বিশ্বাসের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যদিওবা কেউ চেতনার আহবানে মানবিক হয় অর্থাৎ নাস্তিক হয় তখন সে পড়ে মহাবিপদে! কোপারনিকাস, ব্রুনো, প্লাটো থেকে শুরু করে হুমায়ুন আজাদসহ অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন। সালমান রুশদি, দাউদ হায়দার, তসলিমা নাসরিন, বন্যা আহমেদ, জোবায়েন সন্ধি, নাস্তিকের ধর্মকথা, রায়হান আবীর পর্যন্ত সকলেই মহাবিপদকাল কাটাচ্ছেন এবং এই অব্যাহত ধারায় কাটাবেন সকলেই! তার কারণ হলো প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি ‘ধর্ম’ সামাজিক প্রথা, কালচার, শাসন, অনুশাসন হিসেবে এমনভাবে মানুষের মনের মধ্যে শিকড় গেড়ে আছে যে তা থেকে আসলে কোনো মুক্তি নেই! একজন মানুষ যখন তার বয়সের এক বিশেষ স্তরে এসে চেতনালব্ধ হয়, তার পুর্ব পর্যন্ত সময়ে সে সেই শেকড়ের সংগে বাধা পড়ে যায়। শত প্রচেষ্টাতেও পরে আর তা থেকে ছিন্ন হতে পারে না। যদি কেউ পারেও তবে সে হয়ে পড়ে তার দেশ, সমাজ, পরিবার, স্বজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন! যারা নানা কারণেই বিচ্ছিন্ন হতে পারে না, তারা মন-যন্ত্রণায় বিব্রতকর অবস্থায় রাষ্ট্র-সমাজ-পরিবারে অভিনয় করে যান কিংবা বলা যায় ভণ্ডামি করে যান! একজন মানুষ তার পরিবার, সমাজ, গ্রাম, পাড়া মহল্লা ও রাষ্ট্রে ধর্মাশ্রিত বিধিবিধান, প্রথা, আচরণ, প্রাত্যহিক ভাষা ইত্যাদির মধ্যেই লালিত পালিত আশ্রিত অভ্যস্ত হয়ে আসেন। চেতনায় যেই মূহুর্তেই তিনি নাস্তিক হয়ে পড়েন সেই মূহুর্ত থেকেই তিনি ওই শিকড়কে বাতিল করতে পারেন না। ওই প্রথাসিদ্ধ আচরণগুলো অনেকটা প্রাকৃতিকভাবেই তাকে সঙ্গ দিতে বাধ্য। যেমন- মুসলিম সমাজের একজন নাস্তিক মানুষও ঘুম থেকে উঠতে আইম ছাড়লে তার মুখ থেকে যে কমন শব্দটি বেরুবে তা হলো- ‘আল্লাহু‘, হিন্দুর বেলায় ‘রাম‘ কিংবা ‘ভগবান‘! ইংলিশ খ্রিস্টানের বেলায়-‘মাই গড’, বাঙালি খ্রিস্টানের বেলায় ‘গড’ ইত্যাদি। ঘরে একটা কিছু ভাংলে সে বলে উঠবে- ‘হায় আল্লা, এটা কী হলো‘! অথবা ‘এ রাম, হায় ভগবান‘, মুসলমান যে কেউ যার সাথেই দেখা হোক বলবেই-আসসালামু ওয়ালাইকুম, বিদায়লগ্নে খোদা হাফেজ কিংবা আল্লা হাফেজ, হিন্দুরা বলবে- আদাব, ঈশ্বর এর কৃপায় ভালো থাকুন, ইত্যাদি।
সকাল থেকে রাত অবধি এমনই অসংখ্য শব্দ আছে যা অবচেতনভাবেই মুখে আসে! এ থেকে বেরিয়ে একজন নাস্তিক অন্য কোনো বিকল্প শব্দ বা আচরণ চর্চা করতেই পারেন না। পৃথিবীর আপামর মানুষ কোনো না কোনোভাবে নিজ নিজ ধর্মের প্রতি দূর্বল এবং শ্রদ্ধাশীল। সেই ধর্ম হলো ঈশ্বরকেন্দ্রিক, আর ঈশ্বর হলো সন্দেহভিত্তিক অনুমানকেন্দ্রিক এক শক্ত ‘বিশ্বাস‘। এই বিশ্বাস আদিম যুগ থেকেই মানুষের মন ও মগজে লালিত হয়ে অতিদ্রুত সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়েছিল। ধূর্ত মানুষের স্বার্থ হাসিলের অস্ত্র হয়ে ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আপামর নিরীহ মানুষের প্রাত্যহিক চর্চায় এবং সমাজপতিদের পৃষ্ঠপোষকতায়। তারাই (সমাজপতি) একে এমনভাবে গড়ে তুলেছিল যে তা সাধারণ্যে এক অতীব প্রয়োজনীয় মানসিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে উঠেছিল। যেখানেই মানুষ প্রাকৃতিক যে কোনো বিষয়ে কোনো সমাধান আবিষ্কারে ব্যর্থ হতো, সেখানেই সেই বিষয়গুলোকে অদৃশ্য ঈশ্বরের ওপর ছেড়ে দিয়ে তখনকার সময়ের মনুষ্য-কল্পিত ঈশ্বরদের স্মরণে প্রণিপাত, গুণ-কীর্তন, আরাধনা, যজ্ঞ, বলি ইত্যাদির মাধ্যমে অপেক্ষা করতে করতে কখনো কোনো প্রাকৃতিক সমাধান আসলে তাকে ঈশ্বরের কিংবা দেবতার দান বলে, অলৌকিক বলে প্রতিষ্ঠিত করেনিতো! সেই ধারায় প্রবহমান ধর্মীয় আচারাদী, প্রথা, নিয়ম-কানুন, নাম-জপ, বলি, উৎসর্গ, কোরবানি ইত্যাদি সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে পর্যবসিত হয়ে উঠে বিশাল বিশ্বের বিভিন্নস্থানে বিভিন্নকায়দায় পালিত, চর্চিত হতে-হতে সময় ও কালের প্রভাব ও প্রেক্ষিতে ক্রমশঃ আজকের অবস্থানে এসে ঠেকেছে। কিন্তু এর বিপরীতে প্রাকৃতিক বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলো আবিষ্কারে হয়েছে বিলম্ব কিংবা আবিষ্কারককে রাখা হয়েছে বন্দি, নয়তো মারা হয়েছিলো পুড়িয়ে, যে ধারা বিভিন্ন কায়দায় আজ অবধি বহমান।
‘ঈশ্বরচিন্তা’ বা অস্তিত্ববাদ মানুষের মন ও মগজে প্রবেশ করেছিলো সহজ স্বাভাবিকভাবে। ‘অনস্তিত্ব-জ্ঞান’ বা নাস্তিক্যবাদ সহজ নয়, এটা মুক্তচিন্তা ধারক মগজের পক্ষেই সম্ভব। যার মগজের মাদারবোর্ডে একবার ঈশ্বরচিন্তা স্টাক হয়ে গেছে তা ডিলেট করা একেবারেই কঠিন কাজ! সেই অর্থে- ‘স্রষ্টা বলে কেউ একজন কিংবা বহুজন আছে’ ধারণাকে প্রমাণ করার বিষয় (সন্দেহবাদ) ছড়িয়ে আছে অগণিত।
সম্ভবত আমাদের গ্রহের সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত সর্বপ্রথম আদিম মানুষকে ভাবিত করেছিল ঈশ্বরভাবনায়। প্রাচীন ধর্ম চিন্তা, মিথসমূহ, সমাজ-ইতিহাস ইত্যাদি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় সূর্যকে সেভাবেই নিয়েছিল আদিম থেকে শুরু করে প্রাচীন মানুষরা। সমাজ সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় একটা সময় সূর্য মানবসমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়লো ঈশ্বরের আসনে। সূর্য-সংসারের বাকি সদস্যরাও একে একে হয়ে পড়ল দেবতা। ফলে এটাই প্রতিষ্ঠিত হলো যে ঈশ্বর দেবতাদের নিয়ে আকাশে ঘুরছেন! কাজেই এর বিপক্ষে যদি কেউ উল্টো কিছু বলে তাহলে সমাজপতিরা কেনো তা সইবে? মুক্ত ভাবনায় যখন মানুষ কেউ বুঝতে পারলো আসলে সূর্য মহাকাশে অসংখ্য তারার একটি তারামাত্র, আর দুনিয়া অসংখ্য গ্রহ-উপগ্রহের একটিমাত্র, সূর্য ঘোরে না পৃথিবীকে ঘিরে কিছু দেবতার কিংবা ফেরেশতার কাঁধে বসে, বরং পৃথিবীই ঘুরছে সূর্যের চারদিকে ইত্যাদি, তখন সমাজপতিরা সেই মুক্তচিন্তার মানুষদের ঈশ্বরবিরোধী আখ্যা দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে কিংবা কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। অথচ এই সত্যগুলো আবিষ্কারে সেই মহাপুরুষদের মন ও মগজকে নিয়ে শ্রম দিতে হয়েছিল অক্লান্ত।
মানবসভ্যতার শৈশবকাল থেকেই মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে ধর্মের নানাবিধ প্রথা, ভালোমন্দ সংস্কার ইত্যাদি জীবন-যাত্রায়। আর কালের যাত্রায় বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় সময়ে সময়ে বিভিন্ন ধর্মের আবির্ভাবে সেইসব প্রথা গ্রথিত ও প্রোথিত হয়ে পড়েছে মানুষের মন ও মননে। আবার সভ্যতার ক্রমবিকোশের ধারায় সেইসব প্রথাসমূহ বিবর্তিত পরিবর্তিত হতে হতে বর্তমান রূপে এসে ঠেকেছে। পাশাপাশি বিজ্ঞান এবং যুক্তির প্রভাবে এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসা বহু মানুষ সমাজে চর্চিত সেসকল প্রথাকে না পারছে গ্রহণ করতে না পারছে বর্জন করতে। প্রথাবিরোধী মানুষরা তাই মুক্তমনের মানবিক ধারাকে মসৃণ পথে প্রবাহিত করতে পারছেনা। ‘আসসালামু ওয়ালাইকুমের’ পরিবর্তে সে বলতে পারছেনা ‘আপনার উপর প্রকৃতির শান্তি বর্ষিত হোক‘, কথায় কথায় ‘ইনশাল্লাহ‘, ‘মাসাআল্লাহ, ‘করুণাময়ের ইচ্ছায়‘, ‘আল্লার রহমতে‘, ‘ভগবানের কৃপায়‘, ‘বিসমিল্লাহ‘ ইত্যাদি ধর্মাশ্রিত অসংখ্য প্রচলিত শব্দ মানবতাবাদী নাস্তিকের পক্ষে রাতারাতি বদলে ফেলা কঠিন কাজ। সমাজ- সভ্যতা এ সবের ওপর সেই প্রাচীনকাল থেকেই শিকড়শুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে।
জন্ম-মৃত্যু, অভাব-দারিদ্র, রোগ-ব্যাধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতি সকল বিষয়েই প্রচলিত সকল চর্চিত প্রথার আবহে মানুষ ঈশ্বরকেই দায়ী করে! ফলে বিজ্ঞানমনষ্ক মুক্তমনা প্রগতিবাদী কোনো মানুষের (নাস্তিক) মুখে – ‘ঈশ্বর বলে কিছু নেই‘- এমন বাক্য শোনামাত্রই মানুষের প্রচলিত বিশ্বাসের ‘মাদারবোর্ডে‘ নেগেটিভ ক্রিয়া সতেজ হয়ে ওঠে এবং তার মনের ‘ক্যাচিং’ যন্ত্রে তা প্রতিফলিত হয়ে কণ্ঠে ধ্বনিত হয়- ‘তাহলে জীবন দান করো দেখি মৃতের!‘ কী অদ্ভূত ব্যপার দেখুন-
“…যেনো মৃত্যুকে ঠেকানো যাবেনা বলেই সৃষ্টি ধর্মের,
সৃষ্টি অদৃশ্য বিধাতার অস্তিত্ব-বোধের…”
(অদৃশ্য বাস্তব নয় অথচ আকাশ)
গুহা যুগের মানুষ কিছুই ঠেকাতে পারতো না, তাই অসহায়ের মতো ঈশ্বরবোধের আবহে গড়া সংস্কার নিয়ে যাত্রা করেছিল মানব সভ্যতার বিকাশে। কিন্তু বিশেষকরে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে মানবসভ্যতা যেভাবে উত্তরোত্তর চমকিতভাবে বিকশিত হয়ে আসছে, তাতে অনেক সমস্যারই সমাধান এসে গেছে মানুষের হাতে। দূরারোগ্য কলেরা, বসন্ত, যক্ষা, ক্যান্সার ব্যাধি এখন মানুষের নিয়ন্ত্রণে। একেবারেই নতুন মরণব্যাধি ইবলার প্রতিষেধকও আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। ফোনের মতো মানুষের মস্তিষ্কেও সিম সেটিংস করে মানুষের স্মরণশক্তিকে ধরে রাখার বিজ্ঞান আবিষ্কৃত হয়েছে। মানুষ এখন আগে থেকেই জানতে পারে কখন প্রাকৃতিক ঝড় হবে, জলোচ্ছ্বাস হবে, আগ্নেয়গীরির অগ্ন্যূৎপাত হবে, ভূমিকম্প হবে। জেনে বুঝে মানুষ সেভাবেই নিরাপত্তার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। বিংশ শতাব্দীতে এসে সেই বাতাবরণে চিন্তিত হয়ে পড়ে ধর্মবাদীরা। তাদের লালিত ঈশ্বরবোধের দূর্বলতায় তারা খানিকটা দমেও গেলো যেন। বস্তুবাদী বিশ্বের চেতনাপ্রাপ্ত অসংখ্য মানুষের কাছে কী তারা বলতে পারে অদৃশ্য ঈশ্বর এর অস্তিত্বকে বহাল রাখতে, সেই অবস্থায় তারা এই বাহুল্য প্রশ্নটিকে ছুড়ে মারলো বস্তুবাদী মানবতাবাদী মানুষের সামনে-‘তাহলে দাও দেখি একটি মৃত মানুষকে প্রাণ!’ যেন কেবল মৃত্যু আছে বলেই ঈশ্বর আছে। হালে ‘বানাও দেখি একটি মানুষ’-এমন প্রশ্ন আর আসেনা, কারণ টেস্টটিউবে মানব সৃষ্টিও হচ্ছে, এদিকে ক্লোনিং পদ্ধতিও মানবসৃষ্টির সম্ভাবনার পথ তৈরি করেছে! মানুষের আবিষ্কার মানুষের কল্যাণে। আবিষ্কার বিজ্ঞানীরা চোখ বন্ধ করে-‘হও’ বললেই হয়ে যাবেনা। প্রকৃতির তাবৎ উপাদান থেকে নানাবিধ মিশ্রণে, পরীক্ষায়, পর্যবেক্ষণে প্রকৃতিরই সম্পদের রূপান্তর সাধিত হয় মানুষের হাতে। আর রূপান্তরের দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় প্রকৃতির সেরকম প্রাকৃতিক উপাদানের এক মিশ্রণ-ক্রিয়ার যৌগিক সৃষ্টি ‘প্রাণী’ থেকে সৃষ্ট এই ‘মানুষ’। যদি কখনো সেই মিশ্রণ প্রক্রিয়া বিজ্ঞানের আয়ত্বে এসে যায়, তাহলে হতেও পারে অন্তত কৃত্রিম মানুষ সৃষ্টি। আর তা হলে ধর্ম ও ঈশ্বরের সেখানে অসুবিধা কী? এর জন্য বিশ্বাসীদের ক্ষিপ্ত হবারও কোনো কারণ থাকার কথা নয়। তারা তাদের মতো যতো খুশি ঈশ্বর আরাধনা করুক, যতো খুশী মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডা বানাক, স্ব স্ব ধর্মের চর্চা করুক।
ধর্মের মত ও পথকে ঢালাওভাবে সকলের ওপর চাপিয়ে দেবার ধর্মীয় মানসিকতাকে দমিত রাখার সময় হয়ে এসেছে।
মৃত্যু বলতে আমরা কেবল বুঝি মানুষের মৃত্যু! কিন্তু মহাশুন্যে বিশাল যে তারা (সূর্য) তার মৃত্যু! আবার তারার ধুলোতে মহাবিশ্বের অপরাপর গ্রহ নক্ষত্রের জন্ম! মহাপ্রকৃতির নিজস্ব কার্যক্রমে মহাবিশ্বের সকল কিছু এক মহা শৃংখলায় ঘুরছে যে মহাকাল ধরে, এসব কি মানুষ ভাবে? মহাকর্ষণ, মাধ্যাকর্ষণ, ইলেক্ট্রন-প্রোটন ইত্যাদির প্রভাবে আমাদের সূর্য সহ মহাজগতের আরো সব সূর্যাদী তার আবর্তে ঘুর্ণয়মান সকল গ্রহ (পৃথিবী) উপগ্রহ (চাঁদ) ধুমকেতু, উল্কাপিন্ড, এস্টরয়েড ইত্যাদি নিয়ে ঘুরছে। পাশাপাশি প্রতিটি সূর্যকে ঘিরে তীব্র গতিতে ঘুরছে অপরাপর সূর্য-সংসারের সকল গ্রহ উপগ্রহ! এই ঘুর্ণয়মান চক্রের মধ্যেই জন্ম এবং মৃত্যুর ধারাবাহিকতা ঘটছে অনন্তকাল ধরে! সেই ধারাবাহিকতায় জন্ম এবং মৃত্যু, সৃষ্টি এবং ধংসের নিয়মানুবর্তিতায় অনন্ত প্রবাহিত। মহাজাগতিক বিভিন্ন এইসব শক্তি তাদের ককার্যক্রম শুরু করেছিলো হাজার কোটি বছর পূর্বে। তখনো মানুষ তো দূরের কথা, প্রাণেরই সুত্রপাত হয়নি। ঘুর্ণয়মান মহাবিশ্ব তখনো আমাদের এই পৃথিবীকে জন্ম দেয়নি। আনুমানিক ৪৫০ কোটি বছর আগে প্রাকৃতিক এক দুর্যোগে (প্রাকৃতিক এ হেন ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে মহাবিশ্বের (মহাশুন্যের) বিভিন্ন এলাকায়) আমাদের সূর্যের পাশদিয়ে চলে যাওয়া কোন তারার প্রভাবে সূর্য থেকে ছিটকে পড়া উত্তপ্ত সূর্য-দেহাংশ সমুহের একটি আমাদের এই গ্রহ, যার নাম এক সময় মানুষ দিয়েছে- বিশ্ব, পৃথিবী, বসুন্ধরা, ওয়ার্ল্ড, দুনিয়া, জগত ইত্যাদি। কোটি কোটি বছরের প্রাকৃতিক বিবর্তনে এই গ্রহটি অগ্নিগোলা থেকে রূপান্তরিত হয়ে এলো মাটির পৃথিবীতে। এর চারপাশের শুন্যস্থানে (আকাশ) সৃষ্টি হলো জলীয় বাস্প। গ্রহটির অভ্যন্তরে তখনো জ্বলছিলো প্রছন্ড অগ্নি-ক্রিয়া। ভেতরের তাপ এবং বাহিরের ঠান্ডার যৌগিক ক্রিয়ায় গ্রহপৃষ্ঠে সৃষ্টি হতে থাকলো ছোট-বড় ফাটল। জল-বায়ুর প্রভাবে সৃষ্টি হলো বৃষ্টির। সেই বৃষ্টিতে এই গ্রহটি শুধু বিধৌতই হলোনা, সৃষ্ট ফাটলগুলোতে জল জমে লক্ষকুটি বছরে সেগুলো পরিণত হলো সাগর, নদি, হ্রদ ইত্যাদি জলাশয়ে। তখন পর্যন্তও এই গ্রহে প্রাণের সুচনা হয়নি। সাগর-নদিতে জলের উপর প্রাকৃতিক রাসায়নিক বিভিন্ন পদার্থের যৌগিক মিশালের প্রেক্ষিতে ডাংগায় সেওলা জন্মানোর মাধমেই শুরু হয়েছিলো প্রাণের আবির্ভাব। সেগুলোই লক্ষকুটি বছরের বিবর্তনে হয়েছে বৃক্ষ এবং ডাংগা-জাত প্রাণী। পাশাপাশি জলের মধ্যে ভাসমান প্রটোপ্লাজম থেকে সৃষ্ট এককোষি প্রাণী ‘এমিবা’ থেকে সৃষ্টি হয়েছে জলজ প্রাণী। সৃষ্টির এই অধ্যায় পর্যন্তও মানুষ সৃষ্টি হয়নি।
এমিবা থেকে ক্রমে ক্রমে বহুকোষি প্রাণী, জল ও ডাংগায় বাঁচতে পারে এমন উভয়চর প্রাণী, ‘কোয়েলাকান্ত’ নামক মাছ, ঊষ্ণ রক্ত-শিতল রক্তধারী প্রানী, এপম্যান-মানব, প্রভৃতি স্তর শেষে আদিম মানব, গুহা ও বৃক্ষচারী মানব, আদিম সামাজিক মানব, পাথর যুগের মানুষ, নতুন পাথর যুগের মানুষ, ট্রাইবাল মানব-সমাজ, ক্লোন সমাজ ইত্যকার বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে মানব সমাজ বিবর্তনের বিভিন্ন ধারায় এশিয়া আফ্রিকা ইউরোপ আরবসহ বিশ্বের নানা স্থানে বিভিন্ন অবয়বে, রঙে, আকৃতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বর্তমান রূপে এসেছে। মানব সভ্যতার এই কালক্রম এ যাবতকালের বৈজ্ঞ্যানিক, প্রত্নতত্তবিদ, সমাজ বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদদের বহুবিধ গবেষনায় প্রমানিতভাবে প্রতিষ্ঠিত। অপরদিকে মহাবিশ্ব তথা মহাশুন্য এবং এর সকল প্রকার বস্তু (দৃশ্যমান ও অদৃশ্য), এসকল বস্তুর ক্রিয়া-কর্ম বিজ্ঞ্যানের বিভিন্ন শাখার বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে তাদের অজস্র পরীক্ষা, পর্যবেক্ষন, প্রমাণ ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের জ্ঞ্যাতির মধ্যে আনতে সক্ষম হয়েছে। ফলে আমরা অবগত হয়েছি প্রকৃতির সকল কার্যক্রমের অধিকাংশ রহস্য এবং ফলাফল সমুহ সম্পর্কে।
ফেইসবুকে যখন আমি এই লেখাটি লিখছিলাম তখন একজন বন্ধু প্রশ্ন করেছেন-
” সূর্য থেকে না হয় আমরা এলাম, কিন্তু সূর্য এলো কোথা থেকে?”
আমি বিজ্ঞানী নই, তবে বিজ্ঞান সম্পর্কে কোনো সহজ প্রশ্নের সমাধান বিজ্ঞানীদের প্রমাণিত তথ্য থেকেই করা যায়। বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্টিফেন হকিং যিনি কৃষ্ণ-গহ্বর পর্যবেক্ষন ও গবেষনা করতে গিয়ে “বিগব্যাঙ-থিউরী”-এর মাধ্যমে মহাকাল এবং মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য আবিস্কার করেছেন, তাকেই করা হয়েছিলো এমন প্রশ্ন!
তার পরবর্তি গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, বিগবেং সংগঠনের জন্য কোনো ঈশ্বরের প্রয়োজন হয়নি। মহাবিশ্ব এবং মহাকাল মহাবিষ্ফোরণের পরই হয়েছে, পূর্বে হবার কোনোই কারণ নেই! আমরা শুধু আমাদের সূর্যই নয়, মহাশুন্যের অসংখ্য সূর্য পেয়েছি সেই বিগব্যাঙ-এর অব্যাবহিত মূহুর্ত থেকেই। সহস্র কোটি বছর পূর্বে ঘটিত সেই ঘটনাটির পূর্বে কোনো কাল (সময়)বা মহাবিশ্ব কিছুই ছিলোনা।
বিগব্যাঙ- সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা এই আলোচনায় করার অবকাশ নেই। তত্ত্বের অধিকতর নিশ্চয়তার জন্য এখনো গবেষনা চলছে। ফ্রান্স-অস্ট্রেলিয়া সীমান্তের একটি স্থানে এই তত্ত্বটি প্রমাণের একটি বৈজ্ঞ্যানীক কার্যক্রম এখনো চলমান আছে। এখানে আমি সংখেপে কিছুটা বলার প্রয়াস নেবো।
মহাশুন্যে আদি এক প্রচন্ড বিস্ফোরণ-‘বিগব্যাঙ’, যার ফলে মূহুর্তে সৃষ্টি হলো কাল এবং স্থান নিয়ে শিশু মহাবিশ্ব। ক্রমে ক্রমে এটি সর্বাংগে অসংখ্য তারা নিয়ে ফুলতে থাকলো অনবরত এবং সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে আজ অবধি এবং এই সম্প্রসারণ চলবে অনাদিকাল।কাছাকাছি থেকে ক্রমশ দূরে সরছে একটি তারা থেকে অন্যটি। মহাকর্ষন শক্তির সংগে সংগ্রাম করে করে তারাগুলো যেমন সরে যাচ্ছে তেমনি আবার সেই সংগ্রামে প্রায়শই দুর্ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। যে একটি মহাজাগতিক বিন্দু থেকে ঘটেছিলো সেই বিষ্ফোরণ সেই বিন্দুটির সকল ইলেক্ট্রন-নিউট্রন শক্তি প্রাপ্ত সকল তারা তাদের নিজস্ব কেন্দ্রে ঘুর্ণয়মান অবস্থায় কখনো কোনো তারা কক্ষচ্যুত হয়ে অন্য তারার পাশ দিয়ে চলার পথে সেই তারাটিকে প্রচন্ড আঘাত করার ফলে সেই আঘাতপ্রাপ্ত তারা এবং আঘাত দানকারী তারা উভয়ই খানিকটা চূর্নবিচূর্ণ হয়। সেই সকল তারাখন্ড মহাশুন্যে ঘুরতে ঘুরতে একসময় মহাজাগতিক ঘুর্ণনের নিয়ম শৃংখলার আবর্তে একটা স্থান করে নেয় তার নিজের। মহাশুন্যে অসংখ্য তারার মেলা মিলিয়ন ট্রিলিয়ন মাইল জুড়ে এমনভাবে আজ অবধি বিস্তৃত হয়ে চলেছে। এই ধারায় যে তারাটি অন্য যে তারাকে আঘাত করার ফলে সেই তারার শরীর থেকে ছিটকে পড়া ছোটবড় অংশসমূহ সেই তারাটিকে কেন্দ্র করে তারই চারপাশে ঘুরতে থাকে অনাদিকাল। সেগুলোর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলোকে বলা হয় এস্টরয়েড। আমাদের তারা (সূর্য) থেকে আমাদের এই গ্রহ সহ আরো অন্যা্ন্য গ্রহ এবং এই সকল গ্রহ থেকে ছিটকে পড়া অংশ (যেমন আমাদের গ্রহ থেকে ছিটকে পড়া বিশাল একটি অংশ আমাদের উপগ্রহ-চাঁদ) সূর্যকে ঘীরে আবর্তিত হচ্ছে প্রায় সাড়ে চার কোটি বছর ধরে। আমাদের এই চক্রটিকে বৈজ্ঞানিকরা নাম দিয়েছেন স্বৌরজগত। আর আমরা মহাশুন্যের যে এলাকাটিতে আছি অসংখ্য আরো এ ধরনের সবৌরজগত এর পাশে, সেই এলাকাটির নাম মিল্কিওয়ে-গ্যালাক্সি, আমরা বলি ছায়াপথ।
আমি বিজ্ঞানের দাড়িকমা কিংবা ব্যাকরণ দেখে কোনো বই সামনে নিয়ে এসব লিখছিনা। আমার দীর্ঘ জীবনের অধ্যয়ন এবং বিজ্ঞজনদের কাছ থেকে জেনে আমার নিজস্ব চিন্তা চেতনার আলোকে মগজ থেকে, স্মৃতি থেকে বলছি কথাগুলো। কাজেই এই সকল তত্ত্ব এবং তথ্য একেবারে হিসাব কষে বলার খুব একটা প্রয়োজন বোধ করছিনা। যারা খুব কম জানেন এই ডিজিটাল যুগে তাদের আজকাল জানার জন্য খুব একটা কসরত করতে হবেনা।
মহাশুন্যে রয়েছে বিলিয়ন ট্রিলিয়ন তারা, গ্রহ, উপগ্রহ এবং ঐ প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট খন্ডাদিখন্ড বস্তু-পিন্ড, অনু-পিন্ড (উল্কা, ধুমকেতু, এস্টরয়েড ইত্যাদি)। আর এরা মহাশুন্যে ভাসছে এবং ঘুরছে স্ব স্ব আবর্তে। প্রত্যেকটি তারা একেকটি সূর্য। আমাদের সূর্যের চাইতেও আরো অনেক বড় এবং অধিক তাপ সম্পন্ন সূর্যও রয়েছে মহাশুন্যে। পৃথিবীর মানুষ এইসকল তথ্য এবং তত্ত্ব আবিষ্কার করেছে ক্রমে ক্রমে। বিগব্যাঙ-এর পূর্বাবস্থাও নিশ্চয়ই আবিষ্কৃত হবে এক সময়। ততোদিন পর্যন্ত এই জগতের মানুষ যদি মনে করে নেয় ‘ঈশ্বর’ শব্দটি দিয়ে যা বোঝানো হয় সেই বোধের মধ্যেই থাকা উচিত, তো থাকুকনা তা নিয়ে। কিন্তু সেই অনুমান কিংবা সন্দেহ ভিত্তিক বোধ-কেন্দ্রিক নানাবিধ জটিলতা দিয়ে মানুষ মানুষকেই যেনো নিপীড়ন না করে। অদৃশ্য ঈশ্বর খুশী হবে কিংবা ক্ষুন্ন হবে মনে করে মানুষ কেনো মানুষকে মারবে, জ্যান্ত মানুষকে পুড়বে, প্রস্তরাঘাতে নির্মম মৃত্যু দেবে, বিষপানে বাধ্য করবে, জিহাদ, ক্রুসেড প্রভৃতি নামে যুদ্ধ বাধাবে, ঘরে ঘরে নারীনির্যাতন, ধর্ষণ করবে, মেয়ে জন্মালে তাকে মেরে ফেলবে, ঈশ্বরের তুষ্টির জন্য মৃত স্বামীর চিতায় নিরিহ স্ত্রীকে নিক্ষেপ করবে, জ্বীন-ভুতের আছর লেগেছে সিদ্ধান্ত নিয়ে রোগী মানুষকে নাবাবিধ অকারণ ব্যবস্থায় নির্যাতিত করে এমনকি মেরে ফেলবে, ইত্যাদি!
যখন একটি মানবশিশু জন্ম নেয়, তখন সেই মূহুর্তে সে যে পরিবারে জন্ম নিলো সেই পরিবারে শিশুটির মা-বাবা যে ধর্মাচারে পুষ্ট শিশুটিকেও সেইমতো করেই লালন করবে! ফলে অবচেতন শিশুটি ঠিক যেই মূহুর্তে প্রাথমিক মানবিক চেতনপ্রাপ্ত হবে, সেই মূহুর্ত থেকেই সে মাতা-পিতা ও সেই পরিবারের চর্চিত ধর্মীয় রীতি নীতি প্রথাকেই তার নিজস্ব প্রথা হিসেবে মনের মধ্যে লালন শুরু করে দেবে, সেইটাই খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সে যখন মুক্ত পৃথিবীর প্রকৃতি এবং বৃহত্তর মানব-সমাজের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করবে এবং সেই প্রেক্ষিতে তার মানসিক চিন্তা চেতনার দ্বন্দ্ব শুরু হবে, তখন সে তার মতো করে মুক্ত চিন্তা নিয়ে যদি বিজ্ঞানসম্মত সত্যকে বুঝতে আগ্রহী হয়, তখন ঈশ্বর ক্ষুন্ন হবেন ভেবে কেনো জ্ঞানান্বেষী মানুষকে ধর্মবাদী মানুষরা মেরে ফেলবে, কিংবা দেশান্তরী করবে?
আমি ছোট বেলায় মক্তবে (স্কুলের একটি কক্ষে)যে মৌলানার কাছে আরবী শিখতে বাধ্য ছিলাম, সে সময় সেই শিক্ষাকে আরবী-শিক্ষা মনে করতামনা! সেটা ছিলো ইসলাম ধর্ম শিক্ষা। মৌলভী সাহেব আমাকে এবং আমার বোনকে যেভাবে শাসন করেছিলেন এখন বুঝতে পারি তা ছিলো কতোটা অমানবিক। বেতের বাড়ি খেতে খেতে আমরা কুঁকিয়ে উঠতাম, যন্ত্রণায় কাতরাতাম! মাথায় টুপিটা ঠিক মতো লাগাতামনা মনে করতেন মৌলভী সাহেব, হয়তো একটু বাকা হয়ে থাকতো, বোন তার মাথায় হয়তো ভুলে ওড়নাটা দিলোনা, কোনো সুরার আরবী শব্দটা উচ্চারণ ঠিক মৌলভীর মতো হলোনা, মৌলভীর কাঙ্খীত সময়ের মধ্যে সুরা কালেমা মুখস্ত হলোনা ইত্যাদি নানা কারণেই পড়তো পিঠে ও মাথায় চিকন বেতের বাড়ি! সেই অবস্থায় কেউ কি ভাবতে পারে দুনিয়াটা কি, কেমন করে কোথা থেকে এলো এই দুনিয়া আর যাবেইবা কোথায়, কে এর স্রষ্টা, আকাশ কি, চন্দ্র-সূর্য-তারা কি, সাগর-পাহাড় আসলে কি—ইত্যাদির সঠিক সত্য উত্তর? খুব সহজেই বেতের বাড়ির প্রভাবে আমাদের মাথা ও মগজে এইভাবেই প্রবিষ্ট হয়ে যায় ধর্মীয় দর্শন! কিন্তু বয়োস আরো কিছু এগুলেই যখন স্কুলে সংস্কৃতিও শিখতে গেলাম পাশাপাশি বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, ইংলিশ, অংক ইত্যাদি পড়তে ও শিখতে শুরু করলাম তখন মৌলভী সাহেবের বেতের বাড়ির সঙ্গে প্রবিষ্ট দর্শন এবং স্কুলের শিক্ষার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত আমাদেরকে ক্রমে ক্রমে দ্বিধান্বিত করে তোলাটাই স্বাভাবিক! মানুষের চেতনাবোধের এই ট্রান্সফারেন্স সময়টা খুবই উল্লেখযোগ্য। মক্তবে বা মন্দীরে কিংবা গীর্জায় ধর্ম মস্তিষ্কে প্রবিষ্ট করানো হয় ধর্মেরই নির্দেশে। ধর্ম কোনো মানুষ নয়, নয় কিছু দানবও। ধর্মাচারী মানুষরাই বানিয়েছে সেইসব নির্দেশ, পালন করছে তারাই, ছড়িয়ে দিচ্ছে মানব সমাজে! সমাজ তা ধারণ করছে মানুষেরই চর্চায়, পালনে, আচারে, সংস্কারে, প্রথায়, জীবনধারায়। কাজেই যে মানুষ যে ধর্ম-সমাজে ভূমিষ্ট হয়ে এই পারিপার্শ্বিকতায় বেড়ে উঠছে তাকে সেই ধর্ম-প্রথা মেনেই চলতে হবে, সেটাই স্বাভাবিক! যদি কেউ বোধের সেই ট্রান্সফারেন্ট মূহুর্তে দ্বন্দ্ব-গঠিত ব্যতিক্রমী চেতনায় প্রথা থেকে ঘুরে দাঁড়ায় তাতে তা দোষের নয় বটে কিন্তু প্রথাসিদ্ধ ধর্মীয় চিন্তা ও চর্চাকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষরা তা মেনে নিতে পারেনা! মেনে নিতে না পারার কারণও ধর্ম। ঈশ্বর সকল ধর্মেই বলে দিয়েছেন-“তাকে মানতে হবে, ভজতে হবে, পুজতে হবে ইত্যাদি—যারা না মানবে তাদের মানাতে হবে, পুজাতে বাধ্য করতে হবে, ভজনে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে, নইলে নরক অবধারিত। ঈশ্বরকে ভজনের জন্য মানুষকে বোঝানোর দায়িত্ব কেবল ধর্মকারী পুরোহিতেরই নয়, সকল মানুষের। আর এর জন্য পুরষ্কারের ব্যবস্থাও রয়েছে! সুতরাং একদিকে পুরস্কার অন্যদিকে সমুহ শাস্তির নরক! পুরোহিত, পন্ডিতসহ সকল মানুষই তাই মরিয়া হয়ে ধর্ম-বিরোধী মানুষদেরকে পথে আনতে বদ্ধপরিকর। সেই দিক বিবেচনায় আমাদের দেশের ইসলামী দলগুলো মানুষকে দ্বীনে রাখতে এবং কাফেরকে দ্বীনে আনতে বদ্ধপরিকর থাকবে, সেটাইতো স্বাভাবিক! ফলে মুক্ত চিন্তা চেতনার মানুষ অর্থাৎ নাস্তিক ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তুলবে, মানবিকতার জয়গান শোনাবে, জাতীয়তা এবং বিশ্ববোধ এর পক্ষে, অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে কথা বলবে, সেটা কেনো স্বাভাবিক হবে? জামাতে ইসলাম এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির তাদের মতো করে তাদের পবিত্র দায়িত্ব পালন করছে! যেমন করেছিলো ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা, জ্বালাও-পোড়াও, লুটপাট, নারী ধর্ষন, খুন ইত্যাদি তারা তাদের সেই বিশ্বাসলব্ধ চেতনা থেকেই করেছে, করছে এবং করবে। কল্পিত ঈশ্বর আর সেই ঈশ্বর কল্পনার পবিত্র জারকে অবগাহিত ধার্মিকরা তাদের ক্রুসেড চালিয়েই যাবে ততোদিন যতোদিন না মানুষ সম্মিলিতভাবে অন্ধ ধার্মিকতা থেকে বেরিয়ে সত্য বাস্তবতায় না আসতে পারবে, ততোদিন বিচ্ছিন্নভাবে নাস্তিক নামাংকিত প্রগতিবাদী মানুষরা হুমায়ুন আজাদের মতো লাঞ্ছিত হয়ে মৃত্যু বরণ করবে নয়তো রুশদী, দাউদ, তসলিমা, জোবায়েন সন্ধির মতো মানুষরা দেশ-বিতাড়িত হবেই।
‘ঈশ্বর বলে কেউ কিংবা কিছু আছে’ এ বিষয়ে যিনি স্থির সিদ্ধান্তে উপনিত আছেন তাকে ‘ঈশ্বর বলে কেউ কিংবা কিছুই নেই’ এ বিষয়ে ভাবিত হওয়ার জন্য উপদেশ দেয়া নিরর্থক! ঈশ্বর একজন অথবা বহুজন অবশ্যই আছেন-এমন বিশ্বাস সর্বান্তকরণে ধারণ করেই এই শ্রেণীর মানুষরা স্ব স্ব মত ও মিথ অনুযায়ী ধর্ম পালন করছেন নিশ্চিন্তে-ইহকাল এবং পরকালের সকল পুরস্কারের প্রত্যাশায়!
ঈশ্বর বলে কেউ কিংবা কিছুই নেই-এটা কোনো বিশ্বাস নয়, এটা বিজ্ঞান এবং বস্তুবাদ থেকে আহরিত মানুষের চেতনা। এই শ্রেণীর মানুষরা এই ধারায় ভাবিত হয়ে মহাপ্রকৃতির সকল কার্যক্রম বিশ্লেষন করে, পরীক্ষা করে, পর্যবেক্ষন করে নানাবিধ প্রমাণের প্রেক্ষিতে বিগত সহস্র বছরে যে সকল আবিষ্কার করেছেন, বর্তমানে সকল শ্রেণীর মানুষই সেই সকল আবিষ্কারের সুফল ভোগ করছেন। যদিও ধর্মানুসারীরা সকল ক্ষেত্রেই বিশ্বাস করছেন সবই ঈশ্বরের ইচ্ছায় সংগঠিত হয়েছে, হচ্ছে,হবে! তারা বিশ্বাস করছেন এসবই ধর্মগ্রন্থে ছিলো! বিজ্ঞানিরা সেখান থেকে গবেষণা করেই বিভিন্ন আবিষ্কার করছে ! তারা তাদের বিশ্বাস থেকে একচুলও নড়বেনা, প্রমাণাদী পেয়েও! মানুষের মনের কন্দরে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্বাস মানুষ বহন করে আসছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে। তবে বিগত কয়েক হাজার বছরে সেই মূল ঈশ্বর-চিন্তা এবং সেই চিন্তার আবহে সৃষ্ট বহু প্রথা, সংস্কার-কুসংস্কার, মতবাদ, ধারনা ইত্যাদি অনেক পরিবর্তন হয়েছে, হচ্ছে, এবং আরো হবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু মূল ঈশ্বর-চিন্তা সহজে বিলুপ্ত হবেনা।তারপরও মহাবিশ্ব কেমন করে কে সৃষ্টি করেছেন, কিভাবে করেছেন এই বিতর্ক এবং এ নিয়ে বিভ্রান্তি থাকবেই চিরকাল।
এখন প্রশ্ন হলো সবাইতো আজকাল আর ঈশ্বরের অদৃশ্য অস্তিত্বে বিশ্বাস করছেনা, আবার বহু মানুষ তা করছে বলে বিশ্বাসীরাই কেবল পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে, অবিশ্বাসীদের বাঁচার অধিকার নেই-এমন অমানবিক চিন্তা থেকে কিভাবে মানুষকে মুক্ত করা যায়? সেখানে আবার সকল ধর্মেই আছে সহনশীলতার প্রস্তাব, তবুও বিশেষত ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে তার লঙ্ঘন হচ্ছে যত্রতত্র! তারা তাদের মতো করে ইসলামী আইন, আল্লার আইন, রসুলের সুন্নত এরকম বিভিন্ন ঘোষনা দিয়ে কাফের বধের নামে ইসলামের যাত্রা লগ্ন থেকেই জিহাদ (ধর্মযুদ্ধ) এর পোষাকে নির্মম গণহত্যা চালিয়ে আসছে যা বর্তমানে এই অত্যাধুনিক সভ্য যুগেও চলছে! ইহুদী খৃস্টানরা তারও পুর্ব থেকে সাম্রাজ্যবাদী প্রভুত্ব স্থাপন ও তা টিকিয়ে রাখার জন্য নানাবিধ কায়দায় গণহত্যা, নির্যাতন, শোষন, অপশাসন চালিয়ে এসেছে এবং এখনও চালাচ্ছে রাজনৈতিক চকমকে চাদরের আবডালে! যারা ধর্মকে ব্যবহার করে ধর্মপ্রাণ মানুষের চোখে ধুলি ছিটিয়ে পাপের ভয় দেখিয়ে, পুন্যের স্বপ্ন দেখিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের মাধ্যমে সমাজ ও রাস্ট্রে ত্রাসের বিভিষিকা রচনা করছে, তারা হয়তো ধর্মের মূল যে মৌলিকতা সেখানে নিজেদের সম্পৃক্ততাই খুঁজে দেখেনা! আর তাদের ক্রিঢ়নক অসহায় বিশ্বাসী মানুষগুলো পরোকালের ডাইরেক্ট স্বর্গীয় সুখ স্বাচ্ছন্দ হুর গুলেমান ইত্যাদির অন্ধ আকর্ষণে আত্মাহুতি দিচ্ছে অগনিত নিরপরাধ মানুষদের হত্যা করে! আলকায়েদা, তালেবান, বোকো হারাম ইত্যাদিসহ বর্তমানের সর্বশেষ ইসলামী মৌলবাদী আই এস এস যেভাবে ইসলামী রাস্ট্র ও আল্লার আইন প্রতিষ্ঠার সহিংস তান্ডব ঘটিয়ে চলেছে তা ক্রমশ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যাবে! এর থেকে তাদের বের করে আনতে পারে কেবলমাত্র ধর্মীয় নেতারাই। কিন্তু মানবজাতীর দুর্ভাগ্য যে ধর্মীয় নেতারা এবং তাদের চেলারা ধর্মকে ব্যবহার করছে রাজনৌতিক হাতিয়ার হিসেবে। আর তাদের অনুসরণকারীরা অদৃশ্য ঈশ্বর-চিন্তায়, ইহলোক ও পরোলৌকিক সুখ চিন্তায় আল্লার নামে যারা এসব করছে তাদেরকে উচ্ছসিত সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে!
ধর্মান্ধতার এই অশুভ প্রতিক্রিয়া রোধের জন্য মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। কোনো অদৃশ্য শক্তিকে খুশি করার জন্য মানুষ হয়ে মানুষকে খুন করা, লাঞ্ছিত করা, শোষন করা, সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা প্রদর্শন কখনোই ঈশ্বর, আল্লা, প্রভু কাউকেই খুশি করতে পারেনা।