৮১৪ বার পঠিত
রবীন্দ্র রেজিমের বিরুদ্ধে অসম্ভব এক প্রতিবাদের নাম রোদ্দুর রায়। অসম্ভব বললাম এই কারণে যে, এর পূর্বে নতজানু সাহিত্যজনরা এমন সাহস করে উঠতে পারেননি। অনেকে ফেনিয়ে ওঠা প্রশ্ন সাথে ক্ষোভ বুকেই চাপা দিয়েছেন। সে অর্থে রবীন্দ্রনাথ মূলত সাহিত্যে ফ্যাসিজমের একটি নাম। কেউ তার সমালোচনা করতে পারবে না। করলেই তার ভক্ত অনুরাগীরা হামলে পড়বেন। বিশেষ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে কথা বললে দেশদ্রোহীতার আখ্যাও জুটতে পারে বিরোধীদের কপালে। অথচ বিশ্বকবি হিসেবে বিশেষণ ভূষিত রবীন্দ্রনাথের সাথে দেশ বা তার দ্রোহীতার কী সম্পর্ক তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। হতে পারে দু’দেশেরই জাতীয় সঙ্গীত তার লেখা ও সুরে সেজন্য এমনটা বলা হয়। এটা খুবই খোঁড়া যুক্তি। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গেয়ে ভূপেন হাজারিকা বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। শিল্প আর ব্যক্তির বিভেদটা যারা না বোঝেন তারাই এ বিষয়টা নিয়ে গোল বাধান। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গীত হয় মানুষদের যারা নিপীড়িত তাদের জন্যই, ভূপেন হাজারিকার জন্য নয়। ভূপেন হাজারিকা বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন, কিন্তু তার গাওয়া গান তো আর বিজেপির হয়ে যাচ্ছে না।
যেমন বাংলাদেশে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির দলীয় সঙ্গীত ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ’। গানটির কথাগুলো কি বিএনপির লেখা? যে গাইবে সে কি বিএনপির হয়ে যাবে? এটা গাওয়া কি দোষের? এমন প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে তো মহামুশকিল। কী মুশকিল দেখুন, প্রথম বাংলাদেশ, শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ, মরণ বাংলাদেশ- এরচেয়ে বড় দেশপ্রেমের কথা আর কী হতে পারে? এ কথাগুলো যদি শুধু বিএনপির অধিকারে দিয়ে দেন তাহলে অন্যের আর কী থাকে! সুতরাং কর্মের সাথে ব্যক্তি বা দল মিলিয়ে ফেললে ‘তালেগোলে হরিবল’ অবস্থা দাঁড়াবে। যেখানে দেশপ্রেমের অস্তিত্বটাই হারিয়ে যাবে।
যাকগে রবীন্দ্র রেজিম বা ফ্যাসিজম বিষয়ে আসি। আমার সাথে দুই বাংলার বেশ কিছু খ্যাত সাহিত্যজনের কথা-পরিচয় রয়েছে। তাদের অনেকের কাছেই রবীন্দ্রনাথ রীতিমত ঈশ্বরের পর্যায়ের। যেমন ফুটবলে ম্যারাডোনা। জেলে বসে মাফিয়াদের সাথে মদ-মেয়ে-জুয়া সহযোগে মজমা বসানোর পরও যে ম্যারাডোনা ‘ঈশ্বর’ অভিধায় অভিসিক্ত হন! অনেকে তাকে নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য নিবেদিত বলেও আখ্যা-ব্যাখ্যা দেন। সেই আখ্যা-ব্যাখ্যা কারণ হলো, চে আর ক্যাস্ত্রোর ট্যাটু আছে তার শরীরে। জেলে বসে ফুর্তি করা মানুষ যদি ট্যাটু বা ক্যাস্ত্রোর সাথে কথা বলার সুবাদে মুক্তির দূত হয়ে যান তবে তো মুশকিল। সেই সুবাদে আমাদের দেশের রাজাকারদের অনেককেই তেমন আখ্যায় আখ্যায়িত করা সম্ভব। সূত্র তো একই নাকি?
ধুর, আবার বিষয় থেকে সরে গেলাম। অবস্থা হয়েছে এমন, রবীন্দ্রনাথ ধরণের ‘ঈশ্বর’ সমতুল্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে অন্যরা প্রথম আলো’র ভাষায় ‘ভালোর সাথে আলো’ জাতীয় আলাপ শুরু করেন। আমাদের ক্ষেত্রে হয় উল্টোটা। ভালোর আলাপ তুলতে গেলে আগে কালোটা মনে জাগে। যেমন রবীন্দ্রনাথকে যখন অসাম্প্রদায়িক বলা হয়, তখন তার শিবাজী বন্দনা’র যবন নিধন ইচ্ছা মনে জাগে। তাকে যখন ধর্মের উপরে তুলে আনা হয়, তখন তার শক্তিময়ী মা’কে নিবেদন করা সকল গান-কবিতা কানে বাজে। ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে যখন মানবদরদী বলে পুজো দেয়া হয়, তখন তার পারিবারিক নীলচাষ থেকে শুরু করে বেশ্যাবাড়ির ব্যবসা পর্যন্ত স্মৃতিতে জাগরুক হয়। ভেসে ওঠে অত্যাচারিত রায়ত-প্রজাদের সন্ত্রস্ত মুখ।
বাংলা সাহিত্যে ফ্যাসিস্ট অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে। যার শুরুটা রবীন্দ্রনাথ নিজেই করে গিয়েছিলেন। একদিকে জমিদার তারোপর বৃটিশ লবি, সব মিলিয়ে তাকে একটা জায়গায় তখনই দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছিলো। তাকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছিলো এক সাহিত্য বিধ্বংসী কাল্টের। যে কাল্টের সীমারেখা হলো রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত। তাকে ডিঙিয়ে যাবার সাধ্য কারো নেই। শুধু তাই নয়, তাকে সমালোচনার সাধ এবং সাধ্য দুটোকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেই কাল্টের নিয়মে। সেই কাল্ট আর নষ্ট রেজিমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলেন রোদ্দুর রায়।
কাল্ট ব্যাপারটার সোজা ব্যাখ্যা হলো, এমন গোষ্ঠী, যারা মানসিকভাবে অন্ধ, গোষ্ঠী প্রধানের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে দ্বিধাহীন। খ্রিস্টান ধর্মালম্বীরা কাল্ট এর একটি সংজ্ঞায় বলেছিলো, কোনো ব্যক্তি বিশেষ নির্ভর মতবাদে বিশ্বাসী সম্প্রদায় হলো কাল্ট। ব্যাখ্যাটা এমন, ‘এ ধরনের কাল্টের অনুসারীরা কোনো মানুষকে ঈশ্বরের সমতুল্য হিসাবে আরাধনা করে।’ মিলিয়ে দেখুন তো রবীন্দ্রভক্তির সাথে এ সংজ্ঞা এবং ব্যাখ্যা মিলে যায় কিনা। না মিললে কেনো বলা হয়, রবীন্দ্র সঙ্গীত ইবাদতের সামিলের মতন কথা? না মিললে কেনো রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করা যায় না? কেনো বাংলা সাহিত্য মানেই রবীন্দ্রনাথ? কেনো রবীন্দ্রনাথকে ছাপিয়ে যাওয়া যাবে না? এসব প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর আজো পাওয়া যায়নি। যাও বলা হয়েছে তার সবেই ছেদো কথা। রোদ্দুর রায় নামটি সেই সব ছেদো কথারই জবাব।
সকল কাল্ট প্রধানই ভগবান রজনীশ। যত আকাম-কুকাম করুন না কেনো, তার ভক্তদের কাছে তিনি ঈশ্বর সমতুল্য। কোনো ক্ষেত্রে খোদ ‘ঈশ্বর’। খুন আর আত্মহত্যা প্রবণ এক কাল্ট হলো ‘অর্ডার অব দ্য সোলার টেম্পল’। তার প্রধান গুরু ছিলেন জোসেফ ডি মামব্রো। এই গুরু তিন বছরের এক বালিকাকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন। অথচ তার ভক্তরা তাকেই ‘ঈশ্বর’ মানতেন। এমন সব কাল্ট প্রধানই সময়ের বিচারে কালো চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলো এবং হবে। কাল বা সময় কাউকেই ছাড় দেয় না।
সুতরাং কোনো ব্যক্তির কর্মকে বিচার ও সমালোচনার উর্ধ্বে তোলার মানে হলো ‘কাল্ট’ সৃষ্টি করা। আর কাল্ট মানেই কালো অধ্যায়, কালো মানুষ।
পুনশ্চ: আমার গাড়িতে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছিলো, সাথের একজন বললেন, ‘আপনি রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করেন, আবার তার গানও শোনেন’। সাত খন্ড রামায়ণ পড়ে সীতা কার বাপ, এমন প্রশ্নের মুখোমুখি প্রায়ই হই। তাই বিস্ময় ও রাগ বাদেই বললাম, ভাই এখানেই ব্যক্তি আর তার কাজের পার্থক্য।
ফুটনোট: ‘রাম’ শব্দটা মানে বড়। রাম সহযোগে ছাগল যেমন বড় মানে রামছাগল। জানি, রাম সহযোগে তেমনি অনেক বড় মানে রামচিন্তকরাই হয়তো কাল্ট আর ধর্মকে এক কাতারে ফেলতে চাইবেন। এ লেখার বিপরীতে সে অনুযায়ী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও দাঁড় করাবেন। তার জবাবও রয়েছে, পরে দেয়া যাবে। এই পরিসরে সেই জবাবের শুরু ও শেষ কথাটা জানিয়ে দিই, ধর্ম আর কাল্ট এক নয়। বিপরীতমুখী দুই বিষয়কে এক করতে যাওয়া হবে আরেক রামভুল। বুঝলেন হে ভগবান রজনীশের ফ্যান ফলোয়ারগণ।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন