প্রাক কথন
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলা নির্বাচনব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়েছে গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে। পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়া এই নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আর পুনর্জীবন ঘটানো সম্ভব নয়। সেটা আর কোনোক্রমেই সচল হবে না। ভেঙ্গে পড়া নির্বাচনব্যবস্থার মতই, এদেশের প্রশাসন, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, কৃষি খাতসহ জীববৈচিত্র এবং পরিবহন ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়ছে। এর মধ্যে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ এর আঘাত দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অনিয়ম দুর্নীতি ও দুরাবস্থার চিত্র আরো সামনে নিয়ে এসেছে এবং অর্থনীতির ভঙ্গুর দশাকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছে। এর আঘাতে দেশে অর্থনীতির ভঙ্গুর দশার সঙ্গে শুরু হয়েছে মন্দা, চলছে ছাঁটাই। এ সবের প্রতিক্রিয়া আরো বহুদিন থাকবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এর আগে থেকেই দেশে সাংবিধানিক অনুমোদনে অর্থ পাচার, বিচারবর্হিভূত হত্যাকা-, বড় বড় মেগা প্রজেক্টের নামে চলছে হরিলুট। এই রাষ্ট্র ও সরকার টিকে আছে গায়ের জোরে, সকলের মুখ বন্ধ করে, প্রতিপক্ষকে হিংস্রভাবে দমন নির্যাতন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে। এজন্য গুম খুন হত্যা নির্যাতনের মাধ্যমে সমাজে একটি ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। দেশে চলছে ফ্যাসীবাদী দু:শাসন।
সময়টি দাঁড়িয়ে আছে বড় একটা পরিবর্তনের মুখে, বলা চলে এটা একটা বিশেষ যুগ সন্ধিক্ষণ। এমন সংকটকাল ইতিহাসে কম সময়েই আবির্ভূত হয়। এটা হল সেই সময়, যখন জোর করে টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসা বর্র্তমানের আওয়ামী লীগ সরকার নিয়মতান্ত্রিক পথে ক্ষমতা হস্তান্তরের সকল পথ নিজেরাই সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে রেখেছে। সরকারের গণভিত্তি ও জনপ্রিয়তা শুন্যের কোটা ছাড়িয়ে মাইনাসে। গণঅভ্যূত্থান ছাড়া ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার আর কোনো পথই খোলা রাখেনি শেখ হাসিনার সরকার।
শুধু সরকার নয়, ক্ষয়রোগ ধরা পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন এখন একটি আঘাতের অপেক্ষা করছে। সময়ের দাবি পূরণ করতে পারে, এমন সুনির্দ্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি, তাকে বহন করার মত রাজনৈতিক শক্তি, যে শক্তিতে জেগে উঠতে পারে বিপুল জনগোষ্ঠী। সেই রাজনৈতিক কর্মসূচি ও সেই রাজনৈতিক শক্তি দাবি করছে ইতিহাস। একমাত্র সেই শক্তির আঘাতেই ভেঙ্গে পড়তে পারে শত শত বছর ধরে গড়ে ওঠা শোষণ ও লুণ্ঠনমূলক অপশক্তির শক্ত ভিত।
বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি হঠাৎ করেই সৃষ্টি হয়নি, এটা হল পুনর্জীবিত হওয়া উপনিবেশিক শাসনপদ্ধতি ও সীমাহীন পুঁজিবাদী শোষণ, তার সঙ্গে যুক্ত লুণ্ঠন ও দুর্বৃত্তায়নের ফলশ্রুতি। যার ওপর ভর করে জারি আছে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ লুণ্ঠন, ভারতীয় আধিপত্য ও ধর্মীয় ফ্যাসীবাদ। বাংলাদেশে যার যাত্রা শুরু হয়েছে বাহাত্তর সাল থেকেই, পাকিস্তানি শাসনের ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশের ফেলে যাওয়া পচাগলা উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের পুনর্জীবনের মাধ্যমে।
একাত্তরের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে ও স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের জাতিগত শোষণ লুণ্ঠন ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির আকুতি ছিল, তার বিরুদ্ধে লড়াই ছিল, তীব্র ক্ষোভ ছিল, ঘৃণা ছিল। কিন্তু একটি শোষণহীন আধুনিক রাষ্ট্র গড়ার আকাক্সক্ষা ছিল ক্ষীণ ধারায়। পাকিস্তানি লিগ্যাসি প্রত্যাখ্যান করার প্রচ- আবেগ তৈরি হলেও, ব্রিটিশ উপনিবেশিক লিগ্যাসি ছুড়ে ফেলার কোনো আকাক্সক্ষা ছিল না। যার কারণে ইকবাল হলের নামকরণ জহুরুল হক হল, জিন্না হলের নামকরণ সূর্যসেন হল কিন্তু ‘কার্জন হল’ বহালই থেকে গেল। শুধু তাই নয়, এটা নিয়ে প্রশ্নটি পর্যন্ত করল না কেউ। ব্রিটিশের উপনিবেশিক ও পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ জাতিগত নিপীড়ণের ধমভিত্তিক রাষ্ট্রের লিগ্যাসিকে প্রত্যখ্যান করে নিজেদের মত একটি শোষণহীন আধুনিক রাষ্ট্র গড়ার বাসনা ছিল দুর্বল। সেই দুর্বলতার সুযোগে এত যুদ্ধ এত রক্তপাতের পরেও এখানে পরাজিত ও পুরানো লিগ্যাসি ফিরে এসেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উপনিবেশিক লিগ্যাসির ভাবাদর্শ। আর এদের গর্ভে জন্ম নেওয়া দুর্বৃত্তদের শাসন ও শোষণ।
আমরা জানি, মানুষের মধ্যে যত বেশি ক্ষোভ থাকে, শাসকদের পায়ের নীচ থেকে তত বেশি মাটি সরে যায়। উচ্ছেদ হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। একারণে তারা ততবেশি প্রতিপক্ষ দমনে আগ্রাসী ও ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠে। ফ্যাসিস্টদের সামনে তখন দুটি পথ খোলা থাকে। হয় হত্যা খুন দমনপীড়ন করে টিকে থাকা, নতুবা জনরোষে উচ্ছেদ হওয়া। প্রতিপক্ষকে উচ্ছেদ করেও পার পায় না, বাঁচার জন্য আশ্রয় নেয় কখনো মুক্তিযুদ্ধের কাছে, কখনো ধর্মের কাছে।
যা সাধারণ মানুষ শাসকদের এই গণধোকা বুঝে ফেলেছে। তারা এটাও বুঝেছে যে, আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ হল দেশকে বাপদাদার তালুক সম্পত্তি বাণানোর প্রজেক্ট।
জনভিত্তি মাইনাসের কোটায় থাকা বর্তমান সরকারকে রক্ষা করতে জানপ্রাণ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে পদস্থ সামরিক বেসামরিক আমলারা, বিচারপতি ও বিচারকরা, পুলিশ কর্মকর্তা, গণমাধ্যমের কর্মকর্তারা আর তার বশংবদ বুদ্ধিজীবীরা। এরা কাজটি করছে রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্য সম্পূর্ণ ঘুচিয়ে ফেলে। আওয়ামী বশংবদ বুদ্ধিজীবী এবং অনুগত কবি সাংবাদিক ও সাহিত্যিকদের ধারাটি বাংলাদেশে খুবই শক্তিশালী ও প্রভাবশালী। এরা হাসিনার সরকারকে রক্ষার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা ও মুক্তিযুদ্ধের দোহাই দেয় আর জঙ্গিবাদ জুজু’র ভয় দেখায়। সরকার রক্ষার নানা ধরণের চমকপ্রদ কৌশল বের করতে এরা সিদ্ধহস্ত। সরকার রক্ষার এই ইজারাদাররা গণক্ষোভ থেকে ফ্যাসীবাদ সুরক্ষায় কাজ করছেন খুব দক্ষতার সঙ্গে। আওয়ামী লীগ যত অপরাধই করুক, তার বিরুদ্ধে যাওয়ার মত নৈতিক শক্তি-সাহস ও মেধার জোর নেই সরকারের উচ্ছিষ্ট খাওয়া এই লেখক বুদ্ধিজীবীদের। আওয়ামী বলয়ের বাইরে যাওয়ার মত বুদ্ধি ও সাহসের জোর ছাড়া এই পোষমানারা আওয়ামী দুর্বৃত্তায়নের মূল খুটি। এ ব্যাপারে পুরোপুরি নির্ভার হয়ে সরকার একবার পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে ধর্মীয় শক্তিকে, আরেকবার পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে মেকি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের। সরকার জানে যে, তারা যতই ধর্মীয় শক্তির পৃষ্ঠপোষক হোক কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির, এদের কোনো অংশই শাসকদের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে না। শাসকদের খুদকুড়া খাওয়া মেকি ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের কিংবা হেফাজত ইসলাম সহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস ও নৈতিক জোর নেই। এদের স্বরূপ উম্মোচনের কাজটি বকেয়া পরে আছে। পকেটে থাকা এই দুই শক্তিকে সরকার নিজেই মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেশে একটা কৃত্রিম দ্বন্দ্বের পরিবেশ তৈরি করে। কখনো নাস্তিক আস্তিক দ্বন্দ্বে, কখনো স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষের দ্বন্দ্বে। এতে শোষণ লুণ্ঠন হত্যা খুন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াই বিভ্রান্ত হওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়। এ কাজে সরকার কখনো কখনো সফলও হয়। আর সরকার একই সঙ্গে ধর্মীয় শক্তি এবং তথা কথিত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সমর্থন আদায়ে সক্ষম হতে পারে। যে ফাঁকি ও প্রতারণার কারণে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে ধর্মীয় ফ্যাসীবাদের সহাবস্থান ঘটাতে সক্ষম হয়েছে, সেই প্রতারণা ও ফাঁকি উম্মোচন করা জরুরি শুধু নয়, এটা সময়েরও দাবি বটে। এই কাজ সরকারের অনুগত কথিত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির পক্ষে যেমন সম্ভব নয়, তেমনি মুক্তিযুদ্ধকালে তত্ত্বগত জটিলতায় নিমজ্জিত থাকা ও বিভ্রান্তিকর ভূমিকায় থাকা এবং এখনো সেই তাত্ত্বিক অবস্থানে থাকা আত্মসমালোচনাহীন বামপন্থী কমিউনিস্টদের পক্ষেও আওয়ামী লীগের এই প্রতারণার স্বরূপ উম্মোচন সম্ভব নয়। বিষয়টি পরে আলোচনা করা যাবে।
যা হোক আমরা জানি, আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তি ভারত, এশীয় পরাশক্তি চীন, বিশ্ব পরাশক্তি ও সা¤্রাজ্যবাদের মোড়ল মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ এবং তার সঙ্গে শক্তিধর রাশিয়ার সমর্থন সরকারকে টিকিয়ে রাখছে। আর সরকারের জনবিচ্ছিন্নতার সুযোগ নিয়ে তারা আদায় করে নিচ্ছে অন্যায় স্বার্থ। সরকারের যোগসাজসে, যার যেখানে যতটুকু শক্তি সুযোগ আছে, তার সবটুকু ব্যবহার করে ব্যাপক লুটতরাজে তারাও অংশ নিচ্ছে সমানতালে। গণবিরোধী অবস্থানের কারণে সরকার এসব শক্তিশালী দেশের সঙ্গে যে কোনো বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক দরকষাকষির যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। যার ফলে ভারতের সঙ্গে আচরণ হয় দাসোচিত আর সীমান্তে মরে মানুষ আর বাণিজ্যিক বৈষম্য বাড়তেই থাকে। তিস্তার পানি বন্টনসহ অসংখ্য সমস্যার কোনোটাই সমাধান করতে পারে না সরকার। একই কারণে এককোটির অধিক প্রবাসীরা মর্যাদার জীবন যাপন করতে পারেন না। শক্তিধরের সঙ্গে করতে হয় অমর্যাদাকর গোপন চুক্তি, যা জনগণের সামনে প্রকাশ করতে পারে না সরকার।
অন্যদিকে, প্রায় ২০ কোটি লোকের বাজার, দক্ষিণ এশিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব, দেশের তেলগ্যাসহ প্রাকৃতিক সম্পদ, ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে বাঁধ-এসব কারণে বাংলাদেশ এখন শক্তিধর দেশগুলোর মৃগয়াক্ষেত্র। আত্মমর্যাদাহীন তাবেদারি পররাষ্ট্রনীতির কারণে চীন-ভারতের আগ্রাসী দ্বন্দ্বের ঘুটি এখন বাংলাদেশ। ভারতের ওপর নির্ভর করে এই অঞ্চলে আরো প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগাতে মরিয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। অন্যায় স্বার্থ উদ্ধারে, সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী শক্তিধর দেশগুলোর দ্বন্দ্বে, বাংলাদেশ হতে চলেছে বলির পাঠা। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলু খগড়ারা প্রাণ দেয়। বাংলাদেশের মানুষ এই পরিস্থিতির শিকার হতে চায় না। জনসম্মুখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সরকারের সকল চুক্তি ও সমঝোতা প্রকাশ, অসম্মানজনক চুক্তি ও সমঝোতা বাতিলের দাবিতে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে চায়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের মানুষ আত্মমর্যাদাশীল পররাষ্ট্রনীতি চায়, তারা পরাশক্তির দাবার ঘুটি হতে চায় না। তারা দাসোচিত সম্পর্কের জায়গা থেকে বের হতে চায়। বাংলাদেশের মানুষ আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে এই ফ্যাসীবাদী শোষণ নিগড় থেকে বের হতে চায়।
বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থাকে বুর্জোয়ারাই প্রত্যাখ্যান করে:
এটা ঠিক যে, এই উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যতটুকু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব, নানা সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতাসহ সেটা সংঘটিত হয়েছিল একানব্বইয়ের নির্বাচনে। কারণ ওই নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল গণঅভ্যূত্থানের পটভূমে। এছাড়া অতীতের কোনো নির্বাচনই অন্তত: একানব্বইয়ের মতোও সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি। এরপর এদেশে কোনো দিনই স্বাভাবিক নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক পথে ক্ষমতা হস্তান্তরের ইতিহাস নেই। ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে ১৯৯২-৯৬ সালে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এতে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং যতটুকু বাকি ছিল সেটা আওয়ামী লীগ নিজেই হরণ করে নেয়।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রশাসন যন্ত্রের মাধ্যমে পেশী শক্তির প্রয়োগ করা হয়েছিল। তখন কুমিল্লার মুরাদনগরে সম্ভব্য বিজয়ী প্রার্থী ছিলেন জাসদের ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রশিদ। ওই আসনের ব্যালট বাক্স নিরাপত্তার নামে হেলিকপ্টারে করে বঙ্গভবনে এনে গণনা করে আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোস্তাক আহমেদকে বিজয়ী দেখানো হয়। একইভাবে আওয়ামী লীগ নেতা তাহের উদ্দিন ঠাকুরকেও জিতিয়ে আনা হয় ব্রাহ্মনবাড়িয়ার একটি আসন থেকে। বরিশালের একটি আসন থেকে জাসদের মেজর জলিল জিতেছিল, তাকেও পরাজয় দেখানো হয়। একইভাবে আরেকটি আসন থেকে জেতা রাশেদ খান মেননকেও পরাজয় দেখানো হয়। বিরোধীতা বড় জোড় ২০/২৫টি আসন পেত, সেটাই আওয়ামী লীগ মেনে নিতে পারে নাই। একই বছরে ক্ষমতাসীনদের নেতৃত্বে অস্ত্রের জোরে ডাকসু নির্বাচনেও ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে ভোট বানচাল করা হয়েছিল। সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনকালে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়াও হ্যাঁ/না ভোটও নেওয়া হয়েছিল। সেখানেও গণনা অনুযায়ী নয়, শাসকশ্রেণির আকাক্সক্ষা অনুযায়ী ফলাফল দেখানো হয়। স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে তৃতীয়, চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছিল টাউট-বাটপারদের গায়ের জোরে জিতিয়ে আনার পদক্ষেপ। ১৯৯৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মিরপুরে একটি আসনে এবং ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ মাগুরার একটি আসনের উপনির্বাচনে বিএনপি সরকার আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে জোর করে হারিয়ে দিয়েছিল বলে অভিযোগ করে আওয়ামী লীগ। এ কারণে ১৯৯৪ সালের ২৭ জুন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত মিলে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানায় এবং সেই সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এজন্য ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত হরতাল হয় ১৭১ দিন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাত্র ২১ শতাংশ ভোট পড়েছিল, প্রায় ভোটারবিহীন এবং বিরোধীদল বিহীন এক তরফা নির্বাচন করে বিএনপি পায় ২৭৮টি আসন, তাতেও শেষ রক্ষা হয় না। খালেদা জিয়া পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই সংসদেও মেয়াদ ছিল ১১দিন। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় চারমাস পরে বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২২ জুন এক সংবাদ সম্মেলন করে খালেদা জিয়া সেই নির্বাচন সম্পর্কে ‘পুকুর চুরি’র অভিযোগ তোলেন। এরপর ২০০১ সালের ২ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়, তখন ‘স্থূল কারচুপির’ অভিযোগ তুলে শেখ হাসিনা সেই নির্বাচন প্রত্যাখান করার ঘোষণা দেন।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না, এমন অভিযোগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। ভোটারবিহীন এক তরফা নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই, শরীক দলগুলোকে কয়েকটি আসন খয়রাত করে, একতরফা ভাবে প্রায় সকল আসনে জয় পায় আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে মধ্যরাতের কারসাজির নির্বাচনে টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার সরকার। অর্থাৎ এদেশে সকল নির্বাচনের ব্যাপারেই ঘোরতর আপত্তি তুলে বুর্জোয়াদের বিরোধী অংশই সেটা প্রত্যাখ্যান করে। বর্তমান স্বৈরতান্ত্রিক সংবিধান ও অগণতান্ত্রিক আইনকানুনের বদৌলতেই এরকম জোর-জবরদস্তিমূলক নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকার পাকা ব্যবস্থা করতে পারছে শাসক শ্রেণির দলগুলো।
মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী ভাষ্য বনাম গণভাষ্য:
মুক্তিযুদ্ধে মানুষের আবেগ অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে আর আগের মত শোষণ লুটতরাজ হত্যা ও নির্যাতনমূলক শাসন জারি রাখা এই সরকারের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। মানুষ ‘মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ান’ প্রত্যাখ্যান করেছে। এর বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের গণভাষ্য নির্মানের প্রয়োজনীয়তা মানুষ ক্রমশ উপলব্ধি করা শুরু করেছে।
কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেবল ৯ মাসের সামরিক তৎপরতা নয়। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাযুদ্ধ হল রক্তপাতময় রাজনীতি। প্রথমদিকে যে রাজনীতি গড়ে উঠেছিল ষাটের দশকে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের তৎপরতায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে গড়ে ওঠা বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে। তার আগে ১৯৫৭ সালের কাগমারি সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর ‘স্লালামালেকুম’- সেই স্বাধীকার আন্দোলনে পথ ধরে যার যাত্রা শুরু হয়। ’৬৬ তে কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজন, বিভক্ত পাার্টর উভয়াংশের জাতীয় সংগ্রাম ও শ্রেণিসংগ্রামের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটানোর ব্যর্থতা, পরবর্তিতে সামরিক স্বৈরাচার আইউব খান সম্পর্কে একাংশের নমনীয়তা এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিহীনতায় বামপন্থীদের সেই স্বাধীকার আন্দোলনের উজ্জ্বলতা ফিকে হতে থাকে। অপরদিকে বামপন্থীদের স্বাধীকারের আন্দোলন গ্রাস করে নিতে থাকে ’৬৬ র ছয় দফার আন্দোলন।
অপরদিকে, বাষট্টিতে গড়ে ওঠা ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াসপন্থীদের তৎপরতায় স্বাধীনতার রাজনীতি নতুন করে প্রাণ পায়। ছাত্রলীগের এই অংশটিই শেখ মুজিবুর রহমানের কাল্ট গড়ে তোলে এবং তার মাধ্যমেই আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে প্রতিস্থাপন করে। এরাই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার ভিত্তিতে, পুরো ছাত্র সমাজের মাধ্যমে ছয় দফাকে জনগণের কাছে নিয়ে যায়। ছয় দফা নিয়ে প্রথম হরতাল সফল করে ছাত্রলীগের এই অংশই। এমনকি নিউক্লিয়াসের নেতৃত্বই আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে ছয় দফাকে অনুমোদন দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে সফল হয়।
আওয়ামী লীগের সুবিধার দিক হল, শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাবেই হোক, ছয় দফার মত একটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক কর্মসূচি হাজির করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ষাটের দশকের উত্তাল সময়কে বামপন্থী ছাত্র যুবকেরা নির্মান করতে সক্ষম হলেও, জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি বিভক্ত কমিউনিস্টদের কোনো দল বা ধারা জনগণের সামনে হাজির করতে সক্ষম হননি। এই বাস্তবতায় শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থাপিত ছয় দফা উত্তাল ষাটের দশকে প্রবল মুক্তি আকাক্সক্ষী জনগোষ্ঠীর সামনে একটি রাজনৈতিক দিশা হিসাবে উপস্থাপিত হয়। স্বভাবতই: সকল ধারার আন্দোলনের সকল অর্জন গিয়ে জমা পড়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ঝুলিতে। যার ধারাবাহিকতায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান পরবর্তিতে সত্তরের নির্বাচনের ভূমিধ্বস বিজয় শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশালাকার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। আন্দোলন যারাই করুক, যুদ্ধে যারাই অংশ নিক, বাস্তবতা হল শেখ মুজিবের নামে ও নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীন হয়। মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের তেমন অংশ গ্রহণ না থাকলেও, নেতৃত্বটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শেখ মুজিবের।
অপরদিকে, আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিল রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে ভারতের এবং রাশিয়ার সার্বিক সহযোগিতা। বামপন্থীরা জানপ্রাণ দিয়ে স্বাধীকার ও স্বাধীনতার রাজনৈতিক জমিন প্রস্তুত করলেও, মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতিতে প্রধানত: উপরোক্ত ঘটনাই শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বের আসনে পৌঁছে দেয়।
অপরদিকে, পূর্ববাংলায় ক্রিয়াশীল সহযোগী কমিউনিস্ট পার্টিকে এড়িয়ে সেই সময়ে ইন্দিরা মুজিব বলয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পাশে দাঁড়ায় তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন। রুশপন্থী বলে কমিউনিস্টদের পরিচিত অংশটি সেখানে অনুঘটকের কাজ করে মাত্র। অপরদিকে, রাশিয়ার সঙ্গে বিরোধের জের ধরে গণচীন বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এর প্রভাব পড়ে চীনপন্থী নামে পরিচিত কমিউনিস্টদের আরেকাংশের ওপর।
আওয়ামী লীগের ধারার মুক্তিযুদ্ধে ‘সহযোগিতার’ মাসুল ভারত কড়াগ-ায় আদায় করছে প্রায় অর্ধশতক ধরে। মুক্তিযুদ্ধে ও স্বাধীনতাযুদ্ধে ‘সহযোগিতা’র মূল্য আদায় করতে ভারত দিয়েছে সীমান্ত হত্যা, বঞ্চিত করেছে পানির ন্যয্য হিস্যা থেকে আর চাপিয়ে দিয়েছে অন্যায় চুক্তি ও বাণিজ্যিক বৈষম্য। আর সেই সঙ্গে বজায় রেখেছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য।
মুক্তিযুদ্ধে বিভক্ত কমিউনিস্টদের অধিকাংশ গ্রুপের ছিল বিভ্রান্তিমূলক তত্ত্বগত অবস্থান। যা তাদের কর্মীদের অসীম সাহস ও অপ্রতিরোধ্য আকাক্সক্ষাকে দমিয়ে রাখে। এত বিভক্তি ও এত বিভ্রান্তি সত্ত্বেও এসব হতোদ্যম বামপন্থার সম্মিলিত সামরিক তৎপরতা ছিল অপরিমেয়। নরসিংদীর শিবপুরে কাজী জাফর, মান্নান ভূঁইয়া, রুমি, জুনোদের যুদ্ধ; বরিশালের পেয়ারা বাগানে সিরাজ সিকদারের প্রতিরোধ যুদ্ধ, সিরাজগঞ্জে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির ইসলামাইল গ্রুপের নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির স্থানীয় নেতা কমরেড আহমদ হোসেনের নেতৃত্বে প্রথম মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঘটনা, টাঙ্গাইল, নোয়াখালী, যশোর, নড়াইল, খুলনা সাতক্ষীরায় প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়েছে। এসব এলাকায় কোথাও কোথাও পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, কোথাও কোথাও পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি ও কোথাও কোথাও পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে প্রতিরোধযুদ্ধ হয়েছে। এমন অসংখ্য ঘটনা এখনো চাপা পড়ে আছে, তেমন আলোচনায় আসেনি। কুমিল্লার বেতিয়ারায় ন্যাপ সিপিবি ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিরোধ হয়েছে। রাজশাহী অঞ্চলে যুদ্ধ করেছে মাইতি গ্রুপ। এছাড়া কমিউনিস্ট পার্টির হাতিয়ার গ্রুপও যুদ্ধ করেছে। ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ফেরার আগে অন্তত ছয়মাস দেশে প্রতিরোধ যুদ্ধ জারি রেখেছিল বামপন্থী কমিউনিস্টরাই। ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্রুপ, ন্যাপ, কমিউনিস্টদের বিভিন্ন গ্রুপ দলীয় পরিচয় অগ্রাহ্য করে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। এছাড়া ভারত ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের কমিউনিস্ট বিরোধী অবস্থানের কারণে বামপন্থীদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মূলশ্রোতে ভূমিকা রাখা দূরহ হয়ে উঠে। এসব নিয়ে এখনো বিস্তৃত গবেষণার দাবি রাখে। মুক্তিযুদ্ধের এসব ভাষ্য এখনো নির্মিত হয়নি।
অপরদিকে, জাসদের স্বপক্ষ ত্যাগ, মেনন দীলিপ বড়–য়া ও ন্যাপের সরকারে যোগদান, বিএনপি জামাত মোকাবেলার নামে আওয়ামী লীগের প্রতি কমিউনিস্টদের একটি পরিচিত অংশের নমনীয়তা ও দুর্বলতা, সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর লড়াই গড়ে তুলতে অনিহা, সর্বপরি কমিউনিস্টদের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থানের কারণেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র প্রভাব তৈরি হয়েছে, তারা এখন যা বলছে, তাই সত্য হয়ে যাচ্ছে। হেফাজতের মত চরম সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পৃষ্ঠপোষক হয়েও আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধের পোশাকে রাজাকারের দাগ লাগে না।
ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতা ও নিম্নপর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের ধরপাকড়: টিকে থাকার নানা প্রয়াস
শোষণ লুটতরাজ নির্যাতনে শুধু মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে আর সুবিধা করতে পারছে না সরকার। এখন ঝুঁকে পড়ছে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর প্রতি। কব্জায় এনেছে হেফাজতে ইসলামকে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তি এগিয়ে এসেছে সরকারকে রক্ষা করার জন্য। দলে দলে জামায়াতের লোকজন ও উগ্র ইসলামপন্থীরা আশ্রয় নিয়েছে আওয়ামী লীগের ছায়াতলে। মুক্ত চিন্তার মানুষকে হত্যা ও হত্যা চেষ্টার সুযোগ দিয়ে, পাঠ্যপুস্তক থেকে হিন্দু ও প্রগতিশীলদের লেখা বাদ দিয়ে, দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের মর্যাদা দিয়ে ধর্মীয় ফ্যাসিস্টদের কাছে গ্রহণীয় হওয়ার চেষ্টা করে চলেছে সরকার।
এদিকে, বাঁচার শেষ দাওয়ায় হিসেবে রুই কাতলাকে আড়াল করে, কখনো ক্যাসিনোকা-ে জড়িতদের এবং কখনো নিম্নপর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের, কখনো দলের নিম্ন পর্যায়ের চোর ছ্যাচ্চরদের ধরপাকড় শুরু করে সরকার। এতে একদিকে জনরোষকে প্রশমিত করতে চায়, অপরদিকে রুই কাতলা দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের আড়াল করতে চায়।
ভাল খারাপের সমীকরণ:
সরকারের অপকর্ম ঢাকার জন্য একটা সমীকরণ আছে। এটা সরকারকে রক্ষার একটা কৌশল। যে কৌশলটি আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী, আওয়ামী অনুগত তথা কথিত বামপন্থী এবং মিডিয়া হরহামেশায় প্রয়োগ করে। সরকারের নানা অংশের গণবিরোধী ও গণধিকৃত কর্মকান্ডকে বিচ্ছিন্ন করে দেখানো হয়। এটা সরকারের গণবিরোধী চরিত্রকে ঢেকে রাখার আরেক প্রয়াশ। যেমন ছাত্রলীগের কোনো কর্মীর গণবিরোধী অপতৎরতা যদি সংবাদ মাধ্যমে চলে আছেন, সেখানেও এই সমীকরণ প্রয়োগ করা হয়। সমীকরণটি হল, ১. ছাত্রলীগ হত্যা ধর্ষণ লুটপাটে মেতে উঠলে বলা হয়, ছাত্রলীগের কিছু সংখ্যক কর্মী খারাপ, অপকর্ম তারাই করছে কিন্তু ছাত্রলীগ ভাল। ২. যখন ছাত্রলীগের নেতৃত্বের অপকর্ম সামনে চলে আসে, তখন বলা হয় আওয়ামী লীগ ভাল, ছাত্রলীগ খারাপ। ৩. আবার আওয়ামী লীগের কোনো নেতার অপকর্মের খবর ভাইরাল হয় তখন বলা হয়, ওই লোকটিই খারাপ, কিন্তু আওয়ামী লীগ ভাল। ৪. যখন পুরো আওয়ামী লীগই গণবিরোধী অবস্থান নেয় তখন বলা হয়, আওয়ামী লীগ খারাপ তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাল। ৫. যখন শেখ হাসিনাকেও আর রক্ষা করা যায় না, তখন বলা হয় শেখ হাসিনা খারাপ, তবে শেখ মুজিবুর রহমান ভাল। এই সমীকরণ হল আওয়ামী দু:শাসনের অন্যতম রক্ষাকবজ। অথচ এরা সবাই যে এক ও অভিন্ন ধারার, সেটা প্রমাণ করার এখনি সময়।
সংকটের উৎসের সন্ধান:
সংক্ষেপে বর্ণিত বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক সংকট সাধারণভাবে বিশ্ব পুঁজিবাদের সংকট। তবে পুঁজিবাদী শোষণের পাশাপাশি বাংলাদেশের মত ব্যাপকহারে অর্থ পাচার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, গুম খুন, চুরিচামারি, ঘুষ দুর্নীতি, লুটপাট, অযোগ্যদের দায়িত্বপূর্ণ স্থানে বসানো, অনিয়ম, লুুটতরাজ, অপচয়, কালাকানুন ও আমলাতন্ত্র উন্নত পুঁজিবাদী দেশে দৃশ্যমান নয়। এসব গণবিরোধী দেশবিরোধী কার্যকলাপ চলে আইনগত কাঠামোর মধ্যেই। যা ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনকাঠামোরই অনুসঙ্গ। উপনিবেশিক শাসকরা এই আইন ও রাষ্ট্র কাঠামো তৈরি করেছিল ব্যাপকহারে শোষণ ও লুটপাট এবং এদেশ থেকে সম্পদ পাচার করার জন্য। সেই কাজের উপযোগী আইনকাঠামো ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা তৈরি করেছিল। সেটাই দুই দুই বার স্বাধীনতা, এত উত্থানপতন, গণঅভ্যূত্থানে পরও এই ভূখ-ে বহাল রয়েছে। তাই আমাদের শাসকদের চরিত্র দেশদ্রোহীর মত হয়।
যে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও আইনকাঠামোর মধ্যে পুঁজির সুষম বিকাশ হয় না, এমন পরিস্থিতির মধ্যে পুঁজির বিকাশ হয় বেদনাদায়ক (Painfull) পথে। তাই উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্রে যেমন স্বাভাবিক পথে সুষমভাবে পুঁজির বিকাশ সম্ভব হয় না, তেমনি গড়ে ওঠে না ন্যূনতম গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ বিশ্ব পুঁজিবাদের সাধারণ সংকট এবং একই সঙ্গে দেশিয় পুঁজিবাদ বিকশিত না হওয়ার সংকট- বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটকে আরো ঘণীভূত করেছে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র হল সীমাবদ্ধতাসহ অনুন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। আরো সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র হল উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ অনুন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট হল সাধারণভাবে বিশ্ব পুঁজিবাদের সংকট, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সংকট। আমাদের জন্য উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের শাসনতান্ত্রিক সংকটের সমাধানই, বিশ্ব পুঁজিবাদের সংকট মোকাবেলার বাস্তবোচিত পথ।
গণতন্ত্র বিনির্মাণে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের ফাঁকি
বাংলাদেশে বাহাত্তরের সংবিধানের মাধ্যমে উপনিবেশিক রাষ্ট্রের পুনর্জীবন ঘটেছে। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকেরা তার শোষণ ও লুটতরাজের স্বার্থেই, তাদের সুবিধামত সীমাবদ্ধ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। সেটা ফলাও করে প্রচারে আনলেও তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল লুটতরাজ। গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রিটেন ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে অর্থাৎ ১৭৩ বছরে উপমহাদেশ থেকে ৯ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন পাউন্ড (৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার) লুটপাট করে নানাভাবে পাচার করে নিয়ে গেছে। বাংলায় দুই দুটো দুর্ভিক্ষ উপহার দেয় ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদ, যেখানে দুই বাংলা মিলে জনসংখ্যা ছিল তিন কোটি, সেখানে দুর্ভিক্ষে সোয়া কোটি লোকের প্রাণহাণি ঘটে। আইন করেই ব্রিটিশ তাদের লুটপাট, অর্থ পাচার সহ যাবতীয় অপকর্ম করত, বেআইনি পথে নয়। একদিকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা করতে শেখাত এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলত নানাভাবে। আর আরেকদিকে আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধের ফাঁক দিয়ে, আইনের নামেই চালাত লুটপাট। আইনের ফাঁক দিয়ে অবাধ লুটতরাজের এই পদ্ধতির কারণে কোনো ব্রিটিশ কলোনীতে স্বাধীনমত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায়নি, পৃথিবীর কোনো ব্রিটিশ কলোনীতেই সফল হয়নি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। ব্রিটিশরা “ভারতীয়দের আধুনিক করতে” এসেছে বলেও একটা ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমনকি ব্রিটিশ শাসনের উপকারভোগী বহু দেশিয় বুদ্ধিজীবী কবি সাহিত্যিক লেখকেরা এই ধারণা তৈরি করার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে খেটে গেছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এর বাইরে নন। এখনো ইতিহাসের এই ধারাটিই প্রধান, শক্তিশালী ও প্রভাবশালী। এই ধারণার পক্ষে কিঞ্চিত বাস্তবতা থাকলেও সত্যটা হল এটাই যে, ব্রিটিশ আসার বহু আগেই উপমহাদেশে নালন্দা মহাবিহারের মত বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, যেখানে সেই সময়েই ১২ হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া করত। গ্রীস, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, চীন, জাপান, তিব্বতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সেখানে শিক্ষার্থীরা আসতেন জ্ঞানার্জনের জন্য। এক সময় নালন্দা মহাবিহারের মহাচার্য ছিলেন বাঙ্গালী প-িত অতীশ দীপঙ্কর। প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারই ছিল এমন জ্ঞান চর্চার পিঠস্থান। গণিতে শুন্যের ব্যবহার শিখিয়েছে ভারতীয়রাই। ব্রিটিশ আসার আগেই এদেশে ল-নের চেয়েও নদী কেন্দ্রিক জাকজমকময় নগর গড়ে উঠেছিল। ঢাকার মসলিনের কদর ছিল বিশ্বব্যাপী। এছাড়া সিন্ধু সভ্যতার মত সুপ্রাচীন নগর সভ্যতার উত্তরাধিকার বহন করত ভারতবর্ষ। ব্রিটিশ আসার আগেই বাংলার সঙ্গে চীন ও আফ্রিকার নৌবাণিজ্যের প্রমাণ মেলে। কার্ল মার্কস ভারতবর্ষকে তাদের ভাষা ও ধর্মের উৎসভূমি বলে অভিহিত করেছেন। অষ্টম শতাব্দির শেষ ও নবম শতাব্দির শুরুর দিকে মধ্য এশিয়ায় মোহাম্মদ ইব্ন মুসা আল খোরজমী রচনা করেন তার বিখ্যাত গণিতশাস্ত্র ‘আল জব্র’। যেখন থেকেই অ্যালজেব্রা শব্দের উৎপত্তি। গণিতবিদ ছাড়াও তিনি ছিলেন জ্যোতিবিজ্ঞানি, ভূগোলবিদ ও ইতিহাসবেত্তা। ভারতীয় বীজগণিত ও গ্রীক জ্যামিতির সংশ্লেষ ঘটেছে তার সৃষ্টিতে। সেটাই বর্তমানকালের আধুনিক গণিতবিদ্যার ভিত্তিস্থল। এই ভূখ-ে নিজেদের মত আধুনিকতা নির্মানের এমন বহু ঐতিহ্য, বহু উপাদান, বহু শর্ত রয়েছে।
ব্রিটিশ অনুগতরা যতই বলুক, সত্যটা হল এটাই যে, ব্রিটিশ আমাদের যে আধুনিকতা দিয়েছিল, সেটা ছিল আধুনিকতার অনুকৃতি। সেটা ছিল উপনিবেশিক আধুনিকতা। যে আধুনিকতা দিয়ে সমাজতন্ত্র তো দূরের কথা, বুর্জোয়া গণতন্ত্রও নির্মান করা সম্ভব নয়। কারণ ‘বুর্জোয়া শ্রেণি নিজের ছাঁচে জগৎ গড়ে তোলে’। সেই জগৎ বুর্জোয়া জগৎ নয়, সেখানে পাওয়া যাবে বুর্জোয়াদের ঠাঁট। আমাদের প্রয়োজন উপমহাদেশের আধুনিকতার নতুন ভিত্তি নির্মান, যে আধুনিকতার মধ্যে মানুষ এবং প্রকৃতি-দুইই সুরক্ষিত থাকবে। এজন্যই বাহাত্তরের সংবিধানের মাধ্যমে পুনর্জীবিত হওয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্রের অবসান ঘটিয়ে একটি সমাজতন্ত্র অভিমূখি জনবান্ধব ও প্রকৃতিবান্ধব আধুনিক সমাজ নির্মান এখন সময়ের দাবি।
আধুনিকতা বনাম উপনিবেশিক আধুনিকতা
ইউরোপের বিশেষত পশ্চিম ইউরোপে যেভাবে আধুনিক পুঁজিবাদী বুর্জোয়া সমাজ ও রাষ্ট্র এবং সেই সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, সেভাবে বাংলাদেশ সহ উপমহাদেশে গড়ে উঠেনি। ইউরোপে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের ভিত্তি ছিল রেঁনেসা, আর আমাদের এখানে গণতান্ত্রিক পরির্বতন সংঘটিত হয়েছিল উপনিবেশিকতার হাত ধরে আর জাতীয় সংগ্রাম ও শ্রেণি সংগ্রামের প্রভাবে। উপরন্তু ক্ষমতাসীন বুর্জোয়া শাসকশ্রেণি তাদের শাসন নিষ্কন্টক রাখার জন্য সে সব জাতীয় সংগ্রাম ও শ্রেণি সংগ্রামের গণতান্ত্রিক অর্জনগুলো ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে। এ কাজে শাসকদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হল ধর্মীয় ফ্যাসীবাদ। উপনিবেশিকতার হাত ধরে আসা পুঁজিবাদ নিজেই বিকাশিত হচ্ছে উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্রের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যদিয়ে। এসব শাসকশ্রেণির ওপর ভর করেই জারি আছে সা¤্রাজ্যবাদের শোষণ, আঞ্চলিক আধিপত্য ও ধর্মীয় ফ্যাসীবাদ। যে কাজটি ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি করত বাইরে থেকে এসে, একই কাজ একই রাষ্ট্রকাঠামোতে দেশিয় শাসকশ্রেণি করছে দেশের ভেতর থেকেই। যে কারণে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসকদের উচ্ছেদ করা হয়েছে, একই কারণে দেশিয় শাসক শ্রেণিকেও উচ্ছেদ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে উচ্ছেদ করতে হবে এই উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। এই শাসকশ্রেণিই দেশের জনগণের বিশেষত মেহনতী জনগণের প্রধান প্রতিপক্ষ। তাদের উচ্ছেদের ধারায় দেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন জয়যুক্ত হতে পারে।
কীভাবে একটি স্বাধীন দেশের সংবিধানে উপনিবেশিক রাষ্ট্রের পুর্নর্জীবন ঘটল
বাংলাদেশের সংবিধানকে বার বার পরিবর্তন করে তাকে আরো স্বৈরতান্ত্রিক ও আরো অগণতান্ত্রিক রূপ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানকে আলোচনার স্বার্থে আমরা এখানে ‘বাহাত্তরের সংবিধান’ বলেই অভিহিত করছি।
বাহাত্তরের সংবিধানের একাদশ ভাগে অর্থাৎ একেবারে শেষ দিকে একটি প্রায় অনুল্লেখ্য অনুচ্ছেদ হলো ১৪৯। যাতে বলা হয়েছে-“এই সংবিধানের বিধানবলী সাপেক্ষে সকল প্রচলিত আইনের কার্যকরিতা অব্যাহত থাকিবে, তবে অনুরূপ আইন এই সংবিধানের অধীন প্রণীত আইনের দ্বারা সংশোধিত বা রহিত হইতে পারিবে।”
‘প্রচলিত আইন’ অর্থ এই সংবিধান প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানায় বা তার অংশ বিশেষে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সক্রিয় থাকুক বা না থাকুক, এমন যে কোন আইন। অর্থাৎ সংবিধানটি গৃহীত হওয়ার পূর্বে যা ছিলো, সংবিধান গৃহীত হওয়ার পরও তাই আছে- অর্থাৎ পাকিস্তানী আমলে যে সব আইন, বিধি-বিধান জারী ছিলো, যা ছিলো ব্রিটিশদের পরিত্যক্ত- তাই দাড়ি, কমা সমেত বাংলাদেশে জারী করা হলো। এত রক্ত এত যুদ্ধ এত আন্দোলনের পরেও ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী আমলের পচা গলা আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকেই কার্বন কপি করে বাহাত্তরের সংবিধানে খাড়া করা হল।
অপরদিকে, বাংলাদেশের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বা মুজিবনগর সরকার কর্তৃক ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত ঘোষণাপত্রের আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে এ আদেশ জারি করছি যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে সকল আইন চালু ছিল, তা ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একইভাবে চালু থাকবে, তবে প্রয়োজনীয় সংশোধনী সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের জন্য করা যাবে।
সেখানে আরো বলা হয়, ‘সকল সরকারি, সামরিক, বেসামরিক, বিচার বিভাগীয় এবং কূটনৈতিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী যারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছেন, তারা এতদিন পর্যন্ত নিয়োগবিধির আওতায় যে শর্তে কাজে বহাল ছিলেন, সেই একই শর্তে তারা চাকুরিতে বহাল থাকবেন।’
যতদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলেছে এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, ১৯৭২ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর যখন নতুন সংবিধান প্রণীত হয় তখন সংবিধান হিসেবে এর কার্যকারিতার সমাপ্তি ঘটে। অর্থাৎ যুদ্ধচলাকালে এবং যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হওয়ার আগে পর্যন্ত আগের আইনই বলবৎ ছিল, পরবর্তীতে প্রণীত সংবিধানেও তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
সংকট, তার ফলশ্রুতি:
বাংলাদেশের উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ পুঁজিবাদী রাষ্ট্র অনুমোদিত হয়েছে বাহাত্তরের সংবিধানে। বর্তমানের বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট হল সাংবিধানিক সংকট। এই সাংবিধানিক সংকটের জের ধরেই স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বার বার সামরিক শাসন জারি হয়েছে। দীর্ঘ এক দশকের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর নব্বইয়ে সামরিক স্বৈরাচারকে পরাস্থ করা হলেও, সেই সময় এই শাসনতান্ত্রিক সংকটের অতিশয় জরুরি প্রশ্নটি কেউ উত্থাপন করেননি। এই পর্বটি সমাধান না করে এগুনো সম্ভব না, বরং আরো নতুন নতুন জটিলতা এসে আমাদের নিমজ্জিত করে দেবে, আমাদের জটিলতায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
আমাদের মতে, বর্তমানের ঘণীভূত সংকটকালের একমাত্র সমাধান, সকল নিপীড়িত শ্রেণি ও জাতিস্বত্ত্বার অংশ গ্রহণে বিপ্লবী গণঅভ্যূত্থান। তার আগে প্রয়োজন তাদের সঠিক রাজনৈতিক রণনীতি আর রণনীতিতে সজ্জিত একটি বিপ্লবী শক্তির উপস্থিতি। দেশে বিপ্লবী শক্তির আপাত উপস্থিতি না থাকলেও, দুই দুইটি গণঅভূত্থানের (’৬৯ ও ’৯০) গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যম-িত বাংলাদেশে সঠিক রাজনৈতিক রণনীতি এবং তার ভিত্তিতে প্রণীত কর্মসূচির বাস্তব অনুশীলনে সেই বিপ্লবী শক্তির উত্থান সম্ভব।
অর্থাৎ সঠিক রণনীতি বাস্তবায়নে যেমন ব্যাপক জনগণের বিপ্লবী উত্থান দরকার, আবার বিপ্লবী উত্থানের জন্যও দরকার সঠিক রণনীতি। অতীতেও এমন সংকটকালে, জনগণের লড়াইয়ের সামনে দেশের প্রগতিশীল বামপন্থী কমিউনিস্টগণ লেনিনীয় পথ তুলে ধরতে পারেননি। সঠিক রাজনৈতিক কর্মসূচি উত্থাপন করতে সক্ষম হননি। যার ফলে জনগণের আন্দোলন দিকভ্রান্ত হয়েছে, আন্দোলনের ফসল মেহনতীদের গোলায় উঠেনি। তারই ফলাফল হল দেশের এই দুরাবস্থা ও বর্তমানের দুর্বৃত্ত শাসন। এবারো যদি সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে তারও ফল হতে পারে আরো ভয়ঙ্কর। প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি দল ও কর্মসূচির অভাবে আরো প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থান অনিবার্য হয়ে উঠবে। তার উদাহরণ হল ভারতের মোদি সরকারের পুনরুত্থান।
সাধারণত: জাতীয় সংকটকালে সঠিক কর্মসূচি ও শক্তির অনুপস্থিতিতে মানুষ সামনে যাকে পায়, তাকেই অবলম্বন করে বাঁচতে চায়। বিশুদ্ধ তত্ত্ব ও সাচ্চা পার্টির জন্য অপেক্ষা করে না। সেই অবলম্বন যদি আরো প্রতিক্রিয়াশীল হয়, তবুও। সঠিক পথে অনুপস্থিতে তাৎক্ষণিক বিবেচনায় শয়তানকে তাড়াতে পিচাশের সঙ্গেও হাত মেলায় মানুষ। সঠিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তির অনুপস্থিতিতে আরো চরম ধর্মীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানকে উপভোগ করতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। যাতে করে জঙ্গিবাদের ছুতো তুলে, ইরাক আফগানিস্তানের মত, এদেশকেও আরেক দফা নরক বানাতে পারে। সঠিক গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তি ও রাজনীতির অনপুস্থিতিতে ভারতের হিন্দু মৌলবাদী শক্তির উত্থানের প্রতিক্রিয়ায় এখানেও ইসলামি মৌলবাদী শক্তির উত্থান-দেশকে নরক বানানোর ফাঁদে ফেলে দেওয়া।
আমরা বিশ্বাস করি, ক্ষমতা দখল করার মত নির্ভরযোগ্য প্রগতিশীল বিপ্লবী রাজনৈতিক শক্তি ও দল না থাকলেও, সঠিক রাজনীতি থাকলে সেই বিপ্লবী শক্তির উত্থানের কাজ শুরু করা যায়। সে ক্ষেত্রে দল না থাকলেও দল গড়ে উঠার সম্ভবনা তৈরি হতে পারে। মেহনতিদের আন্দোলনের সামনে সঠিক রাজনৈতিক দিশা থাকলে, সেই আন্দোলন পথ হারায় না। কারণ জনতার আন্দোলনই একটি বিপ্লবী শক্তির উত্থান ঘটাতে সক্ষম। বিপ্লবী শক্তির উত্থানের অর্থ হল সম্পর্কের পুরানো সমীকরণ ভেঙ্গে ফেলে দেওয়া। নীরব আন্দোলনের কালে যা অনুধাবন করা মুস্কিল। আমরা জনতার আন্দোলনের ওপর আস্থাশীল, তাকে যথাযথ পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে, যাদের সঙ্গে যতটুকু মতে পথে মিলবে, ততটুকু ঐক্য নিয়েই কাজ করতে চাই। সেক্ষেত্রে আমরা দল ও জোটের বিন্যাস ও পুর্নবিন্যাসের ব্যাপারে শিথিল থাকব।
ব্যক্তি শাসক ও ব্যবস্থা প্রসঙ্গে:
বাংলাদেশে দুইটি গণঅভ্যূত্থানে দুই সামরিক স্বৈরাচার উচ্ছেদ হয়। প্রথমে জেনারেল আইউব খান পরে জেনারেল এরশাদ। এই দুইটি ঘটনায় জনরোষের সামনে ব্যক্তি স্বৈরাচারকেই যেভাবে সামনে আনা হয়েছিল, তাতে আড়ালে থেকে গেছে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা, আলোচনায় আসেনি অতিশয় জরুরি শ্রেণি-প্রশ্নটি। যার ফলশ্রুতিতে আইউবের বদলে ইয়াহিয়া জায়েজ হতে পারে, আর এরশাদের বদলে হাসিনা খালেদার ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী’ ব্যবস্থা জারি রাখতে পারে, আর জায়েজ হয় পতিত স্বৈরাচার। তাই খেয়াল রাখতে হবে, স্বৈরশাসক বা ফ্যাসিস্টকে শুধু দলের প্রতিনিধি বা ব্যক্তি হিসাবে নয়, তাকে শ্রেণি এবং স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপনের রাজনৈতিক লাইন হাজির করতে হবে।
বামপন্থী ও কমিউনিস্টদের দল ও জোটের ঐক্য প্রসঙ্গে : ইতোপূর্বে বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পরিচয়ের বেশ কয়েকটি দল জোড়াতালি দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন করেছিল। কিন্তু যে সব প্রতিশ্রুতি নিয়ে ঐক্য হয়েছিল, তা সফল হয়নি। সেই ঐক্য টেকেনি। নানা গ্রুপে বিভক্ত হয়েছে, ভাঙ্গনের পর্ব চলমান। অর্থাৎ ঐক্য জোড়াতালি দিয়ে হয় না, একটি সঠিক রাজনৈতিক রণনৈতিক লাইনকে ঘিরেই ঐক্য দরকার।
এছাড়া, জোট গঠন করতে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকালে আওয়ামী লীগকে ঘিরে বামপন্থীদের একাংশ মিলে গড়ে তুলেছিল ১৫ দল। আর খালেদাকে ঘিরে বামপন্থীদের আরেক অংশ গড়ে তুলেছিল ৭ দল। পরে ১৯৮৬ সালের ২০ মে আওয়ামী লীগ এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গেলে, সেই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে ১৫ দল থেকে ও ৭ দল থেকে বের হয়ে আসা বামপন্থীরা মিলে গড়ে তুলেছিল পাঁচ দল।
এরশাদ ক্ষমতা দখলের আগে আওয়ামী লীগ ছিল বহু খন্ডে বিভক্ত, শক্তিহীন, নেতৃত্বহীন, ক্ষয়িষ্ণু দল। অপরদিকে সামরিক কুদেতায় নিহত দলের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের করুন মৃত্যুর পর নি:শেষ হওয়ার সম্ভব্য পরিনতির দিকে ক্রমেই ধাবিত হচ্ছিল বিএনপি। দলচ্যুত, নীতিচ্যুত, বিভ্রান্ত ও হতাশাগ্রস্থ গণবিচ্ছিন্ন তথাকথিত প্রগতিশীলদের নিয়ে গঠিত দলটির তেমন কোনো জনভিত্তিই ছিল না তখন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ধারায় দুইটি দলই শক্তিশালী হয়েছে, বিপরীতে শক্তি ক্ষয় পেয়েছে বামপন্থী কমিউনিস্টদের। আন্দোলনের যে কৌশলের কারণে তাদের এই করুণ পরিনতি, তার গ্রহণযোগ্য জবাব এখনো তৈরি হয়নি।
প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অবস্থান থেকে আওয়ামী লীগ তার গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পায় এবং নি:শেষ হওয়ার সম্ভব্য পরিনতি থেকে বিএনপি জনভিত্তি খুঁজে পায় মুলত: এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পরিনতিতেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং শাসন ক্ষমতার নতুন করে বৈধতা পায় ওই দল দুটি। আর সেই কাজের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগান দাতা দেশের বামপন্থী কমিউনিস্টরা। পরবর্তিতে বামপন্থীদের নিয়ে গড়ে ওঠা ৫ দলীয় জোটও দুই নেত্রীকে এক করে আন্দোলন তেজি করতে চেয়েছে। এসকল বামপন্থীরা নানাভাবে ওই দ্বি-দলীয় ধারাটিকেই পরিপুষ্ট করেছে।
ওই দুই দলের ক্ষমতায়নের মধ্যেই বামপন্থীরা দেশের গণতন্ত্রের সম্ভবনা দেখেছে, দেখেছেন নিজেদের ভবিষ্যত। এভাবেই দ্বি-দলীয় রাজনীতি নতুন করে শক্তিশালী হয়েছে এবং ক্ষমতা দখলের বৈধতা অর্জন করেছে। এই বৈধতার ওপর ভর করেই বাংলাদেশের বুর্জোয়া শাসক শ্রেণি দুই দলকে কেন্দ্র করেই তাদের সীমাহীন শোষণ লুণ্ঠন, চুরিচামারি, নির্যাতন এবং যাবতীয় অপকর্ম জারি রাখতে সক্ষম হয়েছে। দুই দলের শোষণ নিপীড়নে মানুষ যখন অতিষ্ট, তখন দ্বি দলীয় পাল্টাপাল্টির বিপরীতে বাম বিকল্পের স্লোগান দিতে দিতে দেখা গেছে বামপন্থী কমিউনিস্টদের একাংশের। কিন্তু বিগত দিনের আন্দোলনে দ্বি দলীয় ধারাকে পরিপুষ্ট করার যে অপরাধ তারা করেছে, তার আত্ম সমালোচনা না করে, দ্বি দলীয় পাল্টাপাল্টির বিরুদ্ধে স্লোগান কখনোই হালে পানি পেতে পারে না, পাইওনি।
নব্বই পরবর্তি খালেদা জিয়ার সময়ে পাঁচ দল এবং সিপিবি মিলে গড়ে তোলে গণতান্ত্রিক বাম ফ্রন্ট। পরে ক্ষমতার তৃতীয় রাজনৈতিক ধারা তৈরি এবং বাহাত্তরের সংবিধান পুণপ্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়ে গণতান্ত্রিক বাম ফ্রন্টের সঙ্গে ন্যাপ ও গণফোরাম, গণ আজাদী লীগ সমন্বয়ে ১১ দল গঠন করা হয়েছিল। ১১ দলের গুরুত্বপুর্ণ দল ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাপ, গণফোরাম, গণআজাদী লীগ সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদী শক্তির উত্থান মোকাবেলার কথা বলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেধে গড়ে তোলে ১৪ দল। এভাবেই তারা এখন সরকারের ক্ষমতার অংশিদার। এভাবেই বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট এবং ১১ দল তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। এ ঘটনার পর বাসদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটিসহ বেশ কয়েকটি গ্রুপ মিলে গঠন করেছিল গণমুক্তি। সেই সময় ৫ বাম দল নামেও কয়েকটি বামপন্থী গ্রুপ ক্রিয়াশীল ছিল।
এরপরে গণমুক্তি, ৫ বাম দল মিলে গঠন করা হয়েছিল বাম মোর্চা, পরে বাম মোর্চা ভেঙ্গে বের হয়ে সিপিবি-বাসদ আলাদাভাবে কাজ শুরু করে। সেখানে রাজনীতির চেয়ে সংগঠনের ব্যাপ্তি বিস্তারকে বেশি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল বলে অনেকে মনে করে থাকেন। বর্তমানে সাবেক বাম মোর্চা ভুক্ত দলের সঙ্গে সিপিবি মিলে গঠন করা হয়েছে গণতান্ত্রিক বাম জোট। যা এখনো কার্যকর।
বাংলাদেশে এভাবেই একাধিকবার বামপন্থীদের মোর্চা বা জোট গঠনের ঘটনা ঘটেছিল। যা প্রায় একই দল সমূহের নানা আঙ্গিকের বিন্যাস পুণবিন্যাস। এসকল মোর্চা বা জোট বা ফ্রন্ট গঠন সময়ের রাজনীতি সংঘটনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধনে সক্ষম হলেও মোটাদাগে মেহনতীদের রাজনীতির বিকাশ সাধনে সক্ষম হয়নি। এসকল ফ্রন্ট বা জোট বা মোর্চা মেহনতিদের স্বার্থে সরকার বিরোধী কোনো কার্যকর রাজনৈতিক আন্দোলন গঠন করতে সক্ষম হয়নি। বিভিন্ন সময়ে সরকারের নানা দু:শাসনের প্রতিবাদ সংঘটিত করলেও, সমাজ রূপান্তরের জন্য কর্মসূচি ভিত্তিক রাজনীতি হাজির করতে পারেনি। তাই পুনরায় বামপন্থী কমিউনিস্টদের মোর্চা বা জোট গঠন করতে হলে, পূর্বেকার সকল জোট মোর্চা বা ফ্রন্ট কেন কার্যকর থাকল না, সেই জোট বা ফ্রন্ট গঠন কেন সফল হল না-তার একটা গ্রহণযোগ্য জবাব থাকা দরকার। ইতোপুর্বেও গঠিত হওয়া সকল জোট বা ফ্রন্ট গঠনের একটা বিচারমূলক সমালোচনা দাঁড় করানো দরকার। তা না করে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যেন তেন ভাবে জোট করলেই তা পুরানো বৃত্তে ঘুরপাক খেতে বাধ্য।
আমাদের মতে, মেহনতি জনগণের মৌলিক শত্রুদের প্রশ্নে একমত হলে ইস্যু ভিত্তিক ঐক্য গড়া যায়। আর প্রধানশত্রু প্রশ্নে একমত হলে রণনীতি প্রশ্নে একমত হওয়া যায়। দেশিয় শাসকশ্রেণিকে উচ্ছেদের প্রশ্নটি সামনে আসলে কর্মসূচি ভিত্তিক ঐক্য গড়া এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য জোট গঠন সম্ভব।
রাজনৈতিক সংগ্রাম প্রসঙ্গে
আমাদের মতে, রাজনৈতিক সংগ্রাম হল ক্ষমতা দখল বিষয়ক সংগ্রাম। নির্বাচন, সংসদ, সংবিধান ও সরকার পদ্ধতি-এসব হল রাজনৈতিক সংগ্রামের অনুসঙ্গ। অপরদিকে অর্থনৈতিক সংগ্রাম হল রুটি রুজি জমি ও কাজের অধিকার এবং ট্রেড ইউনিয়ন বিষয়ক আন্দোলন। এমন কি তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর ও খনিজ সম্পদ রক্ষার আন্দোলনও অর্থনৈতিক সংগ্রাম, একই সঙ্গে এটা সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের অংশও বটে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক সংগ্রাম অনেক সময় সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের রূপেও আবির্ভূত হতে পারে।
এছাড়া রয়েছে সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। যেমন নারী পুরুষের সমাধিকারের আন্দোলন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিপীড়ন ও জঙ্গিবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে লড়াই এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবির আন্দোলন। সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনের উদাহরণ হতে পারে। এসকল আন্দোলনের একটা রাজনৈতিক চরিত্র থাকে।
মজুর শ্রেণির অর্থনৈতিক সংগ্রাম কিংবা সামাজিক সাংস্কৃতিক ও পরিবেশ রক্ষার সংগ্রাম কখনোই নিজে থেকে সেই শ্রেণির রাজনৈতিক সংগ্রামে, অর্থাৎ ক্ষমতা দখল বিষয়ক সংগ্রামে রূপ নিতে পারে না। আলাদা ভাবে রাজনৈতিক সংগ্রাম জারি থাকতে হয়। তবে অন্যান্য সংগ্রাম সমাজে জারি থাকা রাজনৈতিক সংগ্রামকে পুষ্টি যোগায়। যে কোনো অর্থনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশ রক্ষার সংগ্রামের অনুপূরক রাজনৈতিক সংগ্রাম যদি সমাজে অনুপস্থিত থাকে, সেক্ষেত্রে দেশে জারি থাকা যে কোনো রাজনৈতিক সংগ্রামকেই তা পরিপুষ্ট করবে, এমনকি তা বিপরীত পক্ষের হলেও। সমাজে অর্থনৈতিক সংগ্রাম যদি মজুর শ্রেণির রাজনৈতিক দল করে, আর রাজনৈতিক সংগ্রাম যদি জারি থাকে বুর্জোয়া শ্রেণির। সে ক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে মজুরদের অর্থনৈতিক সংগ্রামের সকল অর্জন গ্রাস করবে বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক সংগ্রাম। একই কথা বিভিন্ন শ্রেণির সামাজিক সাংস্কৃতিক ও পরিবেশ রক্ষার লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও খাটে। অনেকটা নদীর পানি যেমন সাগরে যায়, তেমনি অন্যান্য সকল সংগ্রামের অর্জন যাবে রাজনৈতিক সংগ্রামের আধারে। কোনো ভাবেই নিজে থেকে অর্থনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক ও পরিবেশ রক্ষার লড়াই রাজনৈতিক সংগ্রামে রূপ নেয় না, নিতে পারে না। এই কথাটি নিয়ে একটা ভুল বুঝ আছে। সেই ভুল বুঝের কারণে বলা হয়, ‘আন্দোলন গড়ে তুলি আমরা আর ফসল গোলায় তোলে বুর্জোয়ারা।’ কিন্তু তারা এটা বুঝতে সক্ষম হন না যে, ফসলের গোলা মানে রাজনৈতিক সংগ্রাম, সেটা তো একমাত্র বুর্জোয়াদের রয়েছে। সুতরাং কমিউনিস্টদের অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফসল তো সেই গোলাতেই যাবে। কারণ বামপন্থী কমিউনিস্টদের তো কোনো গোলাই (রাজনৈতিক সংগ্রাম) নাই, আগেও ছিল না, এখনো নাই, কোনোদিনই ছিল না। এসকল কমিউনিস্টগণ মনে করেন, তারা যে লড়াই করে যাচ্ছেন, একদিন সেই লড়াই আপনা আপনিই সমাজ বদলের লড়াইয়ে রূপ নেবে। অর্থাৎ তাদের অর্থনৈতিক সংগ্রাম, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগ্রাম নিজে থেকেই রাজনৈতিক সংগ্রামে রূপ নেবে। কিংবা তারা অর্থনৈতিক সংগ্রামকেই রাজনৈতিক সংগ্রাম মনে করে বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন।
আমাদের উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে অর্থনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগ্রামে কমিউনিস্টরা যে ভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন, অনবদ্য ভূমিকা রেখে চলেছেন, সেটা সোনার অক্ষরে লেখা থাকার মত ঘটনা। অতিশয় কষ্টের ব্যাপার হল, রাজনৈতিক সংগ্রামে তারা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হননি। বরং বরাবরই রাজনৈতিক সংগ্রামের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন বুর্জোয়াদের হাতে। চূড়ান্ত মূহুর্তে নিঃশর্তভাবে বুর্জোয়াদেরই সমর্থন দিয়ে গেছেন। উদাহরণ হিসেবে, ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রথমে লাহোরে, ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় পরে ১৮ মার্চ দলের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা পেশ করেন এবং তা গৃহীত হয়, যেটা রাজনৈতিক সংগ্রাম। এর বিপরীতে কমিউনিস্টদের আলাদা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। মাওলানা ভাসানী একই বছরে জুন মাসে কর্মীদের চাপের মুখে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় ১৪ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়। ১৪ দফা ছিল ৬ দফাকে কাউন্টার দেওয়ার জন্য, জনগণের আন্দোলন বিকশিত করার জন্য নয়। সেটা ছিল দেওয়া অর্থে দেওয়া। কর্মীদের চাপে আর তাদের বুঝ দেওয়ার জন্য। যে ১৪ দফা কখনো জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়নি। কাপ্তান বাজারে ন্যাপ অফিসে বস্তাবন্দি ১৪ দফার কাগজ উই পোকায় কেটেছে। শেষে ‘জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব’ বলে আওয়ামী লীগকেই নিঃশর্ত সমর্থন দিতে হয়েছে তাকে। ততদিনে (’৭০ এর নির্বাচনের পর) শেখ মুজিবের পক্ষে ব্যাপক গণজোয়ার তৈরি হয়ে যায়। এমন নিঃশর্ত সমর্থনের উদাহরণ মনি সিংহ গ্রুপেরও পাওয়া যাবে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও দুই নেত্রীকে (আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে) নিঃশর্ত সমর্থন দেওয়ার অসংখ্যা উদাহরণ পাওয়া যাবে। এরমধ্যে মোহাম্মাদ ফরহাদের হাসিনা ও খালেদার ফিফটি ফিফটি তত্ত্ব প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ব্রিটিশ আমলেও কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে ঐক্যবদ্ধ করে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই করতে চেয়েছে কমিউনিস্টরা। শেষে পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন প্রদান করলেও আলাদা কর্মসূচি হাজির করতে পারেনি।
দেখা গেছে, অর্থনৈতিক সংগ্রামে বাংলাদেশের কমিউনিস্টগণ কমবেশি তাদের স্বতন্ত্র সত্ত্বা ধরে রাখতে পারলেও রাজনৈতিক সংগ্রামের বেলায় তা পারেননি। সেক্ষেত্রে তারা বড় বুর্জোয়া দলের দিকে হেলে পড়েন, অনেকক্ষেত্রে তাদের লেজুরে পরিণত হন। এভাবে হেলতে হেলতে একাংশ এখন ‘সরকারি বামপন্থী’ পরিচয় লাভ করেছেন। একই ভাবে এদেশের কমিউনিস্টদের একদল আওয়ামী পন্থী কমিউনিস্ট, আরেক দল বিএনপিপন্থী কমিউনিস্ট হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে চিহ্নিত হয়ে ছিলেন। সত্যকার অর্থেই কমিউনিস্টদের একাংশ বিএনপি গড়ে তুলেছেন, আরেকাংশ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছেন। কেউ সরাসরি যোগ দিয়ে, কেউবা সরাসরি যোগ না দিয়ে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে শোষণ লুটতরাজ করলেও এদের কেউ কেউ বিএনপির সমালোচনা করেন। অপরদিকে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও এদের অনেকে আওয়ামী লীগের সমালোচনাতেই বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এভাবে কমিউনিস্টদের ওপর বুর্জোয়া দলের প্রভাবের মূল কারণ কোনো আন্দোলনে মজুর শ্রেণির পক্ষে স্বতন্ত্র রাজনীতি না থাকা।
রাজনৈতিক সংগ্রামে তাদের অনিহার কারণে ব্রিটিশ আমল থেকেই মানুষ ক্ষমতার জন্য চিন্তা করত বুর্জোয়াদের আর তৎক্ষণিক প্রাপ্তির সংগ্রামের জন্য যেত কমিউনিস্টদের কাছে। তারা বলতেন, ‘রোটিকে লিয়ে কমিউনিস্ট, ভোটকে লিয়ে/স্বরাজকে লিয়ে কংগ্রেস।’ অর্থাৎ রুটি রুজির জন্য যাব কমিউনিস্টদের কাছে আর ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠাব কংগ্রেসকে কিংবা কংগ্রেসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করব স্বরাজ।
কমিউনিস্টগণ কীভাবে রাজনৈতিক সংগ্রাম গড়ে তোলেন?
সাধারণভাবে একটি দেশে নিদিষ্ট সময়ে একটা নিদিষ্ট রাজনৈতিক সংগ্রাম অবশ্যই জারি থাকে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংগ্রাম সাধারণত জারি রাখেন বুর্জোয়া দলগুলো। তাদের রাজনৈতিক সংগ্রাম শতকরা পাঁচভাগ মানুষের স্বার্থে। কমিউনিস্টগণ তাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের লাইন এবং কর্মসূচি নির্ধারণ করেন বিশুদ্ধ তত্ত্বের জায়গা থেকে নয়। বরং সমাজে জারি থাকা বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক সংগ্রামের গুনগত বিপরীত এবং শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের মধ্যে এভাবে রাজনৈতিক সংগ্রামের লাইন এবং কর্মসূচি নির্ধারণের উদাহরণ নাই। তবে ক্রমান্বয়ে বিষয়টি কমিউনিস্ট মহলে আলোচনায় আসতে শুরু করেছে এবং অগ্রসর অংশ বিষয়টি জীবন্তভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হচ্ছেন।
বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেন?
সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের পতন আন্দোলনের সময় থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গটি রাজনীতিতে আলোচনায় চলে আসে। নব্বইয়ের পর প্রথম ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে আওয়ামী লীগ। পরে ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীন সরকার আসার আগে তখনকার ক্ষমতাসীন বিএনপি চাইছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই বহাল রাখতে, আর আওয়ামী লীগ চাইছিল সেই ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করতে। এক এগারোর পরে ক্ষমতায় এসে পুরো তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি আদালতের পুরো রায় প্রকাশের আগেই প্রথম দফাতেই বাতিল করে দেয় টানা তিন দফায় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার। আর বুর্জোয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি জানালেও এজন্য কোনো কার্যকর আন্দোলনই গড়ে তুলতে পারেনি কোমড়ভাঙ্গা বিএনপি। তারা ক্ষমতায় থাকাকালে এত শোষণ নির্যাতন অন্যায় আর অপরাধ করেছে যে, তাদের কোনো কথাতেই মানুষের আস্থা নাই, জনতা আর বিশ্বাস তাদের করে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা বুর্জোয়াদের আন্দোলন নিয়ে কমিউনিস্টদের মধ্যে দুই ধরণের মত ও প্রবণতা রয়েছে। একাংশের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে চরম অনিহা রয়েছে। তারা মনে করেন, এটা বুর্জোয়াদের আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বের ফলাফল, সেখানে শ্রমিকশ্রেণির কোনো স্বার্থ নাই। তারা বিশুদ্ধ তত্ত্বের জায়গা থেকে কিছু ভাল ভাল কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। এটা হল সেই গল্পের মত, যেখানে একটা বাড়িতে হামলা করার জন্য একদল ডাকাত সেই বাড়ির নীচে ঝগড়া শুরু করেছে, তাদের একাংশ বলছে, কলিং বেল টিপে ভেতরে ঢুকে ডাকাতি করব। আর আরেক দল বলছে, কলিং বেল টিপে কাজ হবে না, সরাসরি দরজা লাথি মেরে ভেঙ্গে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে ডাকাতি করব। এনিয়ে ডাকাতদের দুই দলের এমন ঝগড়া জানালা দিয়ে দেখে যদি বাড়ির মালিক বলেন, এটা ওদের আভ্যন্তরীন কোন্দল, আমাদের ওখানে স্বার্থ নাই। আমাদের মতে সেটা হবে হাস্যকর এবং বোকার স্বর্গ। ওই দুর্বৃত্তদের সংঘাত কখনো তাদের আভ্যন্তরীণ বিরোধ নয়।
অপরদিকে, কমিউনিস্টদের আরেকাংশ তত্ত্বাবাধায়ক সরকার প্রশ্নে বুর্জোয়াদের থেকে আলাদা কোনো মত ও কর্মসূচি হাজির করতে পারেন না। তাদের দাবি ক্ষমতার বাইরের বুর্জোয়াদের দাবির সঙ্গে প্রভেদ নাই। আর বুর্জোয়া কর্মসূচিকে একটু পরিশীলিত আকারে উপস্থাপন করে সঙ্গে কিছু ভাল ভাল জনপ্রিয় কর্মসুচি জুড়ে দেওয়া হয় মাত্র। অর্থাৎ এখানোও বাম কমিউনিস্ট বলে পরিচিত এসব গ্রুপ সমূহ অতীতের মতই একই বৃত্তে ঘূর্ণায়মান। সেখান থেকে বের হতে পারছে না।
এবার বাহাত্তরের সংবিধান সম্পর্কে কিছু কথা
কিছু কিছু সমালোচনাসহ বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতি, ঘোষণা ও প্রস্তাবনার দিকটি ইতিবাচক, সেখানে ভাল ভাল কথা লেখা আছে, কারণ এসব অংশে মুক্তিযুদ্ধের আলোকোজ্জ্বল দিকের প্রতিফলন রয়েছে। কিন্তু অনুচ্ছেদের অধ্যায়ে তার প্রতিফলন নাই। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা রয়েছে, তা মিশরের ফারাওদের কাছেও ঈর্ষার কারণ হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর কোনো রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড বা পররাষ্ট্রীয় নীতি যদি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কিংবা বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হয় তাহলে তার বিচারের সুযোগ সংবিধানে নেই। রাষ্ট্রের অর্থ যে কোন ভাবে খরচ করলে, আত্মসাৎ করলে, লুণ্ঠন করলেও তার বৈধতা দেওয়ার এক চমৎকার আইনী প্রক্রিয়া রয়েছে সংবিধানে। ‘ক্রসফায়ার’ এর মতো বর্বর ব্যবস্থাটিও সংবিধানসম্মত। সংবিধানে অন্যান্য জাতি সত্ত্বার স্বীকৃতি নাই। জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনের আইনি সুযোগ রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী তেল-গ্যাস-কয়লা রপ্তানি, অন্য কোন রাষ্ট্রের সাথে কোন প্রকার চুক্তি, হোক তা ট্রানজিট বা করিডোর, কোনো কিছুর জন্যই চুক্তির আগে বা পরে তা কোথাও আলোচনার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। বাহাত্তরের মূল সংবিধান আদতে অগণতান্ত্রিক, জাতিবিদ্বেষী, বর্ণবাদী। এই সংবিধান অনুযায়ী ব্যাংক-বীমা লুটপাট করা যায়, লুটপাটকৃত অর্থের উৎস না জানিয়েই বিনিয়োগ করা যায়। এ সব কিছুর পক্ষে আইন তৈরি করাই আছে, আর না থাকলে ইচ্ছা করলেই তৈরি করা যায়।
প্রথম থেকেই বিরোধীতার মুখে পড়ে বাহাত্তরের সংবিধান
১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি প্রণীত হয় বাংলাদেশ অস্থায়ী গণপরিষদ আদেশ। নতুন সংবিধান প্রণয়নে ১৯৭২ সালের ২২ মার্চ জারি করা হয় ওই বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ। সেটিই বাংলাদেশে সংবিধান সভা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। ১৯৭২ সালের ২১ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সর্বদলীয় অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন এবং অন্তবর্তীকালীন সংবিধান গ্রহণের আহবান জানান। তিনি বলেন, ‘আর একটি সাধারণ নির্বাচন না করে দেশের জন্য স্থায়ী সংবিধান গ্রহণ করা যেতে পারে না।’
১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘মাত্র একবছর পূর্বে আমাদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। কেহ কেহ এখনও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে চাহিলে, আমরা তাহাদের ইচ্ছামতো যেকোনো নির্বাচনি এলাকাতেই তাহাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রস্তুত আছি। শীঘ্রই কতকগুলো উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে এবং তাহারা উক্ত সকল নির্বাচনে প্রতিদ্বদ্বিতা করিয়া দেখিতে পারেন। আমি নিশ্চিত, তাহাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হইবে (ইত্তেফাক ও বাংলাদেশ অবজারভাব ১৫ জানুয়ারি ১৯৭২)। যদিও, পরবর্তীতে কখনও ওই উপ-নির্বাচনগুলোর একটাও অনুষ্ঠিত হয়নি।
এর প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭২ সালের ২৬ মে প্রকাশিত একটি বিবৃতিতে ন্যাপ প্রধানের বক্তব্যেরই অনুরূপ বক্তব্য রাখেন ছাত্রলীগের তিন নেতা আ.স.ম আবদুর রব (তৎকালীন ডাকসু ভিপি), শাহজাহান সিরাজ (তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ছাত্রলীগ) ও শরীফ নুরুল আম্বিয়া। তাঁরা দাবি জানান যে, দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে গণপরিষদ ও মন্ত্রিসভা বাতিল করা হোক এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠন করা হোক জাতীয় সরকার।
পরবর্তীতে রব-সিরাজ আরো একটি প্রশ্ন তোলেন, প্রায় ৬০ জনের অধিক গণপরিষদ সদস্যের (যাদের মধ্যে ৫ জন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, ১০ জন ইতোমধ্যে মারা গেছেন এবং কেহ কেহ দুর্নীতির দায়ে ও মুক্তিযুদ্ধের সময় পদত্যাগের দায়ে বহিষ্কৃত, কেউ কেউ অনুপস্থিত ও পদত্যাগী) অবর্তমানে অর্থাৎ বাংলাদেশের এক কোটির বেশি লোকের প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই গণপরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এছাড়া তাঁরা আরো প্রশ্ন তোলেন যে, জাতীয় পরিষদ সদস্যের শতকরা নব্বইজনই যেখানে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সম্পূর্ণ সময়টুকু ভারতে নির্লিপ্ত জীবনযাপন করেছেন, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অধিকার সেইসব গণপরিষদ সদস্যের আদৌ আছে বলে দেশবাসী মনে করে না।
মাওলানা ভাসানীর ন্যাপ ও দলের মুখপত্র হক কথার ১৪ জুলাই ১৯৭২ সংখ্যায় বলেন, এই গণপরিষদ সদস্যরা সেদিন জে. ইয়াহিয়ার পাঁচ দফা শর্ত মেনে নিয়ে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্যই নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁদের নির্বাচনি সময়কাল থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সময়কালের ব্যবধানও প্রায় ১৪/১৫ মাস হলেও রাজনৈতিক সচেতনতা, আশা-আকাঙ্খা ও মূল্যবোধের দিক দিয়ে জনগণ অনেক এগিয়ে গেছেন। এই সবকিছুর মধ্য দিয়ে পরিস্থিতির যে বিকাশ ও পরির্বুন ঘটেছে সেটিকে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাংবিধানিক কাঠামোয় নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যগণ ধারণ করতে পারেন না।
১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান উত্থাপিত হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক অমল সেন। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘.. .. বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের যে ধরনের সংবিধানিক অধিকার থাকে এখানে তাও নেই।’ সমাজবাদী দলের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রকে ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তির শাসনতন্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলা হয়, ‘এই শাসনতন্ত্র হওয়ার পর পাকিস্তানি নাগরিকদের ফেলে যাওয়া যে সমস্ত সম্পত্তির মালিক সরকার হয়েছে, খসড়া সংবিধানে সে সম্পত্তিকে একটা সমাজতান্ত্রিক লেবেল লাগিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। এমনকি পাকিস্তানি আমলের কতিপয় শিল্প আইন কার্যকর থাকবে বলে ঘোষণা করে বিদেশি মূলধন জাতীয়করণ না করার সরকারি সিদ্ধান্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য পাকাপোক্ত করা হয়েছে।’ ন্যাপ (মোজাফফর) এর একমাত্র সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংসদে তাঁর আলোচনায় খসড়া শাসনতন্ত্র নিয়ে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব দিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের সকল শীর্ষনেতাও ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের সংবিধানের ওপর জনরায় নেওয়ার জন্য গণভোটের প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং যেসব ধারার নিন্দা সেদিন আওয়ামী লীগ করেছিল, হুবহু সে ধারাগুলোই তারা স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে প্রবিষ্ট করিয়াছে। তিনি আরও বলেন, ৫৬ সালের শাসনতন্ত্র রচনা করা হয়েছিল রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানকে সামনে রেখে। আর বর্তমান শাসনতন্ত্র বিলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে তার চেয়েও বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের সংবিধান রচনা বিষয়ে মতামতের জন্য ভারত, যুক্তরাজ্য সফরের নিন্দা করে, মাওলানা ভাসানীর হক কথাতে ‘সংবিধানের ভারত যাত্রা’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র লারমা সংসদে তাঁর আলোচনায় বলেন, শাসনতন্ত্র বিলের প্রতিটা ধারাই প্রমাণ দেয় যে, এক হাতে জনগণকে অধিকার দেওয়া হয়েছে, অন্যহাতে আবার সে অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার স্বীকৃতি দাবি করে তিনি বলেন, আমি সেই নির্যাতিত নিপীড়িত জাতিসত্তার একজন। আমরা বাংলাদেশের জনগণের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে বাঁচতে চাই। কিন্তু আমাদের দাবি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের। খসড়া সংবিধানে আমাদের জাতিসত্তার কথা নেই। একথা আমি শুধু আজ বলছি না ইয়াহিয়া আর আইয়ুবের আমলেও বলেছি। ৫৬ ও ৬২ সালের সংবিধানে জনগণের অধিকার স্বীকৃতি হয়নি। তাই জনগণ তা প্রত্যাখান করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান তৈরি করার সময় আমাদের তা মনে রাখতে হবে। সংবিধান এমন হতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ বংশধরেরা তাকে গ্রহণ করে।
এ প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ২৯ অক্টোবর প্রকাশিত বদরুদ্দীন উমরের চিরস্থায়ী জরুরি অবস্থার সংবিধান নামক নিবন্ধনে বলা হয়েছে : ‘শাসক শ্রেণী যে রাষ্ট্রের মৌলিক সবগুলো প্রতিষ্ঠানকেই বিপুল পরিমাণে অবিশ্বাস করে এই সংবিধান তারই ইঙ্গিতবহ এবং সংবিধানটি সংসদীয় সংখ্যাধিক্যের সাহায্যে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ জোগান দেয়। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এই ইঙ্গিত দেয় যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এমনকি সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাকেও নির্ভরযোগ্য শর্ত হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে না। ফলে এটাকে স্রেফ প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব একটা হাতিয়ার বানিয়ে ফেলা হয়েছে, যাকে শাসকগোষ্ঠীর একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অসীম ক্ষমতা চর্চা করার অধিকার দেওয়া হয়েছে, এই সংবিধান পরিষ্কারভাবেই অসংখ্য অভ্যন্তরীণ সংকটে জর্জরিত নয়, মোটা দাগে তারা অসংহত। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী দৃশ্যমান রয়েছেন সম্পূর্ণ ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার সবচে বড়শর্ত হিসাবে। এবং এ কারণেই অন্যদের নানা রকম আপত্তি সত্ত্বেও চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তারা তাদের আস্থা অন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উপর অর্পণ না করে তাঁর উপর স্থাপন করতেই বাধ্য। এবং এ কারণেই শাসকশ্রেণীর একনায়কত্ব একজন প্রধানমন্ত্রীর সংসদীয় স্বৈরতন্ত্রে পর্যবসিত হওয়ার দিকে যাচ্ছে, এক্ষেত্রে তা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বৈরতন্ত্র। সুনির্দিষ্টভাবে শেখ মুজিব একজন বেসামরিক ব্যক্তি বলেই প্রাথমিক পর্বেই এই স্বৈরতন্ত্র একটা সংসদীয় রূপ পরিগ্রহ করেছে। আগামীকাল যদি পরিস্থিতি বেসামরিক কর্তৃত্বের বাইরে চলে যায় এবং শাসকশ্রেণীর জন্য আরও খারাপ হয়ে ওঠে সংসদীয় ধরনটি রাষ্ট্রপতি ধরনের শাসন দিয়ে কিংবা আরও খারাপ কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপিত হতে পারে। এইসব জরুরি কারণবশতই এখানে একটা চিরস্থায়ী জরুরি অবস্থার পুর্বানুমান করা হয়েছে এবং সেই অনুমানের ভিত্তিতে শাসকগোষ্ঠীর জন্য একটি সংবিধানের কাঠামোর ভেতরে সকল ধরনের জরুরি ক্ষমতা অনুশীলনের বন্দোবস্ত করারই একটা প্রয়াস নেওয়া হয়েছে।’
১৯৭২ সালের অক্টোবরে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সভাপতি কমরেড সিরাজ সিকদারও এই সংবিধানের এবং সংবিধান প্রণয়নের অথরিটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং এর কঠোর সমালোচনা করেন। এভাবে কঠোর সমালোচনা করলেও, তারা সংবিধান প্রত্যাখ্যান করে, গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।
এবার আমাদের কথা
আমরাও মনে করি, পাক সামরিক দস্যু ইয়াহিয়ার অধীনে পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির ৫ দফায় মুচলেকা দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে গঠিত পরিষদের দ্বারা স্বাধীন দেশে সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, সে প্রশ্ন এখনো তোলা যায়। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সম্ভব হলে, এখনো বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের রাজনীতি হাজির করা যায়।
আমরা মনে করি, শোষণমূলক ও লুণ্ঠনমূলক উপনিবেশিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কাঠামো বজায় রাখার মূল দলিল বাহাত্তরের সংবিধানের বিপরীতে মেহনতী নরনারী ও ক্ষুদ্র জাতি সমূহের স্বার্থরক্ষক একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের জন্য সংবিধান সভার নির্বাচন জরুরি হয়ে পড়েছে।
বর্তমানের রাজনৈতিক সংকটকালে আমরা বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি সংবিধান পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি উত্থাপন করেছি। দাবি অনুযায়ী, বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশে দেশিয় শাসকশ্রেণি, সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও ধর্মীয় ফ্যাসীবাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি ধ্বংস করেই নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। নিন্মোক্ত কর্মসূচি সফল করবে। বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে আন্দোলনকারী সংস্থার প্রতিনিধিদের দিয়ে।
যে কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনে অনেকগুলো সংস্থা গড়ে ওঠে। যেমন স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকালে গড়ে উঠেছিল, শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ বা স্কপ, সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য, ১৭টি কৃষক সংগঠন, জাতীয় কবিতা পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। (যদিও এসব সংস্থার নেতারা পরবর্তিতে জনগণের বিপরীত শিবিরে অবস্থান নিয়েছেন।) একইভাবে বর্তমানে রাজনৈতিক আন্দোলনহীন দেশে এখনো আন্দোলনকারী সংস্থা হিসেবে তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর খনিজ সম্পদ রক্ষা আন্দোলন, সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলন চলমান রয়েছে। আমরা আশাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হলে জনগণের ভেতর থেকে আরো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সংস্থা গড়ে উঠবে, বাংলাদেশের আন্দোলনের ইতিহাস তাই বলে।
আমাদের দাবি অনুযায়ী, তার আগে বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। আন্দোলনের সমর্থক বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্টজনদের নিয়ে গণতান্ত্রিক নির্বাচন কশিমন গঠন করতে হবে। যে কমিশন শ্রমজীবী মানুষের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ তৈরি করে দেবে। ব্যক্তিগত ব্যয়ে প্রচারণা নিষিদ্ধ করে সকলের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সমান প্রচারণার ব্যবস্থা করবে। একজন মজুরের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জামানতের অর্থের পরিমান ঠিক করবে।
যে বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকার সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দাবি সমূহ বাস্তবায়নের আইনি স্বীকৃতি দেবে। যে বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকার নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান পরিষদের নির্বাচনের ভিত্তিতে মেহনতি জনগণের, নিপীড়িত নারী সমাজ ও ক্ষুদ্র জাতি সমূহের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রতিষ্ঠা করবে। নির্বাচিত পরিষদ একটি গণসংসদ গঠন করবে। সেই গণসংসদে নানা পেশার শ্রমজীবী মানুষ এবং বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব রাখার বিধান রাখবে। বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিন্মোক্ত কর্মসূচিসমূহ বাস্তবায়ন করবে।
অস্থায়ী বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্তৃব্য হলঃ-
১. আন্দোলনকারী সংস্থার প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংবিধান সভার নির্বাচন দিতে হবে।
২. ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বর্তমান নির্বাচন কমিশন ভেঙ্গে দিয়ে গণআন্দোলনের সমর্থক বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্টজনদের নিয়ে একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবে, যে কমিশন একজন মজুরের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জামানতের পরিমান নির্ধারণ করবে। সকল প্রার্থীকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রচারের সুযোগ দেবে। ব্যক্তিগত ও দলীয় প্রচার অতিশয় সীমিত করে দেওয়া হবে।
৩. তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করবে। যেখানে জনগণের সম্পদ আত্মসাৎকারী, দুর্নীতিবাজ দখলবাজ এবং অর্থ পাচারকারীদের বিচারকাজ শুরু করবে। একই সঙ্গে এদের দেশে বিদেশের যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, এদের ভোটাধিকার বাতিল ও নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করবে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
৪. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্তৃব্য হল, (ক) পরিবেশবান্ধব শিল্প কারখানা গড়ে তোলা, বন্ধ শিল্প কারখানার আধুনিকায়ন করা ও চালু করা, সকল বৃহৎ শিল্প কারখানা ব্যাংক বীমা জাতীয়করণ করা, ভূমি জাতীয়করণ করা, সমবায়ী কৃষি খামারীদের কাছে জমি লিজ প্রদান, সহজ শর্তে ঋণ ও আনুসঙ্গিক সুবিধা প্রদান করা, খাদ্য ব্যবসা, বৃহৎ ব্যবসা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা জাতীয়করণ করা। (খ) যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পাদিত সকল গোপন চুক্তি প্রকাশ করা। অমর্যাদাকর চুক্তি বাতিল করা, অভিন্ন নদীর পানির হিস্যার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হওয়া, সীমান্ত হত্যা ও চোরাচালান বন্ধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ, সৌদি যুদ্ধ জোট থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দেওয়া। (গ) ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ, নারীপুরুষের সমধিকার, সকল জাতি ও ভাষার সমধিকার, অবাধ মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রদান, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দাবিগুলোকে আইনি রূপ প্রদানের পদক্ষেপ গ্রহণ, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বিশেষ তহবিল গঠন করে ধর্মীয় অনুদানের অর্থ গ্রহণ। সেই অর্থ সমাজের মূলশ্রোত থেকে বিচ্যুত ও পশ্চাৎপদ অংশের হিতার্থে ব্যয়। (ঘ) বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও গুমের ঘটনায় শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ওই সব হত্যাকা-ের বিচারকাজ সম্পন্ন করা এবং নিখোঁজদের যারা জীবিত আছেন, তাদের স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। সামরিক বাহিনীতে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য হত্যা গুমের বিচার শুরু, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সেনা পাঠানো বন্ধ, কর্ণেল তাহেরের চিন্তা অনুযায়ী একটি উৎপাদনমুখী, গণমুখী আত্মমর্যাদাশীল চরিত্রের সেনাবাহিনী গঠন।
৫. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচিত পরিষদ একটি গণসংসদ গঠন করবে, যে গণসংসদ মেহনতী নরনারী, নিপীড়িত নারী সমাজ, ক্ষুদ্র জাতিসমূহের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচির ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করবে। ওই গণসংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদক্ষেপ সমূহ এগিয়ে নেবে। ওই গণসংসদেও একটি কক্ষে প্রবাসী সহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব করার বিধান রাখবে। মেহনতিদের গণসংসদ সকল নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে কিংবা নামমাত্র মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, খাদ্য, বাসস্থান, কাজের অধিকার ও বিনোদনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। জনবান্ধব ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের নতুন ধারা সূচনা করবে। সারাবিশ্বের মেহনতি নরনারী ও নিপীড়িত জাতিসমূহের লড়াইয়ের সঙ্গে ঐক্য সংহতি প্রতিষ্ঠা করবে। আত্মমর্যাদাশীল জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের সহযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশের উত্থানে নেতৃত্ব দেবে। সুখী সমৃদ্ধশালী একটি নতুন বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াবে।
মার্চ ১৫, ২০২১; ৬:০০ অপরাহ্ন
লেখাটি সময়োপযোগী। আন্দোলনরত শক্তিগুলোর সাথে লেখাটি নিয়ে আলোচনা মত বিনিময় দরকার। আন্দোলনের দিক নির্দেশনায় লেখাটি ভুমিকা রাখবে।