০
৫৭৭ বার পঠিত
জনৈক বন্ধুবরের পরামর্শে মোরালিটি এবং জাস্টিস এর উপর হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর “মাইকেল স্যান্ডেল” এর কিছু লেকচার দেখা শুরু করেছি। ফ্রি সময় পেলেই একটু একটু করে দেখি। অনেক জ্ঞান অর্জন হয়। স্থান,কাল, পরিস্থিতি ভেদে মানুষের অধিকার এবং কর্তব্যের বৈচিত্র্য ধরা পড়ে। পরিস্থিতির ফাঁদে পড়ে মানুষের নীতি-ন্যায্যতা কিভাবে পরিবর্তিত হয়, অথবা কিছু কিছু সময় মানুষ আপেক্ষিক বা আকস্মিক ভাবে নীতি-ন্যায্যতা এবং বিচার পরিবর্তনে কিভাবে বাধ্য হয়। অনেক সময় বাধ্যবাধকতার ফেরে পড়ে এবং আপেক্ষিকতায় প্রলুব্ধ হয়ে গন-মানব তথা পুরো দেশ বা পৃথিবীর স্বার্থের কারণেও কোন ন্যায়-অন্যায় বা ন্যায্যতার পরিবর্তন করা কতটুকু যুক্তিসংগত বা অযৌক্তিক , অথবা পরিবর্তনের সেই অধিকার দেওয়াটাও উচিত নাকি অনুচিত, এই সকল বিষয়াদিই আলোচ্য সেখানে। (অল্প কিছুক্ষণ দেখে যা বুঝলাম। সময়ের অভাবে এবং টেকনিক্যাল সমস্যার দরুন বেশি দেখতে পারছিনা)
সুদূর বা অদূর অতীতের কিছু উদাহরণ, তা হতে পারে বাস্তব অথবা কাল্পনিক। সেই পরিস্থিতি গুলো খুটে খুটে বিচার করতে গেলে অনেক জায়গায় অনেক রকম জাস্টিসের পার্থক্য ধরা পড়ে। অনেকসময় দ্বিতীয় কোন উপায়ান্তর না পাওয়ার ফলেও মোরালিটির তারতম্য ঘটাতে বাধ্য হয় মানবাধিকার। যেরকম ঘটনা ইতিপূর্বে কখনও ঘটেনি, তারও কাল্পনিক প্রেক্ষাপট রচনা করে সেখানকার জাস্টিসের জন্য পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে। আবার যে ধরণের পরিস্থিতি মানুষ এখনও কল্পনার আওতায় আনতে পারছেনা-পারবেও না, তেমন কোন পরিস্থিতির আগমন ঘটলে সেখানে নতুন কোন মোরালিটি জন্ম নেবে কিনা তাও ভাববার বিষয়।
এটা নিয়ে আজকে আর মাথা ঘামাতে চাইনা।
আমি ছোটবেলা থেকে নানানরকম উপাখ্যান পড়ে বড় হয়েছি। আবার আলিফ লায়লা, গুল-সানোবার, হারকিউলিস, রামায়ণ, মহাভারতের মতো টিভি সিরিয়ালও দেখেছি অনেক (সেগুলিও উপন্যাস বা মহাকাব্য)। এই সব ধরণের উপাখ্যানেই একটা কমন জিনিস শিখতে পেরেছি। তা হলো, নিজের লাভের কথা চিন্তা না করে, অথবা নিজের ক্ষতি করে হলেও কেউ যদি অন্যের উপকার করে, তাহলে ঈশ্বর(?) তার দশগুণ উপকার বা লাভ তাকে ফিরিয়ে দেন। আরও শুনেছি, যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে পরিপূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে, ঈশ্বর তার মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন আলিফ লায়লার মতো। এমনকি কোন উপাখ্যানে এমনও পড়েছি যে, একজন ঈশ্বর বা ঈশ্বরের প্রেরিত দূতের কাছে লজ্জায় নিজের পেটের ক্ষুধার কথা বলতে পারেনি। তো সেই লোক বাড়ি ফিরে দেখে যে, তার বাড়ি ভর্তি খাবার-দাবার এবং ধন-সম্পদ ঈশ্বর ইতিমধ্যেই পাঠিয়ে দিয়েছেন।
কিছুদিন আগে একটা ভিডিও দেখলাম। কাহিনীটা এরকম, আরবীয় অঞ্চলের কোন এক ভদ্রলোক ৫০ টাকার (তাদের দেশের মুদ্রার নাম জানিনা) একটা নোট নিয়ে ময়দা কিনতে গিয়েছে দোকানে। বাড়িতে তার অভুক্ত স্ত্রী আছে। ময়দা কিনে ফেরার পথে সে দেখতে পায়, তারচেয়েও গরীব এবং ক্ষুধায় কাতর এক লোক ভিক্ষা চাচ্ছে তারই কাছে। তখন সে তার ময়দার প্যাকেট ওই ভিখারিকে দিয়ে দেয় এবং এক প্যাকেট ধুলা নিয়ে বাড়িতে রেখে বাড়ি থেকে পালিয়ে বেরিয়ে আসে, যেন স্ত্রীর মুখোমুখি না হতে হয় তাকে। পরে রাতের বেলা বাড়িতে ফিরে সে দেখতে পায়, তার স্ত্রী গরম গরম রুটি আর সালুন নিয়ে অপেক্ষা করছে তার জন্য। তাদের কথোপকথনে বোঝা যায় যে, ঈশ্বর ওই ভদ্রলোকের আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে তার ধুলার প্যাকেটকে ময়দার প্যাকেট বানিয়ে দিয়েছেন। আসলেই আবেগময় ব্যাপার। কিন্তু আমার আবেগের মোড় পরিবর্তন হয়ে গেলো আফ্রিকার কয়েকটি ছবি দেখে।
ক্ষুধায় কাতর দুধের বাচ্চাকে তার মা দুধ খাওয়াতে পারছেনা, কারণ তার স্তন শুকিয়ে শুকনো গাছের ছালের মতো হতে গেছে, খাবার এবং পানীয়ের অভাবে। সেই মা-সন্তান দু’জনেরই চামড়ার নিচে সবগুলো হাড়ের অপূর্ব আর্কিটেকচার ডিজাইন দেখা যাচ্ছে বীভৎস ভাবে। আরেকটা দুধের শিশু শুকিয়ে মারা যাচ্ছে একটু একটু করে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাবে, তাই শকুন তার পাশে বসে অপেক্ষা করছে শিশুটির মৃত্যুর পর তার মাংস খাবে বলে।(এই ছবিটির কথা মোটামুটি সবারই জানা। এটার ফটোগ্রাফারও আত্মহত্যা করেছিলো ছবিটা তোলার কিছুদিন পর।)
একজন মধ্যবয়সী লোক প্রাণপণে চেষ্টা করছে হামাগুড়ি দিয়ে তার মৃতপ্রায় বাচ্চার কাছে যেতে। কিন্তু দু’তিন হাত এগোনোর পরেই মনেহয় সে মারা গেলো। কারণ তার শরীরে মাংস তো নেই ই, হাড় আর শিরা-ধমনী গুলিও অনেক আগেই শুকিয়ে গ্যাছে।
এই মানুষগুলো এমন যে, কথিত ঐশ্বরিক সংবিধান দ্বারা সংজ্ঞায়িত পাপগুলি করার মতো শারীরিক -মানসিক কোন ক্ষমতা বা ইচ্ছাই তাদের নেই। এরা সবসময় একে অপরকে প্রাণ দিয়ে সাহায্য করে আর কয়েকটা মিনিট বেশি বেঁচে থাকার জন্যে। মাটিতে পড়ে থেকে প্রার্থনা করা ছাড়া কিছু জানেওনা এরা। তাহলে এদের মুমূর্ষু দেহের পাশে পড়ে থাকা ধুলাবালি গুলো ঐশ্বরিক কারিশমায় কেন ময়দা হয়ে যায়না আলিফ লায়লার মতো? রুক্ষ পাথরের বুকে লাথি দিয়ে কেন ঈশ্বর ঝরনাধারা পাঠায়না এদের মুখের কাছে!! তাহলে হয়তো মুমূর্ষু দুধের বাচ্চারা দুধ পেতো, মুমূর্ষু বাপ-বেটা এক জীবন বেঁচে থাকতে পারতো একসাথে, ভালোবাসতে পারতো একে-অপরকে আরো কিছুদিন। এরকম হাজার হাজার জন্ম দিয়ে এবং পৈশাচিক মৃত্যুকে দেখে বিকৃত মজা নেওয়ার দরকারটাই বা কী ইশ্বরের? আর এই নিষ্পাপ ক্ষুধার্তদেরকে বাদ দিয়ে ধনকুবেরদের বালির বস্তাকে আটার বস্তা বানানোর প্রয়োজনীয়তাই বা কেন পড়লো!! (আমি ব্যক্তিগত ভাবে এসব ফ্যান্টাসি বিশ্বাস করিনা।)
আমাকে মাইকেল স্যান্ডেল পর্যন্ত যেতে হয়না এই সহজ-সাধারণ মোরালিটি বোঝার জন্য। আমার সামান্যতম অক্ষরজ্ঞানেরও দরকার পড়েনা এই জাস্টিসকে শেখার জন্য। আমি নিজেই শিখতে পারি, বুঝতে পারি, বিচার করতে পারি এই জিনিস গুলো শুধু একবার দেখেই। কিন্তু ঈশ্বর কেন পারছেনা? তার কি আমার কাছ থেকে শিখে নেওয়া উচিত?? আমার কি তাকে শেখাতে চাওয়া উচিত??
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন