পশ্চিম ইউরোপের অভিজ্ঞতা
আধুনিক সভ্যতার যুগে বাস করেও উন্নত ও সভ্য সমাজ নির্মাণে আমাদের ব্যর্থতা কতখানি তা বাংলাদেশের আজকের বাস্তবতার দিকে দৃষ্টি দিলে সহজেই বুঝা যায়। অথচ আধুনিক সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা কম দিনের নয়। ১৭৫৭-তে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর আমরা আধুনিক সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত হই। তবে সেটা ছিল জাতি হিসাবে আমাদের পরাধীনতার কাল। সে কালের অবসান হয়েছে অনেক আগে। ১৯৪৭ সালে। তারপর ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্তও ছিল আমাদের আরেক পরাধীনতার কাল। কিন্তু ১৯৭১ থেকে আজ অবধি আমরা কোন্ বিজাতির শাসনাধীনে আছি যে তাকে দোষারোপ করে আমাদের দারিদ্র্য, দুর্নীতি, পশ্চাৎপদতা, অব্যবস্থা, সন্ত্রাস এবং অনুন্নয়নের জন্য সান্ত্বনা খুঁজে পাব? অথচ পৃথিবীর অনেক জাতিই পরাধীনতার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসে আমাদের থেকে ভিন্ন ইতিহাস গড়েছে। তারা পরাধীনতার অবসান ঘটিয়ে উন্নত সভ্যতার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পেরেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে উন্নত ও পরাক্রান্ত রাষ্ট্র গড়েছে। চীন, ভিয়েৎনাম ইত্যাদি রাষ্ট্রও বিদেশী রাষ্ট্রের আধিপত্যকে উৎখাত করে উন্নত রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের পথে দৃপ্তপায়ে এগিয়ে চলেছে ।
যুদ্ধ না করে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে উন্নত রাষ্ট্র গঠন করেছে। হয়ত বলা হবে এই তিনটি দেশের বর্তমান অধিবাসীবৃন্দ সাধারণভাবে ইউরোপ থেকে আগত। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত উপনিবেশিক কালেও তারা যে আধুনিক ও উন্নত সমাজ গঠন করেছিল আজকের রাষ্ট্রগুলি তারই ধারাবাহিক, স্বাধীন ও রাজনৈতিক রূপ মাত্র। আর এখানেই আমরা আমাদের অনুসন্ধানের মূল জায়গাটা খুঁজে পাই। সেটা হচ্ছে ইউরোপ। অর্থাৎ আজকের আধুনিক সভ্যতার উৎস ইউরোপের সমাজে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল যা সেখানে আধুনিক ও উন্নত সভ্যতার উপযোগী সমাজ ও রাষ্ট্রের উদ্ভবকে সম্ভব করেছিল। সুতরাং এখন আমরা সেই দিকটাতে দৃষ্টি দিই। তাহলেই আমরা আমাদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাব।
আমরা যেটাকে আধুনিক ইউরোপ বলি তার যাত্রা রেনেসাঁ বা নবজাগরণ দিয়ে। ইউরোপে নবজাগরণের কাল হিসাবে সাধারণভাবে ধরা হয় খ্রিস্ট্রিয় চতুর্দশ-সপ্তদশ শতাব্দীকে, যে সময়টাতে প্রাচীন বিস্মৃত গ্রীক ও ল্যাটিন সাহিত্য, শিল্পকলা ও জ্ঞানের চর্চা শুরু হয়। রোমান সভ্যতার পতনের পর খ্রিস্টধর্মের প্রভাবে এই সব বিষয়ের চর্চা নিষিদ্ধ অথবা পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বর্বরদের হাতে রোমান সভ্যতার চূড়ান্ত পতন হয় ৪৭৬ খ্রীষ্টাব্দে। এরপর থেকে একেবারে প্রায় চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত যে কাল চলে সেটাকে বলা হয় অন্ধকার যুগ, যখন ধর্মের বিধিনিষেধের কারাগারে মানুষের যুক্তি-বুদ্ধি-বিবেচনা বন্দী হয়ে পড়ে। মানুষের চিন্তার নিয়ামক হিসাবে দেখা দেয় অন্ধ বিশ্বাস নির্ভর ধর্ম। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পথও অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
সমগ্র ইউরোপ জুড়ে অভিন্ন খ্রিস্টধর্মের প্রসার ঘটলেও বিভিন্ন ধর্মীয় প্রশ্নে মতভেদকে কেন্দ্র করে ইউরোপ রোমান ক্যাথলিক ও অর্থডক্স্ এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পশ্চিম ইউরোপে খ্রিস্ট্রিয় ধর্মের যে মতবাদ প্রাধান্য অর্জন করে সেটাকে আমরা জানি রোমান ক্যাথলিক হিসাবে আর পূর্ব ইউরোপে যে মতবাদ প্রাধান্য অর্জন করে সেটা পরিচিত অর্থডক্স্ হিসাবে। খ্রিস্ট্রিয় গীর্জা বা চার্চ এই দুই প্রধান ধারায় বিভক্ত হয়। ক্যাথলিক চার্চ রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী রোমকে কেন্দ্র ক’রে এবং অর্থডক্স্ চার্চ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্স্ট্যান্টিনোপলকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়। প্রধানত এই দুই শাখায় খ্রিস্ট ধর্মের বিকাশে যেটা সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় সেটা হচ্ছে ধর্মগুরু হিসাবে পোপকে কেন্দ্র করে ক্যাথলিক চার্চের কেন্দ্রীভূত প্রতিষ্ঠান রূপে বিকাশ লাভ যেটা অর্থডক্স্ চার্চের ক্ষেত্রে ঘটে নাই। এই প্রভেদ ইউরোপের রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেও গুরুতর প্রভেদ বা পার্থক্য ঘটায়। পশ্চিম ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে পোপের উদ্ভব রাষ্ট্রের উপর পোপ তথা চার্চের যে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে সেটা পূর্ব ইউরোপের ক্ষেত্রে ঘটে নাই।
আমাদের আলোচনায় এই বিষয় মনে রাখতে হবে যে, খ্রিস্টধর্মের বিশেষ দর্শন ও বিকাশ পদ্ধতি চার্চ ও রাষ্ট্রকে কখনই পুরাপুরি একীভূত করে নাই। অর্থাৎ যারা ধর্ম চর্চা ও প্রচারের নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করে তারা প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করে না, যদিও তারা রাষ্ট্রকে প্রভাবিত এমনকি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণও করতে পারে। তবে সেটা তারা করলেও করে নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা বজায় রেখে। অর্থাৎ ধর্ম নেতা বা পুরোহিত এবং রাষ্ট্র নেতা বা রাষ্ট্রের শাসক একজন নয়।
তবে ক্যাথলিক চার্চ ব্যবস্থায় সকল চার্চ বা গীর্জার কেন্দ্রীভূত কর্তৃত্ব হিসাবে পোপের পদ সৃষ্টি ক্যাথলিক মতাবলম্বী পশ্চিম ইউরোপে চার্চ রাষ্ট্র থেকে পৃথক হলেও রাষ্ট্রের উপর পোপের প্রাধান্য সৃষ্টি করে। পোপ যেহেতু সর্বোচ্চ ধর্মগুরু বা ধর্মনেতা এবং পশ্চিম ইউরোপের জনগণ ক্যাথলিক খ্রিস্ট্রিয় মতাবলম্বী হিসাবে পোপকে তাদের সর্বোচ্চ আধাত্মিক ও নৈতিক কর্তৃত্ব হিসাবে মেনে নেয় সেহেতু পশ্চিম ইউরোপের রাজা বা সম্রাটরাও পোপের ধর্মীয় কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদান করতে বাধ্য হয়। আর এইভাবে পশ্চিম ইউরোপে সুদীর্ঘ কাল রাষ্ট্রের উপর পরোক্ষভাবে হলেও পোপ তথা চার্চের আধিপত্য বজায় থাকে। রাজা বা সম্রাটরা যা-ই করুক পোপ বা গীর্জার নৈতিক কর্তৃত্বকে মেনে চলতে হত। এটা একটা বড় কারণ যার ফলে পশ্চিম ইউরোপে রাজা বা রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ স্বেচ্ছাচার বা স্বৈরতন্ত্র গড়ে উঠার সুযোগ পায় নাই। অন্যদিকে, চার্চের হাতে সরাসরি রাষ্ট্র ক্ষমতা না থাকায় তাকেও নির্ভর করতে হত রাষ্ট্রের উপর। এর ফলে পশ্চিম ইউরোপে ধর্ম ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য সৃষ্টি হয়েছিল।
কিন্তু পূর্ব ইউরোপের অর্থডক্স্ প্রভাবিত দেশগুলির পরিস্থিতি ভিন্ন হল। অর্থডক্স্ চার্চগুলির কেন্দ্রীভূত রূপ হিসাবে পোপ জাতীয় কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল না। অর্থডক্স্ মতবাদকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় থাকলেও চার্চগুলি কেন্দ্রীভুত ধর্মীয় কর্তৃত্বের অধীনে সংগঠিত না হওয়ায় এগুলির রাষ্ট্রের উপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উপায় থাকে নাই, বরং রাষ্ট্রই চার্চকে নিজের অধীনে নিয়েছে। প্রতিষ্ঠান হিসাবে চার্চ ও রাষ্ট্র স্বতন্ত্র থেকেছে। কিন্তু চার্চের উপর রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে রাজা বা সম্রাটের প্রাধান্য থেকে গেছে। ফলে ধর্মীয় বিষয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ঘটতে পেরেছে। এরই প্রকাশ হিসাবে আমরা বাইজেন্টাইন রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্স্ট্যান্টিনোপলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা অর্থডক্স্ চার্চের উপর বাইজেন্টাইন সম্রাটের আধিপত্যমূলক ভূমিকা দেখতে পাই; অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে অর্থডক্স্ চার্চের পোপ হিসাবে অনেকাংশে ভূমিকা পালন করতেন সম্রাট নিজে। এর ফলে রাষ্ট্র ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের যে অভাব ঘটে তার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই অর্থডক্স্ চার্চ নিয়ন্ত্রিত খ্রিস্টান সমাজগুলিতে। অর্থডক্স্ খ্রিস্টান অধ্যুষিত রাশিয়ায়ও আমরা স্পষ্টরূপে এই বাস্তবতার প্রকাশ দেখতে পাই যেখানে রাষ্ট্র অনেকাংশে এশীয় স্বৈরতন্ত্রের অনুরূপ হয়ে গড়ে উঠেছে। এর ফলে যে সামন্ত শ্রেণী পশ্চিম ইউরোপে গড়ে উঠেছিল তার অনুরূপ কোন শ্রেণী আমরা এখানে দেখতে পাই না।
পশ্চিম ইউরোপে সামন্ত প্রভুরা রাজার অধীনস্থ হলেও তারা নিজ নিজ জমিদারী বা ভূখণ্ডে প্রায় স্বাধীন ছিল। কিন্তু পূর্ব ইউরোপ বিশেষত রাশিয়ায় ভূ-স্বামী বা সামন্তদের তেমন কোন অবস্থা ছিল না। রাশিয়ায় জার বা সম্রাটদের মর্জির উপর নির্ভর করত সামন্ত প্রভু বা ভূ-স্বামীদের অস্তিত্ব। এটা ঠিক যে জারের শাসন ব্যবস্থা ভূ-স্বামীদের উপর নির্ভর করত। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বিশেষ কোন ভূ-স্বামীর অধিকারে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা তার ছিল না।
কিন্তু পশ্চিম ইউরোপে ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সময় থেকে এখানে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় অঞ্চলগত বিভিন্নতা, জটিলতা ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সামন্ত ব্যবস্থার একটি জটিল রূপ গড়ে উঠে। এখানে সামন্ত প্রভু ভিন্ন সত্তা। তার জমিদারী বা ভূ-স্বত্বে রাজা ইচ্ছা করলেই হস্তক্ষেপ করতে পারত না। তাদের অধিকারভুক্ত ভূমি তাদের ব্যক্তিগত অধিকারে থাকত যা তারা বংশপরম্পরায় ভোগদখল করত। তবে এটা ঠিক যে, এই সামন্ত প্রভুরা রাজাকে নিয়মিত কর এবং যুদ্ধের প্রয়োজনে রাজাকে সেনাবাহিনী দিয়ে সাহায্য করতে বাধ্য ছিল। তা সত্ত্বেও পশ্চিম ইউরোপে শত শত বৎসর ধরে সামন্ত শ্রেণীর এই আপেক্ষিক স্বাধীনতা বজায় ছিল। সামন্ত শ্রেণীর এই তুলনামূলক বা আপেক্ষিক স্বাধীনতা এবং রাজা বা রাষ্ট্রের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে ক্যাথলিক চার্চের ভূমিকাকে যদি আমরা বুঝতে বা চিনতে না পারি তবে পশ্চিম ইউরোপের সামন্তবাদ সম্পর্কে আমরা কিছুই বুঝব না। বস্তুত চার্চের এই ভূমিকার কারণে পশ্চিম ইউরোপে এমন এক সামন্ত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যার তুলনা আমরা পৃথিবীর কোথায়ও সেভাবে পাই না। এটা ঠিক যে জাপানে পশ্চিম ইউরোপের প্রায় অনুরূপ একটি সামন্ত শ্রেণী ও সামন্ত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও জাপানের সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থাকে পশ্চিম ইউরোপের সামন্তবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে হুবহু এক করে দেখা ঠিক হবে না। যে কারণে জাপানের সামন্তবাদী সমাজের ভিতর থেকে পশ্চিম ইউরোপের মত করে পুঁজি বা পুঁজিবাদী সমাজের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটানো যায় নাই। তবে জাপান যেটা করতে পেরেছিল সেটা হচ্ছে পশ্চিম ইউরোপ তথা পাশ্চাত্যকে অনুকরণ করে দ্রুত শিল্প সভ্যতা নির্মাণের পথ গ্রহণ করা।
যাইহোক, প্রায় স্বাধীন সামন্ত শ্রেণীর অস্তিত্ব রাজা বা রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করায় পশ্চিম ইউরোপে রাষ্ট্র তুলনামূলকভাবে দুর্বল ছিল। এই অবস্থায় সামাজিক বিশৃঙ্খলা এবং পরিণতিতে বৈদেশিক আগ্রাসনে সমাজ ও রাষ্ট্রের ধ্বংস হওয়া স্বাভাবিক হতে পারত। বিশেষত খ্রিস্ট্রিয় ৮ম শতাব্দী থেকে ইসলামের যে অভিযান ইউরোপের উপর আছড়ে পড়ছিল (৭১১ খ্রীষ্টাব্দে তারিকের নেতৃত্বে ইসলামী আরব বাহিনী স্পেনে প্রবেশ করার পর সেখানে ইসলামের বিজয় অভিযান শুরু হয়) তার আঘাতে ইউরোপের প্রতিরোধের শক্তি চূর্ণ হতে পারত। মুসলিম আরবরা স্পেন জয় করল। পরবর্তীকালে তুর্কী মুসলিমরা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্স্ট্যান্টিনোপলও জয় করল (১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ), যা ইস্তানবুল নাম নিয়ে আজ অবধি তুরস্কের অধিকারে আছে।
কিন্তু এর পরেও ইসলামী বাহিনী ইউরোপের অভ্যন্তরে খুব বেশী যে অগ্রসর হতে পারে নাই তার পিছনে ক্যাথলিক চার্চের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইসলামী আগ্রাসনে বাইজেন্টাইন রোমান সাম্রাজ্যের পতন-পরবর্তী কালে ইসলামী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব ইউরোপে প্রতিরোধের শক্তি হিসাবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল বৃহৎ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র রাশিয়া। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপ ছিল রাজনৈতিকভাবে তুলনায় অনেক বেশী বিভাজিত। বেশী রকম রাষ্ট্রীয় বিভাজন থাকলেও পশ্চিম ইউরোপের সমাজ বা রাষ্ট্রগুলিতে খ্রিস্টধর্ম এবং পোপ কেন্দ্রিক চার্চ যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে তা ইসলামী আক্রমণ অভিযান প্রতিহত করতে বিরাট ভূমিকা রাখে।
ক্যাথলিক চার্চের এই ঐক্য রক্ষাকারী ভূমিকা বলার সময় আমরা যেন এমন মনে না করি যে চার্চের আধিপত্যের ফলে পশ্চিম ইউরোপ অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ ও বিদ্রোহ থেকে মুক্ত ছিল। রাজাদের তথা রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক যুদ্ধ যেমন লেগে থাকত তেমন রাজাদের বিরুদ্ধে সামন্তদের বিদ্রোহও অনুপস্থিত ছিল না। এ ছাড়া ছিল সামন্ত প্রভুদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ। অর্থাৎ চার্চের নিয়ন্ত্রণ বা পোপের আধিপত্যের ফলে পশ্চিম ইউরোপে অভ্যন্তরীণভাবে শত শত বৎসর ব্যাপী শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছিল এ কথা মনে করা ভুল হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সবার উপরে পোপের নৈতিক অবস্থান পশ্চিম ইউরোপকে অনেকখানি সামাজিক সংহতি এবং তুলনামূলক শান্তি ও স্থিতিশীলতা দিয়েছিল। এর জন্য প্রাচ্য সমাজের মত প্রধানত বৃহদায়তন রাষ্ট্র অথবা নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্র নির্ভর এককেন্দ্রিক শাসনের প্রয়োজন হয় নাই।
পশ্চিম ইউরোপে চার্চের এই ভূমিকাকে বুঝলে আমরা সেখানে ভিতর থেকে বুর্জোয়া সমাজের উত্থানের প্রক্রিয়াকেও অনেকাংশে বুঝতে পারব। বুর্জোয়া শ্রেণীকে কেন্দ্র করে আধুনিক এবং শিল্প সভ্যতার যে উদ্ভব পশ্চিম ইউরোপে হয়েছে তার মর্মে যে ব্যক্তিসত্তা আছে তাকে বুঝতে না পারলে আমরা আধুনিক ইউরোপের উদ্ভবের বিষয়টাও বুঝব না। বস্তুত রাষ্ট্র থেকে চার্চের স্বতন্ত্র এবং প্রাধান্যকারী অবস্থান পশ্চিম ইউরোপে রাজা বা রাষ্ট্রকে নিরকুশ হতে দেয় নাই। এর ফলে সেখানে সামন্ত শ্রেণীর তুলনামূলকভাবে স্বাধীন অস্তিত্ব সম্ভব হয়। এই সামন্ত শ্রেণীর শক্তিশালী অবস্থান রাজার বা রাষ্ট্রের শক্তিকে খর্ব করত যা আবার চার্চকে সুবিধাজনক অবস্থায় রাখত। এভাবে পশ্চিম ইউরোপে চার্চ, রাষ্ট্র এবং সামন্ত শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্বের পাশাপাশি ঐক্য ও সমন্বয়ের মাধ্যমে এমন এক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত ছিল যার ফলে সেখানে ব্যক্তি ও গণতন্ত্রের বীজ রক্ষা পেয়েছিল।
চার্চের প্রধান বা পোপ বংশগত হতে পারত না। কারণ পাদ্রী বা পুরোহিতরা বিবাহ করতে পারত না। সুতরাং এখানে যে ধরনের হোক নির্বাচন বা মনোনয়নের ভূমিকা থেকে গিয়েছিল। অন্য দিকে, সামন্ত ভূস্বামীর ব্যক্তি মালিকানার মধ্যে রক্ষা পেয়েছিল ব্যক্তির মালিকানা এবং অধিকার। সর্বোপরি, রাজাকে পরামর্শ দান এবং রাজকার্যে সহায়তার জন্য যে রাজসভা বা পার্লামেন্ট থাকত সেখানে সামন্ত্র প্রভু এবং পুরোহিত বা পাদ্রীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এই রকম এক সামাজিক বাস্তবতায় ব্যবসায়ী এবং কারখানা মালিকদের অস্তিত্ব পরবর্তীকালে পুঁজিবাদের দিকে অর্থনীতির ক্রমবিকাশে ধীরগতিতে হলেও ভূমিকা রেখেছিল।
তবে নবজাগরণের পূর্ব পর্যন্ত গোটা মধ্য যুগ ছিল অন্ধকারের যুগ যখন যুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিবর্তে প্রধানত ধর্ম বিশ্বাস দ্বারা মানুষের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন নিয়ন্ত্রিত হত। ধর্ম ছিল মধ্য যুগের ভাবাদর্শ। যে কথা ইতিপূর্বে বলেছি চতুর্দশ-সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রাচীন গ্রীক ও রোমান বা লাতিন শিল্পকলা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পুনরুজ্জীবনের ফলে নবজাগরণ শুরু হলে অন্ধকার যুগের অবসান ঘটে এবং ধর্মের যে আধিপত্য ইউরোপে এতকাল ছিল তা ভেঙ্গে পড়তে থাকে। তবে রেনেসাঁর পূর্বে ছিল প্রায় দুই শতাব্দীব্যাপী ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের কাল।
ক্রুসেড ছিল খ্রিস্টানদের তীর্থভূমি জেরুসালেম এবং প্যালেস্টাইনকে মুসলমানদের আধিপত্য থেকে মুক্ত করার জন্য ইউরোপের খ্রিস্টানদের যুদ্ধ, যা ১০৯৬ সালে শুরু হয়ে ১২৯১ সাল পর্যন্ত চলে। খ্রিস্ট্রিয় শক্তি প্যালেস্টাইন মুক্ত করার জন্য অনেক কয়টি অভিযান পরিচালনা করে এবং জেরুসালেম ও প্যালেস্টাইনের অনেক এলাকা মুক্ত করতে সক্ষমও হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্রুসেড ব্যর্থ হয়। মুসলমানদের হাতে ১২৯১-তে খ্রিস্টানদের শেষ দুর্গের পতন হলে খ্রিস্টানদের জেরুসালেমকে মুক্ত করার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়। এভাবে ক্রুসেডের অবসান হয়। দুইশত বৎসর ব্যাপী ক্রুসেডে ইউরোপের বিপুল জীবন ও সম্পদ ক্ষয় হয়। ক্রুসেডের ব্যর্থতা ছিল পোপ এবং ধর্মের মর্যাদার উপর বিরাট আঘাত। এর ফলে নূতন উদ্যমে জেগে উঠতে থাকা ইউরোপের শক্তি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও জাগতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবার সুযোগ পায়। এর ফলে ঘটে নবজাগরণ। এটা লক্ষ্যণীয় যে, ক্রুসেডের সমাপ্তি এবং নবজাগরণের সূচনা প্রায় একই সময়ে ঘটে। প্যালেস্টাইনের শেষ খ্রিস্টান দুর্গের পতন ঘটে ১২৯১-তে। এটাও লক্ষ্যণীয় যে নবজাগরণ চর্তুদশ শতাব্দীতে প্রবল রূপ নিলেও তার সূচনা প্রকৃতপক্ষে ক্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে হয়। অর্থাৎ ব্যাপারটা এমন যে, ব্যর্থ ধর্মযুদ্ধের কাল শেষ হবার পাশাপাশি শুরু হয়েছে সফল নবজাগরণের কাল। এভাবে ইউরোপের উত্থান শুরু হয়।
তবে এই উত্থান বাধামুক্ত ছিল না। অনেক সংগ্রাম করেই নবজাগরণের পথে ইউরোপকে অগ্রসর হতে হয়েছে। এই সংগ্রাম ছিল প্রধানত বিদ্যমান ধর্মের আধিপত্যের বিরুদ্ধে। একদিকে, ধর্মযুদ্ধের ব্যর্থতা, অপরদিকে সাহিত্য, শিল্পকলা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ফলে নবজাগরণ ক্যাথলিক চার্চের প্রবল প্রভাবের উপর আঘাত হানে। তার ফলে জ্ঞান জগতে লোকবাদী বা জাগতিক চেতনার উন্মেষ ঘটাটা যে সম্ভব হয় শুধু তা-ই নয়, অধিকন্তু এর একটা ফল হয় বিদ্যমান খ্রিস্টান ধর্মের সংস্কার। ক্যাথলিক চার্চের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬), ক্যালভিন (১৫০৯-১৫৬৪), জুইংলি (১৪৮৪-১৫৩১) ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্ম সংস্কারক তাদের মতবাদ প্রচার করতে থাকেন, যার মূল কথা ছিল যীশু খ্রীষ্টের মূল আদর্শে ফিরে যাওয়া তথা মূল বাইবেলের শিক্ষায় খ্রিস্টান সমাজের পুনর্গঠন।
প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন (ষোড়শ শতাব্দীতে সূচিত) পশ্চিম ইউরোপের উত্তরাংশে ক্রমে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ক্যাথলিক চার্চ তাকে দমনের জন্য অনেক চেষ্টা চালায়। বিভিন্ন দেশে বহু সংখ্যক প্রোটেস্ট্যান্টকে হত্যা করা হয়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের মধ্যে যুদ্ধও সংঘটিত হয়, যার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্ট তথা ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবকে ঠেকানো গেল না। ক্রমে সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর থেকে চার্চের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হল।
প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের প্রভাব পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে পোপ তথা কেন্দ্রীভূত চার্চের মর্যাদায় বিরাট আঘাত করে। এর ফলে রাষ্ট্রের উপর এতকাল ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে চার্চের যে আধিপত্য ছিল তা দুর্বল হতে বা ভেঙ্গে পড়তে থাকে। এই ভাঙ্গন সবচেয়ে প্রবল রূপ নেয় ইংল্যান্ডসহ উত্তরের কয়েকটি দেশে। একদিকে, ষোড়শ শতাব্দীতে শুরু হয়ে ইউরোপব্যাপী সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল ধর্মসংস্কার আন্দোলন। অপর দিকে, সপ্তদশ শতাব্দী থেকে শুরু হল যুক্তি ও জ্ঞান চর্চা নির্ভর আলোকায়নের যুগ (Age of Enlightenment বা Age of Reason), যা চলল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত। চার্চের আধিপত্যের যুগ শেষ হয়েছে। ফলে দর্শন ও যুক্তির বিচারে জীবন ও জগতের সবকিছুকে দেখার একটা জোয়ার শুরু হয় বুদ্ধিবৃত্তির জগতে। ধর্মসংস্কার এবং আলোকায়নের যুগের আর একটা ফল ইউরোপে জাতি-রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশ। মানুষের চিন্তার জগতে যে বিপ্লব ঘটতে থাকে তার ফল হল যুগান্তকারী। চিন্তার বিপ্লবের হাত ধরাধরি করে ঘটতে শুরু করে রাজনৈতিক তথা রাষ্ট্র বিপ্লব। ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতাব্দীতে পার্লামেন্টের সঙ্গে রাজার বিবাদ ঘটে, যা ক্রমে গৃহযুদ্ধ ও বিপ্লবে রূপ নেয়। এই বিপ্লবে একটা পর্যায়ে ক্রমওয়েলের (জন্ম ২৫ এপ্রিল ১৫৯৯ – মৃত্যু ৩ সেপ্টেম্বর ১৬৫৮) নেতৃত্বমূলক ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজা ১ম চার্লস পরাজিত ও বন্দী হন। বিচারে রাজাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ৩০ জানুয়ারী ১৬৪৯-এ রাজার শিরোশ্ছেদ করা হয়। ১৬৫৩ থেকে ১৬৫৮ পর্যন্ত ক্রমওয়েল শাসন করেন। ক্রমওয়েলের মৃত্যুর পর রাজতন্ত্র ফিরে এলেও ইতিহাসের গতি ছিল নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ১৬৮৮-তে আর একটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র শাসনের মূল ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে চলে যায়। ফ্রান্সে ১৭৮৯-তে ঘটে আরও প্রচণ্ড এবং যুগান্তকারী একটি ঘটনা – ফরাসী বিপ্লব। এইভাবে পশ্চিম ইউরোপে আধুনিক শিল্প সভ্যতার নায়ক হিসাবে যে ব্যক্তিসত্তা অপরিহার্য ছিল তার উদ্ভব ঘটে। ফলে ইউরোপে ঘটল আধুনিক সভ্যতার সূচনা। ঘটল শিল্প বিপ্লব। প্রতিষ্ঠিত হল শিল্প নির্ভর এবং গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র। এই সব ঘটনার পাশাপাশি পৃথিবী ব্যাপী চলল ইউরোপের জয়যাত্রা।
এটা স্পষ্ট যে ধর্মের তথা চাচের্র আধিপত্য খর্ব না হলে আধুনিক ইউরোপের জন্ম সম্ভব হত না। কিন্তু বিস্ময়কর মনে হলেও এটাই আবার সত্য যে, আধুনিক ইউরোপের জন্মই সম্ভব হত না যদি সেখানে খ্রিস্টধর্ম না থাকত এবং কয়েক শতাব্দী ব্যাপী ক্যথলিক চার্চের আধিপত্য না থাকত।
কেন এ কথা বলছি তা বুঝার জন্য খ্রিস্টধর্মের কিছু বৈশিষ্ট্যের দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। এটা ঠিক যে আর সব আলোকবাদী ধর্মের মত খ্রিস্টধর্মও অন্ধ ও যুক্তি-প্রমাণহীন বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন ঈশ্বর, আত্মা, স্বর্গ-নরক ইত্যাদি সংক্রান্ত ধারণা। কিন্তু এ ধরনের বিশ্বাস নির্ভর ধারণাগুলি সে কালে সাধারণ মানুষের জন্য স্বাভাবিক ছিল এবং দেবতা বা ইশ্বর কিংবা অলৌকিক শক্তি এবং আত্মা ইত্যাদি ধারণাকে কেন্দ্র করে মানুষ তার ধারণা বা বিশ্বাসের যে কাঠামো গড়ে তুলত তা দিয়ে তার বাস্তব জীবনকেও কম বা বেশী নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে চাইত। কিন্তু এই বিশ্বাসের কাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে খ্রিস্টধর্ম এমন কিছু মূল্যবোধ এবং নীতি বা ধারণাকে গুরুত্ব দিয়েছিল যা মানুষের মানবিক গুণাবলীর বিকাশের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। যীশুখ্রীষ্টের বাণীতে ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে মানুষের জন্য প্রেম, সহমর্মিতা এবং সেবা ধর্মকে যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এ ক্ষেত্রে তার উল্লেখ করতে হয়। খ্রিস্টধর্মে শুধু যে যীশু ইশ্বর পুত্র তা-ই নয়, এমন কি মানুষও তা-ই, যে কারণে বাইবেলে যীশু ঈশ্বরকে নিজের সঙ্গে অন্য সব মানুষের পিতা বলছেন, ‘কেননা তোমরা সকলে, খ্রিস্ট যীশুতে বিশ্বাস দ্বারা, ঈশ্বরের পুত্র হইয়াছ।’(বাইবেল, নূতন নিয়ম, গ্যালাতীয়, ৩:২৬)।[1] কিংবা ‘তখন যীশু লোকসমূহকে ও নিজ শিষ্যদিগকে কহিলেন, ….. তোমরা সকলে ভ্রাতা। আর পৃথিবীতে কাহাকেও “পিতা” বলিয়া সম্বোধন করিও না, কারণ তোমাদের পিতা এক জন, তিনি সেই স্বর্গীয়।’(বাইবেল, নূতন নিয়ম, মথি লিখিত সুসমাচার, ২৩:১,৮-৯)। অথবা ‘যীশু তাঁহাকে (মগ্দলীনী মরিয়মকে) কহিলেন, আমাকে স্পর্শ করিও না, কেননা এখনও আমি ঊর্ধ্বে পিতার নিকটে যাই নাই; কিন্তু তুমি আমার ভ্রাতৃগণের কাছে গিয়া তাহাদিগকে বল, যিনি আমার পিতা ও তোমাদের পিতা, এবং আমার ঈশ্বর ও তোমাদের ঈশ্বর, তাঁহার নিকটে আমি ঊর্ধ্বে যাইতেছি।’ (যোহন- ২০:১৭)।
অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক মূলত দাস ও প্রভুর না হয়ে সন্তান ও প্রেমময় পিতার সম্পর্ক হয়ে দেখা দেয়। বাইবেলে মানুষের প্রতি যে বিরাট মর্যাদা যীশু দিয়েছেন তার প্রভাবে মানুষকে অধিকারহীন ও অসহায় দাস বা ইসলামের মত ‘বান্দা’ হিসাবে না দেখে মানুষ হিসাবে দেখা হয়েছে। খ্রিস্ট্রিয় এই দৃষ্টিভঙ্গীর গভীরে ধর্মীয় আবরণে সংগুপ্ত ছিল ব্যক্তি মানুষের মুক্তি এবং স্বাধীনতার চেতনা।
অপর একটি বৈশিষ্ট্য খ্রিস্টধর্মকে অনন্যতা দান করেছে, তা হল এক স্বামী-এক স্ত্রী ভিত্তিক বিবাহ ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব প্রদান, ‘সুতরাং তাহারা আর দুই নয়, কিন্তু একাঙ্গ।‘ (মথি- ১৯:৬)
বস্তুত এর ফলে প্রাচ্য সমাজে অখ্রিস্ট্রিয় সমাজগুলিতে এক স্বামীর বহু নারী বিবাহের যে অবাধ সুযোগ ছিল ইউরোপে সেই সুযোগ থাকে নাই। খ্রিস্টধর্ম পুরুষতান্ত্রিক হলেও এবং নারী-পুরুষের সমাধিকার না দিলেও এক স্বামী এক স্ত্রী ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব দিবার ফল হয়েছে যুগান্তকারী। এটি ভবিষ্যতে নারীর জন্য অধিকতর অধিকার বা সমাধিকার লাভের পথ খুলে দেয়।
অতীতে বিভিন্ন সময়ে আমরা ইউরোপে নারীর যে মর্যাদা ও ভূমিকা দেখতে পাই তা সমকালীন অনেক সমাজের তুলনায় বিস্ময়কর। শুধু ডাইনি পুড়ানো দেখলে হবে না। সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে নারীদের অংশগ্রহণকেও দেখতে পারতে হবে। এখানে স্পেনের রাণী ইসাবেলার (জন্ম ১৪৫১ খ্রীঃ – মৃত্যু ১৫০৪ খ্রীঃ। শাসনকাল ১৪৭৪-১৫০৪।) দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়। তিনি তার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি ছিলেন স্পেনের উত্তরাঞ্চলের একটি শক্তিশালী রাজ্য ক্যাস্তিলের রাণী। স্পেনের উত্তরাঞ্চলের অপর একটি শক্তিশালী রাজ্য আরাগনের রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী ফার্দিনান্দকে তিনি ১৪৬৯-এ বিবাহ করেন এবং স্বামীর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে তার সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করে ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দে মুসলিমদের শেষ রাজ্য গ্রানাডা জয়ের মাধ্যমে সমগ্র স্পেন থেকে মুসলিম শাসন উচ্ছেদ করেন। এই জয়ের মাধ্যমে স্পেন থেকে আটশত বৎসর স্থায়ী মুসলিম শাসন উচ্ছেদ হয়। স্পেনে ইসলামী শাসন ছিল ৭১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী। স্বামীর সঙ্গে রাণী ইসাবেলা যৌথভাবে স্পেন শাসন করেন। আমেরিকা আবিষ্কারের (১৪৯২ খ্রীঃ) জন্য অর্থ, জাহাজ ও জনবল দিয়ে তিনি ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে সাহায্য করেন। এভাবে আমেরিকা আবিষ্কারের কৃতিত্বের সঙ্গে তার নামও জড়িয়ে গেছে।
মধ্যযুগে খ্রিস্টান ইউরোপের বিভিন্ন রাজ্যে রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে জানা যায়, যা প্রাচ্য সমাজে সাধারণভাবে অভাবিত ছিল। মুসলমানদের অধিকার থেকে জেরুসালেম ও প্যালেস্টাইনকে মুক্ত করার জন্য দুই শত বৎসর ব্যাপী পরিচালিত ক্রুসেডে ইউরোপের খ্রিস্টান নারীদের বিপুল ভূমিকা ছিল। পুরুষদের পাশাপাশি তারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এবং প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল।
মধ্যযুগীয় ইউরোপের নাইট বা যোদ্ধা শ্রেণীর কথা হয়ত অনেকের জানা আছে। তাদেরকে আমরা প্রাচীন ভারতের ক্ষত্রিয় কিংবা আরও সঠিকভাবে জাপানের সামুরাই যোদ্ধা শ্রেণীর সঙ্গে তুলনা করতে পারি। তাদের ‘শিভালরি’ বা বীরধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি ছিল নারীর প্রতি সম্মান এবং নারী ও দুর্বলের বিপদ দেখলে তাকে উদ্ধারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া। ইউরোপ এমনই ইউরোপ হয় নাই। নারীর প্রতি এই যে গুরুত্ব ও মর্যাদা দান তার ভাবাদর্শিক প্রেরণার উৎস যদি খ্রিস্টধর্মে না থাকত তাহলে আমরা মধ্যযুগের ইউরোপে নারীর এমন গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান দেখতে পেতাম না। কারণ মধ্যযুগের ভাবাদর্শ ছিল ধর্ম।
এমনিতে খ্রিস্টধর্ম ছিল শান্তিবাদী। শান্তিপূর্ণভাবে জন্ম নেওয়া এই ধর্ম সুদীর্ঘকাল ছিল নির্যাতনের শিকার। প্রথমে ইহুদীদের চাপে এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা যীশুখ্রিস্টকে প্যালেস্টাইনের রোমান শাসক ক্রুশবিদ্ধ করেন। এরপরও যখন রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্ম ছড়িয়ে পড়তে থাকে তখন বহুসংখ্যক খ্রিস্টানকে হত্যা ও অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও খ্রিস্টধর্মের প্রসারকে রোধ করা যায় নাই। এটি ছিল প্রথমে দাস, দরিদ্র এবং নিম্নবর্গের জনসাধারণের ধর্ম। কিন্তু ক্রমে রোমের স্বাধীন মানুষ, দাস মালিক, রোমের সেনাবাহিনীর সদস্য এবং উচ্চ শ্রেণীর নাগরিকদের মধ্যেও তা বিস্তৃত হয়। প্রায় তিনশত বৎসর পর রোমের সম্রাট কন্সট্যান্টাইন (শাসনকাল ৩০৬ খ্রীঃ – ৩৩৭ খ্রীঃ) ৩১৩ খ্রীষ্টাব্দে ‘মিলান অনুশাসন’ দ্বারা খ্রিস্টধর্মসহ সকল ধর্মের প্রতি সহনশীলতার নীতি ঘোষণা করলে খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে রোমান রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের অবসান হয়। তার মা হেলেনা ছিলেন খ্রিস্টান। তিনিও তার মায়ের ধর্ম গ্রহণ করেন। সম্রাট কন্সট্যান্টাইনের উপর খ্রিস্টধর্মের প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে এটুকু বলাই মনে হয় এখানে যথেষ্ট হবে যে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকে ক্রুশবিদ্ধ করে ভয়ানক যন্ত্রণা দিয়ে রোমান সাম্রাজ্যে হত্যার যে জনপ্রিয় বিধান ছিল তা রদ করে তিনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান চালু করেন। এবং ৩২৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি গ্ল্যাডিয়েটদের দিয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য অনুষ্ঠিত নৃশংস মরণ খেলা নিষিদ্ধ করেন। তাছাড়া রোমান সাম্রাজ্যের বন্দীদেরকে কারাগারের অন্ধকারে সারাক্ষণ রাখা নিষিদ্ধ করে তিনি তাদেরকে কারাকক্ষের বাইরে যাবার এবং দিনের আলো পাবার অধিকার দেন।
ভয়ানক সহিংসতা, নির্দয়তা, অসাম্য, যুদ্ধ এবং দাসত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত রোমান সভ্যতার বিরুদ্ধে খ্রিস্টধর্ম ছিল একটা প্রতিক্রিয়া বা বিদ্রোহ। তবে এই বিদ্রোহ ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু দাস, দরিদ্র এবং পরাধীন জাতিসমূহের মানুষদের মনে মানুষের মুক্তির জন্য ক্রুশে আত্মদানকারী যীশুর প্রভাব হল দূর প্রসারী ও প্রচণ্ড। প্রেমময় ও দয়ার্দ্র যে সত্তার আশ্রয় সাধারণ মানুষ খুঁজে ফিরছিল তা তারা পেল ক্রুশবিদ্ধ যীশু এবং তার প্রেমময় ও পরম পিতা ঈশ্বরের কল্পনার মধ্যে।
পোপকে কেন্দ্র করে রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিকাশ আদি খ্রিস্টান ধর্মের সহজ, সরল ও বিকেন্দ্রীভূত রূপের অবসান ঘটায় এবং মূল খ্রিস্টান ধর্মে ছিল না এমন কিছু প্রথা বা নিয়মের বিকাশ ঘটায়। এর মধ্যে একটা ছিল অর্থের বিনিময়ে চার্চ বা পোপের নিকট থেকে পাপমোচন এবং স্বর্গে যাবার ব্যবস্থা। রাষ্ট্র থেকে পার্থক্য থাকলেও রাষ্ট্রের উপরেও চার্চের নিয়ন্ত্রণ বা আধিপত্য চার্চকে ক্রমে একটি বিশেষ সুবিধাভোগী এবং নিপীড়ক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিল। ক্রুসেডের ব্যর্থতা এবং রেনেসাঁ বা নবজাগরণ চার্চের নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করে ফেলে। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষের ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একটি ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের উত্থান স্বাভাবিক ছিল। এটা কেন্দ্রীভূত চার্চের ক্ষমতার অবসান ঘটায়। এর ফলে ধর্ম যেমন আদি খ্রিস্টধর্মের ব্যক্তির বিশ্বাস পালনের স্বেচ্ছামূলক জায়গায় ফিরল তেমন রাষ্ট্র হয়ে উঠল অনেকাংশে ধর্মের খবরদারি মুক্ত। এই অবস্থায় বুদ্ধিবৃত্তির উন্নততর চাহিদা পূরণে দেখা দিল ‘এনলাইটেনমেন্ট’ বা আলোকায়নের যুগ; গুরুত্ব পেল যুক্তি এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য।
এভাবে ব্যক্তি ও তার চেতনার মুক্তির ফলে পুঁজির বিকাশের যে পরিবেশ সৃষ্টি হল তা সম্ভব করল উন্নততর যন্ত্র-কৌশল প্রবর্তনের মাধ্যমে শিল্প বিপ্লব। এ ক্ষেত্রে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে স্টীম ইঞ্জিন উদ্ভাবন ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এভাবে শুধু ইউরোপ নয়, পৃথিবীও প্রবেশ করল মানুষের ইতিহাসের নবতর অধ্যায়ে, যে অধ্যায়ে আজ আমরা বাস করছি। ব্যক্তির মুক্তি না ঘটলে আধুনিক পুঁজির এবং সভ্যতার এই জয়যাত্রা সম্ভব হত না।
ক্যাথলিক চার্চের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হয়ে বিভিন্ন প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ ও চার্চের বিকাশ এবং পাশাপাশি যুক্তিবাদের ক্রমপ্রসার একদিকে উদার ধর্মমতের দিকে যেমন সমাজের বৃহত্তর অংশকে নেয় অপর দিকে তেমন একটি সংখ্যালঘু কিন্তু উন্নততর বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞানতত্ত্বের অধিকারী গোষ্ঠীকে ক্রমবর্ধমানভাবে নিরীশ্বরবাদ বা ধর্ম সম্পর্কে অবিশ্বাসের দিকে নেয়। কিন্তু ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপারে যেমনটাই ঘটুক চার্চের জবরদস্তি বা বলপ্রয়োগের কাল শেষ হয়।
ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এইসব আন্দোলন ও পরিবর্তনের পাশাপাশি ঘটতে থাকে সামন্তবাদ ও স্বৈরতন্ত্র বিরোধী গণতান্ত্রিক চেতনা ও আন্দোলনের ক্রমবিকাশ। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ড-ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ প্রত্যক্ষ করে জাতীয় ও গণতান্ত্রিক বিপ্লব। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ইংল্যান্ডে রাজা ও পার্লামেন্টের মধ্যে যুদ্ধে রাজা পরাজিত এবং রাজতন্ত্র সাময়িকভাবে উচ্ছেদ হলেও ১৬৬০ সালে রাজতন্ত্র ফিরে আসে। ফ্রান্সেও ১৭৮৯-এর প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মাধ্যমে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হলেও পরবর্তী সময়ে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে পুনরায় রাজতন্ত্র ফিরে আসে। কিন্তু এগুলি ছিল পূর্বতন রাজতন্ত্রের অক্ষম অনুকরণ। ইংল্যান্ডে ১৬৮৮-এর বিপ্লবের মাধ্যমে রাজতন্ত্র নিয়মতান্ত্রিক এবং নিয়ন্ত্রিত রাজতন্ত্রে পর্যবসিত হয় যেখানে রাজার নামে প্রকৃতপক্ষে জন-প্রতিনিধিরা দেশ শাসন করে। ফ্রান্স বিভিন্ন পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।
এভাবে পশ্চিম ইউরোপ পুঁজিবাদের বিকাশ ও শিল্প বিপ্লবের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু আধুনিক গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধের অনেক কিছুরই বীজ আমরা খুঁজে পাব খ্রিস্টধর্মের ভিতর। ধর্ম বিশ্বাসের অন্ধত্ব এবং বিশেষত ধর্মের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে চার্চের জবরদস্তির চাপে যে ব্যক্তিসত্তার বীজ ছিল এতকাল সঙ্কুচিত ও অবদমিত হয়ে কেন্দ্রীভূত চার্চের অবসান পশ্চিম ইউরোপের সামন্তবাদী সমাজ জমিতে সেই বীজের অঙ্কুরোদ্গমের মাধ্যমে পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রের উত্থানের পথ করে দেয়।[2]
[ চলবে… ]
রেফারেন্স:
[1] পবিত্র বাইবেল: নূতন ও পুরাতন নিয়ম, বাংলা অনুবাদ, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা।
[2] সমাজতত্ত্ববিদ ম্যাক্স ওয়েবার প্রোটেস্ট্যান্ট নীতিবোধের মধ্যে পুঁজিবাদের বিকাশের শর্ত দেখতে পেয়েছেন। Max Weber, The Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism.
সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৭; ১০:০০ অপরাহ্ন
“বর্বরদের হাতে রোমান সভ্যতার চূড়ান্ত পতন হয় ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে। এরপর থেকে একেবারে প্রায় চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত যে কাল চলে সেটাকে বলা হয় অন্ধকার যুগ, যখন ধর্মের বিধিনিষেধের কারাগারে মানুষের যুক্তি-বুদ্ধি-বিবেচনা বন্দী হয়ে পড়ে। মানুষের চিন্তার নিয়ামক হিসাবে দেখা দেয় অন্ধ বিশ্বাস নির্ভর ধর্ম। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পথও অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।”
ইওরোপে যখন অন্ধকার যুগ তখন আরবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ। ইতিহাসকে শুধু তাই ইওরোপিয়ান বয়ান দিয়ে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক আছে। যখন যেখানে ক্ষমতা থাকে সেখানেই নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্ম হয়। পুরো মধ্যযুগে ক্ষমতার কেন্দ্র বাগদাদ এবং স্পেনে মুসলিম বিজ্ঞানি এবং দার্শনিকেরা রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যায় ব্যাপক উন্নয়ন করে। রেনেসাঁর সময় ইওরোপ সেটা আত্তীকরণ করে নেয়, আর যথারীতি মুসলিম মনীষীদের তাদের প্রাপ্য সম্মান দেয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখে। কিছু ক্ষেত্রে তাদের নাম ও কাজ খণ্ডিতভাবে উপস্থাপিত করে। যেসব ক্ষেত্রে মুসলমানদের সরাসরি অবদান ছিল না, সেখানেও তার মূল গ্রিক এবং ল্যাটিন টেক্সট অনুবাদ করে যার কারণে রেনেসাঁর সময়ে ইওরোপ তাদের প্রাচীন জ্ঞান (গ্রিক, রোমান) প্রথম আরবদের কাছ থেকে পায়। ইতিহাসে যার যেটুকু প্রাপ্য তাকে সেটা দিতে হবে।
সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৭; ৭:২৬ পূর্বাহ্ন
মুসলমানদের গ্রীক-লাতিন কিংবা নিজস্ব জ্ঞানচর্চার তাৎপর্য নিয়ে তৃতীয় অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি। মনে হয় সবটা না হলেও কিছু প্রশ্নের উত্তর সেখানে আছে। তবে সেটা (তৃতীয় অধ্যায়) এখনও অপ্রকাশিত রয়েছে। অবশ্য এই রচনায় আমি আধুনিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠায় ইউরোপ তথা খ্রীষ্টীয় সমাজের সাফল্যের কারণ এবং সেই সঙ্গে ইসলাম ও আরব তথা মুসলিম সমাজের ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করতে চেয়েছি। এটাই আমার অনুসন্ধানের মূল জায়গা। এই সঙ্গে উঠে এসেছে বৌদ্ধ অথবা বৌদ্ধ ধর্ম প্রভাবিত সমাজগুলির তুলনামূলক সাফল্যের বিষয়টিও। আমার ব্যাখ্যা অথবা বক্তব্যের সঙ্গে সকলে সহমত হবেন এই আশা আমি করি না। তবে মুসলিম সমাজের একজন হিসাবে আমার আত্মজিজ্ঞাসার ফসল এই লেখাটি।