০
৬৩৮ বার পঠিত
আমার সাতাত্তর বৎসর বয়সের জীবনে আজ পর্যন্ত আমি অনেক নির্বাচন দেখেছি। নির্বাচনের নামে অনেক প্রহসনও দেখেছি। কিন্তু গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮-তে নির্বাচনের নামে যে প্রহসন হল এতবড় প্রহসন আমি আমার দীর্ঘ জীবনে আগে কখনও দেখি নাই। আমি জানতাম ভোটে সরকারী দল আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সন্ত্রাস এবং কারচুপি হবে। কিন্তু তার পরিমাণ যে এমন হবে তা আমার কল্পনাতে ছিল না। যেটা হয়েছে সেটাকে আসলেই দলীয় এবং একই সাথে প্রায় সর্বাত্মক রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও পরিচালনায় ভোট ডাকাতি ছাড়া আর কোনও অভিধাই দেওয়া যায় না।
তবে ভোট ডাকাতি করে নির্বাচনে জয়ী হওয়া আর সেই জয়ের নৈতিক বৈধতা পাওয়া এক জিনিস নয়। ভোট ডাকাতি করে আওয়ামী লীগ এবং তার জোট ভোটে আপাত দৃষ্টিতে তো বিজয়ী হল। তবে এই বিজয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ যেটা হারালো সেটা হচ্ছে নৈতিক বৈধতা, যা আসে জনসমর্থন থেকে। আর এটাই যে কোনও রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। অর্থাৎ এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এ দেশে এই প্রথম আওয়ামী লীগ তার অস্তিত্বের নৈতিক বৈধতা হারিয়েছে। এটা এ দেশের রাজনীতিতে বিরাট এবং দূর প্রসারী পালাবদলও ঘটাবে। সেটার রূপ কী হবে কিংবা কীভাবে তা ঘটবে তা এখনও বলা না গেলেও এর অনিবার্যতা সম্পর্কে বলা যায়। অর্থাৎ এই বিজয় দিয়ে আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটালো। এখন দল হিসাবে তার বিলুপ্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই জন্যই আমি শিরোনামে বলেছি যে এই জয় জয় নয়। বরং এটা হল তার চূড়ান্ত পরাজয় এবং বিলুপ্তির সূচনা। সূচনাটা ঘটল এই নির্বাচন দিয়েই। এতকাল ধরে এতসব বিপর্যয় এবং অবক্ষয়ের পরেও এ দেশে নির্বাচনী গণতন্ত্রের এবং রাজনৈতিক শিষ্টাচারের যেটুকু অবশেষ ছিল আওয়ামী লীগ সেসবেরও বিলুপ্তি ঘটালো এই নির্বাচনের তামাশা দিয়ে ।
এটা হল একদিক। অপর দিকে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ভোট ডাকাতি প্রতিহত করবার যুদ্ধে পরাজিত হয়েও পরাজিত হয় নাই। বরং তার জয় হয়েছে এই অর্থে যে তা ভোট যুদ্ধে নেমে ইতিহাসে এই প্রথম আওয়ামী লীগের প্রকৃত রূপ সমগ্র দেশবাসী এবং বহির্বিশ্বের নিকট দেখাতে সক্ষম হয়েছে। এ দেশে নানান কারণে সুদীর্ঘ কাল আওয়ামী লীগের প্রতি জনসাধারণের একটি বৃহৎ অংশের মধ্যে একটা মোহ এবং প্রত্যাশা কাজ করেছিল। সেটাকে এই প্রথম আওয়ামী লীগ স্বহস্তে নিধন করল। আসলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টই সে কাজ করতে লীগকে বাধ্য করল। এখন থেকে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন থাকবে একমাত্র লীগ শাসনের সুবিধাভোগী কিছু সংখ্যক দলীয় নেতা-কর্মী এবং মুষ্টিমেয় সংখ্যক সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে। আর সেই সঙ্গে হয়ত সামান্য কিছুসংখ্যক অন্ধ দলদাস থাকবে লীগের পক্ষে। তবে যে বা যারাই আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকুক নৈতিকতার প্রশ্নে কেউ আর লীগের পক্ষে দৃঢ় থাকতে পারবে না। নিজের নৈতিক অবস্থানটা লীগ নিজেই ধ্বংস করেছে।
আওয়ামী লীগ এ দেশের রাজনীতির অগ্রযাত্রার পথে বাধার পাহাড়সম ছিল। লীগের এই নৈতিক পরাজয় সেই বাধার পাহাড়কে সরিয়ে দিল। এটা এ দেশের রাজনীতির আগামী যাত্রার জন্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একটি গৌরবোজ্জ্বল অবদান হয়ে থাকবে। হ্যাঁ, আমি বলব এটা ঐক্যফ্রন্টের একটা বিরাট জয়।
এটা সহজবোধ্য যে এই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিজেদের দুর্বলতার কারণগুলিকে চিহ্নিত করবার চেষ্টা করবে। এটা প্রকৃতপক্ষে আত্মানুসন্ধানের কাজ। এটা বুঝতে হবে যে আওয়ামী লীগ যা-ই করুক সেটা করতে পেরেছে তার প্রতিপক্ষ বা বিরোধী শিবিরের প্রধান শক্তি বিএনপি-এর যে দলীয় এবং বিশেষত রাজনৈতিক দুর্বলতা ছিল সেটার সুযোগ নিয়ে।
এই নির্বাচনের ফল ঐক্যফ্রন্ট এবং বিএনপি মেনে নেয় নাই। তারা লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেছে। আন্দোলন তারা করবে। সেটা করবে জনমতের প্রতিফলন ঘটাবার এবং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করবারও প্রয়োজনে। কিন্তু আগামী আন্দোলনের সাফল্যের জন্য একদিকে যেমন তাদের নিজেদের ভুল ও সীমাবদ্ধতাগুলিকে চিহ্নিত করতে হবে, যেগুলি তাদের এতকালের আন্দোলনের এবং সেই সঙ্গে নির্বাচনে ব্যর্থতার কারণ হয়েছে, অপর দিকে তেমন একই সঙ্গে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের সবলতা ও দুর্বলতার জায়গাগুলিকেও সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারতে হবে। আর তাহলেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সঠিক কর্মসূচী ও কর্মকৌশল নির্ধারণের মাধ্যমে আগামী গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে একটি সঠিক পথ দিতে পারবে। এ কাজগুলি করতে না পারলে ঐক্যফ্রন্ট গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হবে। তবে ইতিহাস কারও জন্য বসে থাকে না। ঐক্যফ্রন্ট ইতিহাসের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে আর কেউ এসে যে সেই কাজ করবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে এখন পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্টের কাছে আমার প্রত্যাশা আছে।
জানুয়ারী, ২০১৯
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন