০
১৩৭৩ বার পঠিত
শুরুটা করি বব ডিলানের গানের একটা লাইন দিয়া, ‘হেইট নাথিথ বাট হেইটরেড‘। ঘৃণার প্রতি ঘৃণাতে আমার কোন আপত্তি নাই ডিলানের মতো। আর তা যদি হয় অরগানাইজড রিলিজিয়নের নামে। বঙ্গদেশে যেহেতু জন্ম, ইসলামের যন্ত্রণাতেই যেহেতু জন্ম থেকে আছি তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের রাগ, ক্ষোভ, ফোকাস সবকিছুই ইসলামের দিকে যে যাবে তাতে কারুরই কোন সন্দেহ থাকার কারণ নাই। তবে সমস্যা হয় যখন আমরা অজান্তেই (!) ইসলাম ধর্মের সমালোচনা করতে গিয়ে অন্য ধর্মের প্রতি প্রেম দেখানো শুরু করি।
আর তা করতে গিয়ে মাঝে মাঝে আমরা প্রমাণ করার চেষ্টা করি যে অন্যধর্মগুলা ইসলামের তুলনায় কতটা ভালো, তারা জ্ঞান বিজ্ঞান সাধনায় কতটা অবদান রাখছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সেটা করতে গিয়ে আমরা কখন যে সুডো-হিস্টরি, মিথ্যা, সায়েন্টিফিক রেসিজম, এমনকী ফ্যাসিস্ট ফিলসফির প্রোপাগান্ডাও যে ব্যাবহার করছি তা মনে রাখছিনা আমরা।
যেমন কিছুদিন আগে ফেসবুকে কোন একজনের পোস্টে দেখলাম সে দাবী করছে খাটি আর্য বংশীয় লোকজনের মধ্যে ইহুদি আর নরডিকেরা উচ্চ শ্রেণীর এবং তারা জ্ঞানে, বুদ্ধিতে প্রজ্ঞায়ও এগিয়ে আছে। সাথে এটাও ইমপ্লাই করার চেষ্টা করলেন আরবেরা খারাপ, কারণ তাদের সাথে নিগ্রয়েডদের সংমিশ্রণ আছে আর যে কারণে তাদের কোকড়া চুল, আর ইহুদিদের চুল স্ট্রেইট। নিঃসন্দেহে ভদ্রলোক ইহুদিদের আসলে সামনাসামনি কখনো দেখে নি বা গুগলে সার্চ করে তারা দেখতে আসলে কেমন তা যাচাই করারও প্রয়োজন বোধ করে নি। আর রেস বা এথনিসিটি সংক্রান্ত পড়াশুনা ভদ্রলোকের শ’দেড়েক বছর আগের লেখা কনসেপ্ট যেখানে মানবসম্প্রদায়ের রেস মাত্র তিনখানা – মংগলয়েড, নিগ্রয়েড আর ককেশিয়ান।
ভদ্রলোকের জানা নাই উনি যেভাবে নরডিকদের উচ্চ শ্রেণীর বলছেন ঠিক সেই প্রোপাগান্ডার কারণেই হাজার হাজার ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ঢুকতে হয়। ইহুদি আরবদের তুলনাতে তারা যে কতো আলাদা তা নানাভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও বলতে ভুলে গেছেন যে রিসেন্ট জেনেটিক স্টাডি প্রমাণ করে যে ইসরাইলি ইহুদিদের বিশাল একটা অংশের মানুষ জেনেটিকালি কত ক্লোজ সেই এলাকার প্ল্যালেস্টিনিয়ান, বেদুইনদের সাথে। একইসাথে ইসরাইলি জিনোমে ইউরোপিয়ান জিনের অবদান যে কম তা বললেও ভুল হবে।
এরপর গতকাল আরেক বন্ধুর স্ট্যাটাসে দেখলাম উলুধ্বনি যেহেতু আরবে দেয়া হয় তাই আগে আরবের লোকজন হিন্দু ছিল এজাতীয় কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। সাথে আরবদের হজ্বে সাত পাক ঘোরা, সাদা পোশাক পরা বা মাথা ন্যাড়া করার মতো বেশ কিছু ব্যাপারও তুলে ধরলেন যা হিন্দু ধর্মের আচারের সাথে কমন। এ থেকেই সিদ্ধান্ত আরবের লোকজন আগে হিন্দু ছিল।
প্রথমেই আসি, উলুধ্বনি প্রসঙ্গে। উলুধ্বনি শুধু হিন্দুদের কর্ম তা যদি ভেবে থাকেন তাহলে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। এশিয়া, আফ্রিকা, মিডলইস্ট এমনকী ইউরোপের কিছু অঞ্চলেও এর প্রচলন আছে। এটা এতোটাই ইউনিভার্সাল যে Ululation বলে ইংরেজি একটা শব্দও আছে। আর এর ব্যবহার বিয়ে, শবযাত্রা, যুদ্ধের চিৎকার, প্রার্থনা কোথায় নাই? অবগতির জন্য জানাই, এই উলুধ্বনির প্রথম লিখিত ইতিহাস হিন্দুস্তানে নাহ, সুদুর মিশরে ফারাওদের আমলে। এখন কেউ দাবী না করলেই হয় যে ফারাওরা সব হিন্দু ছিল।
এর পরে আসি সাদা ড্রেস প্রসঙ্গে। ইয়েস, মুসলিমরা হজ্বের সময় সাদা ড্রেস পরে। যেমন পরে হিন্দু ব্রাম্মণ এবং হিন্দু বিধবারা। এইবার আসেন দেখি আর কারা ধর্মীয় কারণে সাদা ড্রেস পরে। ইহুদিরা পরে? ইয়েস। জোরস্টেরিয়ানেরা পরে? ইয়েস। আফ্রিকান ভুডুওলারা পরে? ইয়েস। খ্রিস্টানেরা পরে? ইয়েস। তাহলে কীভাবে এটা হিন্দুদের একার পোশাক হয়ে গেলো তা একটু বুঝিয়ে বলুন।
এইবার আসি সাতপাকে ঘোরা কাবার চারপাশে যেমন হিন্দুরা ঘোরে। প্রসঙ্গত বলে নিই ভৌগলিকভাবে মুসলিম আরবদের চেয়ে ইহুদি আরবেরা অনেক কাছের, ইনফ্যাক্ট একই এলাকার। ইহুদিদেরও সারপাকে ঘোরার অভ্যাস আছে। আর সাত নম্বরটা বাদ দিলে পাক খেয়ে ঘোরার অভ্যাস আছে বা ছিল মেসোয়ামেরিকানদের, আফ্রিকানদের, ইউরোপিয়ান ড্রুইডদের, অস্ত্রেলিয়ান এবরজিনিদের। মনে হয় এই পাক খেয়ে ঘোরার অভ্যাসটাও ইউনিভার্সাল। বিশ্বাস না হলে নিজের ছোটবেলার কথা মনে করুন।
তারপর পেলাম সুষুপ্ত পাঠকের একটা লেখায়। উনি কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, ব্রুনো সবাইকেই দাবী করেছেন খ্রিস্টান পাদ্রি অথবা ফাদার। সাথে উনি বলার চেষ্টা করলেন যে খ্রিস্টিয় ডকট্রিনে থেকে, চার্চে বসবাস করে, খ্রিস্টিয় ধ্যানধারনার মধ্যেও যে তাহারা কতোটা বিজ্ঞান সাধনায় অবদান রেখেছেন। যদিও পরবর্তীতে উনার ভুলটা ধরিয়ে দেয়ার পরে ওনার লেখা থেকে কোপার্নিকাস আর গ্যালিলিওর নাম সরিয়ে নেন। তারপরেও ওনার সেই পোস্টের মুল বক্তব্যের সাথে দ্বিমত থেকেই যায়।
এটা সত্য যে মধ্যযুগে চার্চের ছত্রছায়ায় থেকে বেশ কিছু বিজ্ঞানী বের হয়ে এসেছে বটে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে চার্চ বিজ্ঞান সাধনাকে প্রমোট করছে। চার্চের ছত্রছায়া থেকে এরকম বিজ্ঞানীদের বের হয়ে আসার একমাত্র কারণ ছিল শুধুমাত্র চার্চ এবং চার্চের ছায়ায় তৈরি হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই পড়াশুনার সুযোগ এবং পরিবেশ ছিল। যেই মূহুর্তে চার্চের বিশ্বাসের কোন বিজ্ঞানীর আইডিয়া মিলতো তাদের দমন করতে এক মুহূর্ত সময় লাগতো না। বিশ্বাস না হলে গ্যালিলিও বা ব্রুনোর ইতিহাস দেখুন। গ্যালিলিও তবুও চার্চের সাথে আপোসে নিজের জান বাঁচাইতে পেরেছিল, কিন্তু ব্রুনো আপোসে না আসায় চার্চের হাতে পুড়ে মরে।
হ্যা, সময়ের সাথে সাথে চার্চের মনোভাবের পরিবর্তন এসেছে। যার পিছনের কারণ সম্ভবত চার্চের হাতে সেই ক্ষমতা নাই যেটা ছিল মধ্যযুগে। ঠ্যালায় পড়ে চার্চ এখন বিবর্তনবাদ পর্যন্ত মেনে নিয়েছে। যদিও তাদের নিজেদের মত তারপরেও মানছে তো।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন