৯৫৬ বার পঠিত
একটি ভয়ঙ্কর রাত এবং ঈদযাত্রা:
আমার তখন গাড়ী ছিলনা। আমার বর বিদেশে পিএইচডি করছে। আমি দুই মেয়েকে সাথে নিয়ে শ্বশুরবাড়ী গেছি শ্বাশুড়ী ও শ্বশুরবাড়ীর সবার সাথে ঈদ করতে। ছোট মেয়েটার বয়স তখন এক বছরের কম। বড়টার ছয়।
ফেরার আগের রাতে হঠাৎ ছোট মেয়ের গায়ে জ্বর। অষুধেও জ্বর সারছে না। অষুধ খেলে ছেড়ে যায়। কিছু সময় পর আবার জ্বর আসে। ঐ অবস্থায়ই বাচ্চা কোলে নিয়ে বওনা দিলাম। আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে। না যেয়ে উপায় নেই। শীতের রাতে ট্রেনে শ্বশুরবাড়ি থেকে রাজশাহী আসব বলে স্টেশনে দাঁড়ালাম।
আব্দুলপুর স্টেশনে ঢাকা থেকে আসা পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনটি থামে মোটেই দু’মিনিট। ঈদের পর বলে প্রচণ্ড ভীড়। তার উপর কয়েকজন আর্মির লোক (তারা কাদিরাবাদ সেনানিবাসে যাবে) ট্রেন থেকে বড় বড় ট্রাঙ্ক নামাচ্ছে। ফলে আমরা ট্রেনে উঠতে না পেরে ট্রেনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ট্রাঙ্ক নামানো শেষ হলে উঠব। কিন্তু বিধি বাম। ওদের নামা শেষ হতেই ট্রেন চলতে শুরু করলো। আমি কোনমতে ট্রেনে উঠতে পারলাম। আমার দেবর আমাদের সাথে থাকা ব্যাগগুলো তুলে দিতে পারলো। কিন্তু সে এবং আমার বড় মেয়ে ট্রেনে উঠতে পারলো না।
আমি জীবনে কখনও এরকম অবস্থায় পড়িনি। আমার কান্না পাচ্ছিল। আমি কয়েকজন যাত্রীকে চেইন টানতে বললাম। কেউ আমার কথা শুনলো না। আমি বড় মেয়ের কথা ভেবে কাঁদতে লাগলাম। ও ভয় পাবে। আমাকে না পেয়ে কাঁদবে। পরের ট্রেন ক’টায়, আমি জানিনা। আদৌ কোন ট্রেন আছে কিনা, তাও জানিনা। থাকলেও লোকাল ট্রেন হবে। সেগুলোর চলাচলের সময়ের কোন ঠিক ঠিকানা নাই।
জানালার ফাঁক দিয়ে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে। বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। ব্যাগগুলো কোনমতে একপাশে রাখলাম। তারপর দেখলাম, আমার নিজের হাতব্যাগ রয়ে গেছে বড় মেয়ের কাছে। আমার কাছে টিকিট, টাকা, মোবাইল কিছুই নাই। সব রয়ে গেছে হাতব্যাগে।
আমার দূরাবস্থা দেখে এক যাত্রী দয়া করে আমাকে তার সীটে বসতে দিলেন। বাচ্চা কাঁদছে। থামাতে পারছি না। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। স্টেশন থেকে এত রাতে একা বাসায় যেতে পারব না। শেষে এক যাত্রীকে অনুরোধ করে তার ফোন থেকে আব্বাকে ফোন করলাম। সব বলে আব্বাকে স্টেশনে আসতে বললাম। আর ট্রেনের এ্যাটেনডেন্টকে বললাম, আমার ব্যাগগুলো যেন স্টেশনে নামিয়ে দেয়।
ট্রেন থামার পর একে একে সব যাত্রী নেমে গেল। তারপর আমি নেমে ব্যাগগুলো নিয়ে একা স্টেশনে বসে আছি। আব্বা তখনও পৌঁছাননি। খোলা স্টেশন। খুব শীত। শীতের রাত বলেই লোকজনও কম। ভয় ভয় করছে। বাচ্চার গা’ জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
খানিক বাদে আব্বা এলে আমরা বাড়ীর দিকে রওনা দিলাম। আব্বার ফোন থেকে দেবরকে ফোন করে বড় মেয়ের সাথে কথা বললাম। সে ততক্ষণে কেঁদে কেটে হুলুস্থুল। “অতগুলো ব্যাগ আর বাচ্চা নিয়ে আম্মু একা কীভাবে যাবে? আম্মুর কাছে টিকিট নাই, টাকা নাই। টিটি ধরলে কী হবে? অন্ধকারে একা বাসায় যাবে কীভাবে?” – এইসব ভেবে ভেবে সে অস্থির। সারাটা পথ সে সমানে কেঁদেছে। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম যে, আমি ভালভাবেই পৌঁছেছি।
আমি বাসায় পৌঁছালাম রাত সাড়ে ন’টায়। আর আমার বড় মেয়ে আর দেবর পৌঁছালো আরো তিন ঘণ্টা পর। মেয়ে ফিরলে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, আমার বর দেশে ফিরলে আমি সব বাদ দিয়ে আগে গাড়ী কিনব, যাতে এরকম বিপদে আর কখনও পড়তে না হয়। তাই করেওছি। এখন আর জার্নি নিয়ে আমাকে ভাবতে হয়না। ইচ্ছামত যখন যেখানে খুশী, আরামে এসি গাড়ীতে জার্নি করতে পারি।
প্রতিবার ঈদের সময় ঘরমুখো মানুষদের ভোগান্তি দেখে আমার খুব কষ্ট লাগে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দ্বিগুণ/তিনগুণ দামে টিকিট কাটা, যাবার সময় যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকা, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চে ওঠা, ট্রেনের-বাসের ছাদে ওঠা, লঞ্চডুবি, দূর্ঘটনায় মৃত্যু, জিনিসপত্র হারানো, সময়মত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে কিনা তার দুশ্চিন্তা ইত্যাদি নানান ভোগান্তি প্রতিবছর যেন এদেশের মানুষদের অবধারিত নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্য যেকোন দেশ হলে এই ভোগান্তি নিরসনে অতিদ্রুত সরকারের স্থায়ী আগাম প্রস্তুতি থাকতো। ফলে মানুষকে প্রতিবছর একই ভোগান্তি বার বার পোহাতে হতনা। উন্নয়নের গালভরা বুলি মানুষের বিশ্বাসযোগ্য হওয়া চাই।
স্কুলের বাচ্চাদের “নিরাপদ সড়ক চাই” আন্দোলনের সময় ঢাকার রাস্তায় লাইন ধরে রিক্সা, গাড়ী, বাস চলতে দেখেছি। এম্বুলেন্সকে আগে যাবার পথ তৈরী করে দিতেও দেখেছি। তখন এই ঢাকার সড়কগুলোতেই কোনরকম বিশৃঙ্খলা ছিলনা। স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারে। কিন্তু এদেশের সরকার, পুলিশ পারেনা। আজব!!! এক মহামান্য তৈলাক্ত ব্যক্তি আবার জানজট নিরসনের পরিবর্ত হাসিমুখে জানজট মেনে নেবার পরামর্শ দেন! আরও আজব!!!
এদেশের মানুষ তো মেনে নিতেই আছে। অরাজকতা, অন্যায়, ঘুষ, অর্থপাচার, অপরাধ, লুটপাট, ভেজাল, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, সংখ্যালঘু নির্যাতন, রেপ, হত্যা, বাকস্বাধীনতা হরণ, বেকারত্ব,……। আর কত?
ঈদের আনন্দ বিষাদে পরিণত না হোক – এদেশের গরীব, অসহায় মানুষদের জন্য এই দোয়া।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন