০
২৪১৪ বার পঠিত
খ্রিস্টিয় সপ্তম শতকে হেজাজের মরূভূমির বিচ্ছিন্ন ছোট লোকালয় থেকে একটা ধূলিঝড় সৃষ্টি হলো। সেই ঝড়ের গতিবেগকে কাজে লাগিয়ে তার সাথে আরবী ঘোড়ার ক্ষিপ্রতা, তরবারির জোর আর বেদুঈন রণকৌশল দিয়ে আরব-মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের নতুন রাজনৈতিক ধর্ম ইসলাম উত্তর-পশ্চিমে বাইজ্যান্টাইন আর পূর্বদিকে পারসিক সাসানিড সাম্রাজ্য থেকে মুক্ত হলো।
পারসিক সাম্রাজ্য জয়ের অনেক আগে থেকে ইসলামের সাথে পারস্যের গভীর সম্পর্ক। বর্তমান দুনিয়ার প্রচলিত বড় ধর্মগুলোর উপর ইরানের প্রভাব অনেক বেশি। ইহুদী এবং খ্রিস্টান ধর্ম ইরানের প্রাচীন জরোয়াস্ট্রিয়ান ধর্ম থেকে অনেক কিছু সরাসরি গ্রহণ করেছে। ইরান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রিচার্ড ফলযের মতে, “the extraordinarily broad and profound influences of Iran on the world’s religions”। ইসলাম পরোক্ষভাবে ইহুদী ধর্ম এবং প্রত্যক্ষভাবে জরোআস্ট্রিয়ান ধর্ম এই দুটি ধর্ম থেকে অনেক রীতি-নীতি, নিয়ম-কানুন, গল্প-কাহিনী এসব গ্রহণ করেছে।
জরোআস্ট্রিয়ান ধর্মের বিশেষজ্ঞ ব্রিটিশ অধ্যাপক ম্যারি বয়েসের মতে, জরোআস্ট্রিয়ান ধর্ম দুনিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন ওহী থেকে নাজিলকৃত ধর্ম। অন্য যেকোন ধর্মের চেয়ে মানবতার উপরে জরোয়াস্ট্রিয়ান ধর্মের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অনেক প্রভাব অনেক বেশি।
“Zoroastrianism is the oldest of the revealed world-religions, and it has probably had more influence on mankind, directly and indirectly, than any other single faith.” – Boyce, Zoroastrians: Their Religious Beliefs and Practices
জরোয়াস্ট্রিয়ানদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হলো আভেস্তা, যার মধ্যে কিছু অংশ ‘গাঁথা’ নামে বিখ্যাত। বাংলা গল্প-গাঁথার গাঁথা শব্দটি ফারসি। জরোয়াস্ট্রিয়ান ধর্ম একত্ববাদী, তাদের ধর্মের প্রধান দেবতার নাম আহুরা মাজদা, যার নামে বর্তমানে মাজদা গাড়ির নামকরণ করা হয়েছে। জরোয়াস্ট্রিয়ান ধর্মে মানুষের চরিত্রের দ্বৈততাকে স্বীকার করা হয়। সেজন্য খারাপ কাজের জন্য আরেকজন আছে, যার নাম আংরা মাইনু, ইসলাম ধর্মের শয়তানের সাথে তুলনীয়। ভাল কাজে আহুরা মাজদা খুশি হয়, মন্দ কাজে আংরা মাইনু প্ররোচনা দেয় এমন ছিল তাদের বিশ্বাস।
সপ্তম শতকে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে পরাজিত হবার পর থেকে জরোয়াস্ট্রিয়ানদের কথা তেমন শোনা যায় না। আধুনিক সময়ে জার্মান দার্শনিক ‘দাস স্পেইক জরাথুস্ট্র’ নামক জনপ্রিয় বইয়ের মাধ্যমে তাদেরকে কিছুটা হলেও আলোচনায় আনেন। মুসলিমদের কাছ থেকে পালিয়ে কিছু জরোয়াস্ট্রিয়ান ভারত এবং চীনে চলে যান। বর্তমানে জরোয়াস্ট্রিয়ানদের মধ্যে বিখ্যাত যারা তারা প্রায় সবাই ভারতে বাস করেন। টাটা পরিবার(বিখ্যাত ধনকুবের রতন টাটা), ওয়াদিয়া পরিবার (পাকিস্তানের জিন্নাহ পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত), জিজিভয়, গোদরেজ, ফিরোজশাহ মেহতা , হোমি ভাভা, সাইরাস পালঞ্জি মিস্ত্রি, ফিল্ড মার্শাল শ্যাম মানেকশা প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
আরেকটি কারণে পারসিকরা মাঝেমধ্যে আলোচনায় আসে সেটা হলো তাদের মৃতদেহ সতকার প্রক্রিয়া। পারসিকরা তাদের মৃতদেহ শকুনকে খাওয়ায়। মৃত্যুর পরে মৃতদেহ পাহাড়ে রেখে আসে সেখানে শকুন সেটা সাবাড় করে। ইদানীং কালে শকুন প্রজাতি বিলীণ হয়ে যাওয়ায় তাদের মৃতদেহ সতকার প্রক্রিয়ায় সমস্যা হতে থাকে। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শকুন প্রজাতিকে বিলীণ হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য পারসিকরা খুব সোচ্চার।
ইসলামের নবী মোহাম্মদের অন্যতম সঙ্গী সালমান ফারসি ছিলেন ইরানের জরোয়াস্ট্রিয়ান ধর্মের অনুসারী। জরোয়াস্ট্রিয়ান ধর্মের দুইজন গডের হাত থেকে রক্ষা পেতে তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মে গিয়ে দেখেন সেখানে একজনের বদলে তিনজন গড। ফলে সবশেষে তিনি নবী মোহাম্মদের সাথে থেকে একেশ্বরবাদী ইসলাম ধর্মে যোগ দেন, ইসলামের প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। সাহাবী সালমান ফারসি ছিলেন জরোয়াস্ট্রিয়ান ধর্ম নিয়ে নবী মোহাম্মদের জ্ঞানের অন্যতম প্রধান সোর্স।
সালমান ফারসি মদীনাকে মক্কার বেদুঈনদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য পরিখা/ খন্দক তৈরি করার পরামর্শ দেন। মুসলমানদের ইরান বিজয়েও সালমান ফারসি খুব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ৬৩৭ সালে সাসানিড সাম্রাজ্যের রাজধানী টেসিফন অবরোধের সময় সালমান ফারসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ইরানীদের নিজেদের মানুষ বলে আশ্বস্ত করেন। তারপরে তাদের সামনে তিনটি অপশান তুলে ধরেন। সালমান ইরানীদের জিজিয়া, ধর্মান্তর অথবা মৃত্যু এর যেকোন একটি বেছে নিতে বলেন। টেসিফন বিজয়ের পরে সালমান সেখানকার গভর্ণর হন। এছাড়া তিনি ফারসি ভাষায় কোরাণ অনুবাদ করেন যেটা ছিল বিদেশী কোন ভাষায় কোরানের প্রথম অনুবাদ।
ইরানীদের কাছে সালমান ফারসি এখনো একজন কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক হিসেবে সমধিক পরিচিত। নবী মোহাম্মদের মৃত্যুর পরে তিনি আলীর অনুসারী হন।( Ctesiphon in Smoke, Fire and Blood- Dr. Kourosh Aryamanesh)
জরোয়াস্ট্রিয়ান ধর্মের সাথে ইসলাম ধর্মের মিল-
জরোয়াস্ট্রিয়ান ধর্ম দুনিয়ার প্রাচীনতম আসমানী কিতাবের ধর্ম। ইব্রাহিমী ধর্মের অনেক আগে প্রচলিত হওয়ায় এই ধর্মের মাধ্যমে পরবর্তী সকল ধর্ম কোন না কোনভাবে প্রভাবিত হয়েছে। ইসলাম ধর্ম ইব্রাহিমী ধর্মের নবীনতম সদস্য বিধায় তারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জরোয়াস্ট্রিয়ান ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠার সময় পারসিক সালমান ফারসির ভূমিকা এবং ধর্মীয় নানা কাহিনীর প্রথাগত মিল থেকে এটি সুস্পষ্ট।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন