধানত বিশেষজ্ঞ ও কারিগর, কোনো না কোনো শিল্পকলা বা কার্যে। অদক্ষ ক্রীতদাসদের অধিকাংশই আসতো ইসলামি বিশ্বের ঠিক উত্তর ও দক্ষিণ থেকে, − শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাসরা ইউরোপ ও ইউরেশিয়ার স্টেপ (সমভূমি) অঞ্চল থেকে, আর কৃষ্ণাঙ্গরা আসতো সাহারার দক্ষিণস্থ আফ্রিকার অঞ্চল থেকে।
ইসলামি বিশ্বে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদেরকে আনা হতো কয়েকটি পথে। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে সাহারা মরুভূমি পার হয়ে মরক্কো ও তিউনিশিয়াতে, চাদ থেকে মরুভূমি পার হয়ে লিবিয়ায়, পূর্ব-আফ্রিকা থেকে নীল নদের ভাটিতে মিশরে এবং লোহিত সাগর ও ভারত মহাসাগর পার হয়ে আরব ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে। সমভূমি অঞ্চল থেকে তুর্কি ক্রীতদাসদের বাজারজাত করা হতো সমরখন্দ ও অন্যান্য মুসলিম মধ্য-এশীয় নগরীগুলোতে, এবং সেখান থেকে তাদেরকে পাচার করা হতো ইরান, ফারটাইল ক্রিসেন্ট এবং তার ওপারে। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠা ককেশীয়দেরকে আনা হতো কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চল থেকে এবং বাজারজাত করা হতো প্রধানত আলেপ্পো ও মসুলে।
সিগল জানান
মুসলিম দাস-ব্যবসায়ীরা ছয়টি প্রধান পথ ধরে লোহিত সাগরের উপকূল থেকে সাহারা মরুভূমি অতিক্রম করে মধ্যপ্রাচ্যে ক্রীতদাস নিয়ে আসতো। পূর্ব-আফ্রিকার ক্রীতদাসদেরকে দলে দলে এনে জড়ো করা হতো ভারত মহাসাগর পার হয়ে। ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কেবলমাত্র উনবিংশ শতাব্দীতেই ১,২০০,০০০ (বার লক্ষ) ক্রীতদাস মধ্যপ্রাচ্যের বাজারগুলোতে চলে আসে সাহারা মরুভূমি পার হয়ে, আর ৪৫০,০০০ লোহিত সাগর এবং ৪৪২,০০০ আসে পূর্ব-আফ্রিকার উপকূলীয় বন্দরগুলো থেকে। আফ্রিকার বাজারগুলোর দাস-ব্যবসা সম্পর্কে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দিয়েছেন সিগল, যা নিচে উল্লেখ করা হলো:
১৫৭০-এর দশকে মিশর সফররত এক ফরাসি নাগরিক কায়রোতে বাজারের দিনে বিক্রির জন্য আনা হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গকে দেখতে পান। ১৬৬৫-৬৬ সালে এক স্পেনীয়/বেলজীয় পর্যটক ফাদার অ্যান্টোনিও গঞ্জালেস একদিনে কায়রোর বাজারে বিক্রির জন্য সমবেত ৮০০ থেকে ১০০০ ক্রীতদাস দেখতে পান। ১৭৯৬ সালে এক ব্রিটিশ পর্যটক লিখেছেন, তিনি দারফুর থেকে ৫,০০০ ক্রীতদাসের একটি বহরকে যেতে দেখেন। ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশ ভাইস কন্সুল ফেজ্জানের মারজুকে ২৩৮৪ জন ক্রীতদাসের (উত্তর পশ্চিম আফ্রিকায়) পৌঁছানোর কথা লিখেছেন।[১৯৭]
ইউরোপীয় ক্রীতদাস
ইউরোপ থেকে মুসলিম বিশ্বে আগত ক্রীতদাসদের সম্বন্ধে লুইস লিখেছেন:
ইউরোপেও গুরুত্বপূর্ণ দাস-বাণিজ্য ছিল, যাদের মধ্যে ছিল মুসলিম, ইহুদি, পৌত্তলিক, এমনকি গোঁড়া খ্রিষ্টান ক্রীতদাস। সাধারণত ‘সাকালিবা’ (অর্থাৎ ক্রীতদাস) নামে পরিচিত মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় ক্রীতদাসদেরকে আমদানি করা হতো প্রধান তিনটি পথ দিয়ে: স্থলপথে ফ্রান্স ও স্পেনের ভিতর দিয়ে, ক্রিমিয়া হয়ে পূর্ব-ইউরোপ থেকে এবং সমুদ্রপথে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে। তারা সবাই নয় কিন্তু অধিকাংশই ছিল স্লাভ ক্রীতদাস। তাদের কিছু সংখ্যককে মুসলিম নৌদস্যুরা ইউরোপীয় উপকূলে, বিশেষত ডালমাশিয়ান অঞ্চলে হানা দিয়ে ধরে আনতো। অধিকাংশই সরবরাহ হতো ইউরোপীয়, বিশেষত ভেনিসের বণিকদের দ্বারা, যারা স্পেন ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম বাজারগুলোতে তাদের বহর পাঠাতো।
ইউরোপীয় ক্রীতদাসদের বিশেষ চাহিদা ছিল যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহারের জন্য, রাজকীয় সেনাবাহিনী ও প্রাসাদসমূহে কাজ করার জন্য, এবং মরক্কো, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া ও লিবিয়ার ধনীদের বাড়িঘর ও প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য। জাইলস্ মিল্টনের ‘হোয়াইট গোল্ড’ ও রবার্ট ডেভিসের ‘ক্রিশ্চিয়ান শ্লেইভস্, মুসলিম মাস্টার্স’ গ্রন্থদ্বয় অনুযায়ী, ১৫৩০ সাল থেকে দীর্ঘ তিন শতাব্দব্যাপী উত্তর আফ্রিকার মুসলিম জলদস্যুরা সিসিলি থেকে কর্নওয়াল পর্যন্ত ইউরোপীয় উপকূলের বিভিন্ন শহর ও গ্রাম এবং ইউরোপীয় জাহাজগুলোতে হানা দিতে থাকে এবং ১৫ লাখেরও বেশি ইউরোপীয়কে ক্রীতদাস করে (যার মধ্যে ছিল আমেরিকার নাবিকও)। এ ক্রীতদাসকরণ সম্পর্কে মানবতাবাদী ব্রিটিশ লেখক ক্রীস্টোফার হিচেন্স আক্ষেপমূলক জিজ্ঞাসার সুরে লিখেছেন: ‘কজন জানে যে, ১৫৩০ থেকে ১৭৮০ সালের মধ্যে ইসলামি উত্তর আফ্রিকায় সম্ভবত দেড় মিলিয়ন (১৫ লাখ) ইউরোপীয় ও আমেরিকানকে ক্রীতদাস করা হয়েছিল; আয়ার্ল্যান্ডের বাল্টিমোর শহরের লোকেদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল? এক রাত্রিতে মুসলিম জলদুস্যুরা হানা দিয়ে সবাইকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।’[১৯৮]
বার্বার মুসলিম জলদস্যুরা উত্তর আফ্রিকার উপকূলীয় জলপথ দিয়ে যাওয়া বাণিজ্য-জাহাজে হানা দিয়ে ইউরোপীয়দেরকে অপহরণ করতো। তারা আটলান্টিকের ইউরোপীয় উপকূলীয় মৎস্যজীবী গ্রাম ও শহরগুলোতে গিয়ে হানা দিয়ে ব্যাপক লুটতরাজ করে ও বাসিন্দাদেরকে বন্দি করে নিয়ে আসতো। ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল ও ফ্রান্সের উপকূলীয় গ্রাম ও শহরগুলো তাদের আঘাতে সবচেয়ে বেশী জর্জরিত হয়। মুসলিম ক্রীতদাস শিকারি হানাদাররা এমনকি আরো দূরবর্তী ব্রিটেন, আয়ারাল্যান্ড ও আইসল্যান্ডেও হানা দিয়ে গ্রাম ও শহরের বাসিন্দাদের অপহরণ করতো।
জিহাদি মুসলিম হানাদাররা ১৫৪৪ খ্রিষ্টাব্দে নেপলসের অদূরবর্তী ভূমধ্যসাগরীয় ইশ্চিয়া দ্বীপে হানা দিয়ে লুটপাট করার পর ৪,০০০ বাসিন্দাকে আটক করে নিয়ে যায় এবং সিসিলির উত্তর উপকূলের অদূরে লিপারি দ্বীপের ৯,০০০ বাসিন্দাকে ক্রীতদাস করে।[১৯৯] ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তুরগুত রাইস নামের এক তুর্কি জলদস্যুপ্রধান গ্রানাডার (স্পেন) উপকূলীয় বসতিগুলোতে হানা দিয়ে লুণ্ঠন করার পর ৪,০০০ বাসিন্দাকে ক্রীতদাস হিসেবে ধরে নিয়ে যায়। ১৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে বার্বার জলদস্যুরা ব্রিস্টল চ্যানেলের লান্ড দ্বীপ দখল করে সেখানে ইসলামের ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে। এ ঘাঁটি থেকে তারা আশেপাশের গ্রাম ও শহরগুলোতে হামলা করে লুটপাট ও দাঙ্গাহাঙ্গামার মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড ও লুটতরাজের এক ভয়ঙ্কর দৃশ্যের অবতারণা করে। মিল্টন জানান: দিনের পর দিন তারা নিরীহ-নিরস্ত্র জেলেদের বসতবাটির উপর হানা দিয়ে বাসিন্দাদেরকে বন্দি ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। ১৬২৫ সালের সে ভয়ঙ্কর গ্রীষ্মের শেষে প্লাইমাউথের মেয়র হিসাব করে জানান: ‘তারা ১,০০০ মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস করে এবং সহস্রাধিক গ্রামবাসীকে ক্রীতদাসরূপে বিক্রির জন্য ধরে নিয়ে যায়।’[২০০] ১৬০৯ থেকে ১৬১৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বার্বার জলদস্যুরা ‘প্রায় ৪৬৬টি ইংরেজ বাণিজ্য-জাহাজ আটক করে।’
ইসলামে ধর্মান্তরিত জনৈক ইউরোপীয় মুরাদ রাইস পরবর্তীকালে মরক্কোর অদূরে উপকূলীয় জলদস্যু বন্দর-শহর সালে’র বার্বার জলদস্যুদের নেতা হয়েছিল। ১৬২৭ সালে সে এক লুটতরাজ ও ক্রীতদাসকরণ অভিযানে আইসল্যান্ডে যায়। রিকইয়াভিকে নোঙ্গর ফেলে তার বাহিনী শহরটিকে তছনছ করে এবং ৪০০ পুরুষ, নারী ও শিশুকে ধরে নিয়ে এসে আলজিয়ার্সে বিক্রি করে দেয়। ১৬৩৭ সালে ২০০ সদস্যের এক রাহাজান জলদস্যুর দল নিয়ে সে আয়ারল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে নৌ-অভিযান চালায় এবং বাল্টিমোর গ্রামের বাড়িঘর তছনছ ও লুটপাট করে এবং ২৩৭ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে ধরে নিয়ে যায় আলজিয়ার্সে।[২০১]
মুসলিম জলদস্যুদের বর্বর ক্রীতদাস শিকারমূলক অভিযান ইউরোপকে মারাত্মকভাবে জর্জরিত করেছিল। ফ্রান্স, স্পেন ও ইংল্যান্ডকে তাদের হাজার হাজার জাহাজ হারাতে হয়েছিল জলদস্যুদের সেসব হামলায়, যা তাদের সামুদ্রিক বাণিজ্যকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিল। উনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত স্পেন ও ইতালির দীর্ঘ উপকূল প্রায় সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত থাকে এবং সেখানকার মৎস্য শিল্প দৃশ্যত ধ্বংস হয়ে যায়।
পল বায়েপলার্স তার ‘হোয়াইট শ্লেইভস, আফ্রিকান মাস্টার্স: অ্যান অ্যান্থোলজি অব আমেরিকান বার্বারি ক্যাপটিভিটি ন্যারেটিভস’ গ্রন্থে উত্তর আফ্রিকায় ধৃত ৯ জন আমেরিকান বন্দির লেখা কতকগুলো নিবন্ধ একত্রিত করেছেন। সে গ্রন্থ অনুসারে, ১৬২০ সালে কেবলমাত্র আলজিয়ার্সেই ২০,০০০-এরও বেশি খ্রিষ্টান শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস ছিল। ১৬৩০ সালে এ সংখ্যা স্ফীত হয়ে ৩০,০০০ পুরুষ ও ২,০০০ নারীতে গিয়ে ঠেকে। আহমেদ এজ্জায়ানি লিখেছেন: ‘সুলতান মৌলে ইসমাইলের প্রাসাদে যে কোনো সময়ে কমপক্ষে ২৫,০০০ শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস থাকতো।’ ১৫৫০ থেকে ১৭৩০ সালের মধ্যে আলজিয়ার্সে ২৫,০০০ শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস সর্বদাই থেকেছে। কোনো কোনো বিশেষ সময়ে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যেতো। একই সময়কালে তিউনিস ও ত্রিপোলিতে কমপক্ষে ৭,৫০০ জন করে শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস থাকতো। বার্বারি জলদস্যুরা দীর্ঘ তিন শতাব্দেরও বেশি সময় ধরে প্রতি বছর গড়ে ৫,০০০ করে ইউরোপীয়কে ক্রীতদাস করেছিল।[২০২]
বার্বারি মুসলিম আফ্রিকায় সবচেয়ে বিখ্যাত যে ইউরোপীয় খ্রিষ্টান ক্রীতদাস হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন বিখ্যাত মহাকাব্য ‘ডন কুইকজোট’-এর লেখক মিগুয়েল ডি সারভান্ডিস। বার্বারি জলদস্যুদের দ্বারা ১৫৭৫ সালে তিনি বন্দি হন এবং পরে মুক্তিপণ দিয়ে তাকে মুক্ত করা হয়। ১৩৫০ সালের দিকে অটোমানদের ইউরোপে অনুপ্রবেশ এবং পরবর্তীতে ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল অধিকার করায় ইউরোপীয় সীমান্ত থেকে অবারিত ক্রীতদাস সরবরাহের দুয়ার খুলে যায়। ১৬৮৩ সালে অটোমান বাহিনীর ইউরোপ বিজয়ের সর্বশেষ প্রয়াস ব্যর্থ হলেও, ভিয়েনা গেট থেকে ফেরার পথে তারা ৮০,০০০ শেতাঙ্গকে বন্দি করে নিয়ে আসে।[২০৩] ক্রিমিয়া, বলকান অঞ্চল ও পশ্চিম এশিয়ার সমভূমি অঞ্চল থেকে বিপুলসংখ্যক ক্রীতদাস ইসলামি বিশ্বের বাজারগুলোতে ঢুকে পড়ে। বি. ডি. ডেভিস দুঃখ করে বলেন: ‘তাতার ও কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের অন্যান্য লোকেরা (মুসলিম) লাখ লাখ ইউক্রেনীয়, জর্জিয়, সার্কাসিয়ান, আর্মেনীয়, বুলগেরীয়, স্লাভ ও তুর্কিদেরকে ধরে এনে বিক্রি করে দিয়েছিল, যা কারো নজরেই পড়েনি।’[২০৪]
১৪৬৮ ও ১৬৯৪ সালের মধ্যে ক্রিমিয়ার তাতাররা ১,৭৫০,০০০ ইউক্রেনীয়, পোল ও রুশকে ক্রীতদাস হিসেবে শিকার করে এনে বিক্রয় করে দেয়।[২০৫] আরেক হিসাব অনুযায়ী, ১৪৫০ ও ১৭০০ সালের মধ্যে ক্রিমিয়ার তাতাররা কিছু সার্কাসিয়ানসহ প্রতি বছর ১০,০০০ করে ক্রীতদাস ধরে এনে (অর্থাৎ সর্বমোট প্রায় পঁচিশ লাখ) অটোম্যান সাম্রাজ্যে রপ্তানি করে।[২০৬] ক্রীতদাস শিকারি তাতার খানরা ১৪৬৩ সালে পোল্যান্ড থেকে ১৮,০০০, ১৪৯৮ সালে লভোভ থেকে ১০০,০০০, ১৫১৫ সালে দক্ষিণ রাশিয়া থেকে ৬০,০০০, ১৫১৬ সালে গ্যালিসিয়া থেকে ৫০,০০০ থেকে ১০০,০০০, ১৫২১ সালে মস্কো থেকে ৮০০,০০০, ১৫৫৫ সালে দক্ষিণ রাশিয়া থেকে ২০০,০০০, ১৫৭১ সালে মস্কো থেকে ১০০,০০০, ১৬১২ সালে পোল্যান্ড থেকে ১০০,০০০, ১৬৫৪ সালে ইউক্রেন থেকে ৩০০,০০০, ১৬৭৬ সালে ভ্যালিনিয়া থেকে ৪০০,০০০ এবং ১৬৯৪ সালে পোল্যান্ড থেকে হাজার হাজার ক্রীতদাস নিয়ে ফিরে যায়। এসব বড় বড় শিকার-অভিযান ছাড়াও, তারা একই সময়ে আরো বহু জিহাদ-অভিযান পরিচালনা করে হাজার হাজার ক্রীতদাস বানায়।[২০৭] তাতারদের দ্বারা ক্রীতদাসকরণের সংখ্যাটি এ প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে যে, সে সময় তাতারস্থানের মোট জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৪০০,০০০-এর মতো।[২০৮]
ভাইকিং দাস-ব্যবসা ও মুসলিম সম্পৃক্ততা
ইসলামের জন্মের পর সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে মুসলিম আক্রমণকারী ও শাসকরা অগণিত সংখ্যক বিধর্মীকে ক্রীতদাসকরণের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে দাস-বাণিজ্যকে একটা বৃহৎ ব্যবসায়িক উদ্যোগে পরিণত করে। অষ্টম শতাব্দীর শেষ দিকে ইউরোপে ‘ভাইকিং’ নামে একদল অমুসলিম দাস-শিকারির উত্থান ঘটে। ভাইকিংরা ছিল উত্তর ইউরোপীয় স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলো (সুইডেন, ডেনমার্ক) থেকে উদ্ভব হওয়া, যারা অষ্টম ও একাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে নিষ্ঠুর হানাদার রাহাজানে পরিণত হয়। তথাকথিত ‘বর্বর’ জার্মান জাতির এসব লোক ব্রিটিশ দ্বীপ ও ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের উপকূল ও রাশিয়ার ভলগা নদী বরাবর দূরপ্রাচ্যে হামলা ও জলদস্যুবৃত্তিতে লিপ্ত হয়। লম্বা জাহাজের জন্য খ্যাত ভাইকিংরা দীর্ঘ তিন শতাব্দীরও বেশি সময় ইউরোপের মূল ভূখন্ড, আয়ারল্যান্ড, নরম্যান্ডি, শেটল্যান্ড, ওরকনি এবং ফারো দ্বীপপুঞ্জ, আইসল্যান্ড, গ্রীনল্যান্ড ও নিউফাইল্যান্ডের উপকূল ও নদীর তীর বরাবর বসতি স্থাপন করে। তারা দক্ষিণে উত্তর আফ্রিকায় এবং পূর্বে রাশিয়া ও কনস্টান্টিনোপলে পৌঁছে যায় লুণ্ঠনকারী, ব্যবসায়ী কিংবা ভাড়াটিয়া বাহিনীরূপে। এরিক দ্য রেড-এর উত্তরসূরী লেফ এরিকসন-এর অধীনে ভাইকিংরা ১০ম শতাব্দীতে উত্তর আমেরিকায় অভিযান চালিয়ে বর্তমান কানাডায় পর্যন্ত পৌঁছে যায়। দশম ও একাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোতে খ্রিষ্টান ধর্মের প্রবর্তন হওয়ার সাথে ভাইকিং হামলা হ্রাস পায়।[২০৯] ৭৯৩ ও ১০৬৬ সালের মধ্যবর্তীকালীন ভাইকিংদের উত্থানের ও কর্তৃত্বের সময়কাল সাধারণত ‘ভাইকিং যুগ’ নামে পরিচিত।
ইউরোপের উপকূল বরাবর বসবাসকারী নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় পরিবার ও সম্প্রদায়ের উপর বর্বর হামলার মাধ্যমে বয়স্কদেরকে হত্যা এবং নারী ও শিশুদেরকে বন্দি করে ক্রীতদাসরূপে বিক্রির পেশায় লিপ্ত হওয়ার কারণে ভাইকিংরা চরমভাবে নিন্দিত হয়েছে। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, ভাইকিংদের উত্থান ও বিস্তারের প্রধান কারণ ছিল অতিরিক্ত জনসংখ্যা, প্রযুক্তিগত আবিষ্কার ও জলবায়ুর পরিবর্তন এবং সে সঙ্গে ৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট শার্লামেন কতৃক ফ্রিজিয়ান জাহাজবহর ধ্বংসের পর বাণিজ্যিক ধারাবাহিকতা ও মধ্য-ইউরোপ থেকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় পণ্য প্রবাহ ভঙ্গ।
কিন্তু ভাইকিংদেরকে ক্রীতদাস-বাণিজ্যে জড়িতকরণে ইসলাম যে ইন্ধন যুগিয়েছিল সে বিষয়টি ঐতিহাসিকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে খুবই কম। ৭৩২ খ্রিষ্টাব্দে টুরের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ে ইউরোপীয় সীমান্তে ইসলামিক বিজয় থেমে যায়। এমনকি তাদেরকে ইতিমধ্যে দখলকৃত কিছু ভূখণ্ড ছেড়ে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। অতঃপর মুসলিম বিশ্বের হেরেমগুলোতে উপপত্নীরূপে অতি চাহিদার ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ নারীদের ক্রীতদাসকরণ ব্যাপকহারে হ্রাস পায়।
যুদ্ধ ও হামলার মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গ যৌনদাসী কব্জা করার প্রক্রিয়ায় এভাবে ভাটা পড়লে মুসলিম বিশ্বে তাদের বিরামহীন ও মোহাবিষ্ট চাহিদা পূরণের বিকল্পরূপে ক্রীতদাস হিসেবে তাদেরকে কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ভয়ঙ্কর উম্মত্ত ভাইকিং দস্যুদের উত্থানকালে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার পশম ব্যবসায়ীরা রাশিয়ার বুলগার ভলগায় অবস্থিত ইউরোপ-আরব বাণিজ্যকন্দ্রে পৌঁছে যায়। এখানে মুসলিম বিশ্বের ব্যবসায়ীদের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয় এবং তারা ইসলামি হেরেমগুলোতে শ্বেতাঙ্গ নারীদের প্রচুর চাহিদার কথা জানতে পারে। অতঃপর হিংস্র ও বর্বর ভাইকিংরা মুসলিম বণিকদের কাছে বিক্রির জন্য শ্বেতাঙ্গ সুন্দরী যুবতীদেরকে শিকার করে আনার পেশায় লিপ্ত হয়। এতে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে পূর্ব-ইউরোপের ক্রীতদাস বাণিজ্যের পথ খুলে যায়। খুব শীঘ্রই স্পেন হয়েও শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস সরবরাহের পথ উন্মুক্ত হয়। উত্তর ইউরোপে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রসারের সাথে ভাইকিং দাস-বাণিজ্য ক্রমশ স্তিমিত হতে হতে বন্ধ হয়ে যায়।
ভাইকিং দাস-বাণিজ্য সর্বোতোভাবে নিন্দিত হয়েছে। কিন্তু ভাইকিংদেরকে এ ঘৃণিত পেশায় লিপ্তকরণে ইসলাম যে বড় ইন্ধন যুগিয়েছিল সে ব্যাপারে আদৌ কিছুই বলা হয় না। ভাইকিংরা যে জঘন্য অপরাধগুলো করেছিল, তা ক্ষমাহীন। তবে ভাইকিংদের ক্রীতদাসী-বাণিজ্যে লিপ্ত হওয়ার অপরাধ থেকে ইসলামকে পৃথক করাও অসম্ভব, কেননা ভাইকিংরা প্রধানত শ্বেতাঙ্গ নারীদেরকে হরণ করতো পুরোপুরিই মুসলিম বিশ্বের অবিরাম চাহিদা পূরণে সরবরাহ করতে।
‘ভাইকিং যুগ’ শেষ হলেও ইসলামি বিশ্বে শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস সরবরাহ শেষ হয়ে যায়নি। ভাইকিং দাস-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার পর মুসলিম ক্রীতদাস শিকারিরাই ভাইকিংদের স্থান দখল করে এবং মুসলিম বিশ্বের চাহিদা পূরণে ইউরোপে ধীরে ধীরে শ্বেতাঙ্গ নারী আটকের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ১৩৫৩ খ্রিষ্টাব্দে অটোমান তুর্কিরা কনস্টান্টিনোপলকে পাশ কাটিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করে এবং বুলগেরিয়া ও সার্বিয়া দখল করার মাধ্যমে নতুন জিহাদী অভিযান শুরু করে। এ ঘটনায় স্বয়ং মুসলিমদের দ্বারা ব্যাপক সংখ্যায় শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস ধরার প্রক্রিয়া নতুন করে সূচিত হয়। ১৪৩০ সালে তুর্কিরা গ্রিসের থেসালোনিকো আক্রমণ করে ৭,০০০ শ্বেতাঙ্গকে ক্রীতদাস করে; অপরদিকে ১৪৯৯ খ্রিষ্টাব্দে অটোমান সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ গ্রিসের মিথোনে হানা দিয়ে লুণ্ঠন করে এবং নগরীর দশ বছরের উর্ধবয়সী সকল পুরুষকে হত্যা করে নারী ও শিশুকে বন্দি করে আনে।[২১০] পারস্যের শাসক শাহ তাহমাস্প (মৃত্যু ১৫৭৬) ১৫৫৩ সালে জর্জিয়া আক্রমণ করে ৩০,০০০-এর বেশি নারী-শিশুকে ক্রীতদাস করে। জর্জিয়ায় তার ১৫৫১ সালের অভিযানে গাজীরা পুরুষদেরকে হত্যা করে তাদের স্ত্রী-সন্তানদেরকে বন্দি করে। জর্জিয়ার বিরুদ্ধে সুলতান ১৫৪০ ও ১৫৪৬ সালে আরো দু’টো সফল অভিযান পরিচালনা করেন। এ দুই অভিযানে কত লোককে ক্রীতদাস করা হয়েছিল তা লেখা হয়নি।[২১১] সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিক পর্যন্ত অটোমান ও পারস্যের সাফাভিদরা ইউরোপীয় ভূখণ্ডে বহু হামলা চালায়। ১৬৮৩ সালে ভিয়েনা অবরোধকালে পরাজয় ও ব্যাপক ক্ষতি স্বীকার সত্ত্বেও অটোমান তুর্কিরা ৮০,০০০ বন্দিকে ধরে নিয়ে আসে। এটা পরিষ্কার যে, তাদের সব অভিযানেই বিপুল সংখ্যায় ক্রীতদাস আটক করা হতো।
ইতিমধ্যে তাতার খানরা পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পূর্ব-ইউরোপ ও রাশিয়ায় অসংখ্য ধর্মযুদ্ধের অভিযান (রাজিয়া) পরিচালনা করে। সেসব অভিযানে তারা হাজার হাজার, এমনকি লাখ লাখ, শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস আটক করে নিয়ে আসে, যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। উত্তর আফ্রিকার বার্বার জলদস্যুরা ১৫৩০ ও ১৭৮০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ইউরোপীয় উপকূলীয় নগরী সিসিলি থেকে কর্নওয়াল পর্যন্ত ও সমুদ্রপথের জাহাজে অব্যাহতভাবে হানা দিয়ে শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস আটকের মাধ্যমে দশ লাখ শ্বেতাঙ্গ পুরুষ-নারীকে ক্রীতদাস বানায়। ১৮২০ সাল পর্যন্ত বার্বার জলদস্যুরা শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস শিকার অব্যাহত রাখে।
[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ ইউরোপীয় দাস-ব্যবসায় ইসলামি সহায়তা]
সূত্র:
185. Lal (1994), p. 124
186. Ibid, p. 121
187. Ibid, p. 51
188. Ibid, p. 120-27
189. Child-slaves brought such high prices, because they could serve the master for their whole life and that they could be handled easily and moulded into whatever the master wanted, particularly to groom them to be ruthless soldiers for waging Jihad against the infidels (like Janissaries).
190. Lal (1994), p. 130-35
191.Miton, p. 69-70, 77
192. At this time, an ordinary London shopkeeper earned £10 a year, while wealthy merchants made £40 at best.
193. Milton, p. 27
194. Curtin PD (1993) The Tropical Atlantic of the Slave Trade in Islamic & European Expansion, in Adas M Ed., p. 174
195. Moreland (1995), p. 69-70
196. Lewis (1994), op cit
197. Segal, p. 59
198. Hitchens C (2007) Jefferson Versus the Muslim Pirates, City Journal, Spring Issue
199. Povoledo E (2003) The Mysteries and Majesties of the Aeolian Islands, International Herald Tribune, 26 September.
200. Milton, p. 11
201. Milton, p. 13-14; Lewis B (1993) Islam and the West, Oxford University Press, New York, p. 74
202. Milton, p. 99, 217-72
203. Erdem YH (1996) Slavery in the Ottoman Empire and Its Demise, 1800-1909, Macmillan, London, p. 30
204. Lal (1994), p. 132
205. Fisher AW (1972) Muscovy and the Black Sea Slave Trade, in Canadian-America Slavic Studies, 6(4), p. 577-83, 592-93
206. Inalcik H (1997) An Economic and Social History of the Ottoman Empire, 1300-1600, Cambridge University Press, Vol. I, p. 285; Fisher, p. 583-84
207. Bostom, p. 679-81
208. Williams BG (2001) The Crimean Tatars: The Diaspora Experience and the Forging of a Nation, E J Brill, Lieden, p. 69-72
209. Viking, Wikipedia, http://en.wikipedia.org/wiki/Vikings
210. Bostom, p. 613, 619
211. Ibid, p. 620-21
চলবে…