আমাদের দেশের মেয়েরা তার নিজের ভাললাগা-মন্দলাগা, পছন্দ-অপছন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিয়ে যতটা না ভাবে, তারচেয়ে হাজারগুণ বেশী ভাবে তার স্বামী-সন্তান-পরিবার, আত্মীয়, প্রতিবেশী সমাজ বা চারপাশের মানুষের কথা। অন্যরা মেয়েদের কোন আচরণকে কিভাবে নেবে, কি বলবে, কি ভাববে… সেটা বিবেচনা করে তারা আচরণ করে। মেয়েদের জীবনের বেশীরভাগ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সে নিজে নিতে পারেনা। নিতে দেওয়া হয়না।
অনেককিছু করতে ইচ্ছে করলেও অন্যরা পছন্দ করবেনা বলে মেয়েরা তা করেনা। করতে পারেনা। যেকোন কিছু করতে মেয়েদেরকে পুরুষের অনুমতি নিতে হয়। চাকরী, কোন কোর্স, পড়াশুনা এমনকি লেখালেখি করতে চাইলেও পরিবারের অনুমতি নিতে হয়। বিয়ে, ডিভোর্স বা পেশা নির্বাচনের বিষয়েও অন্যের মত নিতে হয়। মেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকজন মেয়েদের পড়া বন্ধ করে দেয়, চাকরী ছাড়ায়, বোরখা পরায়, গান-নাচ-খেলা…..ইতাদি বন্ধ করে দেয়। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেককিছু করতে বাধ্য করে।
ছোটবেলা থেকে মেয়েদেরকে বিয়ে করে সংসার করার জন্য তৈরী করা হয়। তারা সংসারের কাজ শেখা, রান্না, সেলাই-ফোঁড়াই, পড়াশুনা, চাকরী, রূপচর্চা, শরীর ঠিক রাখা, এমন কি গান শেখা পর্যন্ত- এসবই পুরুষের জন্য করে, যাতে তার একটা ভাল বিয়ে হয়। অর্থাৎ মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হল ভাল বিয়ে হওয়া। অন্য কথায় ভাল আশ্রয় পাওয়া। নিজেকে স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কোন চেষ্টাই সে করেনা। কারণ সে জানে, একা সে টিকতে পারবেনা, তাকে টিকতে দেয়া হবেনা।
বিয়ের পর সংসারের চাপে বেশীরভাগ মেয়ে নিজের শরীর ও মনের যত্ন নেয়া ছেড়ে দেয়, দিতে বাধ্য হয়। ফলে তারা মুটিয়ে যায়, নিজের দিকে তাকাতে ভুলে যায়, নিজের শখ, বন্ধু-বান্ধব, সৃজনশীলতা, চাকরী, লেখা, গান-নাচ-আঁকা,… সব ছাড়ে পরিবার, বাচ্চা এদের জন্য। মেয়েদের নিজের কোন অস্তিত্ব থাকেনা। সে বাঁচে অন্যের জন্য।
বরের অনুমতি ছাড়া মেয়েরা কোথাও যেতেও পারেনা (মায়ের বাড়ীও না)। স্বামীর হুকুম ছাড়া স্ত্রী কিছু করতে পারেনা। ধর্মও তাই বলেছে। স্ত্রী স্বামীর অনুমতি ছাড়া দানও করতে পারবেনা। ফলে স্ত্রীকে যেকোন কাজে বাধা দিতে বা মেয়েদেরকে সে বাধা মানাতে পুরুষের তেমন কোন অসুবিধা হয়না। কারণ স্ত্রী সবসময়ই স্বামীর অধীনস্ত। স্বামীকে কখনও কোথাও যাবার জন্য স্ত্রীর অনুমতি নিতে হয়না। “আমি অমুকখানে যাচ্ছি”, শুধু এটুকু বললেই চলে। না বললেও চলে।
কেন স্ত্রীদের স্বামীর কাছে এত অধীনতা, এত দায়বদ্ধতা? ভাত-কাপড় দেয় বলে? নাকি পুরুষ ছাড়া সে চলতে পারেনা বলে? নাকি মেয়েরা আর্থ- সামাজিক নিরাপত্তার দিক থেকে পুরুষের তুলনায় দূর্বল বলে পুরুষরা জোর খাটিয়ে আরাম পায়?
আর্থিক নির্ভরশীলতাই নারীর অধীনতার কারণ হলে চাকুরীজীবী বা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী মেয়েরা স্বামীর অধীনতা মেনে নেয় কেন? আসলে নির্ভরশীলতাটা বেশী সামাজিক ও মানসিক কারণে।
আমাদের দেশের নারীদের প্রতি অমানবিক ও বৈষম্যমূলক আচরণের একটি বড় কারণ হলো, মেয়েরা প্রতিবাদ করেনা। সবকিছু বিনা বাধায় মেনে নেয় আর্থ- সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও মানসিক নির্ভরতার কারণে। যেহেতু মেয়েরা একা বাঁচতে পারেনা, সেহেতু পরিবারের সব সিদ্ধান্ত (ভাল না লাগলেও) মেনে নিয়ে পরিবারের ছত্রছায়ায় থাকে, থাকতে বাধ্য হয়।
আমার খুব ইচ্ছে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। আমার আব্বা ভর্তি ফর্মই তুলতে দেননি। কারণ তিনি চাননি একা একা হলে, মেসে কষ্ট করে থেকে আমি পড়াশুনা করি। মেধা থাকা সত্ত্বেও আমি ডিগ্রী বা পড়াশোনা করতে বিদেশে যেতে পারিনি। কারণ আমি জানতাম, আমার মেয়েদের রেখে একা বিদেশ যাবার জন্য আমি পরিবারের অনুমতি পাবনা। অথচ আমার বরের অনেকগুলো বিদেশী ডিগ্রী আছে।
আমাদের এক ম্যাডাম, আমার বরের বান্ধবী, মনোবসু স্কলারশিপ পেয়েও যায়নি বাচ্চার জন্য স্বামীর অনুমতি পায়নি বলে। কোন ছেলে সেটা করতোনা। বহু মেয়ে বাচ্চার জন্য, স্বামী, সংসারের জন্য চাকরী ছেড়ে দেয়। একজন ছেলেও পাওয়া যাবেনা যে স্ত্রী বা বাচ্চার জন্য চাকরী ছেড়ে দিয়েছে। ত্যাগ করার কথা শুধু মেয়েদের। ডিভোর্সের পর বা স্বামী মারা গেলে প্রায় সব পুরুষ বিয়ে করে, মেয়েরা করেনা। করতে পারেনা। কারণ আমাদের সমাজ মনে করে সন্তান লালন-পালনের দায় একা মেয়েদের।
উন্নত দেশগুলোতে স্বামী বা স্ত্রী কেউ একজন মারা গেলে বা তাদের ডিভোর্স হলে বাবা বা মার দ্বিতীয় স্বামী বা স্ত্রীকে সন্তানরা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়। সন্তানরা বিয়ে করে আলাদা থাকে, বাবা-মার সাথে থাকেনা। তাই সন্তানের লালন পালনের কথা ভেবে বাবা-মা একা থাকেনা। তারা মনে করে প্রতিটা মানুষের নিজের মত করে বাঁচার অধিকার আছে। যা ভাল লাগে, তা করার অধিকার আছে। স্বামী মারা গেছে বা ডিভোর্স হয়েছে বলেই মেয়েদের শখ- আহলাদ ফুরিয়ে গেছে, বা সন্তান মানুষ করার জন্য মাকে বাকী জীবন একা কাটাতে হবে – তারা এমনটা মনে করেনা।
আমি ইদানিং লেখালেখি করতে গিয়ে সংসারের, অফিসের কাজে, বিশেষ করে ছোট মেয়েটার পড়াশুনা সেভাবে দেখতে পারছিনা। কিন্তু আমার স্বামী বা পরিবারের লোকেরা কখনোই বলবেনা যে, “বাচ্চাকে আজ থেকে আমি পড়াই, তুমি লেখ।”
আমাদের সমাজের নিয়ম অনুসারে কিছু কাজ ছেলেদের, কিছু কাজ মেয়েদের। তুলনামূলকভাবে মেয়েদের কাজগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় এবং সেগুলো বিরক্তিকর। রান্না, কাচা, সংসারের আরো কাজ, বাচ্চা সামলানো, পরিবারের সবার দেখাশোনা.. ইত্যাদি সব কাজ করতে গিয়ে মায়েরা অবসর পায়না। দিনরাত ব্যস্ত। পুরুষরা কাজ বা চাকরী শেষে বাড়ী ফিরে আরাম করে, বৌ-মেয়ে-বোন-মা তার সেবা করে, কারণ সে সংসার চালানোর জন্য টাকা আনে। (বাবা আয় করে, তাই বাকী আর কিছু সে করবেনা। তার কাছে কেউ কিছু আশাও করেনা। সন্তান লালন-পালন, পড়াশোনা, সব দায় একা মায়ের।) অথচ মায়ের কোন ছুটি নেই। তার কোন বিনোদনেরও প্রয়োজন নেই। কারণ সে সারাদিন বাড়ীতে বসে বসে আরাম করা ছাড়া আর তো কিছু করেইনা! চাকরী বা কাজ করলেও তার রোজকার সংসারের কাজে আর কেউ তাকে সাহায্য করেনা। মেয়েরা বড় হলে বা কাজের লোক থাকলে কিছুটা সাহায্য হয়। তবে কিছু কাজ (যেমন রান্না…) আর কেউ করবেনা। যেমন আমার বাড়ীতে কাজের লোকের রান্না কেউ খেতে চায়না।
মেয়েরা সংসার, বাচ্চা সামলিয়ে সময় পায়না। ফলে তার সৃজনশীলতা থাকলেও প্রকাশ পায়না। ধীরে ধীরে সে পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারেনা, সারাজীবন পরনির্ভরশীল থেকে যায়।
এজন্য মেয়েদের আত্মবিশ্বাস তৈরী হয়না তার উপরে ভরসা করা হয়না বলে। বাবাদের একমাত্র চিন্তা হল, কোন রকমে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে পারলেই তার দায় শেষ! কি মজা!! ছুটি!!! গরম গরম রুটি!!!!
আসলে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো মানসিকতা। মেয়েরাও মানুষ, তাদেরও ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভাললাগা-মন্দলাগা আছে, তারও বিনোদন দরকার, তারও কাজ করার বা নিজের সৃজনীশক্তি প্রকাশ করার অধিকার আছে…. এগুলোকে আমাদের সমাজ স্বীকৃতি দেয়না। ঘরের সব কাজ মেয়েদের ঘাড়ে চাপিয়ে বাসায় বসিয়ে রাখার মানসিকতা আমাদের সমাজের মজ্জাগত।
আমাদের সিস্টেমটাই এরকম। চারবেলা (বিকেলের নাস্তাসহ) রান্না করতে প্রচুর সময় চলে যায়। বাচ্চার জন্য ডেকেয়ার সেন্টার নেই। সংসারের অন্যান্য কাজেও প্রচুর সময় ও শ্রম ব্যয় হয়। হোটেলে মানসম্মত খাবার পাওয়া যায়না। পেলেও ব্যয়সাপেক্ষ। তাছাড়া বাড়ীর খাবার না খেলে আমাদের পেট ভরেনা। তাই বাড়ীর মেয়েদের দিনরাত খেটে সংসার সামলাতে হয়। তবু বউদের প্রতি প্রতিটা স্বামীর একটাই প্রশ্ন, “দিনরাত বাড়ীতে বসে কি কর?”
বউ সাত দিনের জন্য বাপের বাড়ী গেলে অবশ্য সব মহামান্য বররাই এ প্রশ্নের উত্তর পান হাড়ে হাড়ে ।
পুরুষরা যে ইচ্ছে করে মেয়েদের বাড়ীর কাজে আটকে রাখে, তা নয়। আসলে আমাদের সমাজে প্রচলিত মেয়েদের ও ছেলেদের ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের ধারণা বদ্ধমূল। যেমন – সাংসারিক কাজ, রান্না, বাচ্চা সামলানো.. এগুলো মেয়েরাই করবে, ছেলেরা কখনোই করবেনা, চাকরী বা বাইরে কাজ করবে পুরুষ। মেয়েরা বাইরে কাজ করুক, আয় করুক, এটা আমরা পছন্দ করিনা। বউরা কাজ করলে সংসারে নানা অসুবিধা হয়। আমরা সেটা মেনে নিতে পারিনা। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পুরুষরা মনে করে, বাড়তি টাকার দরকার নাই। তারা অনুভব করেনা যে, শুধু টাকার জন্যই মেয়েরা কাজ করেনা, তাদের মনেরও একটা চাহিদা থাকতে পারে। আর্থিক প্রয়োজনে যারা বউদের চাকরী বা কাজ করতে দেয়, তারাও সাংসারিক কাজে সামান্য হেরফের মেনে নিতে পারেনা। কাজ থেকে ফিরতে বউদের সামান্য দেরী হলে খুন করতে চায়।
মেয়েদের চাকরী, লেখা বা অন্য যেকোন কাজ করতে হলে সংসারের যাবতীয় কাজ শেষ করে সময় পেলে তারপর করবে। অর্থাৎ কোন মেয়ে যত ভাল কাজই করুক, সংসারের দায় থেকে তার মুক্তি নেই। চাকরী করলেও, না করলেও। গ্রামের মেয়েরা ফসলের রক্ষণাবেক্ষণের যে কাজ করে, সেটাও তার রান্না, বাচ্চা, পরিবারের লোকেদের দেখাশোনা…র অতিরিক্ত। ধর্মীয় কারণও আছে। মেয়েরা বাইরে কাজের জন্য বের হোক, অনেক ধার্মিক পরিবার সেটা পছন্দ করেনা। পরপুরুষের সাথে মেলামেশা, পরকীয়া, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হলে বরের অধীনতা না মানা…. এসবের ঝুঁকিওতো আছে।
উন্নত দেশগুলোতে সাংসারিক কাজগুলো তারা কিভাবে করে?
ওসব দেশে সবাই নিজের কাজ নিজে করে।সবাই সব কাজ পারে। কোন কাজকে ওরা ছোট মনে করেনা। ‘ছেলেদের কাজ’ বা ‘মেয়েদের কাজ’ বলে তারা কাজের মধ্যে বৈষম্য ও করেনা। ওখানে সব কাজ সবার। সন্তান লালন-পালন, রান্না, কাপড় কাচা, বাড়ী পরিস্কার, বাজার.. ইত্যাদি সব কাজ স্বামীস্ত্রী উভয়ের, স্ত্রীর একার নয়। ছুটির দিনে ওরা পরিবারের সবাই মিলে বাড়ী, গাড়ী পরিস্কার করে, বাগানে কাজ করে ইত্যাদি। ওদের যত টাকাই থাকুক, ওরা নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করে। ওসব দেশে প্রায় সব কাজই হয় মেশিনে। তাই কাপড় ধোয়া, ঘর পরিস্কার করা, রান্না করা- খুবই সহজ। ডেকেয়ার হোমে সন্তান রেখে মেয়েরাও কাজ করে। খুব ছোটবেলা থেকে বাচ্চাদেরকে স্বাবলম্বী করা হয়।
ওরা খাওয়া নিয়ে আমাদের মত অতটা বাছবিচার করেনা। খেলেই হল। রান্না করার সময় না পেলে হোটেলে খাবে। কারণ হোটেলে মানসম্মত ভেজালবিহীন খাবার পাওয়া যায়।
বিদেশে প্রসেসড ফুড কিনতে পাওয়া যায়। তাই কোটা-বাছার ঝামেলা কম। প্যাকেট মশলায় রান্না হয়। তাই মশলা করার ঝামেলা নেই। রান্না হয় ওভেন বা কুকারে। ফলে তাড়াতাড়ি রান্না হয়। তাই আমাদের মত রান্না করাটা ওদের কাছে কঠিণ, বিরক্তিকর, শ্রম ও সময়সাপেক্ষ মনে হয়না।
ইউরোপের দেশগুলোতে ( যেমন নেদারল্যান্ডস) প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য সরকারী হোম আছে। প্রতি পনেরো দিন পর পর হোমের লোকেরা এসে এসব শিশুদের নিয়ে যায় পনেরো দিনের জন্য। এই পনেরো দিন এদের লেখাপড়া, যত্ন – সব করে হোমের লোকেরা। পনেরো দিন পর আবার দিয়ে যায়। এটা তারা করে এসব শিশুর বাবা-মাকে রিলিফ দেবার জন্য। রোজ একটি প্রতিবন্ধী শিশুর যত্ন নিতে গেলে তার বাবা-মার অফিসের কাজের ক্ষতি হবে, তাদের ব্যক্তিগত জীবন আনন্দহীন, একঘেঁয়ে হবে – তাই। কি অসাধারণ চিন্তা! অথচ আমরা মাকে একবেলার জন্যও ছুটি দিইনা।
উন্নত দেশগুলোতে মানুষ শুধু নিজের কথা ভাবেনা, অন্যের কথাও ভাবে। যেমন-
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে বুড়ো-বুড়ীরা বাড়ীতে একা একা থেকে যাতে নিজেদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ না করেন, সেজন্য সরকারী ও স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তায় রয়েছে কমিউনিটি এনগেইজমেন্ট সেন্টার বা দিবাকালীন সেবা আশ্রম। সারাজীবন সমাজকে অনেককিছু দিয়েছেন, কৃতজ্ঞতাস্বরূপ শেষজীবনে তাঁদেরকে কিছুটা ভাল সময় উপহার দেয়ার জন্য এসব সেন্টার। কি অসাধারণ দর্শন! এসব সেন্টারের নিজস্ব পরিবহণে এঁদের আনা-নেয়া করা ও বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়। এঁদের ভাল খাওয়া, বিনোদন ও নানা কিছু শেখানোর মাধ্যমে ব্যস্ত রাখা হয়।শারীরিক ও মানসিকভাবে এঁদের সুস্থ রাখার জন্য আছে ডাক্তার ও প্রফেশনাল ট্রেইনার।এঁরা এখানে বই পড়ে, নেট ব্রাউজিং, ফেসবুক, কম্পিউটার, নেটে পেপার পড়া, ইমেইল করা – এসব শেখেন। কোন কোন এলাকায় মায়েরা তাদের ছোট ছেলে-মেয়েদের সাথে নিয়ে আসেন এঁদের সাথে গল্প করতে, এঁদের বাড়ীর কাজে সাহায্য করতে বা সংগ দিতে। আসার সময় আনেন এঁদের জন্য উপহার, রান্না করা খাবার, বই ইত্যাদি। এসব দেখে দেখে শিশুরা অন্যের প্রতি অনুভূতিশীল হয়। আমরা এসব ফালতু কাজে সময়- শ্রম-টাকা নষ্ট করিনা। বাড়ীতে নিজের মাকে ঘরের কাজে সাহায্য করার মানসিকতাই আমাদের নেই, সেখানে আত্মীয়, প্রতিবেশী বা সুবিধাবঞ্চিতদের কথা ভাবব কিভাবে?
ভারতে দেখলাম, কয়েকটি ঝুপড়ি ঘরের একটি পাড়া থেকে কয়েকটি স্মার্ট ছেলেমেয়ে বেরিয়ে আসছে। প্রত্যেকের চোখেমুখে তৃপ্তির হাসি। পিঠে বড় বড় ব্যাগ। দেখে শিক্ষিত ও ধনী পরিবারের মনে হল। আমার খুব কৌতুহল হল, এরকম ছেলেমেয়ে অমন দরিদ্র বস্তি থেকে কেন আসছে? ওখানে ওদের কি কাজ? প্রশ্ন করে জানলাম ওরা সোশাল ওয়ার্ক করছে। সমাজ তাদেরকে অনেক কিছু দিয়েছে। তাই বস্তির ছেলেমেয়েদেরকে পড়া-গান শিখিয়ে, ওদের খাবার খাইয়ে, আনন্দ দিয়ে সমাজের ঋণ শোধ করছে। ওরা কিছুদিন পর চাকরীতে ঢুকে যাবে। ওরা সবাই ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার, এমবিএ, বিবিএ করা। ওরা সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত বলে সুবিধা বঞ্চিতদের জন্য কিছু করে নিজেদের ধন্য করছে।
আমাদের দেশেও এমন ছেলেমেয়ে আছে। আমার এক পাঠক লিখেছেন, উনি ধানমন্ডি লেকের পাশে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের একটি স্কুলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু ছেলেমেয়েকে পড়াতে দেখে অভিভূত হয়েছেন।
অনেক ছেলেমেয়ে বন্যার্ত, শীতার্ত, বা প্রাকৃতিক দূর্যোগাক্রান্ত মানুষের জন্য ত্রাণ বিতরণ করে। স্বেচ্ছায় রক্তদান, আর্থিকভাবে অসচ্ছল বা অসুস্থ বন্ধুর জন্য অর্থ সংগ্রহের মত মহৎ কাজও করতে দেখি অনেককে। দেখেই মনটা খুশীতে ভরে যায়। যার যার অবস্থান বা সক্ষমতা থেকে আমাদের আরো অনেককিছু করা সম্ভব। যেমন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য গান, পড়া, আঁকা, সেলাই শেখানো, অর্থ, খাবার, পুরনো কাপড়… ইত্যাদি দেয়া।
আমার মনে হয় আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত, মাঝে মাঝে বস্তিগুলোতে যাওয়া। ওদের কাছ থেকে দেখলেই আপনার অনেককিছু করতে ইচ্ছে করবে। আমরা সবাই নানা কাজে ব্যস্ত থাকি। আমি নিজেও ব্যস্ত থাকলেও আমার দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনদের সাহায্য করার চেষ্টা করি, তিনজন ছাত্রের পড়াশুনার খরচ দেই, চিকিৎসার টাকা…। আমার চেয়ে অনেকে নিশ্চয় আরো বেশী করেন। আমি এটুকুও করতে পারতামনা চাকরী না করলে। তাই সংসারের কাজে মেয়েরা একটু সাহায্য পেলে বাইরে কাজ করতে পারবে। তখন সুযোগ পেলে তারাও আকাশ ছুঁতে পারবে।
আমাদের সবার উচিত আত্মীয়দের দেখাশোনা করা। এতে আমরা অন্যের ইচ্ছা, সুবিধা ও কষ্টের প্রতি অনুভূতিশীল হব। তবে সবার আগে নিজ নিজ পরিবারের মেয়েদের সাংসারিক কাজে সাহায্য করা দরকার, যাতে সংসারের বাইরে মেয়েরাও কিছু করতে পারে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, আমাদের বেশীরভাগ ছেলেমেয়েরা শুধু নিজের জন্য বাঁচে। এরা খুব বেশী আত্মকেন্দ্রিক। অন্যের জন্য কিছু করেনা। ফলে এরা প্রেম, নেট ব্রাউজিং, গেম, আড্ডা, নেশা, ইভটিজিং… এসব করে। পরের জন্য কিছু করতে পারলে যে অপার্থিব আনন্দ পাওয়া যায়, এটা তারা জানেইনা। নিজের বাড়ীর লোকদের চা বানিয়ে খাওয়ালেও যে অনেক আনন্দ হয়, আমরা ভাবিওনা। করার চেষ্টাও করিনা। তাই
আমাদের করণীয়ঃ
– আমাদের উচিত, ছেলে ও মেয়ে উভয়কে সংসারের সব কাজ শেখানো।
কাজ করতে দিলে ওদের ক্ষতি হবেনা। বরং ওরা স্বাবলম্বী হবে, ওদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। হলে, হোস্টেলে, মেসে, বিদেশে গেলে বা একা থাকলে কোন কিছুর জন্যই কষ্ট পেতে হবেনা।
– ছোটবেলা থেকে ছেলেমেয়েদের স্বাবলম্বী হতে শেখান। নিজে খাওয়া, নিজে গোসল, নিজের জিনিসপত্র নিজে গোছাতে শেখান। রান্না, নিজের কাপড় নিজে কাচা, ঘর গোছানো, অতিথি আপ্যায়ন… এগুলো করতে অভ্যস্ত করে তুলুন।
– মায়েরা ছেলেদের কিছুই করতে দেয়না, বিশেষ করে ধনী পরিবারের বাবামা ছেলে ও মেয়েদের কাজ করাকে শাস্তি মনে করে। অতি আদরে তারা এক একটা ডিজিটাল বিকলাঙ্গ বাচ্চা তৈরী করেন। এক একটা প্রথম শ্রেণীর অপদার্থ ও স্বার্থপর। সারাজীবন এরা সবার সেবা নেয়, কখনোই কারো জন্য কিছু করার তাগিদ বোধ করেনা।
– মাঝে মাঝে ছেলে ও মেয়েদেরকে রান্নার ভার দিন। তাতে ওরা ঘরের কাজকে বিরক্তিকর মনে করবেনা, বিয়ের পর সংসার করতে কষ্ট হবেনা। আমি কলেজে পড়ার সময় আমার বান্ধবী লোবার বাসায় খুব যেতাম। অনেকদিন দুপুরে ওদের বাসায় খেয়েছি। একদিন দুপুরে খেতে গিয়ে লোবা বলল, “আজ আমার রান্নার পালা। রান্না হলে খাব।” ওর বাবা-মা দু’জনে চাকরী করতেন। ওরা ভাইবোনেরা একেকজন একেকদিন রান্না করত, যার যার কাজ সে সে করত।
– শুধু ছেলেকে কাজ করতে বললেই ছেলেরা করবেনা। বিরক্তি বোধ করবে। তাই সাথে নিয়ে কাজ করুন। ছুটির দিনে বাবারাও কাজ করুন। শিশুরা দেখে দেখে শিখবে, বিরক্ত হবেনা।
– আমাদের ছেলেরা বাড়ীতে এক একটা নবাব। বিদেশে গেলে কিন্তু সবই করে, সবই পারে। আমার বর প্রথমবার বিদেশ যাবার পর মরহুম তাহের স্যাব আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “সেলিম রান্না পারে?” আমি বলেছিলাম, “জ্বি স্যার, ডিম ভাজতে পারে।” স্যার বলেছিলেন, “যাক। অন্ততঃ না খেয়ে মরবে না।” এখন সে আমার চেয়ে ভাল রান্না পারে। তাই সবকিছু শেখান, করতে দিন। তাতে সবারই উপকার।মানুষ চাইলে সব পারে। আমি চট্টগ্রামে চাচীর বাপের বাড়ী ছিলাম পনেরো দিন। সবসময় আমাদের কফি বানিয়ে খাওয়াতেন চাচীর ছোটভাই নাসির মামা। অত ভাল কফি আমিও বানাতে পারিনা। আমার এক ছেলে সহকর্মী বাড়ীর বেশীরভাগ কাজ নিজে করে স্ত্রী, বাচ্চা, নিজের সুবিধার জন্য। যেদিন শেষবার তাহের স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম, স্যার নিজে হাতে চা-নাস্তা সার্ভ করেছিলেন। আপনাকে শ্রদ্ধা জানাই।
– ছেলেরা, এমনকি মেয়েরাও রান্না করতে চায়না। তার কারণ হল রান্নার কাজটি আমাদের দেশে যথেষ্ট ঝামেলার, কষ্টকর, বিরক্তিকর এবং পরিশ্রমের। তাই প্রথমে অল্প সময়-ঝামেলা-পরিশ্রমে করা যায়, সেই রান্নাগুলো শেখান। অভ্যস্ত হলে ধীরে ধীরে অন্যগুলো শেখান।
– প্রথম দিকে পাশে থেকে রান্না বা কাজে সাহায্য করুন। পরে একা করতে দিন।
– ছুটির সময়গুলোতে সবাই মিলে একসাথে কাজ করুন, রান্না করুন,..।
– ছেলেমেয়েদের কাজের প্রশংসা করুন।কখনও নেগেটিভ কথা বলবেননা। আমি ভাল রান্না পারিনা কারণ আমার আম্মার রান্না খুব ভাল। তাই সবাই সেটা খেতে বেশী পছন্দ করে, আমার রান্নার বদনাম করে। আমার রান্না আম্মার মত হয়না।
– টেবিলে খাবার পরিবেশন করাটাও বাচ্চাদের শেখানো দরকার। ধোয়ামোছা, টয়লেট, কিচেন পরিস্কার করতে শেখান। টবে গাছ লাগানে, ঘর সাজানো শেখান। তাতে ওরা সৌন্দর্যপ্রিয় হবে। মন সুন্দর হবে।
– ইউরোপের কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে চার-পাঁচ বছরের শিশুদের পড়া ও খেলার পাশাপাশি নিজে নিজে খাওয়া, নিজের প্লেট-গ্লাস নিজে ধোয়া, খাবার পর টেবিল পরিস্কার করা.. এসব শেখানো হয়। জাপানে ধনী-গরীব সব পরিবারের শিশুদের স্কুলে পালা করে শ্রণীকক্ষ পরিস্কার করা বাধ্যতামূলক। আমাদের স্কুলগুলোতেও এমন নিয়ম চালু করা উচিত।
– বাচ্চারা পড়া নিয়ে সময় পায়না। তাই রোজ কিছু কিছু কাজ ছেলে ও মেয়ে উভয়কে করতে দিন।। যেমন, সালাদ কাটা, নুডুলস, বিকেলের চা-নাস্তা ইত্যাদি বানাতে দিন।
– ছুটির দিনে যার যার ঘর তাকে গোছাতে দিন। থালাবাসন ধোয়া, বাগান করা, কাপড় ইস্ত্রি করা… এসব করতে দিন।
– মায়েরও ছুটি, বিনোদন দরকার, এটা অনুভব করানো দরকার। তাই ভাবছি দিন পনেরোর জন্য একা সমুদ্রে বেড়াতে যাব। আর কোন মা সংগী হতে চাইলে জানাতে পারেন।
খুব খুব ভাল থাকবেন বন্ধুরা…..