রাগ দমনঃ
এক শিষ্য জেন গুরু বাংকেই এর কাছে এসে নালিশ করল, “ গুরু, আমার মাথা গরম, রাগ সামলাতে পারি না। কীভাবে এর থেকে মুক্তি পাব?” শিষ্যের কথা শুনে গুরু বলল, “তোমার কথা খুব অদ্ভূত মনে হচ্ছে, দেখাও দেখি তোমার কেমন রাগ আছে।” শিষ্য বলল, “এখনই কীভাবে দেখাব?” “তাহলে কখন দেখাতে পারবে?”, জেন গুরু জানতে চাইল। “ রাগ হঠাৎ হঠাৎ চাড়া দেয়”, শিষ্য বলল। গুরু তখন বলল, “ তাহলে এটা তোমার সত্যিকারের প্রকৃতি নয়। যদি তা হত, তাহলে তুমি আমাকে যখন তখন তা দেখাতে পারতে। জন্মাবার সময় তোমার মাঝে এটা ছিল না, তোমার বাবা-মাও তোমাকে সেটা দেয়নি। ভাল করে ভেবে দেখ।”
দুনিয়াতে সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু কোনটিঃ
শোজান নামে এক চাইনীজ জেন গুরুর কাছে তার ছাত্র জানতে চাইল, “দুনিয়াতে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস কী?” গুরু জবাব দিল, “ একটা মরা বিড়ালের মাথা।” শিষ্য জানতে চাইল, “কেন মরা বিড়ালের মাথা দুনিয়ার সবচে মূল্যবান জিনিস?” গুরু জবাব দিল, “কারন কেউ এর মূল্য স্থির করতে পারেনি।”
সক্রেটিসের শপিং মলে ঘুরাঘুরিঃ
সক্রেটিস মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে জ্ঞানী মানুষেরা মিতব্যয়ী জীবন-যাপন করবেন। এজন্য তিনি জুতো পর্যন্ত পরতেন না,কিন্তু প্রায়শই তাকে বাজারে গিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী যাচাই করতে দেখা যেত। একদিন কোন এক বন্ধু জানতে চাইলে সক্রেটিস বলল, “আমি বাজারে গিয়ে দেখতে যাই, কত কত জিনিস আছে যেগুলো ছাড়াই আমি অনেক সুখি থাকতে পারি।”
জীবনে যা কিছু মূল্যবান তার জন্য পয়সা খরচ করতে হয় নাঃ
জাপানে একদল বয়স্ক ভদ্রলোক ছিলেন যারা চা-চক্রে বসে আড্ডা দিতেন, খবরাখবর বিনিময় করতেন। তাদের একটা নেশা ছিল দামী, দুষ্প্রাপ্য চা খুজে বের করে নতুন রেসিপি দিয়ে চা বানিয়ে তা পান করা। একদিন সভার সবচেয়ে বয়স্ক লোকটার অন্য সবাইকে আপ্যায়ন করার দায়িত্ব পড়ল।লোকটি তখন খুব আড়ম্বর সহকারে চা-পানের অনুষ্ঠান শুরু করল, হালকা ফুটন্ত পানিতে একটা সোনার পাত্র থেকে মেপে চা পাতা চাড়ল, তারপরে পরিমিত জ্বাল দিয়ে সবাইকে পরিবেশন করল। সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ, জানতে চাইল কীভাবে সে এমন সুস্বাদু চায়ের সন্ধান পেল? বয়স্ক ভদ্রলোক হেসে বলল, “ আপনার যে চা পান করলেন, সে চা আমার জমির কৃষকেরা পান করে। জীবনের সবচেয়ে ভাল জিনিসগুলোর দাম বেশি হয় না অথবা তাদের তেমন খোঁজাখুজিও করতে হয় না।” “The finest things in life are neither costly nor hard to find.”
কীভাবে ধনী হওয়া যায়ঃ
বিখ্যাত বৌদ্ধ সাধু নাগার্জুন একটা নেংটী পরে ঘুরে বেড়াতেন। একবার তার শিষ্য এক রাজা তাকে একটা সোনার বাটি উপহার দেন, নাগার্জুন সে বাটি নিয়ে ভিক্ষা করতেন। একদিন এক প্রাচীন মন্দিরের ভগ্নাবশেষের পাশে শোয়ার সময় নাগার্জুন দেখতে পেলেন পাশেই এক চোর ঘুরাঘুরি করছে। নাগার্জুন তাকে ডেকে বললেন, “এটা নিয়ে যাও, তাহলে তুমি আমাকে আর রাতের ঘুমের সময় ডিস্টার্ব করবে না।” চোর তখন দ্রুত তার হাত থেকে বাটি নিয়ে উধাও হল। কিন্তু পরদিন সকালে সে আবার হাজির হয়ে নাগার্জুনকে বলল, “গতরাতে তুমি যখন আমাকে এত সহজে বাটিটা দিয়ে দিলে তখন আমার নিজেকে খুব গরীব মনে হয়েছে। আমাকে শিখাও কীভাবে তুমি নিজেকে এত ধনবান বানালে যাতে এত সহজে দামী সোনার বাটি দিয়ে দেয়া সম্ভব হয়।”
মৃত্যু অবশ্যম্ভাবীঃ
এক শিষ্য পরিষ্কার করার সময় তার জেন গুরুর পছন্দের মূল্যবান চায়ের পেয়ালাটা ভেঙ্গে ফেলে। ভয় পেয়ে সে তখন গুরুর কাছে জানতে চায়, “ গুরু, মৃত্যু কেন অবশ্যম্ভাবী?” শিষ্যের প্রশ্ন শুনে গুরু জবাবে বলে, “ মৃত্যু প্রকৃতির বিধান। সব মানুষ এবং বস্তুর জীবনে মৃত্যুর থাবা নেমে আসবে, জগতে কোন কিছুই অনিত্য নয়। মৃত্যুকে তাই ভয় পাওয়া উচিত নয়, অথবা মৃত্যুর প্রতি রাগ থাকাও ঠিক না। কিন্তু হঠাৎ মৃত্যু নিয়ে তোমার এ প্রশ্নের কারণ কী?” শিষ্য বলল, “ গুরু, কারণ মৃত্যু আপনার পছন্দের পেয়ালার উপর থাবা বসিয়েছে।” 😛
লোক দেখানো উপাসনাঃ
একদিন হাসান বসরী নদীর পাশ দিয়ে যাবার সময় তাপসী রাবেয়াকে দেখতে পেলেন। হাসান তখন নদীর পানিতে তার প্রার্থনার মাদুর বিছিয়ে বললেন, “রাবেয়া আসো, আমরা একসাথে প্রার্থনা করি।” রাবেয়া বলল, “হাসান,তুমি কেন বাজারের বিক্রেতার মত আচরণ করছ? তোমার দূর্বলতার কারণে এ কাজ করছ।” এটুকু বলেই রাবেয়া তার মাদুরটা শূন্যে বিছিয়ে তাতে চড়ে বসলেন, তারপর হাসানকে ডেকে বললেন, “ হাসান, এখানে ওঠে আসো, তাহলে মানুষ আমাদের ভাল দেখতে পাবে।” কিন্তু হাসানের তা করার ক্ষমতা ছিল না, তাই সে নীরব হয়ে রইল। রাবেয়া তখন বলল, “ হাসান, তুমি যা করলে একটা মাছ সেটা করতে পারে, আর আমি যা করলাম একটা মাছিও সেটা করতে পারে। আসল কাজ হচ্ছে এসব কিছুর বাইরে, আমাদের সেদিকে মনোনিবেশ করা দরকার।”
আসল শক্তিশালীঃ
একবার আঙ্গুলিমাল নামে এক ডাকাত বুদ্ধকে জীবননাশের হুমকি দিল। বুদ্ধ তখন তাকে বলল, “ মারার আগে আমার শেষ ইচ্ছা পূরণ কর, ঐ গাছের ডালটা কেটে ফেল।” বলা মাত্র ডাকাত তরবারির কোপে গাছের ডাল কেটে ফেলল। “এবারে কী”, ডাকাত জানতে চাইল। বুদ্ধ তাকে ডালটা আবার জোড়া দিতে বলল। ডাকাত অট্টহাসি দিয়ে বলল, “ তুমি একটা পাগল,এটা কী কেউ করতে পারে।” বুদ্ধ তখন বলল, “ আমি না, আসলে তুমিই পাগল। তুমি নিজেকে শক্তিশালী ভাবছ কারণ তুমি মানুষের ধ্বংস এবং মৃত্যু ডেকে আনতে পারো। ওটা তো শিশুদের কাজ। আসল শক্তিশালী হলো যে সৃষ্টি এবং নিরাময় করতে পারে।”
প্রতিবেশীর সাথে ব্যবহারঃ
এক কৃষকের ভুট্টা রাজ্যের মেলায় সবসময় প্রথম পুরষ্কার পায়। কৃষক সবসময় তার ফসলের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বীজগুলো তার প্রতিবেশী কৃষকদের সাথে শেয়ার করে। কেন সে এটা করে জানতে চাইলে কৃষক জবাব দিল, “এটা আসলে আমার নিজের স্বার্থেই করি। বাতাসে পরাগরেণু উড়ে এক ক্ষেত থেকে আরেক ক্ষেতে যায়। তাই আমার প্রতিবেশীরা যদি খারাপ জাতের ভুট্টা চাষ কওরে তাহলে সেটা পরাগায়নের মাধ্যমে আমার ভুট্টার জাতকে নষ্ট করে ফেলবে। এই কারণে আমি চাই আমার প্রতিবেশীরা যেন সবচেয়ে ভাল জাতের বীজ চাষ করে।”
নীরবতা হিরন্ময়ঃ
এক দার্শনিক বুদ্ধের কাছে জানতে চাইল, “ তুমি কী আমাকে কোন শব্দ ছাড়া, নৈঃশব্দ ছাড়া সত্য সম্পর্কে বলতে পারবে?” বুদ্ধ নীরব হয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পরে দার্শনিক বুদ্ধকে কুর্ণিশ কওরে বলল, “আপনার মহানুভবতায় আমার বিভ্রম কাটল এবং আমি সত্যের পথে প্রবেশ করলাম।” দার্শনিক চলে যাবার পরে আনন্দ বুদ্ধের কাছে জানতে চাইল, লোকটা কী বুঝল? বুদ্ধ জবাব দিলেন, “ একটা ভাল ঘোড়া চাবুকের ছায়া দেখলেও দৌড় দিতে শুরু করে।”
লক্ষ্য আসলে লক্ষ্য নয়ঃ
এক তীরন্দাজ বিদ্যার স্কুলে একই সাথে জীবন দর্শন সম্বন্ধেও শিক্ষা দেয়া হয়। একদিন স্থানীয় প্রতিযোগিতায় স্কুলের সেরা ছাত্রটি পরপর তিনবার লক্ষ্যভেদ করায় শহরের সবাই তাকে এবং স্কুলের মাস্টারকে ভূয়সী প্রশংসা করতে থাকে। মাস্টার কিন্তু তাতে তেমন খুশি হয় না, এমনকী তার মধ্যে কিছুটা সমালোচনার ভাব দেখা যায়। পরে ছাত্রটি যখন তার কাছে এর কারণ জানতে চায়,তখন ওস্তাদ বলে, “ তোমাকে এখনও শিখতে হবে যে লক্ষ্য আসলে লক্ষ্য নয়।”
সব দিনই ভাল দিনঃ
এক পথিক রাখাল বালকের কাছে জানতে চাইল, “ আজকে আবহাওয়া কেমন হবে বলে মনে হয়?” রাখাল বালক বলল, “ আমি যেমনটা পছন্দ করি, ঠিক সেরকম।”
পথিকঃ “তুমি কীভাবে জানো যে আবহাওয়া তোমার মনের মত হবে?”
রাখালঃ “ অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখেছি, আমি সবসময় যা চাই তা পাই না। তাই আমি যা পাই তাকে পছন্দ করতে শিখেছি। তাই আমি নিশ্চিত আমি যেরকম পছন্দ করি
আমরা সেরকম আবহাওয়াই পাব।”
সেবাধর্ম যখন প্রকৃতিঃ
দুই সন্ন্যাসী নদীর তীরে কাপড় পরিষ্কার করছিল তখন তারা একটা বিছেকে ডুবে যেতে দেখল। এক সন্ন্যাসী তৎক্ষণাত তার বাটি দিয়ে তুলে তাকে ডাঙ্গায় ছেড়ে দিল। এ কাজ করার সময় বিছেটা তাকে দংশন করল। সন্ন্যাসী আবার তার কাপড় ধোয়ায় মন দিল,এবং বিছেটে আবারো পানিতে পড়ে ডুবতে লাগল। সন্ন্যাসীটি আবারো তাকে উদ্ধার করল, এবং উদ্ধার প্রক্রিয়ায় আবারো দংশিত হল। অন্য সন্ন্যাসীটি তখন বলল, “ বন্ধু,তুমি কেন বিছেটাকে বারবার উদ্ধার করছ আর তার কামড় খাচ্ছ, তুমি তো জানই যে বিছের স্বভাবই হল কামড়ানো? “ কারণ আমার স্বভাব হলো উদ্ধার করা”, সন্ন্যাসী জবাব দিল।
ঠুনকো ঐতিহ্যঃ
এক আশ্রমে গুরু এবং তার শিষ্যরা যখন সান্ধ্যকালীন ধ্যান শুরু করে তখন সেখানে আশ্রিত বিড়াল খুব শব্দ করায় তাদের ধ্যানের ব্যাঘাত ঘটে। গুরু তাই নির্দেশ দিলেন, সন্ধ্যার প্রার্থনার সময়টা বিড়ালটাকে বেঁধে রাখতে হবে। অনেক বছর পরে গুরু মারা যাবার পরেও সন্ধ্যার সময় বিড়ালটাকে বেঁধে রাখা হত। একসময় বিড়ালটা মারা গেলে আরেকটা বিড়াল এনে সন্ধ্যার সময় তাকে বেঁধে রাখা হয়। কয়েক শতাব্দী পরে ঐ গুরু বিজ্ঞ অনুসারী শিষ্যরা ‘সন্ধ্যার ধ্যানের সময় বিড়াল বেঁধে রাখার আধ্যাত্মিক গুরুত্ব’ নিয়ে জ্ঞানগর্ভ অভিসন্দর্ভ রচনা করে ফেলেছেন। এভাবেই ঐতিহ্যের সৃষ্টি হয়।