দেশভাগের মতো রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ বাসন্তী রানী বুঝতোনা। তবুও বাসন্তী রানী ৪৭ এর দেশভাগ দেখেছে। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন অনেককেই বাপ-দাদার ভিটেমাটি, যত্নে গড়া ফসলের ক্ষেত, পরিচিত গ্রাম, দেশকে ছেড়ে নিরুদ্দেশ হতে দেখেছে। যে কর্তামা আর কর্তা বাবা এতদিন এতগুলো মানুষের মাথার উপর বটগাছের মতো ছায়া হয়ে থেকেছে, সেই কর্তামা-কর্তা বাবাও তাদের বিশাল জমিদারী, রংমহল, বাগানবাড়ি, কাছারি পুষ্করিণী আর সন্তান স্নেহে আগলে রাখা প্রজাদের ফেলে নিরুদ্দেশ হয়েছে। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনরা বাসন্তী রানী আর তার স্বামীকে তাদের নিরুদ্দেশ যাত্রার সঙ্গী করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে, বারবার বুঝাতে চেয়েছে, এ দেশ এখন আর বাসন্তী রানীদের নেই।
কিন্তু শত অনুনয়ও বাসন্তী আর দীনেশকে তাদের ভিটে থেকে এক চুলও নড়াতে পারে নি। ছোট্ট শিশু যেমন তাদের খেলার পুতুলকে আগলে রাখে, বাসন্তী রানী আর তার স্বামীও তাদের ভিটে-মাটি, ফসলের ক্ষেত, গোয়ালের গরু আর সাধের সংসারটাকে আকঁড়ে ধরে পড়ে থেকেছে এই বাঙলায়। কোথাও যায়নি চেনা গ্রামটাকে ছেড়ে।
চেনা মানুষগুলোকে হারিয়ে পুরো গ্রামটা কেমন জানি স্তব্ধ হয়ে যায়। একদিন কোথা থেকে দলবলসহ এক লোক লাঠিসোঁটা, বন্দুক ও অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে কর্তামাদের রংমহলটা দখল করে নেয়। কেউ বাধা দেওয়ারও আর সাহস পায় না। এরপর আস্তে আস্তে গ্রামে আরও কতগুলো পরিবার আসে। তারা বাসন্তী রানীর পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনদের ফেলে যাওয়া ঘরগুলোতে আশ্রয় নেয়। দিন যায়। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু শান্ত হতে থাকে। মাটি আকঁড়ে পরে থাকা হিন্দু পরিবার আর নতুন আসা মুসলিম পরিবারগুলোর মধ্যে বেশ ভালই সখ্য গড়ে উঠে। সকাল সন্ধ্যায় মন্দির, মসজিদ থেকে ঢাক-ঢোল, উলুধ্বনি আর আজানের শব্দ ভেসে আসতে শোনা যায়। বিপদে আপদে কে রাম, কে রহিম কাউকেই আলাদা করে চেনার উপায় থাকে না।
বিয়ের প্রায় দেড়-যুগেরও বেশী সময় অপেক্ষার পর বাসন্তী রানী দুই সন্তানের মা হোন। এরমধ্যে বাসন্তী রানীদের দেশে আরও কতো ঘটনা ঘটে যায়। ৫২ তে বাসন্তী রানীদের মার্তৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে তরতাজা প্রাণোচ্ছল যুবকেরা বুকের রক্ত ঢেলে দেয়, ৫৪ তে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৫৬ তে শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ৬২ তে শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ তে ছয়দফা আন্দোলন, ৬৯ এ গণ অভ্যুথ্থান…
কিন্তু বাসন্তী রানীদের গ্রামের কোন হিন্দুকে আর ভিটেমাটি ছাড়ার প্রয়োজন পড়েনি। অজপাড়া গাঁয়ের খেঁটে খাওয়া মানুষদের জীবনে সেসব ঘটনা বড় ধরনের কোন প্রভাবও ফেলে না। ফসলের ক্ষেতে কাজ করতে করতেই খেঁটে খাওয়ায় ব্যস্ত মানুষগুলো দেশ, রাজনীতি নিয়ে আলোচনা, সমালোচনায় মেতে উঠে।
কিন্তু তাদের আর সুখ-দুঃখ, ফসলের ক্ষেত, সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকা হয়ে উঠে না। কারণ ততোদিনে দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য, নিজ দেশে মুক্তভাবে প্রাণ খুলে বাঁচার জন্য, এক অপশক্তির কালো ছায়া থেকে দেশমাতাকে মুক্ত করার জন্য লড়াই শুরু করে দিয়েছে। গ্রামে খবর আসে, পাকিস্তানি মিলিটারিরা শহরের পর শহর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই গুলি করে মারছে, মেয়ে-বউদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করছে হিন্দু এলাকাগুলোতে। মুসলিমদেরতো তাও ছাড় দিচ্ছে, কিন্তু হিন্দু যাকে পাচ্ছে তাকেই নাকি গুলি করে মারছে। বাঁচতে হলে দেশ ছেড়ে পালানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
একদিন মিলিটারিরা বাসন্তী রানীদের গ্রামেরও খোঁজ পায়। যে লোকটা দলবল নিয়ে রংমহলের দখল নিয়েছিল সেই লোকটাই মিলিটারিদের গ্রামে নিয়ে আসে, মিলিটারিদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে। তাদের নারীসঙ্গদানের সবরকম বন্দোবস্তও করে রংমহলের দখলদার সেই মানুষ।
যেদিন প্রথম মিলিটারিরা শীল পাড়ায় আক্রমণ করলো তখন বলরামের মা তার ছয়মাসের বাচ্চাটাকে ঘরে ঘুম পাড়িয়ে রেখে সবেমাত্র হেটলুদের কুয়া থেকে পানি আনতে গেছে। মিলিটারিদের বুটের আওয়াজ শোনা মাত্রই সারা পাড়া ফাঁকা হয়ে যায়। কেউ পাশের বাঁশঝাড়ে, কেউ আনু মোড়লের পাট ক্ষেতে, কেউ সুতিয়া নদীতে কচুরিপানার নিচে গলা ডুবিয়ে, যে যেখানে সম্ভব সেখানেই লুকিয়ে পড়ে। মাটি আর শণের ঘরগুলো ঠায় দাড়িয়ে থাকে শুধু। মিলিটারিরা সারা পাড়া তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাউকে পায় না। শুধু বলরামদের ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। মিলিটারিরা সেদিন তাদের আক্রোশের সবটা ঢেলেছিল ছোট্ট শিশুটার উপরে। ছোট্ট শিশুটাকে আছড়ে মেরেছিল সেদিন হৃদয়হীন পাষণ্ডগুলো। তারপর আগুনের লেলিহান শিখা সবকিছু গ্রাস করে নেয় মুহুর্তেই। সেই আগুনে পুড়ে মরে পালিয়ে যেতে অক্ষম নব্বইউর্ধ্ব বয়সী কল্পনার মার শাশুড়ি।
তারপর থেকেই মিলিটারির ভয়ে বাসন্তী রানীসহ গ্রামের সব হিন্দু নারীরা ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে একটু ভর্তা ভাত রান্না করে স্বামী, সন্তানদের খাইয়ে আর নিজেও মুখে দুই-চার গ্রাস দিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে কোন প্রতিবেশী মুসলিম বাড়িতে লুকানোর জন্য জায়গা খুঁজতে বের হয়ে যায়। মুসলিম বাড়িগুলো সবসময়ই পাড়ার হিন্দু মেয়ে, বউ আর বাচ্চায় গিজগিজ করতে থাকে। যেদিন কোথাও লুকানোর যায়গা হয় না, সেদিন ভুট্টা নাহয় পাট ক্ষেতগুলোই হয় শেষ আশ্রয়স্থল। গ্রামের অন্য হিন্দু মেয়ে বউরাও লুকানোর জন্য ভুট্টা আর পাট ক্ষেতগুলোকে বেছে নেয়। বাড়িতে থাকে শুধু পুরুষরা। দুবেলা দু’মুঠো খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য শত ঝুঁকি সত্ত্বেও তাদের বাড়িতেই থাকতে হয়, মাঠে যেতে হয়।
সেদিনের পর থেকেই বাসন্তী রানীদের গ্রামসহ আশেপাশের সব গ্রামেই রোজ মিলিটারিদের তাণ্ডব আর ধ্বংসলীলা চলতে থাকে। তাদের অভিযোগ- গ্রামের ছেলেপেলেরা মিলে নাকি মিলিটারিদের গ্রামছাড়া, দেশছাড়া করার জন্য মুক্তিবাহিনী তৈরি করেছে। তাদের ধরার জন্য পাকিস্তানী আর তাদের এদেশীয় দোসররা দিনরাত এক করে ফেলছে।
বাসন্তী রানী ভয় আর স্বামীর জন্য রাজ্যের দুঃচিন্তা নিয়ে পাটক্ষেতের মাঝখানটায় বসে থাকে। পাশের রাস্তা দিয়েই মিলিটারিদের বুটের আওয়াজ শোনা যায়। ছয় বছরের অবুঝ মেয়েটা বার বার জল চাইতে থাকে। মেয়ের তৃষ্ণা মেটানো আর ছেলেটার কান্না থামানোর জন্য দুই স্তন দুই অবুঝ শিশুর মুখে গুঁজে দিয়ে অসহায় বাসন্তী রানী এক অসাম্প্রদায়িক, স্বাধীন দেশের অপেক্ষায় ঠায় বসে থাকে। আজ জ্বেলে পাড়ার ঘরগুলো জ্বলছে। কালো ধোঁয়া আকাশটাকে ছেয়ে ফেলেছে।
বাসন্তী রানীদের বাড়ীতেও মিলিটারিরা আসে। দিনেশ তখন গোয়ালে রাখা গরু দুটোর জন্য খড় কাটছিল। তারা ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতে উদ্যত হয়, দিনেশকে লক্ষ্য করে রাইফেল তাক করে। হিন্দু না মুসলিম জানতে চায়। সূরা, কলেমা পড়তে বলে। দিনেশ বুঝতে পারে আর রেহাই নেই, শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে। ঠিক তখনই কোথা থেকে দেবদুতের মতো হেটলু দৌড়ে এসে বলে,
: সাব, ইসে মাত মারিয়ে সাব, ইয়ে হামারা আদমি হ্যায়।
: লেকিন হামনে ত সুনা ইয়ে হিন্দুকা বাচ্চা হ্যায়।
: সায়দ কিসিনে আপকো ঝুট বাতায়া সাব। ইয়ে সাচ্চা মুসলিম হ্যায় সাব। হামারা একিন কিজিয়ে।
মিলিটারিরা চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সারা বাড়িতে হিন্দুয়ানীর চিহ্ন খোজে। দিনেশ হয়তো আগে থেকেই এইদিনটার কথা কিছু আন্দাজ করতে পেরেছিল, তাই সে অনেক আগেই উঠানের এক কোণে বাসন্তীর যত্নে লাগানো তুলসী গাছটা উপড়ে ফেলেছিল, তুলসীর বেদীটাও ভেঙে ফেলেছিল যাতে দেখে বুঝা না যায় এখানে হিন্দুয়ানী চিহ্ন বহন করা একটা গাছ কখনো ছিল। কোথাও কিছু না পেয়ে হেটলুর কথাই মেনে নেয় তারা। কারণ হেটলু বিশ্বাসযোগ্য মানুষ, পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়ে, মসজিদে আজান দেয়। মিলিটারিরা চলে যায়, কিন্তু যাওয়ার সময় গোয়ালে বেঁধে রাখা দিনেশের গরুটা রাতের খাবারের জন্য নিয়ে যায়। দিনেশ তাদের প্রস্থানের পথে একদৃষ্টে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না তার।
একসময় গুলির শব্দ থামে, আগুনের লেলিহান শিখা সব কিছু জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে শান্ত হয়। নয় মাস একনাগারে আকাশে উড়াউড়ির পর শকুনের পাখনাতেও ক্লান্তি আসে। যুদ্ধ থামে। স্বাধীন দেশের বাতাস থেকে লাশের গন্ধ আস্তে আস্তে মুছে যেতে থাকে। বাসন্তী রানীদের আর মুসলিম প্রতিবেশীদের বাড়ীতে লুকানোর প্রয়োজন পড়েনা। লণ্ডভণ্ড করে ফেলে রেখে যাওয়া সাধের সংসারকে আবারও গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পরে মানুষগুলো।
সময় অতিবাহিত হতে থাকে। বাসন্তী রানীর ছেলে-মেয়ে, নাতী-নাতনীরা এখন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ স্বাধীন রাষ্ট্রে বাস করে। এখন আর বহিরাগত কেউ এদেশে এসে এদেশের মানুষের কোন ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করতে পারে না। কিন্তু এদেশের চেনা মানুষগুলোই সময়ের সাথে সাথে কেমন যেন বদলে গেল। হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে আগের সেই সৌহার্দ্য সম্প্রীতি আর নেই। যে আনিস দুর্গাপূজার সময় চাঁদা তুলে দিতো, ঢাকের তালে ধুনুচি নাচ নাচতো, কীর্তনের সময় এসে প্যান্ডেল বেধে দিতো সেই আনিসের বংশধররাই ঢাক বাজানোর অপরাধে এসে মন্দির গুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে নিয়মিতই।
যুদ্ধের সময় যে রতন মিয়ার ঘরে দিনের পর দিন হিন্দুরা নিশ্চিন্তে লুকিয়ে থেকেছে সেই রতন মিয়ার নাতিরাই এখন হিন্দুদের বসতবাড়িতে এসে ভিটে বাড়ি খালি করার হুকুম দেয়। যে হেটলু দিনেশের ঘরটাকে ছাই হওয়া থেকে রক্ষা করেছিল, দিনেশকে মৃত্যুর মুখ থেকে ছিনিয়ে এনেছিল সেই হেটলুর ছেলেরাই এখন বাড়িতে এসে আগুন দিয়ে যায়।
একাত্তরের শত্রুগুলো অচেনা, অজানা দেশের হলেও বর্তমানে ‘অসাম্প্রদায়িক’ দেশে আপন মানুষগুলো চেনা রূপ ছেড়ে অচেনা এক ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। এখনকার মানুষগুলো আগের চেয়েও অনেক বেশি ধার্মিক। কথায় কথায় তাদের ধর্ম নষ্ট হয়, ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে। তাই এখন বাসন্তী রানীর উত্তরসূরীদের বাড়ি-ঘর জ্বালাও পোড়াও, ভিটেমাটি ছাড়া, দেশ ছাড়া না করলে তাদের ধর্মকে রক্ষা করা যায় না। এখন আর আগেরমতো মন্দির থেকে ঢাক-ঢোল, শঙ্খ আর উলুধ্বনির আওয়াজও আসে না।
একসময় গ্রামের সব হিন্দু-মুসলিমরা মিলে বড় মাঠের পাশের পরিত্যক্ত এক হিন্দুর জমিতে যে মসজিদটা নির্মাণ করেছিল এখন সেই মসজিদের মাইক থেকেই কয়েকদিন পর পর হিন্দুদের মন্দিরে হামলা করার হুকুম দেওয়া হয়। বড় মাঠের ইজতেমাতে হুজুরেরা বয়ান দেন হিন্দুরা অভিশপ্ত, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা হারাম, তাদের হাতের খাবার খাওয়া হারাম, তাদের পূজায় যাওয়া শিরক। হিন্দুদের মেয়ে, বউরা গণিমতের মাল। হিন্দু নারীদের ধর্ষণ করা বৈধ, মন্দির আর মূর্তি ভাঙা সোয়াবের কাজ, বেহেস্ত লাভের সহজ উপায়। যে যত বেশি মূর্তি ভাঙতে পারবে তার ততো বেশি গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে, তার সোয়াবের ভান্ডার ততো বৃদ্ধি পাবে, সে ততো সহজে বেহেস্তে প্রবেশ করতে পারবে। মুসলমানরা এখন সোয়াব কামাই করা নিয়েই বেশি ব্যস্ত। মানবতা এখন আর তাদের মনকে স্পর্শ করে না। সবাই এখন কাল্পনিক বেহেস্ত লাভের জন্য পৃথিবী আর পৃথিবীর মানুষের জীবনকে নরকে পরিণত করে চলেছে।
বিশ্বায়নের এই যুগে লুকোনোর জন্য এখন আর আনু মোড়লের পাট বা ভুট্টা ক্ষেত নেই। শিলবাড়ির পেছনের সেই বাঁশঝাড়টাও নেই, বাড়িতে লুকিয়ে রাখার জন্য রতন মিয়া, আনু মোড়ল, হেটলু এদের কেউই আর বেঁচে নেই। সুতিয়া নদীও এখন মরা গাঙ, বর্ষাকালেও তাতে কোমর সমান পানি জমে কিনা সন্দেহ।
স্বাধীন দেশে বাস করেও আজ তারা পরাধীন। চেনা গ্রাম, চেনা মানুষ, চেনা দেশ সবকিছুই এখন অচেনা। অচেনা দেশ, অচেনা মানুষ ছেড়ে বাসন্তী রানীর উত্তরসূরীদের চেনা দেশের খোঁজে নিরুদ্দেশ হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। বারবার লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া ঘর, সংসার গোছাতে গোছাতে তারা আজ ভীষণ ক্লান্ত। বাসন্তী রানীরা শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পরাধীন দেশকে ফেলে কোথাও যায় নি, কিন্তু তাদের উত্তরসূরিদের স্বাধীন দেশকে ফেলেও যেতে হয়। কারণ তারা সংখ্যালঘু, কাফের, মালাউন।
বাসন্তী রানীদের গ্রামের নামের শেষে এখনো হিন্দুপল্লী শব্দটা আছে, একদিন সেটাও হয়তো আর থাকবেনা। তখন হয়তো নাম পাল্টে হয়ে যাবে মদিনাপল্লী। হিন্দুয়ানী কোন চিহ্নই তারা আর রাখবে না। ওসব যে দোজখের আগুনে পোড়ানো নিশ্চিত করে। সংখ্যাগরিষ্ঠদের এখন শুধুই বেহেস্ত চাই। আর তার জন্য সংখ্যালঘুদের কোন চিহ্নই এদেশে রাখা যাবে না। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী, উপজাতি কেউই আর এদেশের নাগরিক মর্যাদা ও অধিকার পাবে না। কারণ এই দেশটা এখন শুধুই মুসলমানদের, আর কারুর নয়।