০
৬৭১ বার পঠিত
৬৭১ বার পঠিত
আমাদের দৈনন্দিন জীবন, যাপিত বাস্তব আসলে নানাবিধ লজ্জার উদযাপন ছাড়া কিছুই নয়। নির্লজ্জতা এখানে অভিশাপ, অপরাধ, অন্যায়। শরমে আগাগোড়া মুড়ে দেওয়া শরীর এই বাস্তবের আদর্শ। মুখে বুলি না ফোটা কন্যা বিবাহের জন্য সুযোগ্যা। একের পর এক সন্তানের জন্ম দিয়ে যেতে থাকে স্বামী-স্ত্রী ফি বছর, অথচ একে অপরকে মুখ ফুটে জনসমক্ষে বলবে না, ‘ভালোবাসি’। যৌবনে আনন্দঘন মূহুর্তে যুবক-যুবতী আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলে নাম দেওয়া হয় বেহায়া, বেলেল্লা, অসভ্য। অগত্যা ভালোবাসার উদযাপন আমার বাস্তবতায় এক কথায় অসম্ভব। আমার যাপন প্রতিদিন শেখাচ্ছে আমায় লজ্জার পাঠ। সেখানে মুখ ফুটে খিস্তি বেরোনো স্বাভাবিক, কিন্ত ভালোবাসার কথায় জাত যায়। কূলহারা কলঙ্কিনী কে তখন কেউ ছোঁয় না আর।
ছেলেবেলা থেকেই নিয়ম মেনে বড়দের সম্মান করতে শেখানো হয় রোজ, মানুষকে ভালোবাসাটা নয়। যদিও বা ভুল করে ভালোবেসে ফেলা হয়ে যায় কাউকে, ব্যক্ত করতে নেই কখনো সে কথা। বদলে মাথায়, বুকে, মুখে চেপে দিতে হবে কয়েকশো মণ ওজনের পাথর। নিশ্ছিদ্র হয়ে জেগে থাকতে হবে লজ্জায়, যাতে কোন ফাঁক দিয়ে গলে না বেরিয়ে পড়ে ভালোবাসার কোন বাড়তি অভিব্যক্তি। এভাবেই না-বলা বাণীর পাহাড় জমতে থাকে আমাদের ভেতর, আর বাইরে বর্ধিত হতে থাকে লজ্জার সামাজিক উৎসব।
মনে করে দেখুন তো শেষ কবে পরিবারের কাউকে বলেছিলেন ভালোবাসার কথা। রাগের, অভিমানের দু’কথা বলতে আমাদের কারো বাধেনা, কিন্ত কাছে টেনে নেওয়া? সে পাঠ আমাদের জন্য নয়। সে সব কি আর এদেশে সম্ভব? ও সব তো সিনেমার পর্দায় দেখতে পাই আমরা কেবল। আমার বাস্তবে মানুষ নয়, যন্ত্র বাঁচে। কোনকিছুতেই যার ভ্রূক্ষেপ নেই। ‘আমি সদা অচল থাকি, গভীর চলা গোপন রাখি’- কবেই বলে গেছিলেন বাঙালির অনুভূতির হর্তাকর্তা রবীন্দ্রনাথ। গভীর চলা গোপনই থাকে যতদিন অচল থাকা সম্ভবকর। জীবনের চলমানতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় যখনই কোন চাঞ্চল্য দেখা দেয়, অর্থাৎ জীবনের স্বাভাবিকতায় বিঘ্ন ঘটে। উদাহরণস্বরূপ মৃত্যুর কথাই ধরা যাক নাহয়।
বেঁচে থাকতে কেউ কাউকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেনা। এক সেকেণ্ডও নীরবতা পালন করেনা অপরদিকে থাকা মানুষটির কথা শুনবার জন্য। কথা শুনবার মধ্যে যেন ভীষণ লজ্জা! অকারণ বকবক করে ফেলার মধ্যেই যেন সারা দুনিয়ার বীরত্ব, পৌরুষ, সাফল্য। মাথা নত করে শ্রদ্ধা যেন কেবল মরে যাওয়া মানুষটার জন্যেই সংরক্ষিত। শ্বাস নিতে থাকা জীবন্ত ব্যক্তির জন্য শ্রদ্ধা কাম্য নয়। সেক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে নাটকীয় ভদ্রতা, মেকি সৌজন্যবোধ।
ঠাকুমা মারা যাবার পর অনেক কেঁদেছিলাম। স্মরণ অনুষ্ঠানে গেয়েওছিলাম,
“তুমি মোর আনন্দ হয়ে ছিলে আমার খেলায়/আনন্দে তাই ভুলেছিলেম কেটেছে দিন হেলায়/ গোপন রহি গভীর প্রাণে/ আমার দুঃখসুখের গানে সুর দিয়েছ তুমি/ আমি তোমার গান তো গাইনি, আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখতে আমি পাইনি তোমায় পাইনি/”
সত্যিই তো! ঠাকুমাকে ছাত্র বানিয়ে চিরকাল বেদম পিটিয়েছি আমার খেলনা ইস্কুলে। নরম শরীরের কারণে আদর করে ‘নধর শুয়োর’ বলে ডেকেছি, অথচ সেই ঠাকুমা চলে যাবার পর বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছিল কেন একবারও বললাম না সে আমার কী ছিল, সে কথা। আমি বলিনি, সেও বলেনি কিছু বদলে। ধরেই নিয়েছি যে সে জানে, তাঁর জানা উচিত। আর ধরে নিতে নিতেই একদিন নিপাট অধরা হয়ে যায় মানুষ। চাইলেই আর শোনানো যায়না তাকে ভিতরমহলের কথা।
আমরা মানুষ, কিন্ত মনুষ্যত্বকে বড্ড ভয় পাই। ভাবি, অচেনা থাকাটাই জাদুকরী। দুর্বল হয়ে মানুষ হতে আমরা চাইনা। নির্বাক, যান্ত্রিক রূপ ধারণ করে ঈশ্বর হতে চাই। আর দেবতার লাজ রাখা মানুষের কর্তব্য। এই সমাজ নির্লজ্জকে অমানুষ বলে। ভালোবাসার কথা বলতে আসাদের নামকরণ হয় র্যাডিকাল, সমাজবিরোধী। বাস্তব তাদের প্রতিক্রিয়াশীল বলে ডাকে, প্রেমিক নয়।
মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলতে পারার ধক থেকেই পৃথিবীর সমস্ত প্রেমের গানের জন্ম। আর এই ধক নির্ধারণ করে দেয় কে প্রেমিক, আর কে ঈশ্বর। ঈশ্বরের নামডাক আছে সবজান্তা হবার কারণে। তিনি সব জানেন। তাকে সব প্রশ্ন করা যায়, অথচ উত্তর মেলে না। তিনি মৌন।
আমরা যারা মানুষ, বাস্তবিক, তাদের মৌন থাকাটা অস্বাভাবিক, ঠিক ঈশ্বরের যান্ত্রিকতার মতই। আমরা গান গাই, কাব্য লিখি। তিনি চুপ থাকেন। মানুষ মরলে তাঁর কাছেই নাকি যায়।
আমরা প্রেমিক। আর দেবতা হতে চাওয়ার সাথে প্রেমের কোন যোগ নেই।
অতএব, অপ্রেমিকের জন্য আমার গান নয়। নয় আমার ভালোবাসাও। আমার নির্লজ্জ চিৎকারেই আমি মানুষ হতে থাকি। প্রতিটি অশ্রুকণায় ঝরে যেতে থাকে আমার সাময়িক দেবত্ব।
যান্ত্রিক দেবত্ব হার মেনে যায় প্রেমিক মনুষ্যত্বের বাঁধ ভাঙা অভিব্যক্তির কাছে।
আর অসভ্য, নির্লজ্জ এ যুগের সন্তানের মতই দেবত্বের জন্য এক মিনিট নীরবতা ও কয়েক ছটাক শ্রদ্ধা তুলে রাখি আমি সযত্নে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন