০
৪৪৯ বার পঠিত
একজন বললেন খুব রাগত স্বরে, ‘খুবতো মিয়া দেশ দেশ করেন। দেহেন অবস্থা কি। একজন গোল্ড মেডেল পাওয়া শিক্ষক, তাও আবার ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটির, হ্যার বউরে অসম্মান করলো। নিজের বউয়ের অসম্মানের প্রতিবাদ করতে গিয়া মাইর খাইতে হইল তার। হ্যায় কি দেশে থাকবো, থাকন কি উচিত?’
উত্তর দিতে গিয়ে খানিকটা থমকে গেলাম। দেশেপ্রেমের ভুততো আমার ঘাড়েও সওয়ার ছিল। সুযোগ থাকা সত্বেও দেশ ছাড়িনি। প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার চেষ্টা করেছি। আমার ছেলেও যেতে পারতো দেশের বাইরে, খুব কঠিন ছিলো না যাওয়াটা। কিন্তু সে দেশ ছেড়ে যেতে চায়নি। নিজের নিরাপত্তার চিন্তা না করে দেশের চিন্তা করেছে। হ্যাঁ, দেশের মাটিতেই ঠাঁই হয়েছে তার। সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায়, কবরে। সম্ভবত দেশে এখন কবরটাই সবচেয়ে নিরাপদ। কি জানি, তারপরেও সংশয় জাগে কবরস্থানের জায়গা দখল করে দালান তোলার খবরে।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, যিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছিলেন। কিন্তু সেই বেড়ানোতে বাধ সেধেছে বখাটেরা। স্ত্রীর অসম্মান মেনে নেননি সেই শিক্ষক। প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু প্রতিবাদের ফল হয়েছে উল্টো, তাকে বেধরক পেটানো হয়েছে। মানুষের সাহায্য চেয়েছেন। বলেছেন, ‘উনি আমার বউ, গার্লফ্রেন্ড নন’। বখাটে এবং ততোধিক নির্লজ্জ দর্শকরা প্রশ্ন করেছে, কাবিননামা আছে কিনা সে ব্যাপারে।
এমন অসম্মানের পর সামাজিকমাধ্যমে ওই শিক্ষক জানিয়েছেন, পিএইচডি শেষে তার দেশে ফেরার ইচ্ছা ছিলো, কিন্তু এখন তিনি নতুন করে ভাববেন। শুধু ওই শিক্ষক নয়, অনেকেই নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন দেশে ফেরা ও থাকা নিয়ে। অনেকে জানতে চেয়েছেন, দেশে থাকা ও ফেরার পক্ষে আবেগ বর্জিত যুক্তি সম্পর্কে।
শুনতে চেয়েছেন, একজন মানুষ ঘর থেকে বেরুলে, সে যে ঘরে ফিরবেন, তার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবেন কিনা। প্রতিদিন সড়কেই কতজনের প্রাণ যায়। কেউ মরেন ছিনতাইকারীর ছুরিতে, কেউ আততায়ীর হাতে। নিজের স্ত্রী, বোন এমনকি মা’ও অসম্মানিত হচ্ছেন, কেউবা শ্লীলতা হারাচ্ছেন। প্রতিদিনই গণমাধ্যমগুলো দিচ্ছে এমন শিউরে উঠা খবর। তারপরেও মানুষ সুযোগ পেলে কেনো এখানে থাকতে চাইবে?
সম্ভবত খবরটা এনটিভি অনলাইনের। সে খবরে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলা হয়েছে, মেধাবী ছেলেমেয়েরা দেশ ছাড়ছে, এমনটা। কেন ছাড়বে না! রুয়েটের সেই শিক্ষকের মতন স্ত্রীসহ অসম্মানিত হতে? রাস্তাঘাটে লাশ হতে? চাকরি না পেয়ে আত্মহত্যা করতে? নাকি মেধার যোগ্য জায়গা না পেয়ে হতাশায় পাগল হতে?
গত ২০১৮ এর নভেম্বরে ‘এশিয়া-প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেশের বেকারত্ব সম্পর্কে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)জানায়, ২০১৭ পর্যন্ত সার্বিক বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২.৮ শতাংশ। উচ্চশিক্ষিতের মধ্যে এই বেকারত্বের হার ১০.৭ শতাংশ। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে এই হার দ্বিতীয়। ২০১০ থেকে ২০১৭ এর মধ্যে বেকারত্বের এই হার হয়েছে দ্বিগুন। প্রথমস্থানে রযেছে পাকিস্তান। আরেকটু হলে তাকেও ধরে ফেলা যেতো।
আইএলও’র ভাষ্য অনুযায়ী ২০০০ সালে দেশে সার্বিক বেকারত্বের হার ছিল মাত্র ৩.৩ শতাংশ। অথচ ২০১৭-তে যা বেড়ে যায় আশংকাজনক হারে। যার মধ্যে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। এই পরিসংখ্যান মূলত ২০১৭ সাল পর্যন্ত, যা প্রকাশিত হয় ২০১৮ এর নভেম্বরে। বিপরীতে ২০১৯-তে এমন কোনো মিরাকল ঘটেনি যাকে আশাপ্রদ বলা যেতে পারে। সুতরাং মেধাবী ছেলেমেয়েরা কেন দেশের বাইরে যাবার কথা ভাববে না।
খোদ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বিউরোর তথ্য মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেকারের সংখ্যা ছিল, ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। ২০১৮-তে যোগ হয়েছে আরো ৮৭ হাজারেরও বেশি যুবা। শুধু স্নাতক পাশ করাই ৪০ হাজারের মতন যুবা বেকার ছিলেন। এবারেও অবস্থার কোন উত্তরণ ঘটেনি। বেকারের সংখ্যা কমার মতন কোন আশা জাগানিয়া তথ্য নেই। সাথে, ‘মেধাবীরা কেনো দেশ ছেড়ে যাবে না’, এমন প্রশ্ন উচ্চারিত না হওয়ার কোনো সঙ্গত কারণও নেই।
এখানে জীবনের নিরাপত্তা না থাকার পাশাপাশি নেই কর্মসংস্থানেরও নিশ্চয়তা। ইন্টারভিউ ভালো হলেও চাকরিটি পাবে কিনা। কোনো ‘বিগশটে’র তদবিরে, ঘুষের বদৌলতে অন্য কেউ তা বাগিয়ে নেবে কিনা। এই ‘কিনা’ শব্দটি জীবনযাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে এদেশে। ‘কিনা’র এই ভয়াবহ জাল কেটে বের হওয়া অনেকটাই অসম্ভব। ফলে বিকল্প চিন্তা করতে না চাইলেও এমনিতেই চলে আসে। ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’- এ ধারণাতেই দেশ ছাড়ার কথা ভাবে মানুষ। সঙ্গতিওয়ালা সৌভাগ্যবানেরা ভেগে যায়। আর যাদের সঙ্গতি নেই, তারা বাধ্য হয়েই দেশে থাকে। থেকে যায়, সারাক্ষণ অসম্মান, অপঘাত আর মৃত্যুর আশংকা বুকে চেপেই।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন