বাংলাদেশে বসবাস করা যারা নাস্তিক ও সেক্যুলার চিন্তার মানুষ, যারা পরিবার বা সমাজ থেকে চাপিয়ে দেয়া ধর্মে বিশ্বাসী নই। তাদের এই দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় কী এই বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তোলে। আমি আমার নাগরিক পরিচয়পত্রে, পাসপোর্টে অথবা সরকারি-অসরকারি যে কোনও প্রতিষ্ঠানে- যখন কোনও ফর্ম ফিলাপ করতে যাই, যেখানে আমার একটি ধর্মীয় পরিচয়ের ঘর ফিলাপ করতে হয়, সেখানে এসে আমি বারবার থমকে যাই। কারণ সেখানে আমি যে কোনও ধর্মের নাম লিখতে পারবো কিন্তু নাস্তিক কথাটি লিখতে পারবো না। বাংলাদেশে নাস্তিক পরিচয়টি যেনো সব চাইতে জঘন্যতম অপরাধ। এই দেশের জনগণ এটা ধরে নিয়েই এই দেশের সংবিধান রচনা করেছেন যে, প্রতিটি নাগরিকেরই যেনো বাধ্যতামূলক ধর্মীয় পরিচয় থাকতেই হবে।
যদি আমার কোনও ধর্মীয় পরিচয় না থাকে, তাহলে অঘোষিতভাবেই আমি যেনো ধর্ম অবমাননার দায়ে দায়ী হয়ে যাই। যেহেতু সংবিধান মোতাবেক- এই দেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, অতএব বিশেষভাবে- এই ধর্মের অনুসারীদের মনেই আঘাতটা বেশী লাগে। এই আঘাত দেবার জন্য, তাৎক্ষণিকভাবে কোনও ব্যক্তিকে আমার ধর্মের বিপক্ষে আমার একান্ত যুক্তি-তর্ক, আদর্শ, মতবাদ, ফ্যাক্ট, ফিগার, ইতিহাস বলবার প্রয়োজন নেই, সত্য ইতিহাস বলবার প্রয়োজন নেই, কেবলমাত্র- ‘আমি নাস্তিক’ বা ‘আমি অবিশ্বাসী‘ এই কথাটিই এই দেশের যে কোনও পাবলিক প্লেসে বা প্রতিষ্ঠানে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তির ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত অনুভূত হবার জন্য যথেষ্ট।
এখন আসি যারা নাস্তিক, এবং এই পরিচয়টি যারা প্রয়োজন বা বিশেষ পরিস্থিতিতে মানুষকে জানাতে বাধ্য হয় তাদের কথায়। প্রয়োজন বা বিশেষ পরিস্থিতিটা আসলে কী? এটা একটু পরিষ্কার করে বলি আগে। ধরুন আমি চাকরি করি, এবং রোজার মাস চলছে। যেহেতু বাংলাদেশে ৯৪%-ই মুসলমান তাই স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায় আমার চাকুরিরত প্রতিষ্ঠানেও বেশিরভাগ মানুষ মুসলিম হবেন। বাস্তবিকক্ষেত্রে তাই-ই হয়। তাই রোজার মাসে দেখা যায় অফিসের দুই একজন হিন্দু, বৌদ্ধ, বা খ্রিস্টান ছাড়া আর সকলেই রোজা পালন করছেন। যেহেতু আমি বংশানুক্রমিকভাবে মুসলিম পরিবার থেকে এসেছি, সুতরাং অফিসের মুসলিম কলিগরা ধরেই নেন আমিও রোজা রাখবো।
কারণ রোজা রাখা মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক। এই পরিস্থিতিতে আমি যখন রোজা রাখছি না, আমি যখন- সকালের নাস্তা খাচ্ছি, বা দুপুরের খাবার খাচ্ছি – বা জল পান করছি, এসব দেখে- আমার মুসলিম কলিগদের মুখ রাগে, ঘৃণায়, আমার প্রতি কালো হয়ে যাচ্ছে। তারা যদি জিজ্ঞেস করে – ‘ভাই, আপনি রোজা রাখেননি কেন?’ আমি যদি আদর্শবাদী হই- তাহলে নির্ঘাত আমাকে সত্য বলতেই হয়- যে ভাই, আমি নাস্তিক। আমি ধর্ম-কর্ম পালন করি না। ব্যাস, এরপর কতোরকম অপমান, অবহেলা, অবজ্ঞা, কথার খোঁচা, শুনিয়ে শুনিয়ে গালাগালি আমাকে যে আমাকে শুনতে হবে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। অথচ তারাও কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টায় তিনবারই খাচ্ছে। আমিও চব্বিশ ঘণ্টায় তিনবার খাচ্ছি। কিন্তু তারা যখন ধর্মীয় আইন মানার জন্য নির্দিষ্টসময় বিরতি দিয়ে খাচ্ছেন, তখন তাদের সামনে অন্যের খাওয়াটাকে তারা তাদের এবং তাদের ধর্মের অপমান হিসেবে দেখছেন। রাত বারোটা থেকে পরেরদিন রাত বারোটায় যদি চব্বিশ ঘণ্টা হয়, তাহলে তারা শেষরাতে সেহরি খাচ্ছেন- একবেলা, সন্ধ্যায় ইফতারি করছেন- দুই বেলা, এবং রাতে ডিনার করে ঘুমাতে যাচ্ছেন- তিনবেলা। আর আমি, সকালে নাস্তা করছি- একবেলা, দুপুরে লাঞ্চ করছি- দুই বেলা, আর রাতে ডিনার করছি তিনবেলা। তাহলে খাবার স্পেলে কম বেশী কোথায় হলো চব্বিশ ঘণ্টায়? শুধু তারা জলপান থেকে বিরত থাকছেন। এর জন্য আমার কী দায়- আমি যদি তৃষ্ণা পেলে জল পান করি?
কিন্তু, এইসব বলার সুযোগ বর্তমানে বাংলাদেশে নেই। এই নিয়ে কথা বললে- আপনি নিশ্চিত মার খাবেন। এবং আপনার চাকরীটাও হারাবেন। আপনাকে চিহ্নিত করে রাখা হবে। এই জঙ্গিবাদ বর্ধিষ্ণু দেশে- আপনার পিছনেও দুটি চোখ নিয়ে হাঁটতে হবে। এবং এইসব কথা বলার বা বিচার চাওয়ার কোনও সুযোগ এই সমাজ আপনাকে দেবে না। অফিস দেবে না, প্রশাসন দেবে না, সংবিধানে তো নাস্তিক্যবাদের নাম গন্ধই নেই। এমনকী অসংখ্য অসংখ্য মানুষ তার বন্ধুদের বা পরিবারের কাছেও এইসব বলতে পারে না। কারণ, কারো কারো পরিবার অফিসের চেয়েও অসহিষ্ণু, কারো ছেলেবেলার বন্ধুই এখন হয়তো- নিবেদিত মুসলিম। প্রতিবছর রোজার মাসে ঘুস, দুর্নীতি বেড়ে যাওয়াটা নিয়ে আর কিছু লিখলাম না। এটা সবাই জানেন কী হয় এই মাসে। এবং এটাও জানেন- এই দুর্নীতি আর ঘুষটা কারা বেশী খাচ্ছেন সামনে ঈদ আছে এই অযুহাত দেখিয়ে।
দুই.
এবার বলি, রাস্তা-ঘাটের কথা। আমি নাস্তিক। এই পরিচয় নিয়ে আমাকে কেন লজ্জিত হতে হবে- এটাই আমার প্রথম এবং প্রধান প্রশ্ন এই দেশে। কেন হোটেলগুলোতে আমি সকালের নাস্তা পাবো না? কেন তারা দুপুরে খাবার বিক্রি না করে ইফতারের আইটেমটাই শুধু বানাচ্ছে? যাদেরকে কাজের কারণে রাস্তায় লাঞ্চ করতে হয় তারা কী করবে? কেন চা-সিগারেটের দোকানগুলোকে বোরকা পরানোর মতো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হচ্ছে? কেন যারা রোজা রাখেন না তাদেরকে মাথা নিচু করে লুকিয়ে লুকিয়ে চোরের মতো সেইসব চায়ের দোকানে ঢুকে পানিপান করতে হয়, বনরুটি আর চা খেতে হয়, অথবা ধূমপান করতে হয়? আমি যদি প্রকাশ্যে রোজার মাসে রাস্তায় ধূমপান করি, তাহলে আমাকে শাসানো হয়। রাষ্ট্রীয় আইনে পাবলিক প্লেসে ধূমপান কোথায় কোথায় নিষেধ। কিন্তু রোজার মাসে আমি কেন কোথাও-ই কোনও রোজাদারের সামনে ধূমপান করতে গেলে হয়রানির স্বীকার হবো? তাদের ব্যক্তিগত ধর্ম পালনে আমি যদি বাঁধা না দিই- তবে তারা কেন আমার ব্যক্তিগত অভ্যাসে জোড় খাটাচ্ছে? যত দিন যাচ্ছে ততই- এই জোড় খাটানোর উদাহরণ- দেশের আনাচে কানাচে বেড়েই চলেছে।
গত রোজায় কল্যাণপুরের কয়েকটি চায়ের দোকানে খাবার বিক্রির দায়ে ভাংচুর করেছে একটি মসজিদ কমেটির লোকজন। ভরা বাজারের মধ্যে শত শত লোকের ভিড়েও তারা এটি করার সাহস পায় এখন এই দেশে। তারা চায়ের কেতলিতে বালি ভরি দেয়। দরিদ্র রিকশাওয়ালা অথবা দিনমজুর যারা মূলত ওইসব দোকানের ক্রেতা তারা রোজার মাসে তাহলে কোথায় যাবে? কোথায় খাবে? অথবা বিধর্মীরা? কিংবা আমার মতো নাস্তিকরা? এর উত্তর একটিই। এই দেশে থাকলে এইসব মেনে নিতে হবে, আর নয়তো মার খেয়ে, অপমান, অপদস্থ হতে হবে, কিংবা মরতে হবে, আর নয়তো ভিটা-মাটি, চিরচেনা পরিবেশ, বন্ধু, পরিজন ফেলে- চিরজীবনের জন্য দেশত্যাগ করতে হবে। যেই দেশে একজন পাগল’কেও রোজার মাসে খাওয়ার দায়ে এলাকার লোকজন পিটিয়ে আধমরা করে ফেলে রেখে যায়- কেউ কিচ্ছু বলে না, সেই দেশে নাস্তিকদের ভাগ্যে কী ঘটতে পারে সেটা নিশ্চয়ই বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এই মাসেই সবচেয়ে বেশী খাদ্যের মূল্য বাড়ে। সবচেয়ে বেশী ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর খাবার বাজারে আসে। সবচেয়ে বেশী খাদ্য অপচয় এই মাসেই হয়। এবং এগুলো ধর্মবিশ্বাসী মুসলমানরাই করে। অথচ এক্ষেত্রে সকলেই নীরব থাকে।
বর্তমান বাংলাদেশে যারা নাস্তিক তাদের প্রথম সমস্যাটা পরিবার থেকে শুরু হয়। আমি অনেক উদাহরণে যাবো না। একটা সহজ উদাহরণ দেই। আর সেটা হচ্ছে জুম্মার নামাজ। মুসলিম পরিবারগুলোতে জুম্মার নামাজ পড়তে যাওয়া একরকম বাধ্যতামূলক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার চাপ এখন ধীরে ধীরে বাড়লেও জুম্মার নামাজটা পরিবারে এক প্রকার জিরো টলারেন্স-এ আছে। বাসার পুরুষদেরকে জুম্মার নামাজে যেতেই হবে। আমি যদি নাস্তিক হই, তাহলে এই জুম্মার নামাজে যাওয়ার কোনও কারণ আমার নেই। একটি পরিবার যখন প্রথম নোটিশ করে যে তার ছেলে বা স্বামী জুম্মার নামাজে যাচ্ছে না, প্রথম প্রথম তারা চাপ দেয়। জোরাজুরি আর বাকবিতণ্ডা চলে। কিন্তু, একসময় যখন প্রকাশ পায় যে- যে ব্যক্তিটি নামাজ পড়তে যাচ্ছে না, সে আসলে একজন নাস্তিক, তখন পরিস্থিতি অনেক পরিবারেই ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। গায়ে হাত তোলা, কথা বলা বন্ধ করা, এবং অনেক ক্ষেত্রে ত্যাজ্যপুত্র হবার ঘটাও অহরহ ঘটে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে এই পারিবারিক কোন্দল আত্মীয়-স্বজনের কাছেও দ্রুত পৌছায়, প্রতিবেশীরা জেনে যায়। তখন সেই নাস্তিক ব্যক্তিটি একপ্রকার পরিবার বা সামাজিক জীবনে নিঃসঙ্গ ও একঘরে হয়ে পরে, বা হতে বাধ্য হয়। আত্মীয়স্বজন ভাই-বোনরা কথা বলতে চায় না, এড়িয়ে যায়, প্রতিবেশীরা ফিসফিস করে- ছিঃ-ছিঃ করে। বন্ধু-বান্ধবের মুখে মুখে একসময় তার আবাসিক এলাকার মানুষজনও জেনে ফেলে।
এইক্ষেত্রে, ওই নাস্তিক ব্যক্তিটির মৃত্যু ঝুঁকি অসম্ভবরকম বেড়ে যায়। একজন নাস্তিক’কে যে কোনও মুসলিম ইন্ডিভিজুয়াল ওই মুসলিম ব্যক্তির ব্যক্তিগত ইসলামিক আদর্শ থেকেও যে কোনও সময় হত্যা করতে পারে। বাংলাদেশে যতগুলো ইসলামিক টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন বর্তমানে কার্যকর আছে তাদের কথাতো বাদই দিলাম। একবার চিন্তা করে দেখুন, একজন নাস্তিক, যাকে তার পরিবার ত্যাগ করে, তার আত্মীয়-বন্ধুরা ত্যাগ করে, তার কলিগরা ত্যাগ করে, তার লোকাল পিপল ত্যাগ করে, তার সমাজ ত্যাগ করে, তার রাষ্ট্র তার দায় নেবে না বলে- বলে দেয়। সেই নাস্তিক ব্যক্তিটি এই দেশে বর্তমানে কী পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকে?
এই পরিস্থিতি এক্সপেরিয়েন্স করার জন্য- আপনাকে নাস্তিক ব্লগারদের ৮৪ হিটলিস্টের তালিকায় নাম থাকতে হবে না। আপনাকে একজন নাস্তিক ব্লগার হতে হবে না, একজন নাস্তিক লেখক হতে হবে না, নাস্তিক ফেসবুক সেলিব্রেটি হতে হবে না। স্রেফ আর স্রেফ আপনি নাস্তিক- এই পরিচয়টুকু আপনার পরিচিত পরিমণ্ডলে থাকলেই যথেষ্ট। আপনার গার্লফ্রেন্ড আপনাকে ছেড়ে যাবে, স্ত্রী থাকলে সে ছেড়ে যাবে, আপনার ছেলেবেলার বন্ধু রাস্তায় আপনাকে না দেখার মতো করে হেঁটে চলে যাবে। বাবা-মা, ভাই-বোন আর আগের মতো আগের চোখে আপনাকে দেখবে না। আপনি খোলা আকাশের নিচে মাথা নিচু করে হাঁটবেন, আপনি বাতাসের মধ্যেও বুক ভরে শ্বাস নিতে ভুলে যাবেন, দরজায় কলিং বেল বাজলে চমকে উঠবেন।
পিছন দিকে তাকিয়ে হাঁটা আপনার অভ্যাস হয়ে যাবে।
তিন.
এই বাংলাদেশ কিন্তু স্বাধীনতার পরে আর কখনো এমন এত রেডিক্যাল ছিলো না। অন্তত নব্বইয়ের মাঝামাঝি বা শেষ অব্ধিও এমন দেখিনি। নব্বইয়ের নাটকের নায়িকারা স্লিভলেস ব্লাউজ পরতে পারতেন। রাস্তা-ঘাটে মহিলারা শাড়ি পরতো মাথায় ঘোমটা দিতো না, খোপা করতেন নানান ধরনের। আমাদের মা, খালা, ফুপুদের দেখেছি- স্লিভলেস শাড়ি পড়ে সানগ্লাস চোখে দিয়ে নব্বইয়ে বা আশিতে ছবি তুলতে। তখন রোজায় দোকান-পাট দিব্বি খোলা থাকতো। হুজুররা বাসায় মিলাদ-টিলাতে আসতেন। মাথা দুলিয়ে মিলাদে- ইয়া নবী সালা মালাই কা, ইয়া রসুল সালা মালাইকা, সালামা তুল্লাহ ওলাইকা… সুরে সুরে পড়তে পড়তে দাঁড়িয়ে যেতাম, এক ফাঁকে গোলাপ জলের ছিটা, গরম জিলাপি মিলাদে দেয়া হতো, বেশ একটা আনন্দের স্মৃতি ছিলো এইসব মিলাদ আর হুজুরের দোয়া। তাদের দেখলেই কেমন একটা ভক্তি হতো। তাদের ব্যবহারও ছিলো আন্তরিক অমায়িক অভিভাবকের মতন। কাছে ডেকে নিয়ে আদর করতেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, মাথায় ফুঁ- দিতেন, উচ্চারণের ধরনটা অনেকটা- ছু-উ টাইপের ছিলো। তাদের শরীরের কাছে আতরের গন্ধটা বেশ লাগতো।
কিন্তু পরিস্থিতি বদলাতে বদলাতে এখন এমন অবস্থা- চারপাশে শুধু হুজুর আর বোরকা। ইয়াং ছেলে-পেলেদের সবার মুখেই সুন্নতি দাড়ি। আগে আমাদের বড় ভাইরা ব্যান্ড-এর দল করতো, আরো বড় যারা- তারা করতেন নাট্যদল। আরো বড় যারা- তারা কেউ তেমন দাড়ি রাখতো না। গোঁফ রাখাটাই ছিলো বয়সের একটা ভাবগাম্ভীর্য। আর এখন- গানের দল মানেই- হারাম। নাটক বিশেষ করে, মঞ্চ নাটক করে এই শ্রেণী প্রায় বিলুপ্তির পথে। মিডিয়াতে এখন ইসলামিক অনুষ্ঠানের জয় জয়কার। রমজান মাসে খবর পাঠিকাদের মাথায় কাপড় উঠে যাচ্ছে বা তারা উঠাতে বাধ্য হচ্ছেন। হিজাব এখন বাংলাদেশের মেয়েদের প্রধানতম পোশাক। দ্বিতীয়- হচ্ছে বোরকা। ঢাকা আগে থেকেই মসজিদের শহর বলে পরিচিত ছিল, এখন বাংলাদেশ মসজিদের দেশের দিকে যাচ্ছে। হুজুররা এখন সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্গানাইজড শ্রেণী। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা এখন ডমিনেট করছে জেনারেল শিক্ষা ব্যবস্থাকে। পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে- ইসলামিক ডোমিনেশন। মসজিদের খুতবায়, ওয়াজ, মাহফিলে, নাস্তিকদের কতল করা ফরজ- এই বয়ান শোনা যাচ্ছে। লক্ষ-লক্ষ, কোটি-কোটি মানুষ এইসব দৈনন্দিন শুনছেন। এই সাধারণ নাগরিক এইসব ঘৃণার বয়ান শুনে উত্তেজিত হচ্ছেন। হারামের লিস্ট বাংলাদেশে ক্রমেই বেড়ে উঠছে। নাস্তিকদের বিরুদ্ধে- সোশ্যাল মিডিয়ায় শত শত গ্রুপে লক্ষ লক্ষ মানুষ একটিভ। সরকার তাদের আদর্শের সমর্থক, বাংলাদেশের আইএসাইএস-এর শাখা তাদের সমর্থক, সমস্ত ইসলামিক টেরোরিস্ট গ্রুপগুলো তাদের সমর্থক, এই নাস্তিকদের বিরুদ্ধে- তারা মিডিয়া ব্যবহার করছে, সরকারকে ব্যবহার করছে, মাদ্রাসা, মসজিদ ব্যবহার করছে, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার থেকে উকিল, পুলিশ ডিজিএফআই থেকে- ছাত্র নিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে তারা নাস্তিকদের বিরুদ্ধে তাদের সমর্থন তৈরি করে যাচ্ছে।
এখন ভাস্কর্য, আমাদের পহেলা বৈশাখ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন অথবা জাতীয় সঙ্গীতের বিষয়েও ফতোয়া আসছে। সামনে আরো আরো আরো অনেক আসবে। এই দেশ- পাকিস্তান-আফগানিস্তান’কেও ছাড়িয়ে যাবে। এই বিষয় নিয়ে আরেকদিন লিখবো। আপাতত তাদের সামনে কেউ নেই, কিছু নেই, তাদের মাঠ ফাঁকা। আর একের পর এক নাস্তিকদের নির্মমভাবে হত্যা করে, অথবা ৫৭ ধারায় জেলে ঢুকিয়ে আর বাকীদের বাক- স্বাধীনতায় এমনিতেই কৃতদাসের মতো পরাধীন বানিয়ে রেখেছে। মুসলমানরা- মসজিদে নাস্তিকদের হত্যার কথা বলে, নাস্তিকরা এমন প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ কোথায় পায়? তাও সরকারী বেতনভুক্ত, অসরকারিদের কথা বাদই দিলাম। মুসলমানরা হাজার হাজার ওয়াজে- কোটি-কোটি শ্রোতার কাছে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ পায়। এবং পকেট ভর্তি করে টাকা নিয়ে, সসম্মানে। কেউ কেউ আবার হেলিকপ্টারও পায়। নাস্তিকরা এই সুযোগ কোথায় পায়? মুসলমানরা টেলিভিশনে টক শো’তে কথা বলার সুযোগ পায়, পত্রিকায়, বই লিখে, রাস্তাঘাটে যেখানে খুশি সেখানে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ পায়। হুজুরদের সাংবিধানিক স্বাধীনতা এবং সুযোগ কী একজন নাস্তিকের চেয়ে এত এত এত বেশী! নাস্তিকরা ফেসবুকে লিখলে ৫৭ ধারা, ব্লগে লিখলে- ৫৭ ধারা, বই মেলায় বই পর্যন্ত পুলিসবাহিনী দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মেলায় প্রবেশের অনুমতি পায়।
আর আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বলেন- এই দেশ চলবে মদিনা সনদ অনুসারে। মদিনা সনদে- আদি পৌত্তলিক, ইহুদি, প্যাগান, খ্রিস্টান, অথবা যারা অবিশ্বাসী তাদের প্রতি আর মুসলিমদের প্রতি কী বিধান ছিলো- আমাদের প্রধানমন্ত্রী অবগত আছেন কী? আমরা যারা নাস্তিক, তারা এই মদিনা সনদের দেশে- ঠিক কী আশা করতে পারি কেউ দয়া করে বলবেন কী?
আমি নিজেকে জাতি হিসেবে বাঙালি বলতে পারি। বাংলাদেশের সংবিধানে সেটাই আমার প্রথম পরিচয়। কিন্তু এই সমাজের প্রতিটি স্তরে বা বর্তমান রাষ্ট্রের এমন পরিস্থিতিতে এই পরিচয় যে কতটা গৌণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, বাঙালি জাতি সত্ত্বার বাইরে গিয়েও আপনার ধর্মীও জাতি সত্বার প্রমাণ আপনাকে দিতেই হবে। নাস্তিক হলে- এই দেশে আপনাকে বাস করতে হবে দুটি উপায়ে। এক– যখন তখন যে কারো হাতে মৃত্যু ভয় নিয়ে, দুই– নয়তো তাদের যে কারো হাতে মরে গিয়ে।